গোলাম ওয়াদুদ, ঢাকা
সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের রোগে পরিণত হয়েছে। অন্য রোগের প্রতিষেধক রয়েছে, যা দিয়ে রোগমুক্তি বা রোগের উপশম হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এমন একটি রোগে পরিণত হয়েছে, যার প্রতিষেধকের দেখা নেই। ফলে প্রতিদিনই এই রোগে মারা যাচ্ছে অনেকে। একটি করে বছর যায়, আর সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা আগের বছরকে ছাড়িয়ে যায়। আর নিয়ম মেনেই শুধু দাবিনামাতেই থেকে যায় ‘নিরাপদ সড়ক’। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
২০১৮ সালের মতো এ বছরও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। কাঁচা বয়সের আবেগ নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে এসেছিল। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন পরিবহন শ্রমিকেরা। একই ধরনের আন্দোলন দেখা গিয়েছিল বছরের মাঝামাঝি যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে। তবে বছরের শেষ দিকে হাফ পাস ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কেড়েছে। যদিও কিছু আশ্বাস ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়নি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যখন ঢাকার রাজপথ উত্তাল, তখনো রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে মানুষের।
এবার অবশ্য নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের আগে থেকেই পথে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ২০ নভেম্বর ঠিকানা পরিবহনের একটি বাসে রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী অর্ধেক ভাড়া দিতে চাইলে তাঁকে ধর্ষণের হুমকি দেন বাসচালকের সহকারী। পরদিন ২১ নভেম্বর থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। উঠে আসে সড়কে নারীদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি। সেদিনই গ্রেপ্তার করা হয় ওই অভিযুক্ত বাসচালক ও তাঁর সহকারীকে। কিন্তু হাফ পাসের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যেই সড়কে নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের প্রাণ হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। কিন্তু প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থেকে গেল।
এ আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। ২০২১ সালের বড় একটি অংশ করোনা মহামারির মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে দেশ। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশ কিছু দিনের জন্য চলাচলে বিধিনিষেধ বা লকডাউন আরোপ করা হয়েছিল। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনা থামানো যায়নি। নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে মোট ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ১৪৪ জন। নিহতদের ১৪ শতাংশই শিক্ষার্থী। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এ বছর সড়কে ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, শুধু গত নভেম্বর মাসে দেশে ৩৭৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪১৩ জন। গড়ে প্রতিদিন মারা গেছে ১৪ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুই রয়েছে ১২৫ জন। ওই মাসে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১১৮ শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। এ অবস্থায় ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গাড়ি ধাক্কা দিলে সেখানেই মারা যায় নাঈম। তার মৃত্যুর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। একে একে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাজধানীতে। এবারও আন্দোলনের মূল দাবি ছিল নিরাপদ সড়ক। ডিএসসিসি মেয়রের প্রতিশ্রুতিতে এ আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে আসে, তখনই ২৯ নভেম্বর রামপুরায় একরামুন্নেছা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মাইনুদ্দীন দুর্জয়কে চাপা দেয় বাস। এর পর আরেক দফা আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানেও আন্দোলন শুরু হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখায়। প্রদর্শন করে দুর্নীতিবিরোধী ব্যঙ্গচিত্র। তাদের বক্তব্য ছিল—কোনো ব্যক্তিবিশেষ নন, পরিবহন খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেই এই লাল কার্ড। কিন্তু এই আন্দোলন দমনেও সরকারকে কঠোর হতে দেখা গেছে। এ আন্দোলন থেকেও সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের দাবি ওঠে। গুরুত্ব পায় গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণসহ বেশ কিছু বিষয়।
সুনির্দিষ্ট ১১ দাবি
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ১১ দফা দাবি জানায়। এগুলো হলো—
১. সড়কে কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনউদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে।
২. সারা দেশে সকল গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
৩. গণপরিবহনে ছাত্র-ছাত্রী এবং নারীদের অবাধ যাত্রা ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সকল পরিবহন মালিকের মধ্যে তাদের অংশ অনুয়ায়ী সমানভাবে বণ্টনের নিয়ম চালু করতে হবে।
৭. শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তি ভিত্তিতে বাস দেওয়ার বদলে টিকিট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. গাড়ি চালকের কর্মঘণ্টা একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে দুজন চালক ও দুজন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. যাত্রী-পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
১১. মাদকাসক্ত নিরসনে গোটা সমাজে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই দাবিগুলো নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে এ দাবিগুলো উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই কিছু হয়নি।
এবারও শুধু আশ্বাস মিলেছে
নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর বেগবান হওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ নভেম্বর আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেন ডিএসসিসি মেয়র ফজলে নূর তাপস। তিনি নাঈমের মৃত্যু যেখানে হয়েছে, সেখানে ‘শহীদ নাঈম’ নামে একটি ফুটওভার ব্রিজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। রামপুরায় নিহত মাইনুদ্দীন দুর্জয় নিহতের ঘটনাতেও উঠে আসে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের প্রসঙ্গ। আর সড়কে নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত অন্য বিষয়গুলো একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের দিক থেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে গতিরোধক ও ফুটওভার ব্রিজ তৈরির প্রতিশ্রুতিই এবারও একমাত্র সম্বল। তাও এ ক্ষেত্রে শুধু রাজধানীর দিকেই মনোযোগ পেয়েছে। অথচ দেশের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। নভেম্বর পর্যন্ত সড়কে ৫ হাজার ১৪৪ মৃত্যুর পরিসংখ্যানই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই এত মৃত্যু নিয়ে কিন্তু আলোড়ন হয়নি। হয়েছে রাজধানীর দুটি ঘটনায়। যেন মৃত্যুও প্রতিবাদেরও আছে শ্রেণিবিচার।
গণপরিবহনের বেপরোয়া গতি অটুট
এত এত আন্দোলন, তোলপাড় সত্ত্বেও বিশেষত গণপরিবহনের বেপরোয়া গতি নিয়ে কারও যেন কিছু বলার নেই। হ্যাঁ, হাফ পাস আন্দোলনকে সফল বলা যাবে কিছুটা। কিছুটা এই কারণে যে, প্রথমে রাজধানীর শিক্ষার্থীরা পেলেও পরে আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়ায় গণপরিবহনে চলাচলের অধিকার আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আসা নিরাপদ সড়কের দাবিগুলো যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এবারের আন্দোলনেও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা প্রমাণ করেছে, ২০১৮ সালের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া আইন বা যাবতীয় প্রতিশ্রুতি আদতে ফাঁকা বুলি। এগুলো শুধু তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলনকারীদের শান্ত করতেই দেওয়া হয়। না হলে নভেম্বরের আন্দোলনের পর ডিসেম্বরে অন্তত সড়কে দুর্ঘটনা কমত। কিন্তু শেষ মাসেও যেভাবে দুর্ঘটনায় নিহতের খবর এসেছে, তাতে তেমন লক্ষণ অন্তত দেখা যায়নি। ফলে ফুটওভার ব্রিজের প্রতিশ্রুতিকেই এবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের একমাত্র প্রাপ্তি বলতে হবে। বাকি যা কিছু, তার জায়গা ওই দাবিনামাতেই।
আরও পড়ুন:
সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের রোগে পরিণত হয়েছে। অন্য রোগের প্রতিষেধক রয়েছে, যা দিয়ে রোগমুক্তি বা রোগের উপশম হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এমন একটি রোগে পরিণত হয়েছে, যার প্রতিষেধকের দেখা নেই। ফলে প্রতিদিনই এই রোগে মারা যাচ্ছে অনেকে। একটি করে বছর যায়, আর সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা আগের বছরকে ছাড়িয়ে যায়। আর নিয়ম মেনেই শুধু দাবিনামাতেই থেকে যায় ‘নিরাপদ সড়ক’। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
২০১৮ সালের মতো এ বছরও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। কাঁচা বয়সের আবেগ নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে এসেছিল। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন পরিবহন শ্রমিকেরা। একই ধরনের আন্দোলন দেখা গিয়েছিল বছরের মাঝামাঝি যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে। তবে বছরের শেষ দিকে হাফ পাস ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কেড়েছে। যদিও কিছু আশ্বাস ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়নি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যখন ঢাকার রাজপথ উত্তাল, তখনো রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে মানুষের।
এবার অবশ্য নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের আগে থেকেই পথে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ২০ নভেম্বর ঠিকানা পরিবহনের একটি বাসে রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী অর্ধেক ভাড়া দিতে চাইলে তাঁকে ধর্ষণের হুমকি দেন বাসচালকের সহকারী। পরদিন ২১ নভেম্বর থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। উঠে আসে সড়কে নারীদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি। সেদিনই গ্রেপ্তার করা হয় ওই অভিযুক্ত বাসচালক ও তাঁর সহকারীকে। কিন্তু হাফ পাসের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যেই সড়কে নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের প্রাণ হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। কিন্তু প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থেকে গেল।
এ আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। ২০২১ সালের বড় একটি অংশ করোনা মহামারির মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে দেশ। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশ কিছু দিনের জন্য চলাচলে বিধিনিষেধ বা লকডাউন আরোপ করা হয়েছিল। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনা থামানো যায়নি। নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে মোট ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ১৪৪ জন। নিহতদের ১৪ শতাংশই শিক্ষার্থী। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এ বছর সড়কে ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, শুধু গত নভেম্বর মাসে দেশে ৩৭৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪১৩ জন। গড়ে প্রতিদিন মারা গেছে ১৪ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুই রয়েছে ১২৫ জন। ওই মাসে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১১৮ শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। এ অবস্থায় ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গাড়ি ধাক্কা দিলে সেখানেই মারা যায় নাঈম। তার মৃত্যুর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। একে একে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাজধানীতে। এবারও আন্দোলনের মূল দাবি ছিল নিরাপদ সড়ক। ডিএসসিসি মেয়রের প্রতিশ্রুতিতে এ আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে আসে, তখনই ২৯ নভেম্বর রামপুরায় একরামুন্নেছা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মাইনুদ্দীন দুর্জয়কে চাপা দেয় বাস। এর পর আরেক দফা আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানেও আন্দোলন শুরু হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখায়। প্রদর্শন করে দুর্নীতিবিরোধী ব্যঙ্গচিত্র। তাদের বক্তব্য ছিল—কোনো ব্যক্তিবিশেষ নন, পরিবহন খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেই এই লাল কার্ড। কিন্তু এই আন্দোলন দমনেও সরকারকে কঠোর হতে দেখা গেছে। এ আন্দোলন থেকেও সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের দাবি ওঠে। গুরুত্ব পায় গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণসহ বেশ কিছু বিষয়।
সুনির্দিষ্ট ১১ দাবি
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ১১ দফা দাবি জানায়। এগুলো হলো—
১. সড়কে কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনউদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে।
২. সারা দেশে সকল গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
৩. গণপরিবহনে ছাত্র-ছাত্রী এবং নারীদের অবাধ যাত্রা ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সকল পরিবহন মালিকের মধ্যে তাদের অংশ অনুয়ায়ী সমানভাবে বণ্টনের নিয়ম চালু করতে হবে।
৭. শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তি ভিত্তিতে বাস দেওয়ার বদলে টিকিট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. গাড়ি চালকের কর্মঘণ্টা একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে দুজন চালক ও দুজন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. যাত্রী-পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
১১. মাদকাসক্ত নিরসনে গোটা সমাজে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই দাবিগুলো নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে এ দাবিগুলো উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই কিছু হয়নি।
এবারও শুধু আশ্বাস মিলেছে
নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর বেগবান হওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ নভেম্বর আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেন ডিএসসিসি মেয়র ফজলে নূর তাপস। তিনি নাঈমের মৃত্যু যেখানে হয়েছে, সেখানে ‘শহীদ নাঈম’ নামে একটি ফুটওভার ব্রিজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। রামপুরায় নিহত মাইনুদ্দীন দুর্জয় নিহতের ঘটনাতেও উঠে আসে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের প্রসঙ্গ। আর সড়কে নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত অন্য বিষয়গুলো একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের দিক থেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে গতিরোধক ও ফুটওভার ব্রিজ তৈরির প্রতিশ্রুতিই এবারও একমাত্র সম্বল। তাও এ ক্ষেত্রে শুধু রাজধানীর দিকেই মনোযোগ পেয়েছে। অথচ দেশের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। নভেম্বর পর্যন্ত সড়কে ৫ হাজার ১৪৪ মৃত্যুর পরিসংখ্যানই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই এত মৃত্যু নিয়ে কিন্তু আলোড়ন হয়নি। হয়েছে রাজধানীর দুটি ঘটনায়। যেন মৃত্যুও প্রতিবাদেরও আছে শ্রেণিবিচার।
গণপরিবহনের বেপরোয়া গতি অটুট
এত এত আন্দোলন, তোলপাড় সত্ত্বেও বিশেষত গণপরিবহনের বেপরোয়া গতি নিয়ে কারও যেন কিছু বলার নেই। হ্যাঁ, হাফ পাস আন্দোলনকে সফল বলা যাবে কিছুটা। কিছুটা এই কারণে যে, প্রথমে রাজধানীর শিক্ষার্থীরা পেলেও পরে আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়ায় গণপরিবহনে চলাচলের অধিকার আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আসা নিরাপদ সড়কের দাবিগুলো যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এবারের আন্দোলনেও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা প্রমাণ করেছে, ২০১৮ সালের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া আইন বা যাবতীয় প্রতিশ্রুতি আদতে ফাঁকা বুলি। এগুলো শুধু তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলনকারীদের শান্ত করতেই দেওয়া হয়। না হলে নভেম্বরের আন্দোলনের পর ডিসেম্বরে অন্তত সড়কে দুর্ঘটনা কমত। কিন্তু শেষ মাসেও যেভাবে দুর্ঘটনায় নিহতের খবর এসেছে, তাতে তেমন লক্ষণ অন্তত দেখা যায়নি। ফলে ফুটওভার ব্রিজের প্রতিশ্রুতিকেই এবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের একমাত্র প্রাপ্তি বলতে হবে। বাকি যা কিছু, তার জায়গা ওই দাবিনামাতেই।
আরও পড়ুন:
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বে অব বেঙ্গল সম্মেলন শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশের ৮০০ জন অতিথি। প্রথম দিন অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তা হিসেবে থাকবেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের
২ ঘণ্টা আগেকিছু অসাধু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার স্বত্ব প্রদান এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিচ্ছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
৪ ঘণ্টা আগেছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এর তিন দিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের ১০০ দিন পার হওয়া নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে বেলজিয়ামভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। মূল্যায়নে তারা বলেছে, অন্তর্বর্তী স
৪ ঘণ্টা আগেবিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর চাকরি নিশ্চিত করতে যাচাই-বাছাইয়ের সময় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য অনেকে নিজেই পুলিশকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় সেসব তথ্যই এখন তাঁদের জন্য ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গ
৫ ঘণ্টা আগে