জাফর সাদেক
পূর্ব আফ্রিকার সাভানায় তাঁবুতে শুয়ে আছি। সারা দিনের গেম ড্রাইভ জার্নিতে কিছুটা ক্লান্ত। আশপাশে হঠাৎ শোরগোল শুরু হয়ে গেল। আমাদের ক্যাম্প সাইটের পাশে হায়েনার দল ঘুরঘুর করছে! ভয়ে হিম হওয়ার দশা। তাঁবুর চেইন পরখ করে ঝিম ধরে পড়ে রইলাম।
সেরেংগেটি রিজার্ভ ফরেস্টে সেদিন এমন আশ্চর্য রাত ছিল! ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের কল্যাণে আফ্রিকান সাভানা সম্পর্কে জেনেছিলাম।
আজ আমি সেই সাভানার শত শত মাইল ঘুরে এসে খোলা আকাশের নিচে পাতা তাঁবুতে শুয়ে আছি। আর তাঁবুর পাশে ঘুরছে হায়েনার দল! দূরে বাফেলোর দল বেঁধে আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। হাজার হাজার মাইলের তৃণভূমিতে কোথায় তাদের নিবাস, কে জানে।
ভোরবেলায় হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। প্রভাতের আলো ফোটার আগেই গেম ড্রাইভে বেরিয়ে যেতে হবে। আফ্রিকার বিগ ফাইভ মাংসাশী প্রাণীরা ভোরবেলায় শিকারে বের হয়। সিংহ, চিতা, গন্ডার, হাতি আর বাফেলো—এই পাঁচটি প্রাণীকে একত্রে বিগ ফাইভ বলে। আর এই বিগ ফাইভের বিচরণ, শিকার ও জীবনচক্র দেখার জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযাত্রীরা ছুটে এসেছেন সাভানায়।
আপাতদৃষ্টিকটু মনে হলেও এটাই দুনিয়ার অমোঘ নিয়ম। এখানে কোনো কোনো প্রাণী হিংস্র আর শিকার করেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। আছে শত শত প্রজাতির পশু। তৃণভোজী। ভোরবেলায় খাবারের সন্ধানে যখন তৃণভোজী প্রাণীরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসে, তখন সুযোগসন্ধানী হিংস্র প্রাণী, বিশেষ করে চিতা, বন্য কুকুর, হায়েনা ও সিংহের পাল তাদের আক্রমণ করে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। প্রকৃতির এ বৈচিত্র্যময় দৃশ্য দেখতে আমরা এই প্রান্তরে জড়ো হয়েছি।
ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িতে ছয়জনের দল নিয়ে তানজানিয়ার আরোশা শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে সেরেংগেটির দিকে রওনা হওয়ার আগে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। চলতি পথে আলাপ আর পরিচয়পর্ব শেষে আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য টারাঙ্গির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দিকে। টারাঙ্গির হলো তানজানিয়ার মানিয়ারা অঞ্চলের একটি সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান। এই বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে টারাঙ্গির নদী বয়ে চলেছে। এই অঞ্চলের মিষ্টি জলের প্রাথমিক উৎস এ নদী। শুষ্ক মৌসুমে হাজার হাজার ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রার পাল দূরদূরান্ত থেকে পিপাসা মেটাতে এই নদীতীরে ছুটে আসে।
