কামরুল হাসান, ঢাকা
রিকশাটি এসে থামল থানার ফটকের সামনে। দুই যাত্রীর একজন যুবক, অন্যজন ষাটোর্ধ্ব। যুবকের একটি হাত আলগোছে ধরে আছেন বয়স্ক লোকটি। কোনো রকম জোর-জবরদস্তি নেই। রিকশা থেকে নেমে দুজনে হেঁটে ভেতরে ঢুকলেন। মোহাম্মদপুর থানার ওসি তখন মুখ গুঁজে একটি ফাইল পড়ছিলেন। জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা যুবককে ওসির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে লোকটি বললেন, এই নিন আপনার আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী। ওসি চোখ কপালে তুলে যুবকের কাছে জানতে চাইলেন, কী নাম? যুবক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, কামাল পাশা। ওসি একবার বৃদ্ধের দিকে, আরেকবার যুবকের দিকে তাকালেন। কিছুই বলতে পারছেন না। ততক্ষণে ঝোড়ো গতিতে থানায় রটে গেছে, সরকারের পুরস্কারঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশা ‘সারেন্ডার’ করেছেন।
আগের দিনের পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন, থানা আর খেয়াঘাটে কোনো কথা গোপন থাকে না। মোহাম্মদপুর থানাতেও শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো, নিমেষে খবর পৌঁছে গেল ক্রাইম রিপোর্টারদের কানে। আমি যখন থানায় এলাম, ততক্ষণে কামাল পাশাকে হাজতে ঢোকানো হয়েছে। আর তাঁর বাবা লিয়াকত আলী ডিউটি অফিসারের সামনে নির্বিকার বসে আছেন।
ডিউটি অফিসার আর লিয়াকত আলীর মুখ থেকে আমি পুরো ঘটনা শুনলাম। মনে হলো, তাঁরা কিছুই গোপন করেননি। কিন্তু ওসির রুমে গিয়ে শুনি, এরই মধ্যে দৃশ্যপট বদলে গেছে। ওসি এখন বলছেন, তিনি বৃদ্ধকে চাপ দিয়ে তাঁর সন্ত্রাসী ছেলে কামাল পাশাকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করেছেন। আরও বললেন, এটা নাকি আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের বিশেষ কৌশল। এ ঘটনার যাবতীয় কৃতিত্ব ওসির। তাঁর সঙ্গে আর তর্কে জড়ালাম না, পাছে তিক্ততা বাড়ে! ওসি আমাকে কামাল পাশার সঙ্গে কথার বলার অনুমতি দিলেন।
থানাহাজতের দিকে একটু উঁকি দিয়ে দেখি, কামাল পাশা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, কেন আত্মসমর্পণ করলেন? তিনি চুপ করে থাকলেন। আবার একই প্রশ্ন করলাম। এবার তিনি বললেন, ‘ভাই, এটা না করলে আমার মা-বাবা সুইসাইড করবে। বলেন, আপনি হলে কী করতেন?’ আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করছি। মনে আছে, সেদিন তিনি প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন।
এটা ছিল ২০০২ সালের ২০ মের বিকেল। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তখন কামাল পাশার অনেক নামডাক। সব সময় অস্ত্রধারী সহযোগী নিয়ে চলাফেরা করেন। তবে তাঁর পরিচিতির আরেকটি কারণ ছিল, তিনি সব খুনই করেছিলেন দিনের বেলায়। শত শত লোকের উপস্থিতিতে। খুন করার পরমুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যেতেন। সম্ভবত প্রথমে তিনি একজন ঠিকাদারকে খুন করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ২২ মে শাহবাগে পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ঠিকাদার আশিক ইকবালকে গুলি করে খুন করেন।
এ সময় কামালের সঙ্গে তাঁর সহযোগী রাশেদ মোস্তফা রতনও ছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় শেরাটন হোটেলের সামনে এক সার্জেন্ট জীবনবাজি রেখে তাঁদের গতিরোধ করে আটক করেন। পরে কামাল পাশা জামিনে বেরিয়ে আসেন।
২০০০ সালের প্রথম দিকে উত্তরায় আরেক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন কামাল পাশা ও তাঁর লোকজন। বনানীর একজন ডিশ ব্যবসায়ীও তাঁর হাতে খুন হন।
২০০০ সালের মে মাসে মোহাম্মদপুরে আশরাফ হোসেন জুয়েল ও মোহাম্মদ আলী রিভেল নামের দুই ভাইকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেন কামাল। এরপরই পত্রপত্রিকায় তাঁর নাম বেশি বেশি আসতে থাকে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে কামাল পাশার নাম ছিল। তাঁকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সরকার।
