জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন

জ্যামিতিক নকশার ত্রুটিতে মৃত্যুফাঁদ মল্লিকপুর

সৌগত বসু, ঢাকা 
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২২: ৩৭
আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২৩: ৩০
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনাস্থল। ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক

গত মাসের মাঝামাঝিতে ভোরবেলায় ফরিদপুরের মল্লিকপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে খাগড়াছড়ি পরিবহন ও গ্রিন এক্সপ্রেস বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে সংঘটিত দুর্ঘটনার পেছনে সড়ক অবকাঠামোতে ত্রুটিসহ বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছে জাতীয় তদন্ত কমিটি। এসব কারণে দুর্ঘটনাস্থলটিকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ বা বারংবার দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মৃতুফাঁদে পরিণত ওই সড়কের কাঠামোগত ত্রুটি সারানোসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করে জরুরি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে কমিটি।

গত ১৫ অক্টোবর ভোর ৩টা থেকে ৩টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে ফরিদপুর সদরের কানাইপুরের মল্লিকপুর এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাসের সুপারভাইজার ও হেলপারসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের চার জন সকলে খাগড়াছড়ি পরিবহন বাসের যাত্রী। ওই ঘটনায় ২৫ জন আহত হয়েছেন।

আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে ৩৫ থেকে ৪০ জন ইটভাটা শ্রমিক খাগড়াছড়ি পরিবহনের বাসে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এই দুর্ঘটনায় ঘটে। এসময় অধিকাংশ যাত্রী ঘুমে ছিল। গ্রিন এক্সপ্রেসের বাসটি ঢাকার আব্দুল্লাপুর থেকে ঝিনাইদহ যাচ্ছিল।

তদন্ত কমিটিতে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক। আরমানা সাবিহা হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে গত ১৫ অক্টোবর ভোরে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তার প্রধান কারণ হলো— স্পাইরাল কার্ভ অনিরাপদ ছিল। একের পর এক এস কার্ভের কারণে এলাকাটি দুর্ঘটনাপ্রবণ। উপরন্তু সেই সড়কে লেন আলাদা করে যে ধরণের মার্কিং করা কথা, সেটি করা হয়নি। অনুসন্ধানে সড়কের জ্যামিতিক নকশাই আমরা অনিরাপদ হিসেবে দেখতে পাই। এই ভুলটিকে এ দুর্ঘটনার বড় কারণ হিসেবে দেখছি।’

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে জাতীয় তদন্ত কমিটির সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক। ছবি:  ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে জাতীয় তদন্ত কমিটির সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক। ছবি: ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক

ফরিদপুরের মল্লিকপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওই অংশটি পড়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীনে। নিয়ম অনুযায়ী, মহাসড়কের টানা সাদা দাগ থাকার কথা, যাতে চালক গাড়ির লেন পরিবর্তন করতে না পারেন। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়ে সেখানে সড়কে কাটা সাদা লাইন ছিল। এই লাইনের অর্থ— চালক সতর্কতার সঙ্গে লেন পরিবর্তন করতে পারেন।

জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওই ভয়ঙ্কর বাঁকে ভুল মার্কিং করা হয়েছে। পাশাপাশি বাসের অতিরিক্ত গতি, চালকের ওভারটেকিং করার প্রবণতা, মহাসড়কের পাশে যথাযথ পরিসর (ট্রাভার্সেবল ক্লিয়ারিং জোন) না থাকার কথাও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনাস্থল। ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনাস্থল। ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক

দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনার সময় খাগড়াছড়ি পরিবহনের বাসটি তার লেনেই ছিল। গ্রিন এক্সপ্রেস বাসটি উল্টো দিক এসে দ্রুত গতিতে লেন পরিবর্তন করতে গিয়ে বাসটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।

ড. আরমানা বলেন, ‘ফরিদপুরের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে স্পাইরাল কার্ভে (এস আকৃতির)। এসব কার্ভ এমনিতেই বিপদজনক। সেখানে সলিড মার্কিং (দাগ) না করে ভাঙা ভাঙা মার্কিং করা হয়েছে। ফলে সড়কের এই অংশ আরো বিপদজনক হয়েছে। এটি চালককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে লেন পরিবর্তনের অনুমোদন দিয়েছে। আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সড়কের ওই অংশে অতিরিক্ত গতিতে গাড়িগুলো নিয়মিতভাবে ওভারটেক করে। মহাসড়কে যানবাহনের গতি পরিমাপ করে দেখেছি, ঢাকাগামী যানবাহনগুলোর গতি থাকে অতিরিক্ত।’

