আবদুল লতিফ মাসুম
শিক্ষাই মানবসভ্যতাকে বর্তমান উচ্চতর সোপানে নিয়ে এসেছে। শিক্ষা ব্যাহত হওয়া মানেই সভ্যতার অগ্রগতি থমকে যাওয়া। ২০২০ সালে থেকে আসলেই থমকে আছে পৃথিবীর শিক্ষা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই করোনা মহামারিতে ‘জীবন’-এর পর যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার নাম শিক্ষা। তবে প্রযুক্তি কৌশলের বদৌলতে শিক্ষা খাতের ক্ষতি সামলে নেওয়ার চেষ্টায় উন্নত দেশগুলো কিছুটা সফল হলেও তৃতীয় বিশ্ব আছে পিছিয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতও গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
এই দীর্ঘমেয়াদি বন্ধের কারণে:
ক. শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে;
খ. সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে ও বাল্যবিবাহ বেড়েছে;
গ. শিক্ষার্থী ঝরে পড়া অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ঘ. মানসিক বৈকল্যের সৃষ্টি হয়েছে;
ঙ. কিশোর গ্যাংয়ের মতো আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে; চ. মোবাইল তথা প্রযুক্তিতে আসক্তি বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে।
ইউনিসেফের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যত বেশি সময় ধরে শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে; সহিংসতা, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকি ততই বেড়ে যাবে। তাদের স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যাবে। ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়বে। শিক্ষা কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণ, অর্থাৎ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সশরীর উপস্থিতিও শিক্ষার একটি অংশ। এতে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, মানসিক সুস্থতা ও শারীরিক যোগ্যতা নিশ্চিত হয়। এই গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব যত দ্রুত সম্ভব দূর করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় ইউনিসেফের উপসংহার হচ্ছে: ‘নিরাপদে স্কুল আবার খুলে দেওয়া এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অগ্রাধিকার দেওয়া।’ এই দীর্ঘদিনের অচল অবস্থার পর অনায়াসে মন্তব্য করা যায় যে, শিক্ষা যতটা নিচের শ্রেণির, ক্ষতিটা ততই বেশি। একটি অবুঝ শিশু, যার স্কুলে যাওয়ার বয়স অতিক্রান্ত হয়েছে, তার ক্ষতি দীর্ঘায়িত হয়েছে প্রায় দুই বছর। ঘরে বসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি সম্ভব নয়। স্কুল বন্ধ থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার ‘অনলাইন’ শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে। রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তা অবাস্তব ও অকার্যকর বলে অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে এসবের অপ্রাপ্যতা, অর্থনৈতিক দীনতা ও প্রযুক্তি বিরূপ সংস্কৃতির কারণে সুফল লাভে বঞ্চিত হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হলেও অবশেষে এটা স্বীকৃত হয়েছে যে অনলাইন বা প্রযুক্তি শিক্ষা দ্বারা ২ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উপকৃত হয়নি।
এরপর বর্তমান করোনাকালীন শিক্ষার বড় একটি সংকট পরীক্ষা ও সিলেবাস। ইতিমধ্যে অটো পাসের নামে যে সর্বনাশ সাধিত হয়েছে, তা সবারই জানা আছে। এখন যা সর্বনাশের দিকে আগুয়ান তা হচ্ছে সিলেবাস। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করতে করতে এমন হয়েছে যে শিক্ষার আর কিছুই সেখানে অবশিষ্ট নেই।
প্রাথমিক শিক্ষাটি শিক্ষকের ব্যক্তিগত উপস্থিতি ভিন্ন অকার্যকর ও অবাস্তব। মাধ্যমিক স্তরে প্রয়োজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বিত প্রয়াস। মূলত সেই বহুল কথিত ‘রিডিং, রাইটিং ও অ্যারিথম্যাটিক—এই তিনের অনুশীলন মাধ্যমিক স্তরেই হয়ে থাকে। এখানে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার কোনো সুযোগ নেই। এখন সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থাপকেরা এই সর্বনাশ সাধনে ব্যস্ত রয়েছেন। এই পরীক্ষাহীন ও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের মাধ্যমে আমরা একটি ‘শিক্ষাহীন’ জাতি তৈরি করছি। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা যায়। তা-ও আবার শিক্ষক বা পরীক্ষকদের খেয়াল রাখতে হবে সমগ্র সিলেবাসের পঠন-পাঠনের দিকে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস অধিকতর কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। এই স্তরের শিক্ষার্থীরা যেহেতু অধিকতর পরিপক্ব, সেহেতু তারা ইচ্ছা করলে ব্যক্তিগতভাবেই পুরো পাঠ গ্রহণ করতে পারে।
বিভিন্ন দেশে করোনাকালেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল। তাদের নীতিগত বিষয়টি ছিল এ রকম—করোনা আছে, লকডাউন আছে; করোনা নাই, লকডাউন নাই। করোনার ওঠানামার সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই জাতীয় জীবন পরিচালিত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রকে ভিন্নভাবে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে যে ঘোষণাটি আসে, আমাদের দেশে তা ছিল সর্বাত্মক লকডাউনের। প্রাথমিক অনভিজ্ঞতা ও প্রবল ভীতির কারণে তা অবাস্তব ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন করোনা ওঠানামা করেছে, তখন সুযোগ ছিল প্রকোপহীন বা প্রকোপ কম এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার। গ্রামবাংলা বা উপকূলীয় অঞ্চল বিগত প্রায় সময়ই করোনাহীন ছিল। দ্বিতীয় প্রকোপে ভারতীয় ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব প্রদর্শিত না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী ও গ্রামীণ এলাকা আক্রান্ত হয়েছে।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পর্যায়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। সরকারের পর্যায়েও সেই চাপ অনুভূত হয়েছে। বেশ কয়েকবারই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উদ্বেগ নিরসনের। একপর্যায়ে বেশ জোরেশোরেই বলা হয়েছিল, চলতি বছরের ১২ জুনের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো আংশিকভাবে হলেও খুলে দেওয়া হবে। ৩০ জুন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি নতুন এক ঘোষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা আরও বাড়িয়ে দেন। বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। অনেকে প্রশ্ন করেছেন—অফিস চলছে, ব্যবসা চলছে, বিনোদন ও পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, তাহলে শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন এই বৈরিতা? বিশেষজ্ঞরা সরকারের প্রাথমিক নেতিবাচক সিদ্ধান্তকে এর জন্য দায়ী করছেন। সরকার শিক্ষাকে সামগ্রিকভাবে না দেখে সমাজের একটি সংবেদনশীল অংশ হিসেবে দেখেছে। এটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। বাংলাদেশের মতো অতিমাত্রিক রাজনৈতিক সমাজে সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা স্বাভাবিক। সরকারবিরোধীরা বলছে, আন্দোলনের ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে সরকার। বিরোধীদের এ কথায় হালে পানি দিয়েছেন স্বয়ং ওবায়দুল কাদের। গত ২৭ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে যাচ্ছে। শিগগির বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। অনেক অপশক্তিও প্রস্তুতি নিচ্ছে। অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে এই শক্তি বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।’ ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য বরং বিরোধীদের আশঙ্কাকে শক্তপোক্ত করেছে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য দুটি শর্তের উল্লেখ করছে। প্রথমটি হচ্ছে সংক্রমণের মাত্রা ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসা; দ্বিতীয়টি সব প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করা। দুটি প্রস্তাবই আপেক্ষিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। করোনাভাইরাসের মাত্রা এখন ১০ শতাংশের নিচে। এটি একটি চলমান প্রবাহ। কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। এটি না খোলার বাহানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, টিকা দেওয়ার বিষয়টি খুবই সহজ। এখন যে বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছে, তাদের টিকা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। অথচ এটি খুবই সম্ভব হতে পারে, যদি প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্যাম্পাসে মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। তাদের দায়িত্ব দিলে অল্প সময়েই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক টিকাদান সম্ভব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সমাজে ব্যাপক তাগিদ সৃষ্টি হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আরও কিছু বিষয়ের কথাও আমরা বলতে পারি। ১. কোনোভাবেই কোনো পর্যায়ে অটো পাসের ব্যবস্থা না করা; ২. সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের নামে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার সর্বনাশ সাধন না করা; ৩. সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা করা; ৪. শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ; ৫. শিক্ষার্থীদের করোনা প্রণোদনার আওতায় আর্থিক সহায়তা দেওয়া; ৬. সময়, শ্রম ও মেধা-মননের সমন্বয়ে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা; ৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার দেওয়া; ৮. টপ টু বটম নয়, বরং বটম টু টপ নিচ থেকে ওপরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা; ৯. প্রাতিষ্ঠানিক পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া; ১০. সব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা করা।