সেদিন থানায় কামাল পাশার সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তিনি কীভাবে সন্ত্রাসী হলেন। কামাল পাশা বলছিলেন, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে কিছুদিন একমি ল্যাবরেটরিজে চাকরি করেন। সেখানে এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন। কিছুদিন পর সেই সন্ত্রাসী খুন হয়। এরপর তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা বন্ধ করে দেন।
জানতে চাইলাম, এত দিন গোপনে থাকতেন কোথায়? তিনি বললেন, মোহাম্মদপুরের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের হোস্টেলে। এটা ছিল মোহাম্মদপুর থানার পাঁচ শ গজের মধ্যে। বললেন, আজ সকাল পর্যন্ত ওই হোস্টেলেই ছিলেন। কার রুমে থাকতেন? তিনি বললেন, এটা বলা ঠিক হবে না।
কামাল পাশা বলছিলেন, তিনি ছিলেন জোট সরকারের প্রয়াত এমপি নাসিরউদ্দীন পিন্টুর ঘনিষ্ঠ। বিএনপির পুরো সময়ে তিনি পিন্টুর সহযোগিতা নিয়েই ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতে পালিয়ে যান। কিছুদিন বাস করেন কলকাতায়। সেখানে থাকার সময় জানতে পারেন, আরেক সন্ত্রাসী ইমনকে সে দেশের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এরপর তিনি কলকাতা ছেড়ে আজমির শরিফে চলে যান। সেখানে আরও কিছুদিন কাটান। পরে পিন্টুর সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এসে পিন্টুর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছিলেন। আমাকে বললেন, টেলিফোনে পিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। ঢাকায় আসার পর নিরাপদ জায়গা না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ঝাপড়াজানে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। পরে ঢাকায় ফিরে আসেন। এবার মোহাম্মদপুর থানার উল্টো দিকে গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট হোস্টেলের একটি রুমে পাকাপাকি আস্তানা গাড়েন। তাঁর কাছে জায়গাটি ছিল খুব নিরাপদ। সহজে কেউ সন্দেহ করত না।
বললাম, তাহলে আপনি ধরা দিতে রাজি হলেন কেন? কামাল বললেন, কয়েক দিন আগে বড় ভাই পারভেজ আহমেদকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। বাবার চাকরি নেই। পারভেজ ভাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি না থাকলে বাসার সবাই না খেয়ে থাকবে। এই অবস্থায় আব্বা ওসির কাছে কথা দিয়ে যান, আমি এলে তিনি পুলিশকে খবর দেবেন। সম্ভবত এ ধরনের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিনি ভাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এরপর একদিন ভোরে আমি বাড়ি এলাম। সেদিন সবাই আমাকে নিয়ে বসলেন। তাঁরা আমাকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিলেন। আমি প্রথমে রাজি হইনি। পরে মা-বাবা অনেক কান্নাকাটি করলেন। একপর্যায়ে মা বললেন, তিনি আত্মহত্যা করবেন। মায়ের এই কান্না আমার সহ্য হলো না। মনে হলো, মায়ের জন্য কিছু একটা করি। রাজি হয়ে গেলাম, দেখি কী আছে কপালে। আমি কামাল পাশার দিকে তাকালাম, তিনি হাজতের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর গলা ধরে এসেছে।
আত্মসমর্পণের পর কামাল পাশাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দেশের সব কাগজে তা ফলাও করে ছাপাও হয়। তিনটি খুনের মামলার আসামি হিসেবে পুলিশ তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নেয়। এভাবে একের পর এক মামলায় তাঁকে আসামি হিসেবে দেখানো হতে থাকে। এগুলোর মধ্যে ছিল রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর ও রমনা থানার দুটি পৃথক হত্যা মামলা এবং তেজগাঁও থানার একটি অস্ত্র মামলা। এসব মামলায় তাঁর ৯০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ২০০৫ সালের ২৬ আগস্ট তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ স্থানান্তর করা হয়।
