কামরুল হাসান, ঢাকা
আমার অবস্থা তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো, ‘অতিদূর সমুদ্রের ’পর হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা’। দিনভর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো কূলকিনারা করতে পারছি না। স্থানীয় লোকজন আমাকে সাহায্য না করে উল্টো সন্দেহ করতে শুরু করেছে। এ রকম অবস্থায় তথ্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, তাতে সমূহ আশঙ্কা থাকে। একবার ভাবছি ফিরে যাব। এভাবে ফিরে যাওয়াকে বলে ‘রণে ভঙ্গ দেওয়া’, মানে পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো। কিন্তু আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। শেষমেশ চন্দ্রবিন্দুর ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ গাইতে গাইতে রাজ্যের ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম।
পরদিন সিআইডির এএসপি মোহাম্মদ মুসলিমকে (বর্তমানে চট্টগ্রাম সিআইডির প্রধান) পুরো ঘটনা খুলে বলতেই তিনি মৃদৃ ভর্ৎসনা করে বললেন, একলা গেলেন কেন, আপনার কি মাথা খারাপ! মুসলিমের কথা শুনেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, খুব সহজেই সবকিছু জানতে পারব। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, পুলিশি অভিযানের কারণে সবাই সেখানে সতর্ক। অচেনা লোক দেখলেই সন্দেহ করছে।
যে গ্রামের কথা বলছি, তার নাম মিজমিজি। আলোঝলমলে রাজধানীর অদূরে তখন এক অজগাঁ। ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল গেলেই শেষ হয়ে যায় মহানগরীর সীমানা। এর প্রান্তসীমার গ্রামই মিজমিজি। জেলার তালিকায় পড়েছে নারায়ণগঞ্জে। পুলিশ প্রশাসনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা। পাশেই একসময় ছিল দেশের বৃহত্তম আদমজী পাটকল। নদীশিকস্তি এই গ্রামের মাঝ দিয়ে একসময় অনেক নদী প্রবহমান ছিল। যখন গেলাম, দেখলাম নদী আর নেই; শুকিয়ে মরা খাল হয়ে পড়ে আছে। গ্রামটি আরেকটি কারণে বিখ্যাত, শহীদ সাংবাদিকের কন্যা শারমিন রীমা খুন হয়েছিলেন এই গ্রামের রাস্তায়।
দুই দিন আগে সিআইডির এএসপি মুসলিমের টিম এই গ্রাম থেকে কয়েকটি শিশুকে উদ্ধার করে, সঙ্গে কয়েকজন নারী-পুরুষ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারেন, দুবাইয়ে উটের দৌড়ে ব্যবহার করা শিশুদের পাচার করা হয় এই গ্রাম থেকে। এখানে একটি শক্তিশালী চক্র আছে, যারা শত শত মাকে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের কোলের শিশুকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
মুসলিম আমাকে বলেছিলেন, এটা একটি আজব গ্রাম, অদ্ভুত এখানকার মা-বাবা। গ্রামের প্রায় ঘরেই আছে উটের জকি। পিতামাতার আয়ের স্বপ্নপূরণে সেই গ্রামের শিশুদের পাঠানো হয়েছে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে। সেখানে উটের দৌড়ের জুয়ায় জকি হতে গিয়ে কেউ কেউ অকালে প্রাণ হারিয়েছে, কেউবা চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। কেউ ফিরে এসেছে আঁতকে ওঠার মতো স্মৃতি নিয়ে। আবার দু-একজন আছে, যারা প্রচুর টাকা কামিয়ে মা-বাবার স্বপ্নপূরণে সক্ষম হয়েছে।
