নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ডেকেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুতে সেই সংঘর্ষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা লিপ্ত হলেও পরে আর তা ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থানীয়রাসহ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুক্রবার রাতে কারফিউ জারি করে সরকার। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কারফিউর মধ্যেই শনি ও রোববার সংঘর্ষ চলে।
এর মধ্যে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন জানায়। পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে যায় গত পাঁচ দিনে। নজিরবিহীন এই সহিংসতার মধ্যে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বিটিভিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর চালানো হয়েছে। কোটার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত নাশকতা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। এ অবস্থায় ১৭ জুলাই থেকে সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ থাকে। সহিংসতার এই পাঁচ দিনে যা যা ঘটেছে, তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
বৃহস্পতিবার যা ঘটেছিল
‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ গত বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার ২৫ স্থানে অগ্নিসংযোগ করা হয়, ৪৮ স্থানে সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন অন্তত ২৮ জন। এ চিত্র দেশের বড় বড় নগরসহ অনেক জেলা শহরেও। সংঘর্ষ-গুলিতে দিন শেষে শিক্ষার্থী-সাংবাদিক-পথচারীসহ নিহত অন্তত ২৮। আহত দেড় হাজারের বেশি। এর আগে বুধবার মধ্যরাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক টিম শাটডাউনে দেশের সব অফিস-আদালত বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়। ঠিক তখন থেকেই যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজাসহ শনির আখড়ার অন্তত ২০টি জায়গায় আন্দোলনকারীরা আগুন ধরিয়ে দেন। সেখান থেকে রাতেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিহত অজ্ঞাত একজনকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘণ্টাখানেক বিরতির পর সকাল থেকে একই স্থানে আবার পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক রিকশাচালককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষা শেষে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি ও মিরপুর এলাকা। সড়কে থাকা পুলিশের অধিকাংশ ট্রাফিক বক্স, পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল, সরকারি নানা স্থাপনা, সরকারি গাড়ি, ফুটওভার ব্রিজ, গণপরিবহন, এমনকি বিটিভি কার্যালয়ে আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টায় মেরুল বাড্ডা এলাকায় রাজধানীর প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়। সেখানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা পাশের রামপুরা ও মালিবাগ এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। রামপুরায় বিটিভি ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এদিন সকাল ১০টায় অবরোধ শুরু হয় রামপুরা-কুড়িল সড়কে। রাস্তায় নামেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১১টার পর রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও র্যাবের সংঘর্ষ হয়। সেখানে ঘটনাস্থলে দুজনসহ ছয়জন নিহত হন। বেলা ১১টায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এরপর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তা পুরোপুরি অবরোধ করেন। এই সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয় হাতিরঝিল পুলিশ বক্স। বেলা ২টায় র্যাবের হেলিকপ্টার কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে পড়া পুলিশের সদস্যদের উদ্ধার করে।
বিটিভি ভবনে হামলা: বৃহস্পতিবার ঢাকার রামপুরায় বিটিভি ভবনে দিনভর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণকক্ষেরও দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছিল হামলাকারীরা। বিটিভি কার্যালয়ের মুজিব কর্নার এবং ঢাকা কেন্দ্রের নিরাপত্তা গেট, অভ্যর্থনা কক্ষসহ অন্তত আটটি স্থানে আগুন দেওয়া হয়। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিন দফায় হামলার পর ৭টা ৪ মিনিটে বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ করে স্টেশন ত্যাগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে চতুর্থ দফা হামলা হয়; ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাটও চালানো হয়। এতে ২২ ঘণ্টা সম্প্রচার বন্ধ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এই টিভি স্টেশনটির।
উত্তরা রণক্ষেত্র: বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উত্তরায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভকারীরা। তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাও করে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা। সেখানে সাতজন নিহত হয়। র্যাবের এক সদস্যকে গণপিটুনি দেয় বিক্ষোভকারীরা। বিভিন্ন স্থানে থাকে পুলিশ বক্স ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