এরপর দিনে দিনে কামাল পাশা হারিয়ে যান। অনেক দিন তাঁর আর খোঁজ করিনি। ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই শুনলাম, কামাল পাশা মারা গেছেন। কাশিমপুরের জেলার বলেছিলেন, কারাগারে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কামাল পাশাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রচিত হয় জীবনকাহিনির শেষ অধ্যায়।
অনেক দিন পর পুরোনো ডায়েরি খুঁজতে গিয়ে কামাল পাশার ইন্টারভিউর সেই নোটটা পেয়ে গেলাম। পড়তে গিয়ে মনে হলো, সেদিন থানা থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। বের হওয়ার পথে ডিউটি অফিসারের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, কামাল পাশার বাবা লিয়াকত আলী তখনো বসে আছেন। আমি আবার তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার আর তিনি কিছুই বললেন না। আমার দিকে তাকালেনও না। টলমল চোখে শূন্যের দিকে চেয়ে আছেন। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, অসহায় এই বাবার সঙ্গে আরেকটু কথা বলি। কিন্তু অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বেরিয়ে এলাম থানা থেকে। ‘সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।’
আরও পড়ুন:
রিকশাটি এসে থামল থানার ফটকের সামনে। দুই যাত্রীর একজন যুবক, অন্যজন ষাটোর্ধ্ব। যুবকের একটি হাত আলগোছে ধরে আছেন বয়স্ক লোকটি। কোনো রকম জোর-জবরদস্তি নেই। রিকশা থেকে নেমে দুজনে হেঁটে ভেতরে ঢুকলেন। মোহাম্মদপুর থানার ওসি তখন মুখ গুঁজে একটি ফাইল পড়ছিলেন। জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা যুবককে ওসির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে লোকটি বললেন, এই নিন আপনার আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী। ওসি চোখ কপালে তুলে যুবকের কাছে জানতে চাইলেন, কী নাম? যুবক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, কামাল পাশা। ওসি একবার বৃদ্ধের দিকে, আরেকবার যুবকের দিকে তাকালেন। কিছুই বলতে পারছেন না। ততক্ষণে ঝোড়ো গতিতে থানায় রটে গেছে, সরকারের পুরস্কারঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশা ‘সারেন্ডার’ করেছেন।
আগের দিনের পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন, থানা আর খেয়াঘাটে কোনো কথা গোপন থাকে না। মোহাম্মদপুর থানাতেও শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো, নিমেষে খবর পৌঁছে গেল ক্রাইম রিপোর্টারদের কানে। আমি যখন থানায় এলাম, ততক্ষণে কামাল পাশাকে হাজতে ঢোকানো হয়েছে। আর তাঁর বাবা লিয়াকত আলী ডিউটি অফিসারের সামনে নির্বিকার বসে আছেন।
ডিউটি অফিসার আর লিয়াকত আলীর মুখ থেকে আমি পুরো ঘটনা শুনলাম। মনে হলো, তাঁরা কিছুই গোপন করেননি। কিন্তু ওসির রুমে গিয়ে শুনি, এরই মধ্যে দৃশ্যপট বদলে গেছে। ওসি এখন বলছেন, তিনি বৃদ্ধকে চাপ দিয়ে তাঁর সন্ত্রাসী ছেলে কামাল পাশাকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করেছেন। আরও বললেন, এটা নাকি আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের বিশেষ কৌশল। এ ঘটনার যাবতীয় কৃতিত্ব ওসির। তাঁর সঙ্গে আর তর্কে জড়ালাম না, পাছে তিক্ততা বাড়ে! ওসি আমাকে কামাল পাশার সঙ্গে কথার বলার অনুমতি দিলেন।
থানাহাজতের দিকে একটু উঁকি দিয়ে দেখি, কামাল পাশা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, কেন আত্মসমর্পণ করলেন? তিনি চুপ করে থাকলেন। আবার একই প্রশ্ন করলাম। এবার তিনি বললেন, ‘ভাই, এটা না করলে আমার মা-বাবা সুইসাইড করবে। বলেন, আপনি হলে কী করতেন?’ আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করছি। মনে আছে, সেদিন তিনি প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন।
এটা ছিল ২০০২ সালের ২০ মের বিকেল। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তখন কামাল পাশার অনেক নামডাক। সব সময় অস্ত্রধারী সহযোগী নিয়ে চলাফেরা করেন। তবে তাঁর পরিচিতির আরেকটি কারণ ছিল, তিনি সব খুনই করেছিলেন দিনের বেলায়। শত শত লোকের উপস্থিতিতে। খুন করার পরমুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যেতেন। সম্ভবত প্রথমে তিনি একজন ঠিকাদারকে খুন করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ২২ মে শাহবাগে পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ঠিকাদার আশিক ইকবালকে গুলি করে খুন করেন।
এ সময় কামালের সঙ্গে তাঁর সহযোগী রাশেদ মোস্তফা রতনও ছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় শেরাটন হোটেলের সামনে এক সার্জেন্ট জীবনবাজি রেখে তাঁদের গতিরোধ করে আটক করেন। পরে কামাল পাশা জামিনে বেরিয়ে আসেন।
২০০০ সালের প্রথম দিকে উত্তরায় আরেক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন কামাল পাশা ও তাঁর লোকজন। বনানীর একজন ডিশ ব্যবসায়ীও তাঁর হাতে খুন হন।
২০০০ সালের মে মাসে মোহাম্মদপুরে আশরাফ হোসেন জুয়েল ও মোহাম্মদ আলী রিভেল নামের দুই ভাইকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেন কামাল। এরপরই পত্রপত্রিকায় তাঁর নাম বেশি বেশি আসতে থাকে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে কামাল পাশার নাম ছিল। তাঁকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সরকার।
সেদিন থানায় কামাল পাশার সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তিনি কীভাবে সন্ত্রাসী হলেন। কামাল পাশা বলছিলেন, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে কিছুদিন একমি ল্যাবরেটরিজে চাকরি করেন। সেখানে এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন। কিছুদিন পর সেই সন্ত্রাসী খুন হয়। এরপর তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা বন্ধ করে দেন।
জানতে চাইলাম, এত দিন গোপনে থাকতেন কোথায়? তিনি বললেন, মোহাম্মদপুরের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের হোস্টেলে। এটা ছিল মোহাম্মদপুর থানার পাঁচ শ গজের মধ্যে। বললেন, আজ সকাল পর্যন্ত ওই হোস্টেলেই ছিলেন। কার রুমে থাকতেন? তিনি বললেন, এটা বলা ঠিক হবে না।
কামাল পাশা বলছিলেন, তিনি ছিলেন জোট সরকারের প্রয়াত এমপি নাসিরউদ্দীন পিন্টুর ঘনিষ্ঠ। বিএনপির পুরো সময়ে তিনি পিন্টুর সহযোগিতা নিয়েই ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতে পালিয়ে যান। কিছুদিন বাস করেন কলকাতায়। সেখানে থাকার সময় জানতে পারেন, আরেক সন্ত্রাসী ইমনকে সে দেশের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এরপর তিনি কলকাতা ছেড়ে আজমির শরিফে চলে যান। সেখানে আরও কিছুদিন কাটান। পরে পিন্টুর সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এসে পিন্টুর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছিলেন। আমাকে বললেন, টেলিফোনে পিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। ঢাকায় আসার পর নিরাপদ জায়গা না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ঝাপড়াজানে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। পরে ঢাকায় ফিরে আসেন। এবার মোহাম্মদপুর থানার উল্টো দিকে গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট হোস্টেলের একটি রুমে পাকাপাকি আস্তানা গাড়েন। তাঁর কাছে জায়গাটি ছিল খুব নিরাপদ। সহজে কেউ সন্দেহ করত না।