এসব উপদেশ, পরামর্শ ও প্রস্তাব মেনে নেওয়া না-নেওয়া সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা বর্তমান সরকারকে শিক্ষার বিষয়ে সংবেদনশীল বলেই মনে করি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাই মানবসভ্যতাকে বর্তমান উচ্চতর সোপানে নিয়ে এসেছে। শিক্ষা ব্যাহত হওয়া মানেই সভ্যতার অগ্রগতি থমকে যাওয়া। ২০২০ সালে থেকে আসলেই থমকে আছে পৃথিবীর শিক্ষা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই করোনা মহামারিতে ‘জীবন’-এর পর যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার নাম শিক্ষা। তবে প্রযুক্তি কৌশলের বদৌলতে শিক্ষা খাতের ক্ষতি সামলে নেওয়ার চেষ্টায় উন্নত দেশগুলো কিছুটা সফল হলেও তৃতীয় বিশ্ব আছে পিছিয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতও গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
এই দীর্ঘমেয়াদি বন্ধের কারণে:
ক. শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে;
খ. সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে ও বাল্যবিবাহ বেড়েছে;
গ. শিক্ষার্থী ঝরে পড়া অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ঘ. মানসিক বৈকল্যের সৃষ্টি হয়েছে;
ঙ. কিশোর গ্যাংয়ের মতো আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে; চ. মোবাইল তথা প্রযুক্তিতে আসক্তি বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে।
ইউনিসেফের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যত বেশি সময় ধরে শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে; সহিংসতা, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকি ততই বেড়ে যাবে। তাদের স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যাবে। ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়বে। শিক্ষা কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণ, অর্থাৎ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সশরীর উপস্থিতিও শিক্ষার একটি অংশ। এতে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, মানসিক সুস্থতা ও শারীরিক যোগ্যতা নিশ্চিত হয়। এই গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব যত দ্রুত সম্ভব দূর করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় ইউনিসেফের উপসংহার হচ্ছে: ‘নিরাপদে স্কুল আবার খুলে দেওয়া এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অগ্রাধিকার দেওয়া।’ এই দীর্ঘদিনের অচল অবস্থার পর অনায়াসে মন্তব্য করা যায় যে, শিক্ষা যতটা নিচের শ্রেণির, ক্ষতিটা ততই বেশি। একটি অবুঝ শিশু, যার স্কুলে যাওয়ার বয়স অতিক্রান্ত হয়েছে, তার ক্ষতি দীর্ঘায়িত হয়েছে প্রায় দুই বছর। ঘরে বসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি সম্ভব নয়। স্কুল বন্ধ থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার ‘অনলাইন’ শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে। রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তা অবাস্তব ও অকার্যকর বলে অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে এসবের অপ্রাপ্যতা, অর্থনৈতিক দীনতা ও প্রযুক্তি বিরূপ সংস্কৃতির কারণে সুফল লাভে বঞ্চিত হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হলেও অবশেষে এটা স্বীকৃত হয়েছে যে অনলাইন বা প্রযুক্তি শিক্ষা দ্বারা ২ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উপকৃত হয়নি।
এরপর বর্তমান করোনাকালীন শিক্ষার বড় একটি সংকট পরীক্ষা ও সিলেবাস। ইতিমধ্যে অটো পাসের নামে যে সর্বনাশ সাধিত হয়েছে, তা সবারই জানা আছে। এখন যা সর্বনাশের দিকে আগুয়ান তা হচ্ছে সিলেবাস। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করতে করতে এমন হয়েছে যে শিক্ষার আর কিছুই সেখানে অবশিষ্ট নেই।
প্রাথমিক শিক্ষাটি শিক্ষকের ব্যক্তিগত উপস্থিতি ভিন্ন অকার্যকর ও অবাস্তব। মাধ্যমিক স্তরে প্রয়োজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বিত প্রয়াস। মূলত সেই বহুল কথিত ‘রিডিং, রাইটিং ও অ্যারিথম্যাটিক—এই তিনের অনুশীলন মাধ্যমিক স্তরেই হয়ে থাকে। এখানে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার কোনো সুযোগ নেই। এখন সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থাপকেরা এই সর্বনাশ সাধনে ব্যস্ত রয়েছেন। এই পরীক্ষাহীন ও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের মাধ্যমে আমরা একটি ‘শিক্ষাহীন’ জাতি তৈরি করছি। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা যায়। তা-ও আবার শিক্ষক বা পরীক্ষকদের খেয়াল রাখতে হবে সমগ্র সিলেবাসের পঠন-পাঠনের দিকে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস অধিকতর কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। এই স্তরের শিক্ষার্থীরা যেহেতু অধিকতর পরিপক্ব, সেহেতু তারা ইচ্ছা করলে ব্যক্তিগতভাবেই পুরো পাঠ গ্রহণ করতে পারে।
বিভিন্ন দেশে করোনাকালেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল। তাদের নীতিগত বিষয়টি ছিল এ রকম—করোনা আছে, লকডাউন আছে; করোনা নাই, লকডাউন নাই। করোনার ওঠানামার সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই জাতীয় জীবন পরিচালিত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রকে ভিন্নভাবে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে যে ঘোষণাটি আসে, আমাদের দেশে তা ছিল সর্বাত্মক লকডাউনের। প্রাথমিক অনভিজ্ঞতা ও প্রবল ভীতির কারণে তা অবাস্তব ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন করোনা ওঠানামা করেছে, তখন সুযোগ ছিল প্রকোপহীন বা প্রকোপ কম এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার। গ্রামবাংলা বা উপকূলীয় অঞ্চল বিগত প্রায় সময়ই করোনাহীন ছিল। দ্বিতীয় প্রকোপে ভারতীয় ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব প্রদর্শিত না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী ও গ্রামীণ এলাকা আক্রান্ত হয়েছে।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পর্যায়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। সরকারের পর্যায়েও সেই চাপ অনুভূত হয়েছে। বেশ কয়েকবারই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উদ্বেগ নিরসনের। একপর্যায়ে বেশ জোরেশোরেই বলা হয়েছিল, চলতি বছরের ১২ জুনের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো আংশিকভাবে হলেও খুলে দেওয়া হবে। ৩০ জুন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি নতুন এক ঘোষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা আরও বাড়িয়ে দেন। বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। অনেকে প্রশ্ন করেছেন—অফিস চলছে, ব্যবসা চলছে, বিনোদন ও পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, তাহলে শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন এই বৈরিতা? বিশেষজ্ঞরা সরকারের প্রাথমিক নেতিবাচক সিদ্ধান্তকে এর জন্য দায়ী করছেন। সরকার শিক্ষাকে সামগ্রিকভাবে না দেখে সমাজের একটি সংবেদনশীল অংশ হিসেবে দেখেছে। এটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। বাংলাদেশের মতো অতিমাত্রিক রাজনৈতিক সমাজে সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা স্বাভাবিক। সরকারবিরোধীরা বলছে, আন্দোলনের ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে সরকার। বিরোধীদের এ কথায় হালে পানি দিয়েছেন স্বয়ং ওবায়দুল কাদের। গত ২৭ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে যাচ্ছে। শিগগির বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। অনেক অপশক্তিও প্রস্তুতি নিচ্ছে। অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে এই শক্তি বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।’ ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য বরং বিরোধীদের আশঙ্কাকে শক্তপোক্ত করেছে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য দুটি শর্তের উল্লেখ করছে। প্রথমটি হচ্ছে সংক্রমণের মাত্রা ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসা; দ্বিতীয়টি সব প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করা। দুটি প্রস্তাবই আপেক্ষিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। করোনাভাইরাসের মাত্রা এখন ১০ শতাংশের নিচে। এটি একটি চলমান প্রবাহ। কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। এটি না খোলার বাহানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, টিকা দেওয়ার বিষয়টি খুবই সহজ। এখন যে বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছে, তাদের টিকা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। অথচ এটি খুবই সম্ভব হতে পারে, যদি প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্যাম্পাসে মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। তাদের দায়িত্ব দিলে অল্প সময়েই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক টিকাদান সম্ভব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সমাজে ব্যাপক তাগিদ সৃষ্টি হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আরও কিছু বিষয়ের কথাও আমরা বলতে পারি। ১. কোনোভাবেই কোনো পর্যায়ে অটো পাসের ব্যবস্থা না করা; ২. সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের নামে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার সর্বনাশ সাধন না করা; ৩. সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা করা; ৪. শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ; ৫. শিক্ষার্থীদের করোনা প্রণোদনার আওতায় আর্থিক সহায়তা দেওয়া; ৬. সময়, শ্রম ও মেধা-মননের সমন্বয়ে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা; ৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার দেওয়া; ৮. টপ টু বটম নয়, বরং বটম টু টপ নিচ থেকে ওপরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা; ৯. প্রাতিষ্ঠানিক পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া; ১০. সব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা করা।
এসব উপদেশ, পরামর্শ ও প্রস্তাব মেনে নেওয়া না-নেওয়া সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা বর্তমান সরকারকে শিক্ষার বিষয়ে সংবেদনশীল বলেই মনে করি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৭ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৮ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৮ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৮ ঘণ্টা আগে