প্রথম দিন আমি একাই সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামের লোক আমাকে বিশ্বাস করেনি। মুসলিম আমাকে বলেছিলেন তাঁদের লোকের সঙ্গে যেতে। কিন্তু পুলিশের লোকদের সঙ্গে গেলে যা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে ভালো কোনো প্রতিবেদন হবে না। তাই একাই গেলাম। ফিরে আসার পর আমার মাথায় এল খলিলের কথা।
জনকণ্ঠের সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান। প্রথমে ভেবেছিলাম, খলিল এলাকার ছেলে, তাঁকে বাদ দিয়ে নিজের মতো করে অনুসন্ধান করব। কিন্তু হালে পানি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত খলিলের দ্বারস্থ হলাম। তিনি আমাকে পথের দিশা দিলেন। তাঁর সাহায্য নিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। যত কথা বলি তত বিস্মিত হই।
এই গ্রামের তরুণ ঠিকাদার ফজলুল হক আমাকে বললেন, একসময় এই গ্রামের মানুষের কাজই ছিল আদমজী পাটকলকেন্দ্রিক নানা ধরনের ব্যবসা করা। এরপর আদমজীতে ধস নামতে শুরু করলে অনেক লোক বেকার হয়ে পড়েন। বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য শুরু হয় বিদেশ যাওয়া। অনেকে ঢাকার ট্রাভেল এজেন্টদের দালালের হাত ধরে বিদেশ যেতে থাকেন। গ্রামে গড়ে ওঠে আদম পাচারের দালাল চক্র। একপর্যায়ে শুরু হয় উটের জকি পাচার। গ্রামে প্রথম এই কারবারের সূচনা করেন মোতালেব নামের এক প্রকৌশলী। তিনি একসময় আদমজীতে চাকরি করতেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর ট্রাভেল ব্যবসার নামে দুবাই, সৌদি আরবে লোক পাঠাতে শুরু করেন। সেই লোক পাঠানোর সঙ্গে তিনি কয়েকটি শিশুকে দুবাই পাঠান। অল্প দিনেই এটি যে লাভজনক, সে খবর গ্রামে তা রটে যায়। এরপর অনেকে এই কারবারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সেখানে একটা চক্র গড়ে ওঠে। এদের কেউ মুদিদোকানি, কেউ পাইকারি ফড়িয়া আবার কেউ বেকার। শুরু হয় গ্রামের দরিদ্র মানুষকে দ্রুত বড় লোক হওয়ার লোভ দেখানো। সেই লোভে অনেক মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের তুলে দেন চক্রের হাতে।
আমি সেখানে খোঁজ করতে গিয়ে অনেককে পেয়েছিলামও। যেমন সর্দারপাড়ার জহির আহমেদের পুত্র মহিউদ্দিন। তাকে পাচার করেছিল এলাকার আলাউদ্দিন নামের এক যুবক। কয়েক বছর পর ফিরে এসেছিল জহির। দুবাই যাওয়ার সুবাদে তার পরিবার উঠে যায় পাকা বাড়িতে। মহিউদ্দিনের মতো আরেকজন আজিবপুরের সুবেদ আলীর ছেলে হোসেন তখন মিজমিজির বেতিমোহন স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ত। সাত-আট বছর আগে তাকে পাঠানো হয়েছিল উটের জকি হিসেবে।
গ্রামের আরেক পিতা নূর মোহাম্মদ আব্দুলের পুলপাড়ে বাড়ি। তাঁর দুই সন্তান শাহাবুদ্দিন ও মহিউদ্দিন। এই দুই সন্তানকে নিয়ে নূর মোহাম্মদ দুবাই গিয়েছিলেন। নিজের সন্তানকে লাগিয়েছিলেন জকির কাজে। একদিন উটের পিঠ থেকে পড়ে এক ছেলে মারা যায়। আমি নূর মোহাম্মদের স্ত্রী জমিলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। জমিলা বলেছিলেন, আমার ছেলে গেছে, কিন্তু ভাগ্য তো ফিরেছে। এখন তাঁদের অনেক আয়-রোজগার। বাড়িও পাকা হয়েছে। নূর মোহাম্মদ বঙ্গবাজারে টুপির কারবার করেন। তাঁর ছেলে শাহাবুদিন তখন কলেজে পড়ত। সে আমাকে বলেছিল, সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে ফেরে।
সে সময় ওই গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, মিজমিজি থেকে উটের জকি হিসেবে শিশু পাচারের ঘটনা সেখানে ওপেন সিক্রেট। গ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন জানে বিষয়টি, তেমনি জানেন পুলিশ-প্রশাসনসহ স্থানীয় কর্মকর্তারা। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তখন ওসি ছিলেন ইসমাইল হোসেন খন্দকার। তিনি বলেছিলেন, কিছুই জানেন না। নারায়ণগঞ্জের এসপি ছিলেন শফিকুল ইসলাম। তিনিও একই সুরে কথা বললেন। কিন্তু আমি মাত্র তিন দিনে সে গ্রাম থেকে দুই শতাধিক শিশু পাচারের তথ্য পেয়েছিলাম।
গ্রামের অনেকে আমাকে বলেছিলেন, চিটাগাং রোডের দুই কসাই চান মিয়া আর কুব্বতের স্ত্রীরাও দুবাইতে থাকেন। প্রতিবছর তাঁরা দেশে এসে একটি করে বাচ্চা নিয়ে যান। পুলপাড়ের বেগমের ছেলে গ্রামে বসে এ কাজ করেন। গ্রামের আরেকজন ইসমাইলের ভাই নাসির দুটি বাচ্চা নিয়ে দুবাই যান। একটি বাচ্চা ফেরত এসেছে, অন্যটি এখনো আসেনি। পাচার হওয়া অনেক বাচ্চার মতো সেই বাচ্চাও উটের পায়ের তলায় পড়ে মারা যায়।
পাচারকারী চক্রের সদস্য আলিম মুনশির দুই ছেলে ইবরা ও হোসেন এমন একটি মরা বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। পরে এ নিয়ে গ্রামে সালিস হয়। এরপর তিন লাখ টাকায় মিটমাট হয়ে যায়। গ্রাম থেকে পাচার হওয়া আরেক শিশু নাজমুল উটের দৌড়ের সময় পড়ে গিয়ে আহত হলে তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
তখনকার পিজি হাসপাতালে শিশুটি মারা যায় ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল। শিশু পাচার নিয়ে আমার সিরিজ প্রতিবেদনটি ছাপা শুরু হয়েছিল ২০০২ সালের ২০ মে থেকে। এই প্রতিবেদন করতে গিয়ে মানুষের যে ভয়াবহ রূপ দেখেছি, তা আমাকে ব্যথিত করেছিল।
শিশু নাজমুল মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিউম্যান রাইটস মনিটরিং সেলের আইনজীবী দিলরুবা আফতাবী ও ইসরাত ফাতেমা একটি মামলাও করেন আদালতে। প্রথম প্রথম সবকিছু ভালোই চলছিল। একদিন ফলোআপ করতে গিয়ে শুনি, দিলরুবার মন খারাপ। নাজমুলের মা নাজমা আর মামলা চালাতে চান না। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সব মিটমাট করে ফেলেছেন। এরপর পাচারকারীদের পরামর্শে নাজমুলের মা অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। দিলরুবা একটি টানা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, দারিদ্র্য, লোভ ও হুমকির কাছে হার মেনে গেল মাতৃস্নেহ। আমাদের জীবন বোধ হয় এ রকমই ভাই।
দিলরুবার কথায় আমারও খুব মন খারাপ হলো। তাঁর কথার কোনো জবাব না দিয়েই ফিরে এলাম।
আরও পড়ুন:
আমার অবস্থা তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো, ‘অতিদূর সমুদ্রের ’পর হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা’। দিনভর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো কূলকিনারা করতে পারছি না। স্থানীয় লোকজন আমাকে সাহায্য না করে উল্টো সন্দেহ করতে শুরু করেছে। এ রকম অবস্থায় তথ্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, তাতে সমূহ আশঙ্কা থাকে। একবার ভাবছি ফিরে যাব। এভাবে ফিরে যাওয়াকে বলে ‘রণে ভঙ্গ দেওয়া’, মানে পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো। কিন্তু আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। শেষমেশ চন্দ্রবিন্দুর ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ গাইতে গাইতে রাজ্যের ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম।
পরদিন সিআইডির এএসপি মোহাম্মদ মুসলিমকে (বর্তমানে চট্টগ্রাম সিআইডির প্রধান) পুরো ঘটনা খুলে বলতেই তিনি মৃদৃ ভর্ৎসনা করে বললেন, একলা গেলেন কেন, আপনার কি মাথা খারাপ! মুসলিমের কথা শুনেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, খুব সহজেই সবকিছু জানতে পারব। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, পুলিশি অভিযানের কারণে সবাই সেখানে সতর্ক। অচেনা লোক দেখলেই সন্দেহ করছে।
যে গ্রামের কথা বলছি, তার নাম মিজমিজি। আলোঝলমলে রাজধানীর অদূরে তখন এক অজগাঁ। ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল গেলেই শেষ হয়ে যায় মহানগরীর সীমানা। এর প্রান্তসীমার গ্রামই মিজমিজি। জেলার তালিকায় পড়েছে নারায়ণগঞ্জে। পুলিশ প্রশাসনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা। পাশেই একসময় ছিল দেশের বৃহত্তম আদমজী পাটকল। নদীশিকস্তি এই গ্রামের মাঝ দিয়ে একসময় অনেক নদী প্রবহমান ছিল। যখন গেলাম, দেখলাম নদী আর নেই; শুকিয়ে মরা খাল হয়ে পড়ে আছে। গ্রামটি আরেকটি কারণে বিখ্যাত, শহীদ সাংবাদিকের কন্যা শারমিন রীমা খুন হয়েছিলেন এই গ্রামের রাস্তায়।
দুই দিন আগে সিআইডির এএসপি মুসলিমের টিম এই গ্রাম থেকে কয়েকটি শিশুকে উদ্ধার করে, সঙ্গে কয়েকজন নারী-পুরুষ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারেন, দুবাইয়ে উটের দৌড়ে ব্যবহার করা শিশুদের পাচার করা হয় এই গ্রাম থেকে। এখানে একটি শক্তিশালী চক্র আছে, যারা শত শত মাকে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের কোলের শিশুকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
মুসলিম আমাকে বলেছিলেন, এটা একটি আজব গ্রাম, অদ্ভুত এখানকার মা-বাবা। গ্রামের প্রায় ঘরেই আছে উটের জকি। পিতামাতার আয়ের স্বপ্নপূরণে সেই গ্রামের শিশুদের পাঠানো হয়েছে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে। সেখানে উটের দৌড়ের জুয়ায় জকি হতে গিয়ে কেউ কেউ অকালে প্রাণ হারিয়েছে, কেউবা চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। কেউ ফিরে এসেছে আঁতকে ওঠার মতো স্মৃতি নিয়ে। আবার দু-একজন আছে, যারা প্রচুর টাকা কামিয়ে মা-বাবার স্বপ্নপূরণে সক্ষম হয়েছে।
প্রথম দিন আমি একাই সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামের লোক আমাকে বিশ্বাস করেনি। মুসলিম আমাকে বলেছিলেন তাঁদের লোকের সঙ্গে যেতে। কিন্তু পুলিশের লোকদের সঙ্গে গেলে যা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে ভালো কোনো প্রতিবেদন হবে না। তাই একাই গেলাম। ফিরে আসার পর আমার মাথায় এল খলিলের কথা।
জনকণ্ঠের সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান। প্রথমে ভেবেছিলাম, খলিল এলাকার ছেলে, তাঁকে বাদ দিয়ে নিজের মতো করে অনুসন্ধান করব। কিন্তু হালে পানি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত খলিলের দ্বারস্থ হলাম। তিনি আমাকে পথের দিশা দিলেন। তাঁর সাহায্য নিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। যত কথা বলি তত বিস্মিত হই।