টারাঙ্গিরের আয়তন আনুমানিক ২ হাজার ৮৫০ বর্গকিলোমিটার। এটি একটি গ্রানাটিক পর্বতমালা, নদী, উপত্যকা আর জলাভূমির সমন্বয়ে গঠিত। বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে রয়েছে নানা প্রজাতির ফণীমনসা, বাবলাসহ কাঁটাযুক্ত গুল্মজাতীয় গাছপালা, মৌসুমি প্লাবিত তৃণভূমি ও বাওবাবগাছের সারি। এখানে শত শত হাতি, জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট এবং বাফেলোর পালের পাশাপাশি দেখা মিলল ওয়াটারবাক, জিরাফ, ডিক ডিক, ইমপালা, উটপাখি, গ্রান্টস গাজেল, ভারভেট বানর, ব্যান্ডেড মঙ্গুজ, অলিভ বেবুনসহ নাম না জানা অসংখ্য পশুপাখি।
বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আফ্রিকার বিখ্যাত বাওবাবগাছের দেখা পেয়ে একটির ফোকরে গিয়ে ফটাফট ছবি তুলে নিলাম। এ গাছগুলো পাঁচ শ থেকে এক হাজার বছরের প্রাচীন। পাতাহীন গাছের ডালপালায় হাজার হাজার পাখির বাসা ও আশ্রয় দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেলে ফিরতি পথ ধরার সময় গাড়ির পথে ওয়াইল্ডবিস্ট, জেব্রা আর হাতি দল বেঁধে রাস্তা পারাপার হচ্ছে দেখে আমরা গাড়ি থামিয়ে অসংখ্য ছবি আর ভিডিও তুলে নিলাম। হাত বাড়ানো দূরত্বে উটপাখির দল গলা উঁচু করে আমাদের পরখ করছে। এত বন্য প্রাণীর বিচরণ দৃশ্য চোখের সামনে দেখার মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় সানবাইট ক্যাম্প সাইটে রাতের আশ্রয়ের জন্য ছুটে গেলাম।
পরদিন ছিল আরও বেশি রোমাঞ্চকর। সানবাইট ক্যাম্প সাইট থেকে সকালবেলা ড্রাইভার এসে আমাদের তুলে নিয়ে যায় সেরেংগেটির জাতীয় উদ্যানে। এটি বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। গ্রেট মাইগ্রেশন হিসেবে পরিচিত ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রাদের মহান স্থানান্তরের জায়গা এ সেরেংগেটি।
চিরায়ত আফ্রিকার এই সাভানায় বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ। এর পশ্চিম করিডরটি গ্রুমেটি নদী দিয়ে বিভক্ত, যেখানে বন ও ঘন ঝোপ রয়েছে। উত্তরে লোবো এলাকা কেনিয়ার মাসাইমারা রিজার্ভের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সেরেংগেটি থেকে মারে নদী পেরিয়ে কেনিয়ার মাসাইমারার দিকে লাখ লাখ ওয়াইল্ডবিস্ট, জেব্রা সারিবদ্ধভাবে চলতে থাকে। এই স্থানান্তর গ্রেট মাইগ্রেশন নামে পরিচিত। এই মাইগ্রেশন অনেক জটিল ও কঠিন বিষয়। ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রা পালের স্থানান্তর হওয়ার পথে ওত পেতে থাকে চিতা, হায়েনা আর সিংহের মতো হিংস্র প্রাণী। এ ছাড়া মারে নদীতে লুকিয়ে থাকে বিশাল কুমির। জলে কুমির, ডাঙায় হিংস্র প্রাণী। সেরেংগেটির তীব্র উত্তাপ ও শুষ্কতার ফলে খাবারের অভাবে তৃণভোজী প্রাণীদের এই কঠিন পথ বিচরণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। শুষ্ক মৌসুমে সেরেংগেটি থেকে মাসাইমারা আবার বর্ষা মৌসুমে বিপরীত পথে গ্রেট মাইগ্রেশন প্রকৃতির এক আশ্চর্য লীলাখেলা।
সেরেংগেটি যাওয়ার পথে দেখতে পাই মাসাই উপজাতির বসতি। মাসাই ভাষায় সেরেংগেটি অর্থ অন্তহীন সমভূমি। মাসাইরা যুগ যুগ ধরে বন্য পরিবেশে হিংস্র প্রাণীদের পাশাপাশি বাস করছে। শিকার, পশুপালন, কৃষিকাজ ও মধু আহরণের মাধ্যমে তাদের জীবন-জীবিকা চলে। তারা দুরন্ত সাহসী হিসেবে পরিচিত। বুনো পরিবেশে বিশেষভাবে তৈরি মাসাইদের আবাস। এদের বিচিত্র বর্ণের পোশাক, অলংকার যে কাউকেই আকৃষ্ট করে। দর্শনার্থীদের জন্য মাসাই গ্রামে গিয়ে তাঁদের সংস্কৃতি পরখ করার সুযোগ আছে। ফিরতি পথে দেখব বলে মাসাই গ্রাম পেরিয়ে ৩ ঘণ্টা যাত্রার পর ওল্ডুভাই গর্জ নামের একটি জাদুঘরের সামনে যাত্রাবিরতি। এখান থেকে সেরেংগেটি ন্যাশনাল পার্কে যেতে আরও ৪ ঘণ্টার মতো লাগে। ওল্ডুভাই গর্জ হলো পূর্ব সেরেংগেটি সমভূমিতে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যেখানে মানুষের বিচরণের অস্তিত্ব এবং পৃথিবীর প্রথম দিকের মানুষের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল। ওল্ডুভাই গর্জের জাদুঘরে তিন মিলিয়ন বছর আগে বিচরণকারী পৃথিবীর আদিম মানুষের ফসিল দেখে বিস্মিত হয়েছি। চারপাশের আশ্চর্যজনক ল্যান্ডস্কেপ আর আগ্নেয়গিরির প্রভাবে লাখ লাখ বছর আগে সৃষ্ট গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
হাজার হাজার মাইলের এই তৃণভূমিতে কোনো বসতি নেই। এখানে প্রচণ্ড উত্তাপে সব পুড়ে ছাই হয়ে আছে। আবার পাশেই আছে উঁচু তৃণভূমি। পর্যটকদের গাড়ি নির্দিষ্ট পথ ধরে চলে। খোলা প্রান্তর বলে যেখানে-সেখানে গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। চলতি পথে অলস ভঙ্গিতে সিংহকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একপাল হায়েনার দেখা। রাস্তার বিপরীত পাশে শত শত ইমপালা বিচরণ করছে। এ যেন এক নতুন পৃথিবী! তারপর গভীর সন্ধ্যায় সেরোনেরা ওয়াইল্ডলাইফ ক্যাম্পে যাত্রাবিরতি। এভাবেই সেরেংগেটিতে সকাল ও বিকেলে গেম ড্রাইভ চলছে সমানতালে।
তৃতীয় দিনের ভোরবেলার সূর্যোদয়ের দৃশ্য ছিল স্বর্গীয়। শত শত গাড়িতে পর্যটকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন প্রাইভেট বিমান, আবার কেউ চড়েছেন হট বেলুনে। এলাহি কাণ্ড চলছে সাভানাজুড়ে। একটা জায়গায় দেখলাম অর্ধডজন সিংহ অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, হট বেলুনের আওয়াজ—কোনো কিছুতেই তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। পাশ ফিরে দেখি, মায়ের সঙ্গে নয়টি সিংহশাবক হেঁটে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার শাটার কাউন্ট শুরু হয়ে গেল। এমন মধুর দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী না করে উপায় আছে! তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। তিন দিনের স্মৃতি নিয়ে এবার অন্য গন্তব্যের পানে যেতে হবে।
পঞ্চম দিনের গন্তব্য ছিল ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এনগরংগোরো। মাসাই লোকজন গবাদিপশুর গলায় বিশেষ ঘণ্টা বেঁধে রাখত। আর নিজেরাও বাহারি অলংকার পরত। চলার পথে গড়গড় শব্দ হতো বলেই এ জায়গার নাম হয়ে যায় এনগরংগোরো। এর অবস্থান উত্তর তানজানিয়ার ক্রেটার হাইল্যান্ডস ভূতাত্ত্বিক এলাকার মধ্যে। একটি বড় আগ্নেয়গিরি ক্যালডেরার কারণে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে এনগরংগোরো ক্রেটার। এটি বিশ্বের বৃহত্তম নিষ্ক্রিয়, অক্ষত এবং অপূর্ণ আগ্নেয়গিরি। ২ থেকে ৩ মিলিয়ন বছর আগে একটি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে জায়গাটি ধসে পড়ার ফলে সৃষ্টি হয় ২ হাজার ফুট গভীর গর্ত। এর মেঝের আয়তন ২৬০ বর্গকিলোমিটার। ক্রেটার রিম ২ হাজার ২০০ মিটার উঁচু হওয়ার এখানে জলবায়ু একদম আলাদা। এখানে রয়েছে তৃণভূমি, জলাভূমি, মুঙ্গে নদী, সোডিয়াম হ্রদ। এখানে খেলা করে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন ফ্ল্যামিঙ্গোসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। আরও দেখা যায় কালো গন্ডার, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়েনা, জলহস্তী, অ্যান্টিলোপ পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী।
পাঁচ কিলোমিটার নিচে নামার পর এনগরংগোরো ক্রেটারের প্রবেশমুখে কেপ বাফেলোর পাল দেখা গেল। এখানে তীব্র ঠান্ডা বিরাজমান থাকলেও বাইরের দৃশ্যের মুগ্ধতায় সবকিছু ভুলে গেছি। হাজার হাজার ওয়াইল্ডবিস্ট আর জেব্রা এক লাইন ধরে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। তাদের গন্তব্য কোথায়, কেউ জানে না। জলাভূমিতে নাম না জানা অনেক প্রজাতির পাখি দেখলাম। লেকের জলে হাজার হাজার ফ্ল্যামিঙ্গো, জলহস্তী পানিতে গা ডুবিয়ে রয়েছে। চার-পাঁচটি জলহস্তী পানির ওপরে উঠে এল। উঁচু গাছের পাতাহীন ডালে চিল আর শকুনজাতীয় পাখিদের দেখা পেলাম। বিস্ময়কর ছিল সিংহের বাফেলো শিকারের দৃশ্য। তিনটি সিংহ এসে চোখের সামনে একটি বাফেলোকে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলার দৃশ্য সহজে ভোলার নয়।
পূর্ব আফ্রিকার সাভানায় তাঁবুতে শুয়ে আছি। সারা দিনের গেম ড্রাইভ জার্নিতে কিছুটা ক্লান্ত। আশপাশে হঠাৎ শোরগোল শুরু হয়ে গেল। আমাদের ক্যাম্প সাইটের পাশে হায়েনার দল ঘুরঘুর করছে! ভয়ে হিম হওয়ার দশা। তাঁবুর চেইন পরখ করে ঝিম ধরে পড়ে রইলাম।
সেরেংগেটি রিজার্ভ ফরেস্টে সেদিন এমন আশ্চর্য রাত ছিল! ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের কল্যাণে আফ্রিকান সাভানা সম্পর্কে জেনেছিলাম।
আজ আমি সেই সাভানার শত শত মাইল ঘুরে এসে খোলা আকাশের নিচে পাতা তাঁবুতে শুয়ে আছি। আর তাঁবুর পাশে ঘুরছে হায়েনার দল! দূরে বাফেলোর দল বেঁধে আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। হাজার হাজার মাইলের তৃণভূমিতে কোথায় তাদের নিবাস, কে জানে।
ভোরবেলায় হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। প্রভাতের আলো ফোটার আগেই গেম ড্রাইভে বেরিয়ে যেতে হবে। আফ্রিকার বিগ ফাইভ মাংসাশী প্রাণীরা ভোরবেলায় শিকারে বের হয়। সিংহ, চিতা, গন্ডার, হাতি আর বাফেলো—এই পাঁচটি প্রাণীকে একত্রে বিগ ফাইভ বলে। আর এই বিগ ফাইভের বিচরণ, শিকার ও জীবনচক্র দেখার জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযাত্রীরা ছুটে এসেছেন সাভানায়।
আপাতদৃষ্টিকটু মনে হলেও এটাই দুনিয়ার অমোঘ নিয়ম। এখানে কোনো কোনো প্রাণী হিংস্র আর শিকার করেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। আছে শত শত প্রজাতির পশু। তৃণভোজী। ভোরবেলায় খাবারের সন্ধানে যখন তৃণভোজী প্রাণীরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসে, তখন সুযোগসন্ধানী হিংস্র প্রাণী, বিশেষ করে চিতা, বন্য কুকুর, হায়েনা ও সিংহের পাল তাদের আক্রমণ করে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। প্রকৃতির এ বৈচিত্র্যময় দৃশ্য দেখতে আমরা এই প্রান্তরে জড়ো হয়েছি।
ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িতে ছয়জনের দল নিয়ে তানজানিয়ার আরোশা শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে সেরেংগেটির দিকে রওনা হওয়ার আগে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। চলতি পথে আলাপ আর পরিচয়পর্ব শেষে আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য টারাঙ্গির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দিকে। টারাঙ্গির হলো তানজানিয়ার মানিয়ারা অঞ্চলের একটি সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান। এই বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে টারাঙ্গির নদী বয়ে চলেছে। এই অঞ্চলের মিষ্টি জলের প্রাথমিক উৎস এ নদী। শুষ্ক মৌসুমে হাজার হাজার ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রার পাল দূরদূরান্ত থেকে পিপাসা মেটাতে এই নদীতীরে ছুটে আসে।
টারাঙ্গিরের আয়তন আনুমানিক ২ হাজার ৮৫০ বর্গকিলোমিটার। এটি একটি গ্রানাটিক পর্বতমালা, নদী, উপত্যকা আর জলাভূমির সমন্বয়ে গঠিত। বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে রয়েছে নানা প্রজাতির ফণীমনসা, বাবলাসহ কাঁটাযুক্ত গুল্মজাতীয় গাছপালা, মৌসুমি প্লাবিত তৃণভূমি ও বাওবাবগাছের সারি। এখানে শত শত হাতি, জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট এবং বাফেলোর পালের পাশাপাশি দেখা মিলল ওয়াটারবাক, জিরাফ, ডিক ডিক, ইমপালা, উটপাখি, গ্রান্টস গাজেল, ভারভেট বানর, ব্যান্ডেড মঙ্গুজ, অলিভ বেবুনসহ নাম না জানা অসংখ্য পশুপাখি।
বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আফ্রিকার বিখ্যাত বাওবাবগাছের দেখা পেয়ে একটির ফোকরে গিয়ে ফটাফট ছবি তুলে নিলাম। এ গাছগুলো পাঁচ শ থেকে এক হাজার বছরের প্রাচীন। পাতাহীন গাছের ডালপালায় হাজার হাজার পাখির বাসা ও আশ্রয় দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেলে ফিরতি পথ ধরার সময় গাড়ির পথে ওয়াইল্ডবিস্ট, জেব্রা আর হাতি দল বেঁধে রাস্তা পারাপার হচ্ছে দেখে আমরা গাড়ি থামিয়ে অসংখ্য ছবি আর ভিডিও তুলে নিলাম। হাত বাড়ানো দূরত্বে উটপাখির দল গলা উঁচু করে আমাদের পরখ করছে। এত বন্য প্রাণীর বিচরণ দৃশ্য চোখের সামনে দেখার মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় সানবাইট ক্যাম্প সাইটে রাতের আশ্রয়ের জন্য ছুটে গেলাম।
পরদিন ছিল আরও বেশি রোমাঞ্চকর। সানবাইট ক্যাম্প সাইট থেকে সকালবেলা ড্রাইভার এসে আমাদের তুলে নিয়ে যায় সেরেংগেটির জাতীয় উদ্যানে। এটি বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। গ্রেট মাইগ্রেশন হিসেবে পরিচিত ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রাদের মহান স্থানান্তরের জায়গা এ সেরেংগেটি।
চিরায়ত আফ্রিকার এই সাভানায় বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ। এর পশ্চিম করিডরটি গ্রুমেটি নদী দিয়ে বিভক্ত, যেখানে বন ও ঘন ঝোপ রয়েছে। উত্তরে লোবো এলাকা কেনিয়ার মাসাইমারা রিজার্ভের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সেরেংগেটি থেকে মারে নদী পেরিয়ে কেনিয়ার মাসাইমারার দিকে লাখ লাখ ওয়াইল্ডবিস্ট, জেব্রা সারিবদ্ধভাবে চলতে থাকে। এই স্থানান্তর গ্রেট মাইগ্রেশন নামে পরিচিত। এই মাইগ্রেশন অনেক জটিল ও কঠিন বিষয়। ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রা পালের স্থানান্তর হওয়ার পথে ওত পেতে থাকে চিতা, হায়েনা আর সিংহের মতো হিংস্র প্রাণী। এ ছাড়া মারে নদীতে লুকিয়ে থাকে বিশাল কুমির। জলে কুমির, ডাঙায় হিংস্র প্রাণী। সেরেংগেটির তীব্র উত্তাপ ও শুষ্কতার ফলে খাবারের অভাবে তৃণভোজী প্রাণীদের এই কঠিন পথ বিচরণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। শুষ্ক মৌসুমে সেরেংগেটি থেকে মাসাইমারা আবার বর্ষা মৌসুমে বিপরীত পথে গ্রেট মাইগ্রেশন প্রকৃতির এক আশ্চর্য লীলাখেলা।
সেরেংগেটি যাওয়ার পথে দেখতে পাই মাসাই উপজাতির বসতি। মাসাই ভাষায় সেরেংগেটি অর্থ অন্তহীন সমভূমি। মাসাইরা যুগ যুগ ধরে বন্য পরিবেশে হিংস্র প্রাণীদের পাশাপাশি বাস করছে। শিকার, পশুপালন, কৃষিকাজ ও মধু আহরণের মাধ্যমে তাদের জীবন-জীবিকা চলে। তারা দুরন্ত সাহসী হিসেবে পরিচিত। বুনো পরিবেশে বিশেষভাবে তৈরি মাসাইদের আবাস। এদের বিচিত্র বর্ণের পোশাক, অলংকার যে কাউকেই আকৃষ্ট করে। দর্শনার্থীদের জন্য মাসাই গ্রামে গিয়ে তাঁদের সংস্কৃতি পরখ করার সুযোগ আছে। ফিরতি পথে দেখব বলে মাসাই গ্রাম পেরিয়ে ৩ ঘণ্টা যাত্রার পর ওল্ডুভাই গর্জ নামের একটি জাদুঘরের সামনে যাত্রাবিরতি। এখান থেকে সেরেংগেটি ন্যাশনাল পার্কে যেতে আরও ৪ ঘণ্টার মতো লাগে। ওল্ডুভাই গর্জ হলো পূর্ব সেরেংগেটি সমভূমিতে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যেখানে মানুষের বিচরণের অস্তিত্ব এবং পৃথিবীর প্রথম দিকের মানুষের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল। ওল্ডুভাই গর্জের জাদুঘরে তিন মিলিয়ন বছর আগে বিচরণকারী পৃথিবীর আদিম মানুষের ফসিল দেখে বিস্মিত হয়েছি। চারপাশের আশ্চর্যজনক ল্যান্ডস্কেপ আর আগ্নেয়গিরির প্রভাবে লাখ লাখ বছর আগে সৃষ্ট গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
হাজার হাজার মাইলের এই তৃণভূমিতে কোনো বসতি নেই। এখানে প্রচণ্ড উত্তাপে সব পুড়ে ছাই হয়ে আছে। আবার পাশেই আছে উঁচু তৃণভূমি। পর্যটকদের গাড়ি নির্দিষ্ট পথ ধরে চলে। খোলা প্রান্তর বলে যেখানে-সেখানে গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। চলতি পথে অলস ভঙ্গিতে সিংহকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একপাল হায়েনার দেখা। রাস্তার বিপরীত পাশে শত শত ইমপালা বিচরণ করছে। এ যেন এক নতুন পৃথিবী! তারপর গভীর সন্ধ্যায় সেরোনেরা ওয়াইল্ডলাইফ ক্যাম্পে যাত্রাবিরতি। এভাবেই সেরেংগেটিতে সকাল ও বিকেলে গেম ড্রাইভ চলছে সমানতালে।
তৃতীয় দিনের ভোরবেলার সূর্যোদয়ের দৃশ্য ছিল স্বর্গীয়। শত শত গাড়িতে পর্যটকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন প্রাইভেট বিমান, আবার কেউ চড়েছেন হট বেলুনে। এলাহি কাণ্ড চলছে সাভানাজুড়ে। একটা জায়গায় দেখলাম অর্ধডজন সিংহ অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, হট বেলুনের আওয়াজ—কোনো কিছুতেই তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। পাশ ফিরে দেখি, মায়ের সঙ্গে নয়টি সিংহশাবক হেঁটে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার শাটার কাউন্ট শুরু হয়ে গেল। এমন মধুর দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী না করে উপায় আছে! তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। তিন দিনের স্মৃতি নিয়ে এবার অন্য গন্তব্যের পানে যেতে হবে।
পঞ্চম দিনের গন্তব্য ছিল ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এনগরংগোরো। মাসাই লোকজন গবাদিপশুর গলায় বিশেষ ঘণ্টা বেঁধে রাখত। আর নিজেরাও বাহারি অলংকার পরত। চলার পথে গড়গড় শব্দ হতো বলেই এ জায়গার নাম হয়ে যায় এনগরংগোরো। এর অবস্থান উত্তর তানজানিয়ার ক্রেটার হাইল্যান্ডস ভূতাত্ত্বিক এলাকার মধ্যে। একটি বড় আগ্নেয়গিরি ক্যালডেরার কারণে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে এনগরংগোরো ক্রেটার। এটি বিশ্বের বৃহত্তম নিষ্ক্রিয়, অক্ষত এবং অপূর্ণ আগ্নেয়গিরি। ২ থেকে ৩ মিলিয়ন বছর আগে একটি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে জায়গাটি ধসে পড়ার ফলে সৃষ্টি হয় ২ হাজার ফুট গভীর গর্ত। এর মেঝের আয়তন ২৬০ বর্গকিলোমিটার। ক্রেটার রিম ২ হাজার ২০০ মিটার উঁচু হওয়ার এখানে জলবায়ু একদম আলাদা। এখানে রয়েছে তৃণভূমি, জলাভূমি, মুঙ্গে নদী, সোডিয়াম হ্রদ। এখানে খেলা করে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন ফ্ল্যামিঙ্গোসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। আরও দেখা যায় কালো গন্ডার, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়েনা, জলহস্তী, অ্যান্টিলোপ পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী।
পাঁচ কিলোমিটার নিচে নামার পর এনগরংগোরো ক্রেটারের প্রবেশমুখে কেপ বাফেলোর পাল দেখা গেল। এখানে তীব্র ঠান্ডা বিরাজমান থাকলেও বাইরের দৃশ্যের মুগ্ধতায় সবকিছু ভুলে গেছি। হাজার হাজার ওয়াইল্ডবিস্ট আর জেব্রা এক লাইন ধরে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। তাদের গন্তব্য কোথায়, কেউ জানে না। জলাভূমিতে নাম না জানা অনেক প্রজাতির পাখি দেখলাম। লেকের জলে হাজার হাজার ফ্ল্যামিঙ্গো, জলহস্তী পানিতে গা ডুবিয়ে রয়েছে। চার-পাঁচটি জলহস্তী পানির ওপরে উঠে এল। উঁচু গাছের পাতাহীন ডালে চিল আর শকুনজাতীয় পাখিদের দেখা পেলাম। বিস্ময়কর ছিল সিংহের বাফেলো শিকারের দৃশ্য। তিনটি সিংহ এসে চোখের সামনে একটি বাফেলোকে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলার দৃশ্য সহজে ভোলার নয়।
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
৩ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
৩ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
৩ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
৩ দিন আগে