বললাম, তাহলে আপনি ধরা দিতে রাজি হলেন কেন? কামাল বললেন, কয়েক দিন আগে বড় ভাই পারভেজ আহমেদকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। বাবার চাকরি নেই। পারভেজ ভাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি না থাকলে বাসার সবাই না খেয়ে থাকবে। এই অবস্থায় আব্বা ওসির কাছে কথা দিয়ে যান, আমি এলে তিনি পুলিশকে খবর দেবেন। সম্ভবত এ ধরনের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিনি ভাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এরপর একদিন ভোরে আমি বাড়ি এলাম। সেদিন সবাই আমাকে নিয়ে বসলেন। তাঁরা আমাকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিলেন। আমি প্রথমে রাজি হইনি। পরে মা-বাবা অনেক কান্নাকাটি করলেন। একপর্যায়ে মা বললেন, তিনি আত্মহত্যা করবেন। মায়ের এই কান্না আমার সহ্য হলো না। মনে হলো, মায়ের জন্য কিছু একটা করি। রাজি হয়ে গেলাম, দেখি কী আছে কপালে। আমি কামাল পাশার দিকে তাকালাম, তিনি হাজতের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর গলা ধরে এসেছে।
আত্মসমর্পণের পর কামাল পাশাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দেশের সব কাগজে তা ফলাও করে ছাপাও হয়। তিনটি খুনের মামলার আসামি হিসেবে পুলিশ তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নেয়। এভাবে একের পর এক মামলায় তাঁকে আসামি হিসেবে দেখানো হতে থাকে। এগুলোর মধ্যে ছিল রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর ও রমনা থানার দুটি পৃথক হত্যা মামলা এবং তেজগাঁও থানার একটি অস্ত্র মামলা। এসব মামলায় তাঁর ৯০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ২০০৫ সালের ২৬ আগস্ট তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ স্থানান্তর করা হয়।
এরপর দিনে দিনে কামাল পাশা হারিয়ে যান। অনেক দিন তাঁর আর খোঁজ করিনি। ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই শুনলাম, কামাল পাশা মারা গেছেন। কাশিমপুরের জেলার বলেছিলেন, কারাগারে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কামাল পাশাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রচিত হয় জীবনকাহিনির শেষ অধ্যায়।
অনেক দিন পর পুরোনো ডায়েরি খুঁজতে গিয়ে কামাল পাশার ইন্টারভিউর সেই নোটটা পেয়ে গেলাম। পড়তে গিয়ে মনে হলো, সেদিন থানা থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। বের হওয়ার পথে ডিউটি অফিসারের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, কামাল পাশার বাবা লিয়াকত আলী তখনো বসে আছেন। আমি আবার তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার আর তিনি কিছুই বললেন না। আমার দিকে তাকালেনও না। টলমল চোখে শূন্যের দিকে চেয়ে আছেন। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, অসহায় এই বাবার সঙ্গে আরেকটু কথা বলি। কিন্তু অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বেরিয়ে এলাম থানা থেকে। ‘সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।’
আরও পড়ুন:
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বে অব বেঙ্গল সম্মেলন শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশের ৮০০ জন অতিথি। প্রথম দিন অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তা হিসেবে থাকবেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের
৪ ঘণ্টা আগেকিছু অসাধু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার স্বত্ব প্রদান এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিচ্ছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
৫ ঘণ্টা আগেছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এর তিন দিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের ১০০ দিন পার হওয়া নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে বেলজিয়ামভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। মূল্যায়নে তারা বলেছে, অন্তর্বর্তী স
৫ ঘণ্টা আগেবিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর চাকরি নিশ্চিত করতে যাচাই-বাছাইয়ের সময় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য অনেকে নিজেই পুলিশকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় সেসব তথ্যই এখন তাঁদের জন্য ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গ
৬ ঘণ্টা আগে