এই গ্রামের তরুণ ঠিকাদার ফজলুল হক আমাকে বললেন, একসময় এই গ্রামের মানুষের কাজই ছিল আদমজী পাটকলকেন্দ্রিক নানা ধরনের ব্যবসা করা। এরপর আদমজীতে ধস নামতে শুরু করলে অনেক লোক বেকার হয়ে পড়েন। বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য শুরু হয় বিদেশ যাওয়া। অনেকে ঢাকার ট্রাভেল এজেন্টদের দালালের হাত ধরে বিদেশ যেতে থাকেন। গ্রামে গড়ে ওঠে আদম পাচারের দালাল চক্র। একপর্যায়ে শুরু হয় উটের জকি পাচার। গ্রামে প্রথম এই কারবারের সূচনা করেন মোতালেব নামের এক প্রকৌশলী। তিনি একসময় আদমজীতে চাকরি করতেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর ট্রাভেল ব্যবসার নামে দুবাই, সৌদি আরবে লোক পাঠাতে শুরু করেন। সেই লোক পাঠানোর সঙ্গে তিনি কয়েকটি শিশুকে দুবাই পাঠান। অল্প দিনেই এটি যে লাভজনক, সে খবর গ্রামে তা রটে যায়। এরপর অনেকে এই কারবারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সেখানে একটা চক্র গড়ে ওঠে। এদের কেউ মুদিদোকানি, কেউ পাইকারি ফড়িয়া আবার কেউ বেকার। শুরু হয় গ্রামের দরিদ্র মানুষকে দ্রুত বড় লোক হওয়ার লোভ দেখানো। সেই লোভে অনেক মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের তুলে দেন চক্রের হাতে।
আমি সেখানে খোঁজ করতে গিয়ে অনেককে পেয়েছিলামও। যেমন সর্দারপাড়ার জহির আহমেদের পুত্র মহিউদ্দিন। তাকে পাচার করেছিল এলাকার আলাউদ্দিন নামের এক যুবক। কয়েক বছর পর ফিরে এসেছিল জহির। দুবাই যাওয়ার সুবাদে তার পরিবার উঠে যায় পাকা বাড়িতে। মহিউদ্দিনের মতো আরেকজন আজিবপুরের সুবেদ আলীর ছেলে হোসেন তখন মিজমিজির বেতিমোহন স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ত। সাত-আট বছর আগে তাকে পাঠানো হয়েছিল উটের জকি হিসেবে।
গ্রামের আরেক পিতা নূর মোহাম্মদ আব্দুলের পুলপাড়ে বাড়ি। তাঁর দুই সন্তান শাহাবুদ্দিন ও মহিউদ্দিন। এই দুই সন্তানকে নিয়ে নূর মোহাম্মদ দুবাই গিয়েছিলেন। নিজের সন্তানকে লাগিয়েছিলেন জকির কাজে। একদিন উটের পিঠ থেকে পড়ে এক ছেলে মারা যায়। আমি নূর মোহাম্মদের স্ত্রী জমিলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। জমিলা বলেছিলেন, আমার ছেলে গেছে, কিন্তু ভাগ্য তো ফিরেছে। এখন তাঁদের অনেক আয়-রোজগার। বাড়িও পাকা হয়েছে। নূর মোহাম্মদ বঙ্গবাজারে টুপির কারবার করেন। তাঁর ছেলে শাহাবুদিন তখন কলেজে পড়ত। সে আমাকে বলেছিল, সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে ফেরে।
সে সময় ওই গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, মিজমিজি থেকে উটের জকি হিসেবে শিশু পাচারের ঘটনা সেখানে ওপেন সিক্রেট। গ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন জানে বিষয়টি, তেমনি জানেন পুলিশ-প্রশাসনসহ স্থানীয় কর্মকর্তারা। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তখন ওসি ছিলেন ইসমাইল হোসেন খন্দকার। তিনি বলেছিলেন, কিছুই জানেন না। নারায়ণগঞ্জের এসপি ছিলেন শফিকুল ইসলাম। তিনিও একই সুরে কথা বললেন। কিন্তু আমি মাত্র তিন দিনে সে গ্রাম থেকে দুই শতাধিক শিশু পাচারের তথ্য পেয়েছিলাম।
