বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ এর আগমন উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এই শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ সময় পবিত্র রমজান উপলক্ষেও শুভেচ্ছা জানান।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘জাগতিক নিয়মের পথ-পরিক্রমায় বছর শেষে আমাদের মধ্যে আবার এসেছে নতুন বছর-১৪২৯ বঙ্গাব্দ। সবাইকে নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।’

এর পরপরই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুসলমানদের সিয়াম সাধনার পবিত্র রমজান মাস চলছে এখন। আমি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে পবিত্র মাহে রমজানের মোবারকবাদ জানাচ্ছি।’ 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ভূখণ্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির বাহক এ দেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত হলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় সব বাঙালি এক এবং অভিন্ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উদ্‌যাপন এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে। সারা বছরের ক্লেদ-গ্লানি, হতাশা ভুলে এদিন সব বাঙালি নতুন আনন্দ-উদ্দীপনায় মেতে ওঠেন। ‘‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী এই গান গেয়ে আমরা আবাহন করি নতুন বছরকে।’ 

পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণকে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবহমানকাল ধরে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন ছিল বর্ষবরণের মূল অনুষঙ্গ। ব্যবসায়ীরা আগের বছরের দেনা-পাওনা আদায়ের জন্য আয়োজন করতেন হালখাতা উৎসবের। গ্রামীণ পরিবারগুলো মেলা থেকে সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র কিনে রাখতেন। গৃহস্থ বাড়িতে রান্না হতো সাধ্যমতো উন্নত মানের খাবার।’ 

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের চল ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজিমপুর, ওয়ারী,  ওয়াইজঘাট, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হালখাতা উৎসব হতো, মেলা বসত, মেলায় পণ্য বেচাকেনা, গান-বাজনা, যাত্রা-সার্কাস ইত্যাদির আয়োজন হতো। ষাটের দশকে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ সংগীত পরিবেশন শুরু হয়।’ 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকল সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পয়লা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। মনের ভেতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যমে বাঁচার শক্তি জোগায়, স্বপ্ন দেখায়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।’ 

বাঙালি সংস্কৃতি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ শুধু দেশে নয়, বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি তাঁর বসবাস গড়ে তুলেছেন, সেখানেই বাঙালির হাজার বছরের লোক-সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। বর্ষবরণসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁরা জানান দেন, তাঁরা বাঙালি। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীজুড়ে তৈরি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধ।’ 

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালির মুখের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একদিন এ দেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। যার ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা মানে আমাদের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।’ 

নববর্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আসুন, বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, মানুষে মানুষে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, থাকবে না ধর্মে-ধর্মে কোনো বিভেদ।’