যাত্রাবাড়ী-মিরপুর-মহাখালী রণক্ষেত্র: বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যাত্রাবাড়ীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখল নেয় বিক্ষোভকারীরা। এরপর রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় তাদের সঙ্গে পুলিশ-র্যাবের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তারা ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও ফুটওভার ব্রিজে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিকেলে মহাখালী এলাকার সেতু ভবন ও দুর্যোগ ভবনে আগুন দেওয়া হয়। সেখানে থাকা গাড়িগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
রাতে ইন্টারনেট বন্ধ: রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গত বুধবার রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেটের ফোর-জি সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে ব্রডব্যান্ড চালু থাকে। মোবাইল ইন্টারনেটের টু-জি সেবাও চালু ছিল। ফোর-জি সেবা বন্ধ থাকায় মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবহারকারীরা। প্রবেশ করা যাচ্ছিল না ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
শুক্রবার কী হয়েছিল
শুক্রবার দিনের প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয় বিটিভির সামনে রামপুরা ব্রিজ এলাকায়। আগের দিনও এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দিনভর সংঘর্ষ হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। পরে তা পুরো বনশ্রী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলে বনশ্রী পুলিশ ফাঁড়ি আর সন্ধ্যায় রামপুরা থানায় হামলা করে আন্দোলনকারীরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মেরাদিয়া পুলিশের পিবিআই পূর্ব কার্যালয়ও। এই ঘটনাস্থল থেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে যায় ২৫টি শিশু, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।
এদিনও রণক্ষেত্রে পরিণত উত্তরা এলাকা। আগের দিন আটক হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের গতকাল বেলা ১১টার দিকে আদালতে পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাজধানীতে প্রবেশ করতে চাইলে বিকেলে উত্তরার বিজিবি মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় আন্দোলনকারীদের হামলায় আহত হন সাবেক এই মেয়র। মারা যান তাঁর দেহরক্ষী হামিদুর রহমান জুয়েল (৩৫)। আর সন্ধ্যার পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা হামলা চালান উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরে পুলিশ কোয়ার্টারে।
ভয়ানক অবস্থা তৈরি হয় মিরপুর এলাকাতেও। জুমার নামাজের পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর ওপর সেখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন। তাঁদের পেছনে থাকেন পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা। সেখানে চারজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। পরে বিকেলে তাঁরা মিরপুর ১০-এ কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিকেলের দিকে বনানীতে সেতু ভবন, এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোল প্লাজা, মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আজিমপুর, বাড্ডা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার (সায়েন্স ল্যাব), দুর্যোগ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর করে আগুন দেয় আন্দোলনকারী। রাত পর্যন্ত ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাব এলাকা আটকে রেখে সড়কে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরা। এসব জায়গাতেও পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সেখানেও রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, ছররা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হতাহত হয় শতাধিক আন্দোলনকারী।
এদিন দুপুর ১২টার দিকে বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী আটকের পর গণতন্ত্র মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মারধর করেন। এর পরপরই সেখানে থাকা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনার রেশ চলে যায় নয়াপল্টনের বিএনপির কার্যালয়ের সামনে। সেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি চালায়। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন শতাধিক নেতা-কর্মী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও পরিবেশ ছিল থমথমে। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অবস্থান কর্মসূচি ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। তবে এত কিছুর পরেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, পুলিশ এখনো ধৈর্য ধারণ করে আছে।
সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার মিলে সারা দেশে নিহত হন ১০৩ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার নিহত হন ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪১ জন এবং শুক্রবার নিহত হন ৫৬ জন। শুক্রবার রাতে সরকারে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে কারফিউ জারি করা হয়।
মধ্য রাতে কারফিউ জারি করা হলেও বিক্ষুব্ধরা তখনো সড়কে ছিল। গভীর রাত পর্যন্ত আগুন জ্বালিয়ে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে তারা। গত শনিবার সারা দিন সেই ধারাবাহিকতা ছিল।
শনিবার যা ঘটেছিল
প্রথম দিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়, পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশ। ভাঙচুর-সংঘর্ষে টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের সঙ্গে মাঠে নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তাতেও পরিস্থিতি দিন দিন বেসামাল হয়ে পড়ছিল। সেই অবস্থায় জারি করা হয় কারফিউ। রাতারাতি মাঠে নামে সেনাবাহিনী। তারপরও বিক্ষোভ দমানো যায়নি। পথে পথে সেনাসদস্যদের টহলের পরও শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এবং ঢাকার বাইরে কয়েক জায়গায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে ৪৫ জনের মতো।
রামপুরা-বাড্ডা এদিনও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। তবে এবার পুলিশের সঙ্গে মাঠে ছিল সেনাবাহিনীও। বিক্ষোভকারীরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সড়কে আগুন জ্বালিয়ে স্লোগান দেয়। তাদের লক্ষ্য করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালান। দিনভর দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলতে থাকে। রামপুরার মতো যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ও কদমতলীর অবস্থাও ছিল একই রকম।
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম ছিল। টঙ্গীতে শিল্প পুলিশের কার্যালয়, পুলিশ বক্স এবং বিআরটিএ প্রকল্পের চলন্ত সিঁড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া টঙ্গী থানা এবং সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে তারা। সিটি করপোরেশনের ১১টি গাড়িসহ প্রায় ৪০টি গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া চেরাগ আলী এলাকায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কারখানায় হামলা চালিয়ে তিনটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভরত তিন শিক্ষার্থী নিহত হন। দুপুর ১২টার দিকে কলতাপাড়া এলাকার ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। গাজীপুর-ময়মনসিংহ ছাড়া আরও কয়েক জেলায় ভাঙচুর চালানো হয়। সেখানেও তাদের সংঘর্ষ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে।
রোববার যা হয়েছিল
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।
আদালত বলেছেন, নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। তবে সরকার প্রয়োজনে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল বা সংশোধন করতে পারবে।
হাইকোর্টের রায় বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর করা লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে রোববার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করেন।
এদিকে পাঁচ দিনে মৃত্যু বেড়ে হয়েছে ১৭৪। আহত কয়েকজনের মৃত্যু হওয়ায় এবং আগের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার কারণে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে।
সোমবার কী হয়েছিল
টানা হামলা-সংঘর্ষ-ভাঙচুর, এর মধ্যে কারফিউ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জিম্মি হয়ে পড়েছিল রাজধানীবাসী। কারফিউ না উঠলেও গতকাল ঢাকায় নতুন করে সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন নগর ও জেলার পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে নগরজীবনে। হাঁপ ছেড়েছে দেশের মানুষ।
আবার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এতেও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারী বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। রাস্তা ছেড়ে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার কথা বলছেন তাঁরা।
সব মিলিয়ে সংঘর্ষ-ভাঙচুর-গুলি আর লাশের পর এবার আতঙ্ক কাটছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে ইন্টারনেট সেবা না থাকায় এবং টাকা উত্তোলন করতে না পারায় নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে মানুষের হাতে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রাজধানী ও ঢাকার বাইরে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবারের সংঘর্ষে যখন কমবেশি ৮০ জনের মৃত্যু হয়, তখন কারফিউ জারি করে সরকার। শনিবার থেকে সেনাসদস্যরা নামলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। অবশ্য তার আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সরকারি অনেক স্থাপনা, যানবাহন, এমনকি পুলিশের বিভিন্ন কার্যালয়।
রাজধানীতে গত কয়েক দিনের সহিংসতার দৃশ্য পরিদর্শনে নেমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, সেনা মোতায়েনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে।
গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, আগের দিনও আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে যেসব সড়ক অচল ছিল, গতকাল তা সচল হয়েছে। রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের রাখা বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ। তবে রাস্তায় কোনো যাত্রীবাহী বাস কিংবা মালবাহী ট্রাক দেখা যায়নি।
কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ডেকেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুতে সেই সংঘর্ষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা লিপ্ত হলেও পরে আর তা ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থানীয়রাসহ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুক্রবার রাতে কারফিউ জারি করে সরকার। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কারফিউর মধ্যেই শনি ও রোববার সংঘর্ষ চলে।
এর মধ্যে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন জানায়। পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে যায় গত পাঁচ দিনে। নজিরবিহীন এই সহিংসতার মধ্যে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বিটিভিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর চালানো হয়েছে। কোটার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত নাশকতা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। এ অবস্থায় ১৭ জুলাই থেকে সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ থাকে। সহিংসতার এই পাঁচ দিনে যা যা ঘটেছে, তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
বৃহস্পতিবার যা ঘটেছিল
‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ গত বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার ২৫ স্থানে অগ্নিসংযোগ করা হয়, ৪৮ স্থানে সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন অন্তত ২৮ জন। এ চিত্র দেশের বড় বড় নগরসহ অনেক জেলা শহরেও। সংঘর্ষ-গুলিতে দিন শেষে শিক্ষার্থী-সাংবাদিক-পথচারীসহ নিহত অন্তত ২৮। আহত দেড় হাজারের বেশি। এর আগে বুধবার মধ্যরাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক টিম শাটডাউনে দেশের সব অফিস-আদালত বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়। ঠিক তখন থেকেই যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজাসহ শনির আখড়ার অন্তত ২০টি জায়গায় আন্দোলনকারীরা আগুন ধরিয়ে দেন। সেখান থেকে রাতেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিহত অজ্ঞাত একজনকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘণ্টাখানেক বিরতির পর সকাল থেকে একই স্থানে আবার পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক রিকশাচালককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষা শেষে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি ও মিরপুর এলাকা। সড়কে থাকা পুলিশের অধিকাংশ ট্রাফিক বক্স, পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল, সরকারি নানা স্থাপনা, সরকারি গাড়ি, ফুটওভার ব্রিজ, গণপরিবহন, এমনকি বিটিভি কার্যালয়ে আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টায় মেরুল বাড্ডা এলাকায় রাজধানীর প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়। সেখানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা পাশের রামপুরা ও মালিবাগ এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। রামপুরায় বিটিভি ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এদিন সকাল ১০টায় অবরোধ শুরু হয় রামপুরা-কুড়িল সড়কে। রাস্তায় নামেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১১টার পর রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও র্যাবের সংঘর্ষ হয়। সেখানে ঘটনাস্থলে দুজনসহ ছয়জন নিহত হন। বেলা ১১টায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এরপর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তা পুরোপুরি অবরোধ করেন। এই সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয় হাতিরঝিল পুলিশ বক্স। বেলা ২টায় র্যাবের হেলিকপ্টার কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে পড়া পুলিশের সদস্যদের উদ্ধার করে।
বিটিভি ভবনে হামলা: বৃহস্পতিবার ঢাকার রামপুরায় বিটিভি ভবনে দিনভর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণকক্ষেরও দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছিল হামলাকারীরা। বিটিভি কার্যালয়ের মুজিব কর্নার এবং ঢাকা কেন্দ্রের নিরাপত্তা গেট, অভ্যর্থনা কক্ষসহ অন্তত আটটি স্থানে আগুন দেওয়া হয়। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিন দফায় হামলার পর ৭টা ৪ মিনিটে বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ করে স্টেশন ত্যাগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে চতুর্থ দফা হামলা হয়; ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাটও চালানো হয়। এতে ২২ ঘণ্টা সম্প্রচার বন্ধ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এই টিভি স্টেশনটির।
উত্তরা রণক্ষেত্র: বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উত্তরায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভকারীরা। তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাও করে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা। সেখানে সাতজন নিহত হয়। র্যাবের এক সদস্যকে গণপিটুনি দেয় বিক্ষোভকারীরা। বিভিন্ন স্থানে থাকে পুলিশ বক্স ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
যাত্রাবাড়ী-মিরপুর-মহাখালী রণক্ষেত্র: বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যাত্রাবাড়ীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখল নেয় বিক্ষোভকারীরা। এরপর রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় তাদের সঙ্গে পুলিশ-র্যাবের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তারা ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও ফুটওভার ব্রিজে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিকেলে মহাখালী এলাকার সেতু ভবন ও দুর্যোগ ভবনে আগুন দেওয়া হয়। সেখানে থাকা গাড়িগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
রাতে ইন্টারনেট বন্ধ: রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গত বুধবার রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেটের ফোর-জি সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে ব্রডব্যান্ড চালু থাকে। মোবাইল ইন্টারনেটের টু-জি সেবাও চালু ছিল। ফোর-জি সেবা বন্ধ থাকায় মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবহারকারীরা। প্রবেশ করা যাচ্ছিল না ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
শুক্রবার কী হয়েছিল
শুক্রবার দিনের প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয় বিটিভির সামনে রামপুরা ব্রিজ এলাকায়। আগের দিনও এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দিনভর সংঘর্ষ হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। পরে তা পুরো বনশ্রী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলে বনশ্রী পুলিশ ফাঁড়ি আর সন্ধ্যায় রামপুরা থানায় হামলা করে আন্দোলনকারীরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মেরাদিয়া পুলিশের পিবিআই পূর্ব কার্যালয়ও। এই ঘটনাস্থল থেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে যায় ২৫টি শিশু, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।
এদিনও রণক্ষেত্রে পরিণত উত্তরা এলাকা। আগের দিন আটক হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের গতকাল বেলা ১১টার দিকে আদালতে পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাজধানীতে প্রবেশ করতে চাইলে বিকেলে উত্তরার বিজিবি মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় আন্দোলনকারীদের হামলায় আহত হন সাবেক এই মেয়র। মারা যান তাঁর দেহরক্ষী হামিদুর রহমান জুয়েল (৩৫)। আর সন্ধ্যার পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা হামলা চালান উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরে পুলিশ কোয়ার্টারে।
ভয়ানক অবস্থা তৈরি হয় মিরপুর এলাকাতেও। জুমার নামাজের পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর ওপর সেখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন। তাঁদের পেছনে থাকেন পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা। সেখানে চারজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। পরে বিকেলে তাঁরা মিরপুর ১০-এ কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিকেলের দিকে বনানীতে সেতু ভবন, এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোল প্লাজা, মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আজিমপুর, বাড্ডা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার (সায়েন্স ল্যাব), দুর্যোগ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর করে আগুন দেয় আন্দোলনকারী। রাত পর্যন্ত ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাব এলাকা আটকে রেখে সড়কে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরা। এসব জায়গাতেও পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সেখানেও রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, ছররা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হতাহত হয় শতাধিক আন্দোলনকারী।
এদিন দুপুর ১২টার দিকে বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী আটকের পর গণতন্ত্র মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মারধর করেন। এর পরপরই সেখানে থাকা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনার রেশ চলে যায় নয়াপল্টনের বিএনপির কার্যালয়ের সামনে। সেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি চালায়। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন শতাধিক নেতা-কর্মী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও পরিবেশ ছিল থমথমে। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অবস্থান কর্মসূচি ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। তবে এত কিছুর পরেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, পুলিশ এখনো ধৈর্য ধারণ করে আছে।
সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার মিলে সারা দেশে নিহত হন ১০৩ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার নিহত হন ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪১ জন এবং শুক্রবার নিহত হন ৫৬ জন। শুক্রবার রাতে সরকারে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে কারফিউ জারি করা হয়।
মধ্য রাতে কারফিউ জারি করা হলেও বিক্ষুব্ধরা তখনো সড়কে ছিল। গভীর রাত পর্যন্ত আগুন জ্বালিয়ে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে তারা। গত শনিবার সারা দিন সেই ধারাবাহিকতা ছিল।
শনিবার যা ঘটেছিল
প্রথম দিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়, পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশ। ভাঙচুর-সংঘর্ষে টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের সঙ্গে মাঠে নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তাতেও পরিস্থিতি দিন দিন বেসামাল হয়ে পড়ছিল। সেই অবস্থায় জারি করা হয় কারফিউ। রাতারাতি মাঠে নামে সেনাবাহিনী। তারপরও বিক্ষোভ দমানো যায়নি। পথে পথে সেনাসদস্যদের টহলের পরও শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এবং ঢাকার বাইরে কয়েক জায়গায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে ৪৫ জনের মতো।
রামপুরা-বাড্ডা এদিনও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। তবে এবার পুলিশের সঙ্গে মাঠে ছিল সেনাবাহিনীও। বিক্ষোভকারীরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সড়কে আগুন জ্বালিয়ে স্লোগান দেয়। তাদের লক্ষ্য করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালান। দিনভর দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলতে থাকে। রামপুরার মতো যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ও কদমতলীর অবস্থাও ছিল একই রকম।
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম ছিল। টঙ্গীতে শিল্প পুলিশের কার্যালয়, পুলিশ বক্স এবং বিআরটিএ প্রকল্পের চলন্ত সিঁড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া টঙ্গী থানা এবং সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে তারা। সিটি করপোরেশনের ১১টি গাড়িসহ প্রায় ৪০টি গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া চেরাগ আলী এলাকায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কারখানায় হামলা চালিয়ে তিনটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভরত তিন শিক্ষার্থী নিহত হন। দুপুর ১২টার দিকে কলতাপাড়া এলাকার ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। গাজীপুর-ময়মনসিংহ ছাড়া আরও কয়েক জেলায় ভাঙচুর চালানো হয়। সেখানেও তাদের সংঘর্ষ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে।
রোববার যা হয়েছিল
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।
আদালত বলেছেন, নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। তবে সরকার প্রয়োজনে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল বা সংশোধন করতে পারবে।
হাইকোর্টের রায় বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর করা লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে রোববার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করেন।
এদিকে পাঁচ দিনে মৃত্যু বেড়ে হয়েছে ১৭৪। আহত কয়েকজনের মৃত্যু হওয়ায় এবং আগের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার কারণে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে।
সোমবার কী হয়েছিল
টানা হামলা-সংঘর্ষ-ভাঙচুর, এর মধ্যে কারফিউ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জিম্মি হয়ে পড়েছিল রাজধানীবাসী। কারফিউ না উঠলেও গতকাল ঢাকায় নতুন করে সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন নগর ও জেলার পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে নগরজীবনে। হাঁপ ছেড়েছে দেশের মানুষ।
আবার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এতেও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারী বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। রাস্তা ছেড়ে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার কথা বলছেন তাঁরা।
সব মিলিয়ে সংঘর্ষ-ভাঙচুর-গুলি আর লাশের পর এবার আতঙ্ক কাটছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে ইন্টারনেট সেবা না থাকায় এবং টাকা উত্তোলন করতে না পারায় নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে মানুষের হাতে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রাজধানী ও ঢাকার বাইরে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবারের সংঘর্ষে যখন কমবেশি ৮০ জনের মৃত্যু হয়, তখন কারফিউ জারি করে সরকার। শনিবার থেকে সেনাসদস্যরা নামলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। অবশ্য তার আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সরকারি অনেক স্থাপনা, যানবাহন, এমনকি পুলিশের বিভিন্ন কার্যালয়।
রাজধানীতে গত কয়েক দিনের সহিংসতার দৃশ্য পরিদর্শনে নেমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, সেনা মোতায়েনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে।
গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, আগের দিনও আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে যেসব সড়ক অচল ছিল, গতকাল তা সচল হয়েছে। রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের রাখা বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ। তবে রাস্তায় কোনো যাত্রীবাহী বাস কিংবা মালবাহী ট্রাক দেখা যায়নি।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বে অব বেঙ্গল সম্মেলন শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশের ৮০০ জন অতিথি। প্রথম দিন অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তা হিসেবে থাকবেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের
৪ ঘণ্টা আগেকিছু অসাধু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার স্বত্ব প্রদান এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিচ্ছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
৬ ঘণ্টা আগেছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এর তিন দিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের ১০০ দিন পার হওয়া নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে বেলজিয়ামভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। মূল্যায়নে তারা বলেছে, অন্তর্বর্তী স
৬ ঘণ্টা আগেবিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর চাকরি নিশ্চিত করতে যাচাই-বাছাইয়ের সময় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য অনেকে নিজেই পুলিশকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় সেসব তথ্যই এখন তাঁদের জন্য ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গ
৭ ঘণ্টা আগে