গ্রামের অনেকে আমাকে বলেছিলেন, চিটাগাং রোডের দুই কসাই চান মিয়া আর কুব্বতের স্ত্রীরাও দুবাইতে থাকেন। প্রতিবছর তাঁরা দেশে এসে একটি করে বাচ্চা নিয়ে যান। পুলপাড়ের বেগমের ছেলে গ্রামে বসে এ কাজ করেন। গ্রামের আরেকজন ইসমাইলের ভাই নাসির দুটি বাচ্চা নিয়ে দুবাই যান। একটি বাচ্চা ফেরত এসেছে, অন্যটি এখনো আসেনি। পাচার হওয়া অনেক বাচ্চার মতো সেই বাচ্চাও উটের পায়ের তলায় পড়ে মারা যায়।
পাচারকারী চক্রের সদস্য আলিম মুনশির দুই ছেলে ইবরা ও হোসেন এমন একটি মরা বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। পরে এ নিয়ে গ্রামে সালিস হয়। এরপর তিন লাখ টাকায় মিটমাট হয়ে যায়। গ্রাম থেকে পাচার হওয়া আরেক শিশু নাজমুল উটের দৌড়ের সময় পড়ে গিয়ে আহত হলে তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
তখনকার পিজি হাসপাতালে শিশুটি মারা যায় ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল। শিশু পাচার নিয়ে আমার সিরিজ প্রতিবেদনটি ছাপা শুরু হয়েছিল ২০০২ সালের ২০ মে থেকে। এই প্রতিবেদন করতে গিয়ে মানুষের যে ভয়াবহ রূপ দেখেছি, তা আমাকে ব্যথিত করেছিল।
শিশু নাজমুল মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিউম্যান রাইটস মনিটরিং সেলের আইনজীবী দিলরুবা আফতাবী ও ইসরাত ফাতেমা একটি মামলাও করেন আদালতে। প্রথম প্রথম সবকিছু ভালোই চলছিল। একদিন ফলোআপ করতে গিয়ে শুনি, দিলরুবার মন খারাপ। নাজমুলের মা নাজমা আর মামলা চালাতে চান না। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সব মিটমাট করে ফেলেছেন। এরপর পাচারকারীদের পরামর্শে নাজমুলের মা অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। দিলরুবা একটি টানা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, দারিদ্র্য, লোভ ও হুমকির কাছে হার মেনে গেল মাতৃস্নেহ। আমাদের জীবন বোধ হয় এ রকমই ভাই।
দিলরুবার কথায় আমারও খুব মন খারাপ হলো। তাঁর কথার কোনো জবাব না দিয়েই ফিরে এলাম।
আরও পড়ুন:
ফ্যাসিবাদের দোসরেরা এখনো বিভিন্ন জায়গায় বহাল তবিয়তে রয়েছে। তাদের পরিহারের ঘোষণা দিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (নাসির আব্দুল্লাহ) বলেছেন, ‘খুনি ও খুনের হুকুমদাতারা যদি তাদের স্কিলের কারণে থেকে যায়, তাহলে আমরা আরেকটি যুদ্ধ করতে বাধ্য হব।
১ ঘণ্টা আগেসেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বে অব বেঙ্গল সম্মেলন শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশের ৮০০ জন অতিথি। প্রথম দিন অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তা হিসেবে থাকবেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের
৮ ঘণ্টা আগেকিছু অসাধু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার স্বত্ব প্রদান এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিচ্ছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
৯ ঘণ্টা আগেছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এর তিন দিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের ১০০ দিন পার হওয়া নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে বেলজিয়ামভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। মূল্যায়নে তারা বলেছে, অন্তর্বর্তী স
৯ ঘণ্টা আগে