অলাত এহ্সান
বিজ্ঞাপনী বাণিজ্যের যুগে বইও প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। বইয়ের মান নির্ধারিত হচ্ছে মূলত বিক্রির সংখ্যা দিয়ে। লেখালেখির জগতে ‘জনপ্রিয় ধারা’ শব্দটি আগেও ছিল। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেস্ট সেলার, দু–চারটি সংস্করণের তকমার প্রবল প্রতাপ।
বহুল প্রচার, আর ফেসবুকে মুহুর্মুহু মুখ দেখানো তো আছেই। রয়েছে অনলাইন জরিপ, মুহূর্তেই যা বদলে দিতে পারে যেকোনো হিসাব। এমনকি লেখালেখি হয়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত সুবিধা আদায়ের মাধ্যম। এর ভেতর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী করে স্মরণ করা যায়?
গত শতাব্দীর ত্রিশ–চল্লিশের দশক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেমন, সাহিত্যের ইতিহাসেও তেমনি ঘটনাবহুল ও অবিস্মরণীয় কাল। বাংলা সাহিত্যেও এ কথা সমান সত্য। এ সময় বাংলা কবিতায় যেমন ‘আধুনিক’ ধারা সূচিত হয়, কথাসাহিত্যে তেমনি আবির্ভূত হয় ঈপ্সিত আধুনিকতা।
কবিতায় অনুবাদনির্ভর আধুনিকতার তুলনায় কথাসাহিত্য অনেক বেশি প্রাচুর্যময় ছিল। আসলে একই সময়ে কোনো একটি ভাষায় এতজন কর্মচঞ্চল ও শক্তিশালী লেখক-কবির উপস্থিতি বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশ্বস্বীকৃত ও বিপুল কর্মরাজীর মহাপুরুষ সচল থাকার পরও সে সময় রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিকতা বিস্তার লাভ করে।
বিশেষত তাঁর ভাব নির্ভরতার বিপরীতে মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বৈচিত্র্য এবং সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। আর এই ক্ষেত্রেই দক্ষতা দেখিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কাল। এর মধ্যে ৩৭টি উপন্যাস, দুই শতাধিক গল্প, কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন মানিক। এগুলো বিশ্বের যেকোনো সৃষ্টিবহুল লেখকের সমৃদ্ধ সম্ভারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তা ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর শতাধিক সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ কবিতা ও খসড়া পাওয়া যায়। অবশ্য এগুলো তাঁর যুবক বয়সেই (১৬–২১ বছর) রচিত। মৃত্যুর পরও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক অপ্রকাশিত সাহিত্য পাওয়া গেছে। তা ছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পত্রিকায় লিখতেন। যদিও লেখাগুলো পরে আর সংগ্রহ করা যায়নি। তাতেই ‘জীবনঘনিষ্ঠ কথাশিল্পী’ অভিধা তাঁর নামের সঙ্গে স্থায়ী হয়ে গেছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯০৮ সালের ১৯ মে, বঙ্গাব্দ ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৫। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মস্থল ভারতের সাঁওতাল পরগণার দুমকা শহরে তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকার তৎকালীন বিক্রমপুর মহকুমার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) মালদপিয়া গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁদের পরিবার দেশ ত্যাগ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি খুঁজে পাওয়া নিয়ে চমৎকার গল্প আছে প্রয়াত কথাশিল্পী কায়েস আহমেদের; নাম—‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালদপিয়ার রমণী মুখুজ্জে’। গল্পের কোথাও সাম্প্রদায়িকতার কথা নেই। তবু গল্পটা পড়লেই বোঝা যায় তাঁরা কেন দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
সাহিত্যের সূচনা বিচারে এ তথ্য সত্য যে, কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’ লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুরুতেই বাজিমাত। প্রথম গল্প গ্রন্থভুক্ত ‘মহাসংগম’ গল্পটি সম্পর্কে অধ্যাপক নির্মাল্য আচার্য বলেন, ‘এর তুল্য গল্প বিশ্বসাহিত্যে কদাচিৎ মিলবে।’ এই শুরুর গল্পটি ইঙ্গিত দেয়—সাহিত্যের জগতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলা হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল। সাধারণ্যে অন্তত এমন ধারণা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন হলো—সত্যি কি হঠাৎ করে লেখকের জন্ম হয়? এই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন মানিক। ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন—‘আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখক পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসলেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’
‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক মানিকের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩৪ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসটি সম্পর্কে আরেক অগ্রগণ্য ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য কিছু নন, তিনি ঔপন্যাসিক।’ পরের বছর ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। ১৯৩৫ সালে ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর গ্রন্থকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।
মনে রাখা দরকার, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক সাহিত্যের মতো ভারতবর্ষে রাজনীতিরও উত্থান–পতনের সময়। তখনই প্রকাশ হয় মানিকের প্রথম উপন্যাস। এর অন্তত একটি দিক তাঁর ‘নিজস্ব ধরন’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তা হলো, সমসাময়িক ইতিহাস ও সমাজের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যের নিবিড় যোগ। সমাজের তল খুঁজতে গিয়ে, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তাঁর রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছিল প্রায় অবধারিত। এর একটা উত্তর পাওয়া যাবে তাঁর ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে। তিনি লেখেন, ‘মার্কসবাদ যেটুকু বুঝেছি তাতেই আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে যে, আমার সৃষ্টিতে কত মিথ্যা, বিভ্রান্তি আর আবর্জনা আমি আমদানি করেছি– জীবন ও সাহিত্য এগিয়ে নেবার উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও।’
আজকের দিনে রাষ্ট্রের বিরাজনীতিকরণ প্রকল্প (বলা যায়, রাজনীতিহীনতার রাজনীতি) কিংবা রাজনীতিবিমুখ নৈনাগরিকের সময়ে দাঁড়িয়ে মানিকের এই উপলব্ধির অনুধাবন খানিকটা কঠিন। তবে অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, সেই সময় রাজনীতির ভেতরই মানুষের মুক্তির দিশা ছিল। তা ছিল মানবমুক্তি-সমাজ প্রগতির রাজনীতি। তাই রাজনৈতিক সংস্রব তাঁর সাহিত্যের মান কমিয়েছে, নিন্দুকের এমন প্রচার সত্য নয়। বরং তাঁর লেখনী এতটা উর্বর ছিল যে, সমসাময়িক বিষয়ের প্রতি সাবলীল সাড়া দিতে পেরেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর সাহিত্যে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষাতত্ত্ব ও মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা সফলভাবে যুক্ত হয়েছে। সাহিত্যে উঠে এসেছে সেসব মানুষের জীবন ও সংগ্রাম।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখক হিসেবে, সাহিত্যের প্রতি ‘সৎ’ থেকেই কমিউনিজমে আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক চর্চা তাঁর সাহিত্যকে দলীয় প্রচারপত্রে নামিয়ে আনেনি। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এ যুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে যুক্ত হন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। যুগপৎ লেখক ও রাজনীতিক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। তিনি পরবর্তীতে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’–এর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
মূলত শ্রমিক ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে দু–খণ্ডের ‘শহরতলি’ উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর সাড়া পড়ে। দাঙ্গার পটভূমিতে কলকাতার বেহাল নগরজীবন নিয়ে তাঁর প্রখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘স্বাধীনতার স্বাদ’। বাঙালি সমাজের হতাশা, গ্রামীণ জীবনের অবহেলা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অসারতা নিয়ে লেখেন শ্লেষাত্মক উপন্যাস ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’।
শব্দ নির্বাচন, উপমা ও ভাষাশৈলীর কারণে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। ‘ভিটেমাটি’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে রচিত ‘আজ কাল পরশুর গল্প’ গল্পগ্রন্থটি তাঁর বিপ্লবী চেতনার অনন্য দলিল। কোনো কোনো গল্পে তাঁর জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা ও মানসের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর অনেক উপন্যাস, গল্পই পরে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। জানিয়ে রাখা যেতে পারে, তাঁর জীবদ্দশাতেই ১৯৪৮ সালে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় এবং লেখক হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কারণে পরিবারের সঙ্গে বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এর কারণে দ্রুতই তাঁকে পেশাজীবন বেছে নিতে হয়। ১৯৩৫ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় পদে পাঁচ বছর যুক্ত থাকেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা ছেড়ে দিয়ে পরে ভাইয়ের সঙ্গে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যদিও আড়াই বছরের মাথায় তা গোটাতে হয়। পরে স্বল্পকালীন নানা পেশায় যুক্ত হলেও কোনোটাই আর স্থায়ী হয়নি। লেখক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই কেটেছে তাঁর আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাঁর এই জীবনযুদ্ধ আরও কঠিন হয়ে পড়ল। একদিকে অর্থ সংস্থানের জন্য প্রচুর পরিশ্রম, অন্যদিকে বিদ্যমান বাস্তবতায় পার্টির কাচের ক্রমবর্ধমান চাপ; সব মিলিয়ে মানিক এক ত্রিশঙ্কু দশায় পড়লেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দশা থেকে তাঁর মুক্তি মেলেনি। বলা যায়, চিকিৎসার অভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। দিনটি ছিল ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। বঙ্গাব্দ ১৭ অগ্রহায়ণ ১৩৬৩।