তদন্ত কমিটিতে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক
তদন্ত কমিটিতে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক

বুয়েট শিক্ষক সাবিহা বলেন, সড়কের এই ভয়াবহ বাঁকের অংশটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। দুপাশে গাছের ঘন সারি থাকায় বাসের হেডলাইটের আলো কম প্রতিফলিত হয়েছে। কোনো সড়ক বাতির ব্যবস্থা ছিল না। সড়কের যে বাঁক রয়েছে সেটিরও নির্দেশনা সাইন ছিল না। সড়কের উভয় পাশে ১০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা না থাকার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। তার অর্থ মূল সড়ক থেকে কোনো গাড়ি নামতে বাধ্য হলে তার জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকতে হবে, যেটিকে ট্রাভার্সেবল ক্লিয়ারিং জোন বলা হয়। সেটি ছিল না সেখানে।

জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ আসনবিশিষ্ট খাগড়াছড়ি পরিবহনের বাসের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৩২টি করা হয়েছিল। বাসটির ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, রুট পারমিট সবই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। গ্রিন এক্সপ্রেসের বাসটির রুট পারমিট ছিল শুধু। এই বাসের আসন সংখ্যা ৪১টি থেকে বাড়িয়ে ৪৫টিতে উন্নীত করা হয়েছিল। দুর্ঘটনার পরে দুই বাসের চালকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। দুই চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক
ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, খাগড়াছড়ি পরিবহনের বাসটির আসনগুলো ছিল নড়বড়ে, কোনোরকমে ঢালাই করা হয়েছিল। দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে এটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে আরো কিছু সুপারিশ করা হয়েছে—

#সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী বাসগুলোর ফিটনেস, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সগুলো নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

#রুট পারমিটবিহীন কোনো বাস যেন সড়কে নামার অনুমতি না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

#কোনো বাস চালক যেন ৫ ঘণ্টার বেশি টানা বাস চালাতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে।

#দূরপাল্লার বাসগুলোতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং তা ব্যবহার করতে পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

#মহাসড়কে থ্রি হুইলার যানবাহন বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

Mallikpur Curve Acident 3
Mallikpur Curve Acident 3

বুয়েটের এই শিক্ষক আরো বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে তিনি বেশ কয়েকটা জায়গাকে অনিরাপদ পেয়েছেন। ‘আঞ্চলিক একটা সড়কের সঙ্গে এই মহাসড়কের এমন একটি সংযোগস্থল পাওয়া গেছে যেখানে কোন সাইন ছিল না। যিনি এই রাস্তা করেছেন, তিনি এই বিষয়ে অবগত নন।’

ড. আরমানা বলেন, ‘সড়কের ওই জায়গার নকশাকে বিপদমুক্ত করতে হলে কার্ভ নিরাপদ করতে হবে। কার্ভের উপর শেভরন সাইন, রেক্ট্রো রিফ্লেক্টিং মার্কিং বসাতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ওভারটেকিং কমানোর জন্য পর্যাপ্ত সেফটি মেজার নিতে হবে।’

তবে এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর শুধুমাত্র ভাঙা মার্কিংগুলোকে সলিড মার্কিংয়ে পরিণত করা ছাড়া সুপারিশ বাস্তবায়নে সওজ থেকে আর কোনো কিছু করা হয়নি বলে তিনি জানান।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনা কবলিত বাস। ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুরের মল্লিকপুরে দুর্ঘটনা কবলিত বাস। ছবি: ড. আরমানা সাবিহা হক

জাতীয় তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সফিকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মল্লিকপুরের সড়ক দুর্ঘটনার পরে জাতীয় তদন্ত কমিটি সওজকে বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছে। আমরা সেই মোতাবেক কিছু কাজ করছি।’

সড়কে ভুল মার্কিংয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্ট তো মাত্র এসেছে আমাদের হাতে। আমরা কাজ করছি। কারা জড়িত, কাদের কী ভুল, এসব আমি বিস্তারিত বলতে পারব না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কাজ করছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত