সুদীপ্ত সালাম
রূপসা নদী থেকে কখন পশুর নদীতে উঠলাম, বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের লঞ্চটি একটি ঘোলা পানির উত্তাল নদীর মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটিই পশুর নদী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘পশোর’ নদী। এই নদীতে পড়ে সুন্দরবনের আভাস পাওয়া যায়। পাড়গুলোতে সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ জন্মেছে। পার্থক্য, এখানে অতটা ঘন নয় এবং একটু দূরেই গ্রাম ও ফসলি জমিগুলো স্পষ্ট।
‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ বইয়ে বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘সামনে বিস্তৃত পশোর নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতাল ঝোপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।’ আর আমার ধারণা ছিল পশুর শুধু নামেই নদী, আদতে একটি খাল। বিশালদেহী নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমি লজ্জাই পেলাম।
এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। পেশাগত কাজে আগে খুলনা ও বাগেরহাট আসা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এসেছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা পর্যন্ত। সুন্দরবনে এখনই হয়তো আসা হতো না যদি ‘ফেমাস ট্যুরস বিডি’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজির হোসেন রুবেল জোর আমন্ত্রণ না করতেন। যে লঞ্চের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘এমভি দ্য ভেসপার’। সকালে (১৪ জানুয়ারি, ২০২২) রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে ভেড়ানো ছিল। আমি ট্রেন থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখান থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। ঘাট থেকে একটি ট্রলার আমাকেসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে নিয়ে আসে লঞ্চটির কাছে। তিনতলা লঞ্চটির একদম নিচতলায় ইঞ্জিন, জেনারেটর ও রান্নাঘর। দ্বিতীয় তলায় অতিথিদের রুম এবং তৃতীয় তলায় হলরুম; এখানকার লোকজন বলে ‘লাউঞ্জ’। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমার রুমটি দ্বিতীয়তলার সামনের দিকে। সেখান থেকে বাইরের দৃশ্য দারুণ দেখায়। আমাদের দুই রাত, তিন দিনের সফর। এই কয়েকটা দিন এই লঞ্চে করেই জলে ভেসে বেড়াব আমরা।
লঞ্চের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ, নদী কাটার ঝিরঝির শব্দ ও হিমেল বাতাস, মনটা আনমনে করে দেয়। কী এক স্বর্গীয় ভালো লাগা ভর করে শরীরে। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় যত দূর চোখ যায়। কোথাও ইটপাথরের বড় বড় দালান নেই, যানজটের বালাই নেই, তীব্র হর্নের ডামাডোল নেই—নেই দম বন্ধ করা ধোঁয়া। বুঁদ হয়েছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। মন ভালো করা চলচ্চিত্রে হুট করেই ঢুকে পড়ল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পশুর নদীর পাড়েই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীর পাড়ে কি এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটছে—তা বুঝতে বিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ হতে হয় না। ওখানে গেলেই বোঝা যায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন—সুন্দরবনের কাছে একাধিক সিমেন্ট ও তরল গ্যাস তৈরির কারখানাও তো রয়েছে। যা হোক, বেলা দেড়টার দিকে আমাদের লঞ্চটি এসে থামল মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায়। আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, মুরগি, মাছ, পালং শাক, আলুর ভর্তা ও ডাল। খাবার সবই লঞ্চে রান্না হয়। খুবই সুস্বাদু, বাড়ির খাবারের মতো। বিশেষ করে কোরাল মাছের স্বাদ মুখে লেগে রইল অনেকক্ষণ। এই মাছ স্থানীয়দের কাছে ভেটকি বলে পরিচিত। মংলা এলাকায় নানা পণ্যের জাহাজ। এখানে রাতদিন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলে। জাহাজ আসছে, যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে হাতে এক কাপ চা নিয়ে লঞ্চের এদিক-ওদিক হাঁটছি। দেখলাম লঞ্চের পেছনের দিকে এক কোণে বসে এক নারী আমাদের নোংরা করা বাসনকোসন পরিষ্কার করছেন। তাঁকে দেখতে আমার মায়ের মতো। বয়সও একই, পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তাঁর গল্পটা শুনতে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নাম তাসলিমা বেগম। তিনি মূলত লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী। তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কাটা এবং থালা-বাসন ধোয়া তাঁর কাজ। তাসলিমা বেগমও আমাদের সঙ্গে এই লঞ্চে তিন দিন থাকবেন। শুনে অবাক হলাম, এই তিন দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পাবেন মাত্র ১ হাজার টাকা! ‘টাকা এত কম, কিছু বলেন না?’ জানতে চাইলাম। বললেন, লাভ নেই। বেশি দাবি করলে বাবুর্চি তাঁকে বাদ দিয়ে দেবেন। খুলনার তাসলিমা বেগমের একমাত্র ছেলের বাগেরহাটে একটি দোকান ছিল। তখন তাঁদের অবস্থা বেশ ভালোই। করোনাকালে লোকসান ও দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ছেলে এখন রিকশাভ্যান চালায়। আমি তাসলিমা বেগমকে কিছু টাকা দিলাম। টাকাটা পেয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। বললেন, ‘বাবা, আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’
বেলা ৪টার দিকে আমরা চলে এলাম হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম কেন্দ্রে। লঞ্চ থেকে আমরা উঠে পড়লাম লঞ্চের সঙ্গে থাকা ট্রলারটিতে। আমাদের নামতে দেখে দুজন নারী নৌকা বেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা ডাব বিক্রি করেন, আমরা যদি কিনি। সেই মোংলার একটি গ্রামে দুই বোন দিলারা ও হাজেরার বসবাস। প্রতিদিন সেখান থেকে ডাব এনে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করেন।
ছোট্ট নৌকাটির বইঠা বড় বোন দিলারার হাতে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। আর হাজেরার বয়স হবে চল্লিশের মতো। ডাবের দাম ঢাকা থেকেও বেশি। তবুও আমরা কয়েকজন ডাব কিনলাম। ট্রলারে করে ইকোপার্কের ঘাটে যেতে মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এটি বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য।
বনের এই অংশটিকে ঘিরে একটি কাঠের দীর্ঘ সেতু করা হয়েছে। সেই সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা চক্কর দেওয়া যায়। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। এখানে বাঘের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব; অর্থাৎ, এলাকাটি নিরাপদ। তবে একাধিক প্রজাতির বানর ও চিত্রা হরিণ অহরহ চোখে পড়বে। এই পার্কেই প্রথমবার বন্য হরিণের ছবি তুললাম। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমরা আবার ট্রলারে ফিরে এলাম। শীতকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, জাগেও অনেক বেলা করে। বিস্তীর্ণ সবুজ বন নিজেকে সঁপে দিল অন্ধকারের হাতে। সারা দিন যে বন দেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ—অন্ধকার নামলেই সেই বন থেকে সবাই পালাতে চায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের গতি ও শীতলতা। ভারী বাতাসের ছোঁয়ায় মনটাও কোনো কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়। ‘ভেসপার’ চলছে অন্ধকার ও শ্যালা নদী কেটে কেটে।
সাগর মোহনায় জোয়ার-ভাটা এবং নোনা ও মিষ্টি পানির প্রবাহ ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কারণ, পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় নদী যেখানে সাগরে মেশে, সাগর মোহনার যে অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে, সেখানেই ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন তেমনি একটি বন। এর বয়স তিন থেকে চার হাজার বছর। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সভায় দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। ঘোষণার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, অবদান ও পৃথিবীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি শর্ত বিবেচনা করা হয়। একই দিনে ইউনেসকো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ‘৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য’ এলাকা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত। এই তালিকাতেও আছে সুন্দরবনের নাম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই বিশেষ এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় একে ‘রামসার চুক্তি’ বলা হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কতটা কাজ করছি, তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।
আমাদের সঙ্গে আছেন ফরেস্ট গার্ড আলী হোসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত ১০-১২বার তিনি বাঘ দেখেছেন। একবার হয়েছেন মুখোমুখি। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তিনি মাত্র এসেছেন আন্ধারমানিক ক্যাম্পে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একে একে সবার অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে যায়, রইলেন শুধু তিনিই। পুরো ক্যাম্পে তিনি ও তাঁর বাবুর্চি। বনের মাঝখানে গা ছমছমে পরিবেশে তাঁদের ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি দু-তিনটি ঘর। ক্যাম্পের ভিতটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পের পাটাতনে নিরস্ত্র আলী হোসেন বসে আছেন। বাবুর্চিও নেই। তিনি শুনতে পেলেন পাটাতনের নিচে শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন বন্য শূকর। তিনি মুখে শব্দ করলেন, যাতে শূকরটি পালিয়ে যায়। একটু পর পাটাতনের নিচ থেকে বের হলো একটি পূর্ণবয়স্ক বেঙ্গল টাইগার!
বাঘটি ঘুরে আলী হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। আলী হোসেনের গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বাঘটি দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। সে বুঝে নিতে চাইছে তার শিকারটি অসহায় কিনা। আলী হোসেন বুঝলেন, এভাবে বসে থাকলে মরতে হবে। তিনি তাঁর সামনে থাকা টেবিলটি টেনে ঢালের মতো করে নিজের সামনে ধরলেন। বাঘটা গর্জন করে জানিয়ে দিল, কাজটি তার পছন্দ হয়নি। আলী হোসেনের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি শুনেছেন, বিকট শব্দে বাঘ ভয় পায়। তিনি সময় নষ্ট না করে টেবিলটিতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চাপড় মারতে লাগলেন। জোরে! আরও জোরে! এটাই বাঁচার শেষ চেষ্টা।
আলীর ভাগ্য ভালো; বাঘ সত্যিই ভয় পায়। ধীরে ধীরে বাঘটি ফিরে গেল। বাঘটি বনে মিলিয়ে যেতেই আলী হোসেন এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে আলী হোসেন জানিয়ে দিলেন, তিনি আর একা আন্ধারমানিক ক্যাম্পে থাকবেন না। তাঁকে রেঞ্জ অফিসেই রেখে দেওয়া হয়। গল্প শেষে আলী হোসেন বললেন, ‘ভাইজান, আমি এক মাস বাঘের ভয় থেইকা বাইর হইতে পারি নাই। একা বনে হাঁটলেই মনে হইতো আমার পিছনে বুঝি সেই বাঘটা আসতাছে।’ আরও বললেন, ‘খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক না। আমি জানি কারে কয় ছাড়া বাঘ।’
হাড়বাড়িয়া থেকে কটকা যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের লঞ্চ স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আছে সুন্দরবন। শ্যালা নদীর দুপাশে সুন্দরবন। বন যেন গার্ড অব অনার দিয়ে পর্যটক বোঝাই লঞ্চগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শীতের রাতে অদ্ভুত এক রূপে হাজির হয় সুন্দরবন। মাথার উপরে অবারিত ধূসর আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে থোকা থোকা মেঘ। যেন আকাশ ফেটে চৌচির। মেঘের আড়ালে চাঁদ। আড়ালে থেকেও আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে ওই আলোই তো ভরসা। বিভূতিভূষণের বর্ণনা, ‘ছোট খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই।’ আমিও দেখিনি।
জম্পেশ নৈশভোজ শেষে ঘুমাতে গেলাম। প্রথম রাতেই বুঝলাম এই মনোরম রুমটির একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন সমস্যাটা টের পাওয়া যায়। নোঙর ওঠানো-নামানোর যন্ত্রটা আমার রুমঘেঁষা। নোঙর নামানোর সময় ভয়ংকর দীর্ঘ শব্দ হয়, আর সে সময় যদি আপনি ঘুমে থাকেন, তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর একটিও নেই। ভোর তিনটায় আমি বিকট আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
লঞ্চ কটকা খালে নোঙর ফেলেছে। নোঙর ফেলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম সাড়ে ৫টার দিকে। তখনো ঘোর অন্ধকার। আকাশে মেঘ নেই। তবে চাঁদটি আকাশের শিরোমণি হয়ে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এখন গন্তব্য জামতলা সমুদ্রসৈকত। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ট্রলারে করে রওনা হলাম। কটকা থেকে আমাদের ট্রলার গিয়ে পড়ল জামতলা খালে। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো সুবিধা করতে পারছে না। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ঘাটে নামলাম। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। কখনো উন্মুক্ত প্রান্তর, কখনো ঘন বন। এদিকটায় অনেক বেশি টাইগার ফার্ন। বাংলাদেশে ২৫০ প্রজাতির ফার্ন হয়। এর বেশির ভাগই জন্মে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) বেশি দেখা যায়।
এই ফার্নের পাতার রঙের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। অনেক সময় শিকারের জন্য এই ফার্নের আড়ালে বাঘ ওত পেতে থাকে। আমার চোখ ঘুরেফিরে ওই ফার্নের ঝোপের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক চুপ করে বসে নেই তো! আমরা হেঁটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জামতলা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছালাম। সৈকতের এদিকটায় প্রচুর সুন্দরী গাছ। এখানে সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের চিহ্ন। একটি কথা বলে রাখি, আমরা এখন যেদিকেই যাচ্ছি চিত্রা হরিণ চোখে পড়ে। সুতরাং এই হরিণ ও বানর দেখা ডালভাত হয়ে গেছে।
আমরা যখন জামতলা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম, তখনো সূর্য কুয়াশার কবলে। সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়। এখানকার সমুদ্রের পানি নদীর পানির মতো ঘোলা। সমুদ্রে কেউ নামে না। তবু সমুদ্র তো সমুদ্রই, বড় বড় ঢেউ আছে—আছে গর্জনও। কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দূরে যেমন জাহাজ বা নৌকা দেখা যায়—এই সৈকত থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এখানকার বালিও ধূসর। এই সৈকতে আপনি যদি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, মনে হবে আপনিই প্রথম সৈকতটি আবিষ্কার করলেন। কারণ মানবসভ্যতার কোনো উপকরণ ত্রিসীমানায় নেই। এদিক থেকে এই সৈকতটি ভিন্ন। দুঃখজনক হলো, এখানে সেখানে বর্জ্য পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় খাবারের মোড়ক ও প্লাস্টিক বোতল ফেলে রেখে যায়। সমুদ্রও নানা বর্জ্য উগরে দেয় সৈকতে। এসব পরিষ্কার করার লোক আছে বলে মনে হয়নি।
একই দিন, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গেলাম টাইগার টিলায়। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। একটু পরপরই হরিণের পাল দেখা যায়। এই এলাকায় প্রচুর সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, ধুন্দুল, ওরা ও বাইন গাছ। এদের অনেকের শুলো হয়। এই শুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। মাটি ভেদ করে এই শুলোগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুলোর জন্য হাঁটা মুশকিল। এই এলাকার প্রায় পুরোটাই শুলো দিয়ে ছাওয়া। টিলা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ঢিবিও না। একটু উঁচু স্থান। এমন কয়েকটা তথাকথিত টিলা পেলাম। এই টিলাগুলোতে নাকি বাঘ বিশ্রাম নেয়। টিলাগুলোতে পুরোনো অবকাঠামোর চিহ্ন স্পষ্ট, আর টিলা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃৎপাত্রের অসংখ্য টুকরো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এগুলোকে সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতির নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। আমার কাছে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলোকে প্রাচীন মনে হয়নি। আরও কিছু দূর গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম আরেকটি ধ্বংসস্তূপের সামনে। এটি নাকি কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি লবণ কারখানার নিদর্শন। আমি এবারও সম্মত হতে পারলাম না। যা হোক, একাধিক হরিণের পাল, কথিত প্রত্নকেন্দ্র ও শুলোর গালিচা দেখা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কটকা নামে খাল হলেও অনেক নদীর চেয়েও বড়। সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের লঞ্চটি সেই কটকা থেকে ছিটা কটকা বা ছোট কটকা খাল ধরে চলা শুরু করল। সবার আশা, এবার কুমির দেখা যাবে। আমার এই পুরো ভ্রমণের এই অংশটুকু বিশিষ্ট।
খাল ধরে চলতে গিয়ে সুন্দরবনের এক অনন্য রূপ দেখা গেল। খালগুলোকে সুন্দরবনের ধমনি বলা যায়। গাঙ্গেয় মোহনায় কয়েক শ দ্বীপাঞ্চল নিয়ে সুন্দরবনের পরিবার। তার আয়তন এখন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে নদী-নালা ও খাল-বিলই দখল করে আছে ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুন্দরবনের অধিকাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ—৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আমরা এখন লঞ্চ নিয়ে যে খাল ধরে যাচ্ছি, তা স্বাভাবিকভাবেই ওই জলভাগের অংশ। এলাকাজুড়ে ভীষণ নীরবতা। কখনো কখনো সেই নীরবতাকে ভাঙে পাখির ডাক। খাল বলেই হয়তো আমাদের লঞ্চটিও খুব ধীর গতিতে চলছে, ফলে শব্দও কম। খালের ঘোলা পানিতে গাছের ছায়া পড়ায় পানির রং সবুজ বলে ভ্রম হয়। সরু খাল ধরে লঞ্চ কখনো ডানে, কখনো বাঁয় যাচ্ছে। অনেক সময় বড় গাছ ঘেঁষে চলতে হচ্ছে লঞ্চটিকে। এদিকটায় নানা প্রজাতির মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। ছিটা কটকা থেকে কচিখালী খালে ওঠার একটু আগে কুমিরের দেখা মিলল। একঝলক। খালপাড়ে বসে ছিল একটি কুমির ছানা। লম্বায় মাত্র দেড় হাত হবে। লঞ্চ কাছে আসতেই দ্রুত পানিতে নেমে উধাও হয়ে গেল। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ তা দেখার সুযোগ পেল না। যারা দেখতে পেল না—তাদের সে কী আফসোস! বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনে প্রধানত পাঁচটি প্রাণী দেখার আছে—বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও কুমির। আমার চারটি দেখা হয়ে গেছে। বাঘ দেখতে পাব সে আশা আমার নেই। বেলা দেড়টার দিকে আমাদের ‘ভেসপার’ কচিখালী খালে উঠল।
লঞ্চ ছুটছে কচিখালী অফিস পার্কের দিকে। সেখানে অনেক হাঁটতে হবে, আমরা দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম। কচিখালী অফিস পার্কে পৌঁছাতে বেলা ২টা ৪০ বেজে গেল। পার্কের নামে সরকারি যত স্থাপনা আছে, সেগুলো এই বনাঞ্চলে একেবারেই বেমানান। এখানেও যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ভবন—দেখতে বিকট।
একজনকে দেখলাম মসজিদের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন। তানজির হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে আমাদের দলটি এসব ফেলে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল। তবে এবার সব পর্যটক এই দলে নেই। অর্ধেকই আরাম করতে লঞ্চে রয়ে গেছে। যা হোক, যত দূর চোখ যায় আধমরা কোমরসমান ঘাস (ছন) আর ছোট ছোট বুনোফুলের গাছ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আতঙ্ক জাগানো টাইগার ফার্ন এবং দু-একট বড় গাছও রয়েছে। তবে এই খোলা প্রান্তরেরও সীমানা রয়েছে। এর সীমানা প্রাচীর ঘন বন। কিছু দূর হাঁটতেই বুঝলাম আমরা এখানে কেন এসেছি। অদূরেই অসংখ্য চিত্রা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। নীরবে দেখতে লাগলাম সোনার হরিণের পাল। আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গেলাম। ক্যামেরা নিয়ে পড়লে এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা হবে না। আমরা যেমন হরিণ দেখছি, হরিণও কিন্তু একদল মানুষ দেখছে। সুতরাং হরিণগুলো ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই পুরো এলাকা সাফারি পার্কের মতো—আফ্রিকায় যেমন দেখা যায়। হরিণ দেখা শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুলে আমরা লঞ্চের দিকে পা বাড়ালাম।
এবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদের লঞ্চ—যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। ফেরার পথে দেখা হবে ডিমের চর ও করমজল। এখানে বলে রাখি, এই পুরো দলে আমারই কোনো উপদল ছিল না। আমি ঢাকা থেকে একাই এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনই আমার একটি দল তৈরি হয়। আমার এই দলে আছে এক তরুণ, এক শিশু আর দুই কিশোর—মাসুম, প্রত্যয়, প্রান্ত ও মাহী। ওরা থাকাতে আমার ভ্রমণটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়েছে। এবার আসি ‘ডিমের চর’ প্রসঙ্গে। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ডিমের চরে পা রাখলাম। এই চরের এই অদ্ভুত নামের কারণ কী? জানলাম, চরটি ডিম্বাকৃতির। তবে এর আরেকটি নামও রয়েছে—‘চর বিচ্ছু’।
এই চরের দক্ষিণ দিকে পক্ষীর চর। পাড় থেকেই বোঝা যায় চরটি গোল। ডিমের চরের চতুর্দিকে অথই পানি। এটি আসলে নদী ও সমুদ্রে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাড় থেকে ওপরের দিকে উঠতেই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে নানা ধরনের আবর্জনা পড়ে আছে। সাগর ও নদীতে ভেসে আসা আবর্জনার শেষ গন্তব্য এই চর। আর আবর্জনার স্তূপ আরও উঁচু করতে অনেক অসচেতন পর্যটক তো আছেই। এটিকে আবর্জনার চর বললেও ভুল হতো না। আবর্জনার কথা বাদ দিলে চরটি চমৎকার।
বিভূতিভূষণের ভাষায় বলতে হয়, ‘পিছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল—যেন কোন নূতন দেশের নূতন জীবনের সন্ধান পাইলাম এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।’
সত্যিই তাই, মনে হবে এই নির্জন দ্বীপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত! বালির গায়ে বসে যাওয়া সর্পিল পথ ধরে চরের ভেতরের দিকে (পূর্বদিক) এগিয়ে যাই। কিছু দূর গিয়ে আমরা থমকে গেলাম। একটু দূরেই ছনের বনে অগণিত চিত্রা হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি তারা টের পেল; কিন্তু পালাল না। হয়তো সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায়—সাহসও বেশি। ছনবনের পরেই ঘন বন। আমাদের সুন্দরবনের ডাঙার ৭০ শতাংশ ঘন গাছপালায় ছাওয়া। বাকি ৩০ শতাংশ ঘাসে আবৃত, চর এলাকা, সমুদ্রসৈকত, বালি ও কাদাময় প্রান্তর।
আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে আমরা আবার পাড়ের দিকে চলে এলাম। এখানে যখন নেমেছিলাম, তখন পানিতে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হয়েছিল পানিতে আগুন জ্বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে পানি তরল সোনায় পরিণত হয়েছে। যেন কেউ কোথাও নেই, আছে শুধু সূর্য ও তার জাদুর প্রতিবিম্ব। অন্ধকার বাড়ছে সূর্যও লাল হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে কিনা জানি না—সূর্য কিন্তু ডুবল না। পানিতে গা ডোবানোর আগেই নীরবে ধূসর আকাশে মিলিয়ে গেল। ঝপ করে নামল অন্ধকার। সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, খেয়ালই করিনি আমার পেছনে দুটো বন্য শূকর! আমার ভাগ্য ভালো তারা খাবারের খোঁজে ব্যস্ত ছিল। আমি ট্রলারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কী নিপুণভাবে নদী ও খাল পাড়ি দিচ্ছে নির্বিঘ্ন। কখনো গতি বাড়ছে, কখনো কমছে। কী রাত কী দিন—ভেসপার ভেসে চলেছে। আসলে তা চলে না—একজন তাকে চালায়। আর যিনি অবিরাম এটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি হলেন আবদুর রাজ্জাক। তৃতীয় তলার সামনের অংশে তাঁর অবস্থান। বয়স ত্রিশ। এই তরুণের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। ভেসপার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে আমাকে বললেন, তাঁকে কেউ বলে সারেং, কেউ বলে সুকানি, কেউ মাস্টার বলে। অনেকে নাকি ক্যাপ্টেন ও পাইলটও বলে।
শেষের লাইনটি বলে নিজেই হেসে ফেললেন রাজ্জাক। জানলাম, তিনি এখানে আছেন চার বছর ধরে। তার আগে কার্গো বোট চালাতেন, ঘুরতে হতো এক জেলা থেকে আরেক জেলা। তবে খুলনা এসে তিনি খুশি। জানতে চাইলাম, সুন্দরবন ভালো লাগে এ জন্য কাজটা করেন কিনা। উত্তর দিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া কিছু জানি না, তাই এটাই করি।’ রাজ্জাকদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিনি একাই। লঞ্চেই থাকা-খাওয়া। পর্যটন স্পট বন্ধ থাকলে অথবা ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফরিদপুরে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে ফেরা হয় না—দিনের পর দিন।
সুন্দরবনে এটিই শেষ রাত। তাই রাতের খাবারের মেনুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। মাছ ও মুরগির বারবিকিউ। কয়েকজন গান করলেন, নাচলেন—অনেক মজা হলো। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দূর থেকে রাতের সুন্দরবন দেখা হলো। সুন্দরবন দেবীর ঘুম যেন ভেঙে না যায়, সে জন্যই কি রাজ্জাক যতটা সম্ভব নীরবতা বজায় রেখে লঞ্চ চালাচ্ছেন? সুন্দরবনের রাত দেখে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘আবার আকাশে নক্ষত্র উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিচে অনন্ত সমুদ্র—মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম!’ যদিও এখন কুয়াশার কারণে খুব বেশি তারা আকাশে নেই। রাতের বাতাস বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে, লাউঞ্জে কেউ একজন গান ধরেছেন, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/ তোমায় আমি হলেম অচেনা...’ এই অচীন-অবর্ণনীয় নীরবতা কি মানুষের ভেতরের নীরবতাকেও উসকে দেয়? আর তখন পশুর নদীর মতোই কি ছলকে ওঠে সেই নীরবতা? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত একটার দিকে চাঁদপাই এলাকায় নোঙর ফেলল ভেসপার।
খুলনার দক্ষিণে দুবলার চরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে রূপসা নদী—যার একটি শাখা সমুদ্রে নেমেছে। অন্য শাখাটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী মংলা খালের সঙ্গে যুক্ত। এর পর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শিবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পশুর নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পশুর ভীষণ গভীর ও খরস্রোতা। সেই নদীকে আমি দুর্বল ভেবেছিলাম! সে জন্যই কিনা জানি না—আজ নিজের সক্ষমতা দেখাচ্ছে পশুর। সমুদ্রের মতো তার গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ, তীব্র তার স্রোত। তার আজ পশুর মতো বল। আচ্ছা নামটি পশুর কেন হলো? পশুর নামের গাছ থেকে? সুন্দরবনে প্রচুর পশুর গাছ জন্মে। বিভূতিভূষণ ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ নামের কিশোর উপন্যাসে এই পশুরকেই কি ভুলে ‘পশোর’ বলেছেন? নাকি মূল নাম পশোরই? পশোরের অর্থই-বা কী? যা হোক, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রলারে উঠে পড়লাম, গন্তব্য—করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র।
টালমাটাল অবস্থায় ট্রলার ১০ মিনিটের মধ্যেই বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে পৌঁছে গেল। কুমির দেখার জন্য জায়গাটি আদর্শ। বিভিন্ন চৌবাচ্চায় ছোট-বড় কুমির রয়েছে। একটি পুকুরে ‘রোমিও-জুলিয়েট’ নামে দুটি কুমিরের বসবাস। কেন্দ্রের লোকজন নাম ধরে ডাকলে সাঁতার কেটে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হয় তারা। এটি একটি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি চৌবাচ্চায় কয়েকটি কচ্ছপকে সাঁতার কেটে বেড়াতে দেখলাম। এই কেন্দ্রে যে প্রাণীগুলো সুখে-শান্তিতে নেই, তা বোঝা যায়। গোটা কেন্দ্রটিই শ্রীহীন, চৌবাচ্চার দেয়াল এবং খাঁচার লোহার জালগুলো ভাঙাচোরা, আর মানুষের উৎপাত তো রয়েছেই। বেলা ১১টার দিকে আমরা ফিরে এলাম।
বাঘ যে দেখা হলো না, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি বাঘ দেখতে আসিনি—এসেছি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হতে। পরিচয় বললাম, কারণ সুন্দরবনকে জানতে, বুঝতে মাসের পর মাস ব্যয় করলেও কম পড়তে পারে। আমরা গত দু-তিন দিনে বনদেবীর এক শতাংশও দর্শন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে যে সুন্দরবনের গল্প শুনছি, যার ছবি দেখি—তাকে সরাসরি একবার দেখার সাধ অন্তত মিটল। আমার এবারের প্রত্যাশা তাই ছিল। সুন্দরবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না হয় আবার আসব। দুপুরের দিকে আমরা ফিরে এলাম খুলনা সদরে।
রূপসা নদী থেকে কখন পশুর নদীতে উঠলাম, বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের লঞ্চটি একটি ঘোলা পানির উত্তাল নদীর মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটিই পশুর নদী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘পশোর’ নদী। এই নদীতে পড়ে সুন্দরবনের আভাস পাওয়া যায়। পাড়গুলোতে সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ জন্মেছে। পার্থক্য, এখানে অতটা ঘন নয় এবং একটু দূরেই গ্রাম ও ফসলি জমিগুলো স্পষ্ট।
‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ বইয়ে বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘সামনে বিস্তৃত পশোর নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতাল ঝোপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।’ আর আমার ধারণা ছিল পশুর শুধু নামেই নদী, আদতে একটি খাল। বিশালদেহী নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমি লজ্জাই পেলাম।
এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। পেশাগত কাজে আগে খুলনা ও বাগেরহাট আসা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এসেছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা পর্যন্ত। সুন্দরবনে এখনই হয়তো আসা হতো না যদি ‘ফেমাস ট্যুরস বিডি’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজির হোসেন রুবেল জোর আমন্ত্রণ না করতেন। যে লঞ্চের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘এমভি দ্য ভেসপার’। সকালে (১৪ জানুয়ারি, ২০২২) রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে ভেড়ানো ছিল। আমি ট্রেন থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখান থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। ঘাট থেকে একটি ট্রলার আমাকেসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে নিয়ে আসে লঞ্চটির কাছে। তিনতলা লঞ্চটির একদম নিচতলায় ইঞ্জিন, জেনারেটর ও রান্নাঘর। দ্বিতীয় তলায় অতিথিদের রুম এবং তৃতীয় তলায় হলরুম; এখানকার লোকজন বলে ‘লাউঞ্জ’। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমার রুমটি দ্বিতীয়তলার সামনের দিকে। সেখান থেকে বাইরের দৃশ্য দারুণ দেখায়। আমাদের দুই রাত, তিন দিনের সফর। এই কয়েকটা দিন এই লঞ্চে করেই জলে ভেসে বেড়াব আমরা।
লঞ্চের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ, নদী কাটার ঝিরঝির শব্দ ও হিমেল বাতাস, মনটা আনমনে করে দেয়। কী এক স্বর্গীয় ভালো লাগা ভর করে শরীরে। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় যত দূর চোখ যায়। কোথাও ইটপাথরের বড় বড় দালান নেই, যানজটের বালাই নেই, তীব্র হর্নের ডামাডোল নেই—নেই দম বন্ধ করা ধোঁয়া। বুঁদ হয়েছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। মন ভালো করা চলচ্চিত্রে হুট করেই ঢুকে পড়ল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পশুর নদীর পাড়েই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীর পাড়ে কি এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটছে—তা বুঝতে বিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ হতে হয় না। ওখানে গেলেই বোঝা যায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন—সুন্দরবনের কাছে একাধিক সিমেন্ট ও তরল গ্যাস তৈরির কারখানাও তো রয়েছে। যা হোক, বেলা দেড়টার দিকে আমাদের লঞ্চটি এসে থামল মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায়। আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, মুরগি, মাছ, পালং শাক, আলুর ভর্তা ও ডাল। খাবার সবই লঞ্চে রান্না হয়। খুবই সুস্বাদু, বাড়ির খাবারের মতো। বিশেষ করে কোরাল মাছের স্বাদ মুখে লেগে রইল অনেকক্ষণ। এই মাছ স্থানীয়দের কাছে ভেটকি বলে পরিচিত। মংলা এলাকায় নানা পণ্যের জাহাজ। এখানে রাতদিন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলে। জাহাজ আসছে, যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে হাতে এক কাপ চা নিয়ে লঞ্চের এদিক-ওদিক হাঁটছি। দেখলাম লঞ্চের পেছনের দিকে এক কোণে বসে এক নারী আমাদের নোংরা করা বাসনকোসন পরিষ্কার করছেন। তাঁকে দেখতে আমার মায়ের মতো। বয়সও একই, পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তাঁর গল্পটা শুনতে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নাম তাসলিমা বেগম। তিনি মূলত লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী। তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কাটা এবং থালা-বাসন ধোয়া তাঁর কাজ। তাসলিমা বেগমও আমাদের সঙ্গে এই লঞ্চে তিন দিন থাকবেন। শুনে অবাক হলাম, এই তিন দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পাবেন মাত্র ১ হাজার টাকা! ‘টাকা এত কম, কিছু বলেন না?’ জানতে চাইলাম। বললেন, লাভ নেই। বেশি দাবি করলে বাবুর্চি তাঁকে বাদ দিয়ে দেবেন। খুলনার তাসলিমা বেগমের একমাত্র ছেলের বাগেরহাটে একটি দোকান ছিল। তখন তাঁদের অবস্থা বেশ ভালোই। করোনাকালে লোকসান ও দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ছেলে এখন রিকশাভ্যান চালায়। আমি তাসলিমা বেগমকে কিছু টাকা দিলাম। টাকাটা পেয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। বললেন, ‘বাবা, আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’
বেলা ৪টার দিকে আমরা চলে এলাম হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম কেন্দ্রে। লঞ্চ থেকে আমরা উঠে পড়লাম লঞ্চের সঙ্গে থাকা ট্রলারটিতে। আমাদের নামতে দেখে দুজন নারী নৌকা বেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা ডাব বিক্রি করেন, আমরা যদি কিনি। সেই মোংলার একটি গ্রামে দুই বোন দিলারা ও হাজেরার বসবাস। প্রতিদিন সেখান থেকে ডাব এনে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করেন।
ছোট্ট নৌকাটির বইঠা বড় বোন দিলারার হাতে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। আর হাজেরার বয়স হবে চল্লিশের মতো। ডাবের দাম ঢাকা থেকেও বেশি। তবুও আমরা কয়েকজন ডাব কিনলাম। ট্রলারে করে ইকোপার্কের ঘাটে যেতে মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এটি বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য।
বনের এই অংশটিকে ঘিরে একটি কাঠের দীর্ঘ সেতু করা হয়েছে। সেই সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা চক্কর দেওয়া যায়। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। এখানে বাঘের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব; অর্থাৎ, এলাকাটি নিরাপদ। তবে একাধিক প্রজাতির বানর ও চিত্রা হরিণ অহরহ চোখে পড়বে। এই পার্কেই প্রথমবার বন্য হরিণের ছবি তুললাম। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমরা আবার ট্রলারে ফিরে এলাম। শীতকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, জাগেও অনেক বেলা করে। বিস্তীর্ণ সবুজ বন নিজেকে সঁপে দিল অন্ধকারের হাতে। সারা দিন যে বন দেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ—অন্ধকার নামলেই সেই বন থেকে সবাই পালাতে চায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের গতি ও শীতলতা। ভারী বাতাসের ছোঁয়ায় মনটাও কোনো কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়। ‘ভেসপার’ চলছে অন্ধকার ও শ্যালা নদী কেটে কেটে।
সাগর মোহনায় জোয়ার-ভাটা এবং নোনা ও মিষ্টি পানির প্রবাহ ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কারণ, পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় নদী যেখানে সাগরে মেশে, সাগর মোহনার যে অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে, সেখানেই ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন তেমনি একটি বন। এর বয়স তিন থেকে চার হাজার বছর। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সভায় দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। ঘোষণার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, অবদান ও পৃথিবীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি শর্ত বিবেচনা করা হয়। একই দিনে ইউনেসকো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ‘৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য’ এলাকা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত। এই তালিকাতেও আছে সুন্দরবনের নাম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই বিশেষ এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় একে ‘রামসার চুক্তি’ বলা হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কতটা কাজ করছি, তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।
আমাদের সঙ্গে আছেন ফরেস্ট গার্ড আলী হোসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত ১০-১২বার তিনি বাঘ দেখেছেন। একবার হয়েছেন মুখোমুখি। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তিনি মাত্র এসেছেন আন্ধারমানিক ক্যাম্পে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একে একে সবার অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে যায়, রইলেন শুধু তিনিই। পুরো ক্যাম্পে তিনি ও তাঁর বাবুর্চি। বনের মাঝখানে গা ছমছমে পরিবেশে তাঁদের ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি দু-তিনটি ঘর। ক্যাম্পের ভিতটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পের পাটাতনে নিরস্ত্র আলী হোসেন বসে আছেন। বাবুর্চিও নেই। তিনি শুনতে পেলেন পাটাতনের নিচে শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন বন্য শূকর। তিনি মুখে শব্দ করলেন, যাতে শূকরটি পালিয়ে যায়। একটু পর পাটাতনের নিচ থেকে বের হলো একটি পূর্ণবয়স্ক বেঙ্গল টাইগার!
বাঘটি ঘুরে আলী হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। আলী হোসেনের গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বাঘটি দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। সে বুঝে নিতে চাইছে তার শিকারটি অসহায় কিনা। আলী হোসেন বুঝলেন, এভাবে বসে থাকলে মরতে হবে। তিনি তাঁর সামনে থাকা টেবিলটি টেনে ঢালের মতো করে নিজের সামনে ধরলেন। বাঘটা গর্জন করে জানিয়ে দিল, কাজটি তার পছন্দ হয়নি। আলী হোসেনের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি শুনেছেন, বিকট শব্দে বাঘ ভয় পায়। তিনি সময় নষ্ট না করে টেবিলটিতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চাপড় মারতে লাগলেন। জোরে! আরও জোরে! এটাই বাঁচার শেষ চেষ্টা।
আলীর ভাগ্য ভালো; বাঘ সত্যিই ভয় পায়। ধীরে ধীরে বাঘটি ফিরে গেল। বাঘটি বনে মিলিয়ে যেতেই আলী হোসেন এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে আলী হোসেন জানিয়ে দিলেন, তিনি আর একা আন্ধারমানিক ক্যাম্পে থাকবেন না। তাঁকে রেঞ্জ অফিসেই রেখে দেওয়া হয়। গল্প শেষে আলী হোসেন বললেন, ‘ভাইজান, আমি এক মাস বাঘের ভয় থেইকা বাইর হইতে পারি নাই। একা বনে হাঁটলেই মনে হইতো আমার পিছনে বুঝি সেই বাঘটা আসতাছে।’ আরও বললেন, ‘খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক না। আমি জানি কারে কয় ছাড়া বাঘ।’
হাড়বাড়িয়া থেকে কটকা যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের লঞ্চ স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আছে সুন্দরবন। শ্যালা নদীর দুপাশে সুন্দরবন। বন যেন গার্ড অব অনার দিয়ে পর্যটক বোঝাই লঞ্চগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শীতের রাতে অদ্ভুত এক রূপে হাজির হয় সুন্দরবন। মাথার উপরে অবারিত ধূসর আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে থোকা থোকা মেঘ। যেন আকাশ ফেটে চৌচির। মেঘের আড়ালে চাঁদ। আড়ালে থেকেও আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে ওই আলোই তো ভরসা। বিভূতিভূষণের বর্ণনা, ‘ছোট খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই।’ আমিও দেখিনি।
জম্পেশ নৈশভোজ শেষে ঘুমাতে গেলাম। প্রথম রাতেই বুঝলাম এই মনোরম রুমটির একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন সমস্যাটা টের পাওয়া যায়। নোঙর ওঠানো-নামানোর যন্ত্রটা আমার রুমঘেঁষা। নোঙর নামানোর সময় ভয়ংকর দীর্ঘ শব্দ হয়, আর সে সময় যদি আপনি ঘুমে থাকেন, তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর একটিও নেই। ভোর তিনটায় আমি বিকট আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
লঞ্চ কটকা খালে নোঙর ফেলেছে। নোঙর ফেলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম সাড়ে ৫টার দিকে। তখনো ঘোর অন্ধকার। আকাশে মেঘ নেই। তবে চাঁদটি আকাশের শিরোমণি হয়ে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এখন গন্তব্য জামতলা সমুদ্রসৈকত। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ট্রলারে করে রওনা হলাম। কটকা থেকে আমাদের ট্রলার গিয়ে পড়ল জামতলা খালে। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো সুবিধা করতে পারছে না। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ঘাটে নামলাম। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। কখনো উন্মুক্ত প্রান্তর, কখনো ঘন বন। এদিকটায় অনেক বেশি টাইগার ফার্ন। বাংলাদেশে ২৫০ প্রজাতির ফার্ন হয়। এর বেশির ভাগই জন্মে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) বেশি দেখা যায়।
এই ফার্নের পাতার রঙের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। অনেক সময় শিকারের জন্য এই ফার্নের আড়ালে বাঘ ওত পেতে থাকে। আমার চোখ ঘুরেফিরে ওই ফার্নের ঝোপের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক চুপ করে বসে নেই তো! আমরা হেঁটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জামতলা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছালাম। সৈকতের এদিকটায় প্রচুর সুন্দরী গাছ। এখানে সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের চিহ্ন। একটি কথা বলে রাখি, আমরা এখন যেদিকেই যাচ্ছি চিত্রা হরিণ চোখে পড়ে। সুতরাং এই হরিণ ও বানর দেখা ডালভাত হয়ে গেছে।
আমরা যখন জামতলা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম, তখনো সূর্য কুয়াশার কবলে। সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়। এখানকার সমুদ্রের পানি নদীর পানির মতো ঘোলা। সমুদ্রে কেউ নামে না। তবু সমুদ্র তো সমুদ্রই, বড় বড় ঢেউ আছে—আছে গর্জনও। কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দূরে যেমন জাহাজ বা নৌকা দেখা যায়—এই সৈকত থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এখানকার বালিও ধূসর। এই সৈকতে আপনি যদি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, মনে হবে আপনিই প্রথম সৈকতটি আবিষ্কার করলেন। কারণ মানবসভ্যতার কোনো উপকরণ ত্রিসীমানায় নেই। এদিক থেকে এই সৈকতটি ভিন্ন। দুঃখজনক হলো, এখানে সেখানে বর্জ্য পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় খাবারের মোড়ক ও প্লাস্টিক বোতল ফেলে রেখে যায়। সমুদ্রও নানা বর্জ্য উগরে দেয় সৈকতে। এসব পরিষ্কার করার লোক আছে বলে মনে হয়নি।
একই দিন, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গেলাম টাইগার টিলায়। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। একটু পরপরই হরিণের পাল দেখা যায়। এই এলাকায় প্রচুর সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, ধুন্দুল, ওরা ও বাইন গাছ। এদের অনেকের শুলো হয়। এই শুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। মাটি ভেদ করে এই শুলোগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুলোর জন্য হাঁটা মুশকিল। এই এলাকার প্রায় পুরোটাই শুলো দিয়ে ছাওয়া। টিলা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ঢিবিও না। একটু উঁচু স্থান। এমন কয়েকটা তথাকথিত টিলা পেলাম। এই টিলাগুলোতে নাকি বাঘ বিশ্রাম নেয়। টিলাগুলোতে পুরোনো অবকাঠামোর চিহ্ন স্পষ্ট, আর টিলা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃৎপাত্রের অসংখ্য টুকরো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এগুলোকে সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতির নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। আমার কাছে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলোকে প্রাচীন মনে হয়নি। আরও কিছু দূর গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম আরেকটি ধ্বংসস্তূপের সামনে। এটি নাকি কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি লবণ কারখানার নিদর্শন। আমি এবারও সম্মত হতে পারলাম না। যা হোক, একাধিক হরিণের পাল, কথিত প্রত্নকেন্দ্র ও শুলোর গালিচা দেখা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কটকা নামে খাল হলেও অনেক নদীর চেয়েও বড়। সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের লঞ্চটি সেই কটকা থেকে ছিটা কটকা বা ছোট কটকা খাল ধরে চলা শুরু করল। সবার আশা, এবার কুমির দেখা যাবে। আমার এই পুরো ভ্রমণের এই অংশটুকু বিশিষ্ট।
খাল ধরে চলতে গিয়ে সুন্দরবনের এক অনন্য রূপ দেখা গেল। খালগুলোকে সুন্দরবনের ধমনি বলা যায়। গাঙ্গেয় মোহনায় কয়েক শ দ্বীপাঞ্চল নিয়ে সুন্দরবনের পরিবার। তার আয়তন এখন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে নদী-নালা ও খাল-বিলই দখল করে আছে ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুন্দরবনের অধিকাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ—৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আমরা এখন লঞ্চ নিয়ে যে খাল ধরে যাচ্ছি, তা স্বাভাবিকভাবেই ওই জলভাগের অংশ। এলাকাজুড়ে ভীষণ নীরবতা। কখনো কখনো সেই নীরবতাকে ভাঙে পাখির ডাক। খাল বলেই হয়তো আমাদের লঞ্চটিও খুব ধীর গতিতে চলছে, ফলে শব্দও কম। খালের ঘোলা পানিতে গাছের ছায়া পড়ায় পানির রং সবুজ বলে ভ্রম হয়। সরু খাল ধরে লঞ্চ কখনো ডানে, কখনো বাঁয় যাচ্ছে। অনেক সময় বড় গাছ ঘেঁষে চলতে হচ্ছে লঞ্চটিকে। এদিকটায় নানা প্রজাতির মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। ছিটা কটকা থেকে কচিখালী খালে ওঠার একটু আগে কুমিরের দেখা মিলল। একঝলক। খালপাড়ে বসে ছিল একটি কুমির ছানা। লম্বায় মাত্র দেড় হাত হবে। লঞ্চ কাছে আসতেই দ্রুত পানিতে নেমে উধাও হয়ে গেল। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ তা দেখার সুযোগ পেল না। যারা দেখতে পেল না—তাদের সে কী আফসোস! বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনে প্রধানত পাঁচটি প্রাণী দেখার আছে—বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও কুমির। আমার চারটি দেখা হয়ে গেছে। বাঘ দেখতে পাব সে আশা আমার নেই। বেলা দেড়টার দিকে আমাদের ‘ভেসপার’ কচিখালী খালে উঠল।
লঞ্চ ছুটছে কচিখালী অফিস পার্কের দিকে। সেখানে অনেক হাঁটতে হবে, আমরা দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম। কচিখালী অফিস পার্কে পৌঁছাতে বেলা ২টা ৪০ বেজে গেল। পার্কের নামে সরকারি যত স্থাপনা আছে, সেগুলো এই বনাঞ্চলে একেবারেই বেমানান। এখানেও যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ভবন—দেখতে বিকট।
একজনকে দেখলাম মসজিদের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন। তানজির হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে আমাদের দলটি এসব ফেলে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল। তবে এবার সব পর্যটক এই দলে নেই। অর্ধেকই আরাম করতে লঞ্চে রয়ে গেছে। যা হোক, যত দূর চোখ যায় আধমরা কোমরসমান ঘাস (ছন) আর ছোট ছোট বুনোফুলের গাছ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আতঙ্ক জাগানো টাইগার ফার্ন এবং দু-একট বড় গাছও রয়েছে। তবে এই খোলা প্রান্তরেরও সীমানা রয়েছে। এর সীমানা প্রাচীর ঘন বন। কিছু দূর হাঁটতেই বুঝলাম আমরা এখানে কেন এসেছি। অদূরেই অসংখ্য চিত্রা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। নীরবে দেখতে লাগলাম সোনার হরিণের পাল। আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গেলাম। ক্যামেরা নিয়ে পড়লে এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা হবে না। আমরা যেমন হরিণ দেখছি, হরিণও কিন্তু একদল মানুষ দেখছে। সুতরাং হরিণগুলো ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই পুরো এলাকা সাফারি পার্কের মতো—আফ্রিকায় যেমন দেখা যায়। হরিণ দেখা শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুলে আমরা লঞ্চের দিকে পা বাড়ালাম।
এবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদের লঞ্চ—যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। ফেরার পথে দেখা হবে ডিমের চর ও করমজল। এখানে বলে রাখি, এই পুরো দলে আমারই কোনো উপদল ছিল না। আমি ঢাকা থেকে একাই এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনই আমার একটি দল তৈরি হয়। আমার এই দলে আছে এক তরুণ, এক শিশু আর দুই কিশোর—মাসুম, প্রত্যয়, প্রান্ত ও মাহী। ওরা থাকাতে আমার ভ্রমণটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়েছে। এবার আসি ‘ডিমের চর’ প্রসঙ্গে। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ডিমের চরে পা রাখলাম। এই চরের এই অদ্ভুত নামের কারণ কী? জানলাম, চরটি ডিম্বাকৃতির। তবে এর আরেকটি নামও রয়েছে—‘চর বিচ্ছু’।
এই চরের দক্ষিণ দিকে পক্ষীর চর। পাড় থেকেই বোঝা যায় চরটি গোল। ডিমের চরের চতুর্দিকে অথই পানি। এটি আসলে নদী ও সমুদ্রে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাড় থেকে ওপরের দিকে উঠতেই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে নানা ধরনের আবর্জনা পড়ে আছে। সাগর ও নদীতে ভেসে আসা আবর্জনার শেষ গন্তব্য এই চর। আর আবর্জনার স্তূপ আরও উঁচু করতে অনেক অসচেতন পর্যটক তো আছেই। এটিকে আবর্জনার চর বললেও ভুল হতো না। আবর্জনার কথা বাদ দিলে চরটি চমৎকার।
বিভূতিভূষণের ভাষায় বলতে হয়, ‘পিছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল—যেন কোন নূতন দেশের নূতন জীবনের সন্ধান পাইলাম এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।’
সত্যিই তাই, মনে হবে এই নির্জন দ্বীপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত! বালির গায়ে বসে যাওয়া সর্পিল পথ ধরে চরের ভেতরের দিকে (পূর্বদিক) এগিয়ে যাই। কিছু দূর গিয়ে আমরা থমকে গেলাম। একটু দূরেই ছনের বনে অগণিত চিত্রা হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি তারা টের পেল; কিন্তু পালাল না। হয়তো সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায়—সাহসও বেশি। ছনবনের পরেই ঘন বন। আমাদের সুন্দরবনের ডাঙার ৭০ শতাংশ ঘন গাছপালায় ছাওয়া। বাকি ৩০ শতাংশ ঘাসে আবৃত, চর এলাকা, সমুদ্রসৈকত, বালি ও কাদাময় প্রান্তর।
আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে আমরা আবার পাড়ের দিকে চলে এলাম। এখানে যখন নেমেছিলাম, তখন পানিতে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হয়েছিল পানিতে আগুন জ্বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে পানি তরল সোনায় পরিণত হয়েছে। যেন কেউ কোথাও নেই, আছে শুধু সূর্য ও তার জাদুর প্রতিবিম্ব। অন্ধকার বাড়ছে সূর্যও লাল হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে কিনা জানি না—সূর্য কিন্তু ডুবল না। পানিতে গা ডোবানোর আগেই নীরবে ধূসর আকাশে মিলিয়ে গেল। ঝপ করে নামল অন্ধকার। সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, খেয়ালই করিনি আমার পেছনে দুটো বন্য শূকর! আমার ভাগ্য ভালো তারা খাবারের খোঁজে ব্যস্ত ছিল। আমি ট্রলারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কী নিপুণভাবে নদী ও খাল পাড়ি দিচ্ছে নির্বিঘ্ন। কখনো গতি বাড়ছে, কখনো কমছে। কী রাত কী দিন—ভেসপার ভেসে চলেছে। আসলে তা চলে না—একজন তাকে চালায়। আর যিনি অবিরাম এটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি হলেন আবদুর রাজ্জাক। তৃতীয় তলার সামনের অংশে তাঁর অবস্থান। বয়স ত্রিশ। এই তরুণের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। ভেসপার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে আমাকে বললেন, তাঁকে কেউ বলে সারেং, কেউ বলে সুকানি, কেউ মাস্টার বলে। অনেকে নাকি ক্যাপ্টেন ও পাইলটও বলে।
শেষের লাইনটি বলে নিজেই হেসে ফেললেন রাজ্জাক। জানলাম, তিনি এখানে আছেন চার বছর ধরে। তার আগে কার্গো বোট চালাতেন, ঘুরতে হতো এক জেলা থেকে আরেক জেলা। তবে খুলনা এসে তিনি খুশি। জানতে চাইলাম, সুন্দরবন ভালো লাগে এ জন্য কাজটা করেন কিনা। উত্তর দিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া কিছু জানি না, তাই এটাই করি।’ রাজ্জাকদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিনি একাই। লঞ্চেই থাকা-খাওয়া। পর্যটন স্পট বন্ধ থাকলে অথবা ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফরিদপুরে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে ফেরা হয় না—দিনের পর দিন।
সুন্দরবনে এটিই শেষ রাত। তাই রাতের খাবারের মেনুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। মাছ ও মুরগির বারবিকিউ। কয়েকজন গান করলেন, নাচলেন—অনেক মজা হলো। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দূর থেকে রাতের সুন্দরবন দেখা হলো। সুন্দরবন দেবীর ঘুম যেন ভেঙে না যায়, সে জন্যই কি রাজ্জাক যতটা সম্ভব নীরবতা বজায় রেখে লঞ্চ চালাচ্ছেন? সুন্দরবনের রাত দেখে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘আবার আকাশে নক্ষত্র উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিচে অনন্ত সমুদ্র—মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম!’ যদিও এখন কুয়াশার কারণে খুব বেশি তারা আকাশে নেই। রাতের বাতাস বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে, লাউঞ্জে কেউ একজন গান ধরেছেন, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/ তোমায় আমি হলেম অচেনা...’ এই অচীন-অবর্ণনীয় নীরবতা কি মানুষের ভেতরের নীরবতাকেও উসকে দেয়? আর তখন পশুর নদীর মতোই কি ছলকে ওঠে সেই নীরবতা? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত একটার দিকে চাঁদপাই এলাকায় নোঙর ফেলল ভেসপার।
খুলনার দক্ষিণে দুবলার চরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে রূপসা নদী—যার একটি শাখা সমুদ্রে নেমেছে। অন্য শাখাটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী মংলা খালের সঙ্গে যুক্ত। এর পর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শিবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পশুর নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পশুর ভীষণ গভীর ও খরস্রোতা। সেই নদীকে আমি দুর্বল ভেবেছিলাম! সে জন্যই কিনা জানি না—আজ নিজের সক্ষমতা দেখাচ্ছে পশুর। সমুদ্রের মতো তার গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ, তীব্র তার স্রোত। তার আজ পশুর মতো বল। আচ্ছা নামটি পশুর কেন হলো? পশুর নামের গাছ থেকে? সুন্দরবনে প্রচুর পশুর গাছ জন্মে। বিভূতিভূষণ ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ নামের কিশোর উপন্যাসে এই পশুরকেই কি ভুলে ‘পশোর’ বলেছেন? নাকি মূল নাম পশোরই? পশোরের অর্থই-বা কী? যা হোক, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রলারে উঠে পড়লাম, গন্তব্য—করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র।
টালমাটাল অবস্থায় ট্রলার ১০ মিনিটের মধ্যেই বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে পৌঁছে গেল। কুমির দেখার জন্য জায়গাটি আদর্শ। বিভিন্ন চৌবাচ্চায় ছোট-বড় কুমির রয়েছে। একটি পুকুরে ‘রোমিও-জুলিয়েট’ নামে দুটি কুমিরের বসবাস। কেন্দ্রের লোকজন নাম ধরে ডাকলে সাঁতার কেটে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হয় তারা। এটি একটি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি চৌবাচ্চায় কয়েকটি কচ্ছপকে সাঁতার কেটে বেড়াতে দেখলাম। এই কেন্দ্রে যে প্রাণীগুলো সুখে-শান্তিতে নেই, তা বোঝা যায়। গোটা কেন্দ্রটিই শ্রীহীন, চৌবাচ্চার দেয়াল এবং খাঁচার লোহার জালগুলো ভাঙাচোরা, আর মানুষের উৎপাত তো রয়েছেই। বেলা ১১টার দিকে আমরা ফিরে এলাম।
বাঘ যে দেখা হলো না, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি বাঘ দেখতে আসিনি—এসেছি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হতে। পরিচয় বললাম, কারণ সুন্দরবনকে জানতে, বুঝতে মাসের পর মাস ব্যয় করলেও কম পড়তে পারে। আমরা গত দু-তিন দিনে বনদেবীর এক শতাংশও দর্শন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে যে সুন্দরবনের গল্প শুনছি, যার ছবি দেখি—তাকে সরাসরি একবার দেখার সাধ অন্তত মিটল। আমার এবারের প্রত্যাশা তাই ছিল। সুন্দরবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না হয় আবার আসব। দুপুরের দিকে আমরা ফিরে এলাম খুলনা সদরে।
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
৩ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
৩ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
৩ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
৩ দিন আগে