আমার বই পড়ে গণ–অভ্যুত্থানের দিকনির্দেশনা পেয়েছে তরুণেরা: ফরহাদ মজহার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১: ৪৯

‘আমার লেখা বই “গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন” পড়ে ৫ আগস্টের মতো ঘটনার জন্য তরুণেরা দিকনির্দেশনা পেয়েছেন’, এমন দাবি করেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। 

আজ বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘গণ-অভ্যুত্থান–২৪: জন আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। দ্য ভয়েস অব টাইমস এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। 

ফরহাদ মজহার এমন মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) ছাত্র রেদোয়ানুর রহমান বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। রেদোয়ানুর রহমান প্রয়াত সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আহমেদ ছফার একটি লাইন উদ্ধৃত করে বলেন, ‘দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছিল, বুদ্ধিজীবীরা তা জানতেন না!’ 

এ আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক ওলীউল্লাহ নোমান, জামায়াত ইসলামীর পল্টন থানার আমির শাহীন আহমেদ খান, লেখক ও গবেষক সারোয়ার তুষার, সাংবাদিক নেতা শহীদুল ইসলাম প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন ভয়েস অব টাইমসের সম্পাদক মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম।

‘বুদ্ধিজীবীরা সমাজ বদলায়নি, বদলিয়েছে তরুণেরা’—এমন একটি বক্তব্যের জের টেনে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এমন একজন তরুণ বলেছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বুদ্ধিজীবিতা ছাড়া কোনো বড় ঘটনা বা বাংলাদেশকে গঠন করতে পারব না।’ 

তিনি সেই তরুণকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সে আর একটা কথা বলেছে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থান হচ্ছে—এটা জানত না। এটা ভুল কথা। ২০২৩ সালে আমাদের একটা বই বের হয়েছিল। আমাদের যৌথ প্রযোজনা। বইটির নাম গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট এটা প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটা অংশ সেই বই দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সেই বই তারা পড়েছে। সেই বই থেকে তারা দিকনির্দেশনা পেয়েছে।’ 

রাষ্ট্রচিন্তা প্রকাশনী থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ‘গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন: বাংলাদেশের গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে’ প্রকাশিত হয়। 

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘২০২৩ সালের ৫ আগস্ট বইটি বের হয়েছে। আর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই তরুণেরা যেভাবে বলছে, সেটা ঠিক না। বারুদ কিন্তু জমা ছিল, কিন্তু ম্যাচের কাঠি জ্বালানোর লোক ছিল না। তরুণেরা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়েছে। ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে তরুণেরা যেহেতু বুদ্ধিজীবিতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নাই, তাই তারা বিজয়ের ফসল তুলে দিয়েছেন ওই চুপ্পুর (রাষ্ট্রপতি) হাতে। এটা বুঝতে হবে। তরুণেরা কাজটা শুরু করেছে, জনগণ সাড়া দিয়েছে। আজ এই বিজয়টা চলে গেল তাদের হাতে, যারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন।’ 

জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘গণ-অভ্যুত্থান–২৪: জন আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা। ছবি: আজকের পত্রিকাপ্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ‘নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নাই। গণতন্ত্র হলো রাষ্ট্রের একটা ধরন। বাড়িটা হলো রাষ্ট্র আর বাড়িটা কে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা হচ্ছে নির্বাচন। বাড়ির ঠিক নাই, সেখানে কী নির্বাচন করবেন? এই জন্য বারবার বলা হচ্ছে গঠনের কথা।’ 

সরকারের প্রতি ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই সরকারকে এই বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে। না হলে মারাত্মক ভুল হবে। তরুণদের বুদ্ধিজীবীদের নেতিবাচক হিসেবে মনে করলে হবে না। এটার চর্চা না থাকলে সেই রাষ্ট্রে হাজার হাতুড়ি পিটিয়ে গণতন্ত্র আনতে পারবেন না।’ 

তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানকে কখনো পুরোনো সংবিধানে ঢোকানো যায় না। আর এটার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’ 

উপদেষ্টার সরকার নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘জনগণের অভিপ্রায় হচ্ছে গণতন্ত্র। জনগণের অভিপ্রায় বিসর্জন দিয়ে এখন একটা উপদেষ্টা সরকার বানানো হয়েছে। তাদের ভাষায় এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রশাসনের সব স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এই সরকারের সেটা হচ্ছে না। তারা কিন্তু কাউকে বলে নাই। জনগণের পক্ষে কনক সারোয়ার, পিনাকী কথা বলেছে। কিন্তু এই সরকার কি তাদের কিছু বলেছে, যাদের আন্দোলন ও প্রোপাগান্ডার ফলে হয়েছে?’

সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। আমরা চেয়েছিলাম পুলিশ সংস্কার করা। তা হয়নি। পুলিশ না আসলে তাদের পলাতক ঘোষণা করা। আগে পুলিশ মাসে লাখ টাকা কামাত। তারা তো এই দুই–চার টাকার জন্য ফিরে আসবে না। আগে থেকেই এটা ভাবা উচিত না। তরুণেরা ভেবেছিল বিপ্লব ডিনার পার্টি, এটা ডিনার পার্টি না।’ 

বিচারব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা (বিচার বিভাগ) ইকোনমিক ইস্যুতে, প্রশাসনিক এবং আইনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। এরশাদ সাহেব আদালতকে একবার ডিসেন্ট্রালাইজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এটা আদতে হয়নি, যেটা নিয়ে আমরা আজ পর্যন্ত কাজ করতে পারিনি। আদালতকে জনগণের কাছে থামতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কথাটা বলা সহজ। এক–এগারোর সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার কথা বলে নির্বাহী শাসনব্যবস্থা নিয়ে এসেছিল। মানবিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা আমরা মুখে বলি, কিন্তু কার্যত এর ব্যবস্থা আমরা করতে পারি না। আমরা কারও কথা শুনি না, অন্যের কথায় নাচানাচি করি। এটা কি আমাদের স্বভাব নাকি জ্ঞানের অভাব! এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনেক সচেতন হতে হবে এবং সহনশীল ভাবে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’ 

ছাত্ররা একটি নাগরিক কমিটি করেছে, কিন্তু প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল সেটিকে সন্দেহের চোখে দেখছে উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘কারণ, তারা বলছে, তোমরা নাগরিক কমিটি করো, কিন্তু এই সরকারের ক্ষমতা নিয়ে আরেকটি কিংস পার্টি হইও না। এখন যেটা দরকার সেটি হলো বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। চিন্তার পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠন করা। যে ভিত্তিটা কারও পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হবে না এবং সেই ভিত্তি তৈরি হলে কোনো দেশের পক্ষে নতুন বাংলাদেশ তৈরি হতে কোনো বাধা থাকবে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত