ফাতিমা জাহান
মুক্তেশ্বর নামটা আমার কী যে ভালো লেগেছে! মনে হয় মুক্তাদের ঈশ্বর। সমুদ্রের সব মুক্তা জড়ো করে রাজ্যপাট বসিয়েছে এক রাজাধিরাজ। কোন মুক্তা কার কণ্ঠহার হবে বা কার কানে ঝুমকো হয়ে দুলবে তা এখনই ঠিক হয়ে যাবে। সাগরের গভীরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ভাবতে থাকে খোলসের বাইরেও এক জীবন আছে, চলে যাবে কারও সৌন্দর্যের মাঝে সাঁতরাতে তখন।
ক্র্যা ক্র্যা ক্র্যা শব্দে সংবিৎ ফিরে পেলাম। শব্দটা ছিল টিয়া পাখির ডাকের। আর আমি বসে আছি মুক্তেশ্বর মন্দিরের চাতালে। নামটা শুনে এতই মোহিত হয়ে গিয়েছি যে মন্দিরের সামনে বসে কল্পনার রাজ্যে চলে গিয়েছিলাম। মনে হলো, সাগরের দু-এক ফোঁটা জলও গায়ে ঝাপটা দিয়ে গেল। আসলে এখন টিপটিপ মুক্তার মতো বৃষ্টি পড়ছে ভারতের ভুবনেশ্বর শহরে। তাই সাগর, মুক্তা, মন্দির সব তালগোল পাকিয়ে এক করে ফেলেছি।
ভুবনেশ্বরকে বলা হয় মন্দিরের শহর। হাজার, বারো শ বছরের পুরোনো মন্দির এখানে বিরাজ করছে। মুক্তেশ্বর মূলত শিব ঠাকুরের মন্দির। এত সুন্দর যার নাম, সে দেখতে তবে কেমন? ধরণির বুকে যে এত সুন্দর কারুকার্যময় মন্দির থাকতে পারে তা ভুবনেশ্বরে না এলে অজানা থাকত ষোলো আনা।
মূল মন্দির কেমন আমি এখনো দেখিনি। নাম শুনে আর বৃষ্টি পড়ছে দেখে প্রবেশপথেই বসে পড়েছি। প্রবেশদ্বার বলে কিছু নেই, আছে এক আশ্চর্য তোরণ, পুরোটা কারুকাজ করা। কোথাও ফুলের তোড়া, কোথাও মুক্তার মালা, ময়ূর, কোথাও বা আধশোয়া অবস্থায় অপ্সরীরা আভরণে, বিনা আবরণে নিজেদের আরও সুন্দর করে তুলছে। এত সুন্দর তোরণের কারুকাজ আগে দেখিনি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পোড়ামাটির শিল্পকর্ম, আসলে বেলেপাথরের ওপর খোদাই করা।
তোরণের পর মূল মন্দির। আনুমানিক দশম শতকের মধ্যভাগে নির্মিত এই মন্দিরটিকে কলিঙ্গ শিল্পকর্মের পথনির্দেশক হিসেবে ধরা হয়। মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে একবার মন্দির প্রদক্ষিণ করার ইচ্ছে হলো। মন্দিরের অঙ্গে অঙ্গে মাধুরী। এত সালংকারা, এত রাজকীয়, এত ঐশ্বর্যে ভরপুর যে দেখলে সারাক্ষণ তাদের উপস্থিতিতে বিভোর হয়ে থাকতে হয়। যেমন ভিন্ন ভিন্ন ফুল, নকশা, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন অবতারে দেবীরা কখনো নৃত্যগীতে ব্যস্ত। কোথাও স্বয়ং শিব ঠাকুর মন্দিরের বহিরঙ্গের ভূষণ, কোথাও মহাভারতের একটা ক্ষণ খোদাই করা দেয়ালে। এই খোদাই এতই সূক্ষ্ম যে খুব কাছে থেকে না দেখলে এর মোহনীয়তা, এর বিবৃতি বোঝা দায়। এই কারুকার্যের মাঝে কখনো ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অসামান্য সুন্দরী নারী যোদ্ধা, কখনো সজ্জাকরণে ব্যস্ত দেবী, কখনো বা হাতির বহরের সারি সারি পথ চলা। এক ধাপ ফুল লতাপাতার নকশা, আরেক ধাপ মহাভারতের কাহিনি দেয়ালে খোদাই করা। এমন ছোট আকারের মন্দিরে যে এত মণিমুক্তা লুকিয়ে আছে, কে জানত!
মুক্তেশ্বর শব্দের অর্থ স্বাধীনতার দেবতা। এমন স্বাধীন শিল্পকর্ম দুহাত ভরে আসলেই কোনো মন্দিরকে বোধ হয় দেওয়া হয়নি। মূল মন্দিরের আগে ছোট একটি মন্দির, আকারে আমাদের দেশের কুঁড়েঘরের মতো। এই মন্দিরকে বলা হয় জগমোহন। যেন জগৎকে মোহন রূপ দেওয়াই তার একমাত্র কাজ। বসনে, ভূষণে রাজকীয় ভাব, অঙ্গে তার নান্দনিক কারুকাজ, ভেতরে শিবলিঙ্গ। পরবর্তী মন্দিরটি মূল মন্দির, নাম ভিমানা বা বিমান। ভেতরে গর্ভগৃহ। মূল মন্দিরটি দেখতে আমাদের ঢাকেশ্বরী মন্দির বা কলকাতার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মতো—পুরো শরীরে তার অনবদ্য কারুকাজ। ভেতরের ছাদের মাঝখানে চাঁদ হয়ে আছে ফুলেল নকশা, চারপাশে তার আরও ফুল, এদের ঘিরে রয়েছে নৃত্যরত অপ্সরী। এখানে বিভোর থাকতে হয়।
পূজারি ধুতি পরে গামছা গায়ে পূজার আয়োজন করছেন। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাংলার কোনো এক মন্দিরে পূজা আড়ম্বরে চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব অজানা রাজ্যে ঘুরে বাইরে এসে দেখি রোদেরা মন্দিরের গায়ে খেলা করছে, জৌলুশ বাড়াচ্ছে। মুক্তেশ্বরের পাশে এক টুকরো পুকুর। ঠিকঠাক মানিয়ে গেছে মন্দিরের পাশে। যেন মন চাইলেই মুক্তোরা পুকুরের জল থেকে বেরিয়ে মন্দিরের অঙ্গে জুড়ে যেতে পারে।
মুক্তেশ্বর থেকে বের হয়ে আমি ট্যাক্সি নিয়ে চললাম ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে পুরোনো পরশুরামেশ্বর মন্দিরের দিকে। এই মন্দিরের নির্মাণকাল অষ্টম শতকের দিকে। দূর থেকে দেখে মুক্তেশ্বর মন্দিরের আদলেই গড়া বলে মনে হলো। আসলে ভুবনেশ্বরের সব মন্দিরেই কলিঙ্গ স্থাপত্যশিল্প অনুসরণ করা হয়েছে। বেলেপাথরে তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতির ভগবান বিষ্ণুর এ মন্দিরটি বাইরে থেকে খুবই সাধারণ বলে মনে হলো। চারচালা কুঁড়েঘর আকারের জগমোহনের কাছে গিয়ে বিস্ময় আমার কাটে না! মন্দিরের অঙ্গে অঙ্গে তরঙ্গের মতো সূক্ষ্ম খোদাইয়ের কাজ। মুক্তেশ্বর মন্দিরের চেয়েও সূক্ষ্ম সেই অলংকরণ! জগমোহনের ওপরের দিকের কারুকাজ এতই নিখুঁত, ভরাট আর সূক্ষ্ম যে নিচ থেকে খালি চোখে এর মাধুর্য দেখে বোঝা যায় না। বহিরঙ্গের কোথাও কোনো জায়গা খালি নেই। কোথাও হাতি-ঘোড়া নিয়ে রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা, কোথাও ফুল-লতাপাতার মাঝে শৃঙ্গারে ব্যস্ত দেবী, কোথাও নাগ-নাগিণীর দেবতা; গঙ্গা, যমুনা, পার্বতীর রূপে দেবী দুর্গা, কোথাও দশভুজা দুর্গাপ্রতিমা যেন এই উৎসবের মৌসুমে নেমে আসছেন ধরণিতে। বাংলার মতো ওডিশারও প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা।
দেয়ালের কোথাও ভগবান বিষ্ণুর অবতারে স্বয়ং শিব ঠাকুর। এত রূপ, এত সাধারণ মন্দিরের মাঝে লুকিয়ে থাকা রত্নভান্ডার এই মন্দিরকে অনন্যসাধারণ করেছে। মন্দিরের অন্দরমহল খুব সাধারণ, ওডিশার মানুষের মন-মানসিকতার মতো। দেয়াল ও ছাদ সাধারণ। শিবলিঙ্গের পুজো হয় সকাল-বিকেল। মন্দিরের ভেতরে খালি গায়ে ধুতি পরে নবীন পূজারি ফুলের সাজি থেকে ফুল নিয়ে মালা গাঁথছেন। চারদিক শান্ত, নির্জন। কোনো ভক্ত বা দর্শনার্থী আপাতত নেই।
ভিমানা বা বিমান স্থাপনাটির অঙ্গেও নানান কারুকাজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে দিন পার হয়ে যাবে। এমন আভরণের মাঝে বসে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। দূর থেকে দেখে সাধারণ মন্দির বলে ভ্রম হলেও এ রকম ঐশ্বর্য ও মাধুর্যমণ্ডিত মন্দির আমি ভারতের অন্য শহরে আর দেখিনি। সাধারণ এবং অসাধারণের মিশেলে এই মন্দির হয়ে উঠেছে এক দেব-দেবী নগর।
স্বর্গ দেখার আনন্দ নিয়ে মন্দির থেকে বের হয়ে আমার ভেতরকার মনুষ্য ঈপ্সা মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠল—ক্ষুধা পেয়েছে। ওডিশায় আছি আর এখানকার বিখ্যাত পোখলা খাব না, তা কী করে হয়। ট্যাক্সি ভাড়া করেছি সারা দিনের জন্য। ট্যাক্সি ছুটল রেস্তোরাঁয়।
পোখলা বা পখলা পরিবেশন করা হয় সাধারণত কাঁসার বড় বাটিতে। ভাতের সঙ্গে সামান্য জল আর অনেকটা টক দই মিশিয়ে তৈরি হয় পখলা। আমি এই দই-ভাত খুব আনন্দ নিয়ে খাই। দক্ষিণ ভারতে বসবাস করি, টক দই সেখানকার খাবারের প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য উপকরণ। টক দই দিয়ে ঠান্ডা ভাত গরমকালে শরীরের জন্য উপকারী। পখলার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় আলুভাজা, বেগুনভাজা, টমেটোর চাটনি, শাক, পাঁপড় ও সালাদ। ওডিশার আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। তাই এই শরৎকালের গরমে পখলার চেয়ে উপাদেয় খাবার আর নেই। শেষ পাতে পায়েস। একটি পরিপূর্ণ তৃপ্তিদায়ক মধ্যাহ্নভোজ। ওডিশার অন্যান্য খাবার বা তরকারির স্বাদ আমাদের মতোই। তবে তরকারিতে ঝাল কম দেওয়া হয়। পিঠা, পায়েস বা অন্যান্য মিষ্টান্নের স্বাদ একই। পেটপূজা শেষ করে আমি এগোলাম পরবর্তী মন্দিরে পূজা দেখার জন্য। তার নাম লিঙ্গরাজ মন্দির। ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির এটি।
মন্দিরের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্দিরে প্রবেশের শর্তাবলি পড়ছিলাম। প্রথমত, ছবি তোলা যাবে না ভেতরে। যাহ, এত শখ করে এত দূর থেকে এলাম আর ছবিই তোলা যাবে না! দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত পড়ার আগেই পূজারিগোছের একজন আমায় টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। স্কুল কামাই করা শিশুকে যেমন মাস্টারমশাই কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যান, তেমন আরকি। ভেতরের মন্দিরগুলো বিশাল আকারের এবং অসংখ্য। মন্দির প্রাঙ্গণটিও বেশ বড় কিন্তু এসব আমাকে সেই পূজারি দেখার সময় দিল না। টেনে টেনে এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে নিয়ে গেল দর্শন করাতে। পথিমধ্যে অবশ্য পড়া ফাঁকি দেওয়া দুষ্টু ছাত্রের মতো আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরগুলো দেখে নিচ্ছিলাম। এত পূজনীয়, এত উল্লেখযোগ্য মন্দিরের বহিরঙ্গের দেয়াল থেকে অনেকখানি কারুকাজের খোদাই খসে পড়েছে। সংস্কারের অভাবে মন্দিরের গায়ে জমেছে শেওলা। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পর লিঙ্গরাজ মন্দির ওডিশায় প্রভাবশালী। এগারো শতকে নির্মিত এ মন্দির প্রাঙ্গণে মোট মন্দিরের সংখ্যা ১০৮টি। জগমোহন এবং বিমান ভবন দেখে চিনতে পারলাম, আগের মন্দিরগুলোতে দেখেছি। বাকি উল্লেখযোগ্য ভবন হলো নাটমন্দির ও ভোগমণ্ডপ। বিমান হলো মূল মন্দির, যা এই মন্দির প্রাঙ্গণের সবচেয়ে উঁচু। দেখতে আমাদের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আকারের। বাকি ছোট ছোট মন্দিরও বিমান মন্দির আকারের।
ভোগমণ্ডপ হলো উৎসর্গ মিলনায়তন, যেখানে বিভিন্ন নৈবেদ্য নিয়ে ভক্তরা পূজা দেন। একসময় লিঙ্গরাজ মন্দিরে দেবদাসীরা সেবা দিত। নেচে-গেয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল নাটমন্দির। জগমোহন হলো সাধারণ মিলনায়তন এবং বিমান মূল মন্দির। এই ভবনগুলো ক্রমান্বয়ে নিচু থেকে উঁচু এবং পর পর অবস্থিত। আবারও পূজারি আমাকে একটি ভবনও ঠিকমতো দেখতে না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল সোজা ভোগমন্দিরে। যেন বিশাল অপরাধ করেছি এবং এক্ষুনি আমাকে সাজা দেওয়া হবে।
আমাকে একদল পূজারির সামনে দাঁড় করিয়ে নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম বলতে বলা হলো। আমি একে একে বললাম। পূজারিরা পূজার জন্য রাখা জ্বলন্ত আগুনে কাঠের গুঁড়া, ধূপের গুঁড়া ছুড়ে ফেলতে ফেলতে মন্ত্র পড়তে লাগল, সঙ্গে আমাকেও মন্ত্র পড়তে বলল। চারদিকে আগুন আর ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ায় মন্দিরের ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না পূজারিদের সাদা চকচকে ধুতি ছাড়া। আমি ভাবছি, মন্দিরের দুয়ার থেকে এখান পর্যন্ত যাত্রা ঠিক ছিল। এ কোন ধরনের শাস্তি রে বাবা! আমি তো জানিও না কী অপরাধ করলাম। ধর্মকর্মে আমার কোনোকালেই মন ছিল না। সৈয়দ মুজতবা আলীকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে তিনি টিকি, খড়ম, ধুতি পরে ঢুকেছিলেন। আমি তো এখানে ঢুকে এখন দেখছি এরা খড়ম, ধুতি পরিয়ে পূজারি বানিয়ে বসিয়ে দেবে।
কিছুক্ষণ পর পুজো শেষ হলো। ততক্ষণে আমার কপাল পূজারি দ্বারা ক্রমাগত আবিরের ফোঁটায় লাল হয়ে গেছে। কপাল কি এভাবে খোলে নাকি! পূজা তো আমিও বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বা মন্দিরে বহু বার দিয়েছি। একবারও কপাল নামক বস্তুটি খোলেনি। সেই পান্ডা বা পূজারি এখন আমায় বলল, পূজা শেষ, পয়সা বের কর। আমার তো আক্কেল গুড়ুম। কোথায় আমি নিশ্চিন্তে স্থাপত্যকলা দেখে আনন্দে বাড়ি ফিরব বা ফ্রিতে পূজা দিয়ে কপাল ফেরাব, তা না, আমাকে জোর করে ধরে ধরে মন্দিরে মন্দিরে গরুর মতো চড়িয়েছে। আমিও দমবার পাত্র নই। আরও চড়া গলায় বললাম, ‘আমি তো বলিনি যে পুজো দেব, তুমি আমাকে জোর করে কিছু বুঝবার আগেই ধরেবেঁধে পূজা করতে বসিয়েছ। আর ইনস্ট্যান্ট তো ভাগ্যও খুলল না। তুমি মামদোবাজি পেয়েছ! পয়সা তুমি দেবে।’ বলে আমি হনহন করে বেরিয়ে গেলাম পেছনে না ফিরে। পেছন থেকে পূজারিরা আমায় শাপশাপান্ত করছে নিশ্চয়ই।
বাইরে আমার সামনে এখন বিমান দাঁড়িয়ে, প্রবেশদ্বারের ওপর সিংহের মূর্তি। মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে পাথর দিয়ে, বেশির ভাগই এক প্রস্তর, গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপ কাটা। বহিরঙ্গে শিব ঠাকুর আর পার্বতীর বিভিন্ন অবতার খোদাই করা। কিছু অবিকৃত আছে, কিছু ক্ষয় হয়ে গেছে। তবে আগে দেখা দুই মন্দিরের মতো এত ঘন শিল্পকর্ম খোদাই করা নেই, মন্দিরের খাঁজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প খোদাই চোখে পড়ে। অন্যান্য মন্দিরও একইভাবে অলংকৃত। ভুবনেশ্বরের অন্য মন্দিরগুলোতে যেমন কোনো ভক্ত বা দর্শনার্থী দেখিনি, এখানে এই শিব ঠাকুরের মন্দিরে বেশ কিছু ভক্তের দেখা মিলল। এই প্রাঙ্গণের বেশির ভাগ মন্দিরে শিব ঠাকুরের পূজা হয়, অল্প কয়েকটায় দেবী দুর্গা বা পার্বতীর পূজা হয়।
আমি আরও কিছুক্ষণ আঙিনায় ঘুরে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতে বেরোতে সেই পান্ডাকে আবার দেখলাম। বলতে চাচ্ছিলাম, ধরেবেঁধে কখনো ভক্তি আনয়ন করা যায় না হে বৎস। থাক, নাই-বা বলি। নিশ্চয়ই নতুন খদ্দের ধরার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি উদাস চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
মূলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে মনে হলো, মন্দিরে প্রবেশের শর্তাবলি তো পড়া হয়নি। সেসব পড়ার আগে দেখি দ্বারের ডানপাশে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘এই মন্দিরে যারা হিন্দু নয়, তাদের প্রবেশ নিষেধ।’
মুক্তেশ্বর নামটা আমার কী যে ভালো লেগেছে! মনে হয় মুক্তাদের ঈশ্বর। সমুদ্রের সব মুক্তা জড়ো করে রাজ্যপাট বসিয়েছে এক রাজাধিরাজ। কোন মুক্তা কার কণ্ঠহার হবে বা কার কানে ঝুমকো হয়ে দুলবে তা এখনই ঠিক হয়ে যাবে। সাগরের গভীরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ভাবতে থাকে খোলসের বাইরেও এক জীবন আছে, চলে যাবে কারও সৌন্দর্যের মাঝে সাঁতরাতে তখন।
ক্র্যা ক্র্যা ক্র্যা শব্দে সংবিৎ ফিরে পেলাম। শব্দটা ছিল টিয়া পাখির ডাকের। আর আমি বসে আছি মুক্তেশ্বর মন্দিরের চাতালে। নামটা শুনে এতই মোহিত হয়ে গিয়েছি যে মন্দিরের সামনে বসে কল্পনার রাজ্যে চলে গিয়েছিলাম। মনে হলো, সাগরের দু-এক ফোঁটা জলও গায়ে ঝাপটা দিয়ে গেল। আসলে এখন টিপটিপ মুক্তার মতো বৃষ্টি পড়ছে ভারতের ভুবনেশ্বর শহরে। তাই সাগর, মুক্তা, মন্দির সব তালগোল পাকিয়ে এক করে ফেলেছি।
ভুবনেশ্বরকে বলা হয় মন্দিরের শহর। হাজার, বারো শ বছরের পুরোনো মন্দির এখানে বিরাজ করছে। মুক্তেশ্বর মূলত শিব ঠাকুরের মন্দির। এত সুন্দর যার নাম, সে দেখতে তবে কেমন? ধরণির বুকে যে এত সুন্দর কারুকার্যময় মন্দির থাকতে পারে তা ভুবনেশ্বরে না এলে অজানা থাকত ষোলো আনা।
মূল মন্দির কেমন আমি এখনো দেখিনি। নাম শুনে আর বৃষ্টি পড়ছে দেখে প্রবেশপথেই বসে পড়েছি। প্রবেশদ্বার বলে কিছু নেই, আছে এক আশ্চর্য তোরণ, পুরোটা কারুকাজ করা। কোথাও ফুলের তোড়া, কোথাও মুক্তার মালা, ময়ূর, কোথাও বা আধশোয়া অবস্থায় অপ্সরীরা আভরণে, বিনা আবরণে নিজেদের আরও সুন্দর করে তুলছে। এত সুন্দর তোরণের কারুকাজ আগে দেখিনি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পোড়ামাটির শিল্পকর্ম, আসলে বেলেপাথরের ওপর খোদাই করা।
তোরণের পর মূল মন্দির। আনুমানিক দশম শতকের মধ্যভাগে নির্মিত এই মন্দিরটিকে কলিঙ্গ শিল্পকর্মের পথনির্দেশক হিসেবে ধরা হয়। মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে একবার মন্দির প্রদক্ষিণ করার ইচ্ছে হলো। মন্দিরের অঙ্গে অঙ্গে মাধুরী। এত সালংকারা, এত রাজকীয়, এত ঐশ্বর্যে ভরপুর যে দেখলে সারাক্ষণ তাদের উপস্থিতিতে বিভোর হয়ে থাকতে হয়। যেমন ভিন্ন ভিন্ন ফুল, নকশা, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন অবতারে দেবীরা কখনো নৃত্যগীতে ব্যস্ত। কোথাও স্বয়ং শিব ঠাকুর মন্দিরের বহিরঙ্গের ভূষণ, কোথাও মহাভারতের একটা ক্ষণ খোদাই করা দেয়ালে। এই খোদাই এতই সূক্ষ্ম যে খুব কাছে থেকে না দেখলে এর মোহনীয়তা, এর বিবৃতি বোঝা দায়। এই কারুকার্যের মাঝে কখনো ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অসামান্য সুন্দরী নারী যোদ্ধা, কখনো সজ্জাকরণে ব্যস্ত দেবী, কখনো বা হাতির বহরের সারি সারি পথ চলা। এক ধাপ ফুল লতাপাতার নকশা, আরেক ধাপ মহাভারতের কাহিনি দেয়ালে খোদাই করা। এমন ছোট আকারের মন্দিরে যে এত মণিমুক্তা লুকিয়ে আছে, কে জানত!
মুক্তেশ্বর শব্দের অর্থ স্বাধীনতার দেবতা। এমন স্বাধীন শিল্পকর্ম দুহাত ভরে আসলেই কোনো মন্দিরকে বোধ হয় দেওয়া হয়নি। মূল মন্দিরের আগে ছোট একটি মন্দির, আকারে আমাদের দেশের কুঁড়েঘরের মতো। এই মন্দিরকে বলা হয় জগমোহন। যেন জগৎকে মোহন রূপ দেওয়াই তার একমাত্র কাজ। বসনে, ভূষণে রাজকীয় ভাব, অঙ্গে তার নান্দনিক কারুকাজ, ভেতরে শিবলিঙ্গ। পরবর্তী মন্দিরটি মূল মন্দির, নাম ভিমানা বা বিমান। ভেতরে গর্ভগৃহ। মূল মন্দিরটি দেখতে আমাদের ঢাকেশ্বরী মন্দির বা কলকাতার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মতো—পুরো শরীরে তার অনবদ্য কারুকাজ। ভেতরের ছাদের মাঝখানে চাঁদ হয়ে আছে ফুলেল নকশা, চারপাশে তার আরও ফুল, এদের ঘিরে রয়েছে নৃত্যরত অপ্সরী। এখানে বিভোর থাকতে হয়।
পূজারি ধুতি পরে গামছা গায়ে পূজার আয়োজন করছেন। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাংলার কোনো এক মন্দিরে পূজা আড়ম্বরে চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব অজানা রাজ্যে ঘুরে বাইরে এসে দেখি রোদেরা মন্দিরের গায়ে খেলা করছে, জৌলুশ বাড়াচ্ছে। মুক্তেশ্বরের পাশে এক টুকরো পুকুর। ঠিকঠাক মানিয়ে গেছে মন্দিরের পাশে। যেন মন চাইলেই মুক্তোরা পুকুরের জল থেকে বেরিয়ে মন্দিরের অঙ্গে জুড়ে যেতে পারে।
মুক্তেশ্বর থেকে বের হয়ে আমি ট্যাক্সি নিয়ে চললাম ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে পুরোনো পরশুরামেশ্বর মন্দিরের দিকে। এই মন্দিরের নির্মাণকাল অষ্টম শতকের দিকে। দূর থেকে দেখে মুক্তেশ্বর মন্দিরের আদলেই গড়া বলে মনে হলো। আসলে ভুবনেশ্বরের সব মন্দিরেই কলিঙ্গ স্থাপত্যশিল্প অনুসরণ করা হয়েছে। বেলেপাথরে তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতির ভগবান বিষ্ণুর এ মন্দিরটি বাইরে থেকে খুবই সাধারণ বলে মনে হলো। চারচালা কুঁড়েঘর আকারের জগমোহনের কাছে গিয়ে বিস্ময় আমার কাটে না! মন্দিরের অঙ্গে অঙ্গে তরঙ্গের মতো সূক্ষ্ম খোদাইয়ের কাজ। মুক্তেশ্বর মন্দিরের চেয়েও সূক্ষ্ম সেই অলংকরণ! জগমোহনের ওপরের দিকের কারুকাজ এতই নিখুঁত, ভরাট আর সূক্ষ্ম যে নিচ থেকে খালি চোখে এর মাধুর্য দেখে বোঝা যায় না। বহিরঙ্গের কোথাও কোনো জায়গা খালি নেই। কোথাও হাতি-ঘোড়া নিয়ে রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা, কোথাও ফুল-লতাপাতার মাঝে শৃঙ্গারে ব্যস্ত দেবী, কোথাও নাগ-নাগিণীর দেবতা; গঙ্গা, যমুনা, পার্বতীর রূপে দেবী দুর্গা, কোথাও দশভুজা দুর্গাপ্রতিমা যেন এই উৎসবের মৌসুমে নেমে আসছেন ধরণিতে। বাংলার মতো ওডিশারও প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা।
দেয়ালের কোথাও ভগবান বিষ্ণুর অবতারে স্বয়ং শিব ঠাকুর। এত রূপ, এত সাধারণ মন্দিরের মাঝে লুকিয়ে থাকা রত্নভান্ডার এই মন্দিরকে অনন্যসাধারণ করেছে। মন্দিরের অন্দরমহল খুব সাধারণ, ওডিশার মানুষের মন-মানসিকতার মতো। দেয়াল ও ছাদ সাধারণ। শিবলিঙ্গের পুজো হয় সকাল-বিকেল। মন্দিরের ভেতরে খালি গায়ে ধুতি পরে নবীন পূজারি ফুলের সাজি থেকে ফুল নিয়ে মালা গাঁথছেন। চারদিক শান্ত, নির্জন। কোনো ভক্ত বা দর্শনার্থী আপাতত নেই।
ভিমানা বা বিমান স্থাপনাটির অঙ্গেও নানান কারুকাজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে দিন পার হয়ে যাবে। এমন আভরণের মাঝে বসে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। দূর থেকে দেখে সাধারণ মন্দির বলে ভ্রম হলেও এ রকম ঐশ্বর্য ও মাধুর্যমণ্ডিত মন্দির আমি ভারতের অন্য শহরে আর দেখিনি। সাধারণ এবং অসাধারণের মিশেলে এই মন্দির হয়ে উঠেছে এক দেব-দেবী নগর।
স্বর্গ দেখার আনন্দ নিয়ে মন্দির থেকে বের হয়ে আমার ভেতরকার মনুষ্য ঈপ্সা মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠল—ক্ষুধা পেয়েছে। ওডিশায় আছি আর এখানকার বিখ্যাত পোখলা খাব না, তা কী করে হয়। ট্যাক্সি ভাড়া করেছি সারা দিনের জন্য। ট্যাক্সি ছুটল রেস্তোরাঁয়।
পোখলা বা পখলা পরিবেশন করা হয় সাধারণত কাঁসার বড় বাটিতে। ভাতের সঙ্গে সামান্য জল আর অনেকটা টক দই মিশিয়ে তৈরি হয় পখলা। আমি এই দই-ভাত খুব আনন্দ নিয়ে খাই। দক্ষিণ ভারতে বসবাস করি, টক দই সেখানকার খাবারের প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য উপকরণ। টক দই দিয়ে ঠান্ডা ভাত গরমকালে শরীরের জন্য উপকারী। পখলার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় আলুভাজা, বেগুনভাজা, টমেটোর চাটনি, শাক, পাঁপড় ও সালাদ। ওডিশার আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। তাই এই শরৎকালের গরমে পখলার চেয়ে উপাদেয় খাবার আর নেই। শেষ পাতে পায়েস। একটি পরিপূর্ণ তৃপ্তিদায়ক মধ্যাহ্নভোজ। ওডিশার অন্যান্য খাবার বা তরকারির স্বাদ আমাদের মতোই। তবে তরকারিতে ঝাল কম দেওয়া হয়। পিঠা, পায়েস বা অন্যান্য মিষ্টান্নের স্বাদ একই। পেটপূজা শেষ করে আমি এগোলাম পরবর্তী মন্দিরে পূজা দেখার জন্য। তার নাম লিঙ্গরাজ মন্দির। ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির এটি।
মন্দিরের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্দিরে প্রবেশের শর্তাবলি পড়ছিলাম। প্রথমত, ছবি তোলা যাবে না ভেতরে। যাহ, এত শখ করে এত দূর থেকে এলাম আর ছবিই তোলা যাবে না! দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত পড়ার আগেই পূজারিগোছের একজন আমায় টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। স্কুল কামাই করা শিশুকে যেমন মাস্টারমশাই কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যান, তেমন আরকি। ভেতরের মন্দিরগুলো বিশাল আকারের এবং অসংখ্য। মন্দির প্রাঙ্গণটিও বেশ বড় কিন্তু এসব আমাকে সেই পূজারি দেখার সময় দিল না। টেনে টেনে এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে নিয়ে গেল দর্শন করাতে। পথিমধ্যে অবশ্য পড়া ফাঁকি দেওয়া দুষ্টু ছাত্রের মতো আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরগুলো দেখে নিচ্ছিলাম। এত পূজনীয়, এত উল্লেখযোগ্য মন্দিরের বহিরঙ্গের দেয়াল থেকে অনেকখানি কারুকাজের খোদাই খসে পড়েছে। সংস্কারের অভাবে মন্দিরের গায়ে জমেছে শেওলা। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পর লিঙ্গরাজ মন্দির ওডিশায় প্রভাবশালী। এগারো শতকে নির্মিত এ মন্দির প্রাঙ্গণে মোট মন্দিরের সংখ্যা ১০৮টি। জগমোহন এবং বিমান ভবন দেখে চিনতে পারলাম, আগের মন্দিরগুলোতে দেখেছি। বাকি উল্লেখযোগ্য ভবন হলো নাটমন্দির ও ভোগমণ্ডপ। বিমান হলো মূল মন্দির, যা এই মন্দির প্রাঙ্গণের সবচেয়ে উঁচু। দেখতে আমাদের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আকারের। বাকি ছোট ছোট মন্দিরও বিমান মন্দির আকারের।
ভোগমণ্ডপ হলো উৎসর্গ মিলনায়তন, যেখানে বিভিন্ন নৈবেদ্য নিয়ে ভক্তরা পূজা দেন। একসময় লিঙ্গরাজ মন্দিরে দেবদাসীরা সেবা দিত। নেচে-গেয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল নাটমন্দির। জগমোহন হলো সাধারণ মিলনায়তন এবং বিমান মূল মন্দির। এই ভবনগুলো ক্রমান্বয়ে নিচু থেকে উঁচু এবং পর পর অবস্থিত। আবারও পূজারি আমাকে একটি ভবনও ঠিকমতো দেখতে না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল সোজা ভোগমন্দিরে। যেন বিশাল অপরাধ করেছি এবং এক্ষুনি আমাকে সাজা দেওয়া হবে।
আমাকে একদল পূজারির সামনে দাঁড় করিয়ে নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম বলতে বলা হলো। আমি একে একে বললাম। পূজারিরা পূজার জন্য রাখা জ্বলন্ত আগুনে কাঠের গুঁড়া, ধূপের গুঁড়া ছুড়ে ফেলতে ফেলতে মন্ত্র পড়তে লাগল, সঙ্গে আমাকেও মন্ত্র পড়তে বলল। চারদিকে আগুন আর ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ায় মন্দিরের ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না পূজারিদের সাদা চকচকে ধুতি ছাড়া। আমি ভাবছি, মন্দিরের দুয়ার থেকে এখান পর্যন্ত যাত্রা ঠিক ছিল। এ কোন ধরনের শাস্তি রে বাবা! আমি তো জানিও না কী অপরাধ করলাম। ধর্মকর্মে আমার কোনোকালেই মন ছিল না। সৈয়দ মুজতবা আলীকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে তিনি টিকি, খড়ম, ধুতি পরে ঢুকেছিলেন। আমি তো এখানে ঢুকে এখন দেখছি এরা খড়ম, ধুতি পরিয়ে পূজারি বানিয়ে বসিয়ে দেবে।
কিছুক্ষণ পর পুজো শেষ হলো। ততক্ষণে আমার কপাল পূজারি দ্বারা ক্রমাগত আবিরের ফোঁটায় লাল হয়ে গেছে। কপাল কি এভাবে খোলে নাকি! পূজা তো আমিও বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বা মন্দিরে বহু বার দিয়েছি। একবারও কপাল নামক বস্তুটি খোলেনি। সেই পান্ডা বা পূজারি এখন আমায় বলল, পূজা শেষ, পয়সা বের কর। আমার তো আক্কেল গুড়ুম। কোথায় আমি নিশ্চিন্তে স্থাপত্যকলা দেখে আনন্দে বাড়ি ফিরব বা ফ্রিতে পূজা দিয়ে কপাল ফেরাব, তা না, আমাকে জোর করে ধরে ধরে মন্দিরে মন্দিরে গরুর মতো চড়িয়েছে। আমিও দমবার পাত্র নই। আরও চড়া গলায় বললাম, ‘আমি তো বলিনি যে পুজো দেব, তুমি আমাকে জোর করে কিছু বুঝবার আগেই ধরেবেঁধে পূজা করতে বসিয়েছ। আর ইনস্ট্যান্ট তো ভাগ্যও খুলল না। তুমি মামদোবাজি পেয়েছ! পয়সা তুমি দেবে।’ বলে আমি হনহন করে বেরিয়ে গেলাম পেছনে না ফিরে। পেছন থেকে পূজারিরা আমায় শাপশাপান্ত করছে নিশ্চয়ই।
বাইরে আমার সামনে এখন বিমান দাঁড়িয়ে, প্রবেশদ্বারের ওপর সিংহের মূর্তি। মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে পাথর দিয়ে, বেশির ভাগই এক প্রস্তর, গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপ কাটা। বহিরঙ্গে শিব ঠাকুর আর পার্বতীর বিভিন্ন অবতার খোদাই করা। কিছু অবিকৃত আছে, কিছু ক্ষয় হয়ে গেছে। তবে আগে দেখা দুই মন্দিরের মতো এত ঘন শিল্পকর্ম খোদাই করা নেই, মন্দিরের খাঁজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প খোদাই চোখে পড়ে। অন্যান্য মন্দিরও একইভাবে অলংকৃত। ভুবনেশ্বরের অন্য মন্দিরগুলোতে যেমন কোনো ভক্ত বা দর্শনার্থী দেখিনি, এখানে এই শিব ঠাকুরের মন্দিরে বেশ কিছু ভক্তের দেখা মিলল। এই প্রাঙ্গণের বেশির ভাগ মন্দিরে শিব ঠাকুরের পূজা হয়, অল্প কয়েকটায় দেবী দুর্গা বা পার্বতীর পূজা হয়।
আমি আরও কিছুক্ষণ আঙিনায় ঘুরে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতে বেরোতে সেই পান্ডাকে আবার দেখলাম। বলতে চাচ্ছিলাম, ধরেবেঁধে কখনো ভক্তি আনয়ন করা যায় না হে বৎস। থাক, নাই-বা বলি। নিশ্চয়ই নতুন খদ্দের ধরার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি উদাস চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
মূলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে মনে হলো, মন্দিরে প্রবেশের শর্তাবলি তো পড়া হয়নি। সেসব পড়ার আগে দেখি দ্বারের ডানপাশে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘এই মন্দিরে যারা হিন্দু নয়, তাদের প্রবেশ নিষেধ।’
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
৩ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
৩ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
৩ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
৩ দিন আগে