এমনকি এই মৃত্যুর খবরটি পর্যন্ত মানিকের পার্টি কমরেড ও লেখকদের কাছে পৌঁছানো যায়নি অর্থাভাবে। শুনতে যেমনই লাগুক এটাই সত্য। মানিকের মৃত্যুর খবর প্রথম পেয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি মানিকের স্ত্রী কমলার (ডলি) কাছে জানতে চান, তাঁকে কেন ফোন করে আগে জানানো হয়নি? কমলার উত্তর ছিল—‘তাতেও যে পাঁচ আনা লাগাত দাদা।’
এই বঙ্গে যে শুধু লিখে বাঁচা যায় না, তা কি সমাজঘনিষ্ঠ মানিক জানতেন না? জানতেন নিশ্চয়। তারপরও তিনি এই লেখালিখির জীবনই বেছে নিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আস্থাশীল মানিকের কলম–শ্রমিকের জীবন বেছে নেওয়া তো স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু শুধু এটুকুই কি? না, আরও কিছু তাড়না ছিল। কী সেই তাড়না? উত্তর জানতে মানিকেরই শরণ নেওয়া যাক। ‘লেখকের কথা ও প্রগতি সাহিত্যের আত্মকথা’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধ সংকলনে থাকা ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি, অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি, এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সম ভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।’
এবার ফেরা যাক শুরুর প্রসঙ্গে। এই সময়ে কেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা? এর উত্তর আছে ‘এই সময়’ শব্দের ভেতর। ‘এই সময়’ ও সাহিত্যকে আমরা কীভাবে দেখি, তার মীমাংসার ওপরই আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা ও তাঁর স্মরণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি দাঁড়িয়ে আছে। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ‘এই সময়’ প্রতিটি মানুষ প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতর বাস করেন। বাজার সংস্কৃতির প্রভাব, পুঁজির প্রবল চাপ, রাষ্ট্রের দুঃশাসন, বৈষম্যের ক্ষমতা চর্চা, প্রতিষ্ঠার ইঁদুর দৌড়, পণ্যের ভিড়ে বিপন্ন জীবনে স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই। সমাজের উচ্চকোটি থেকে নিম্নকোটির সবার ভেতর এই দ্বন্দ্ব আছে। ভেতরে-ভেতরে সবাই পুড়ে খাক হয়ে গেলেও প্রকাশ্যে শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে। মানুষের নির্বুদ্ধিতা, শঠতা, প্রতারণা, লোভে খোদ মানবতাই আজ বিপন্ন। যাদের সঙ্গে মিশছে, থাকছে, তাকেও মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারে না।
বিষয়টির চমৎকার তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘ধ্রুপদি যুগে উন্মাদনার ইতিহাস’ বইয়ে। বইটির আলোচনায় অমল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘উত্তর আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক’ বইতে বলছেন: ‘আমরা যাকে প্রাতিস্বিকতা বলতে অভ্যস্ত, যাকে আমরা ধরে নিই মানুষের অনড়, ধ্রুব চরিত্র বলে, সেটি মূলত কিছু সামাজিক ও নৈতিক বিধিনিষেধের প্রত্যাদেশে আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে, একজন সামাজিক প্রাণী তার নিজের কাছে বিদেশি ও বিচ্ছিন্ন।’
সেই পথ ধরে মিশেল ফুকো রীতিমতো ঘোষণা করেছেন, ‘আমাদের চিন্তার কাঠামো খুব সহজেই বলে দেয় যে, মানুষ সাম্প্রতিক সময়ের এক আবিষ্কার। আর যা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।’
এই বাস্তবতায় আমাদের তথাকথিত ‘বেস্ট সেলার’ সাহিত্যের লেখকেরা কী দিচ্ছেন? এই বাস্তবতা কি তাঁরা ধরতে পারছেন? মনে হয় না। এর কিছুই তাঁরা ব্যাখ্যা করার সাধ্য রাখেন না। তাঁরা বিদ্যমান বাস্তবতাকে উদ্যাপন করছেন। এই সাহিত্য আরও সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে চিন্তাকে। তা ছাড়া আমাদের সাহিত্য ঘুরপাক খাচ্ছে মধ্যবিত্তীয় সংকটে। যে কারণে গল্পের চরিত্রগুলো আবর্তিত হয় পলাতক ধরনের ফ্যান্টাসিতে। আর এখানেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব। তিনি এই ব্যবস্থা ও বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেন। সাহিত্যের কাজ যে নিছক আনন্দ দেওয়া নয়, বরং মনকে সমৃদ্ধ করা, চিন্তাকে জাগ্রত করা—সেই কাজ করে মানিকের সাহিত্য।
শেষটা হোক মানিকেরই ভাষ্যে। ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ভদ্র জীবনকে ভালোবাসি, ভদ্র আপনজনদেরই আপন হতে চাই, বন্ধুত্ব করি ভদ্র ঘরের ছেলেদের সঙ্গেই, এই জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে নিজস্ব করে রাখি, অথচ এই জীবনের সংকীর্ণতা, কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা, প্রকাশ্য ও মুখোশ পরা হীনতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। এই জীবন আমার আপন অথচ এই জীবন থেকেই মাঝে মাঝে পালিয়ে ছোটলোক চাষা-ভূষাদের মধ্যে গিয়ে যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচি। আবার ওই ছোটলোকদের অমার্জিত রিক্ত জীবনের রুক্ষ কঠোর নগ্ন বাস্তবতার চাপে অস্থির হয়ে নিজের জীবনে ফিরে এসে হাঁফ ছাড়ি।’
অলাত এহ্সান: গল্পকার ও সমালোচক
বিজ্ঞাপনী বাণিজ্যের যুগে বইও প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। বইয়ের মান নির্ধারিত হচ্ছে মূলত বিক্রির সংখ্যা দিয়ে। লেখালেখির জগতে ‘জনপ্রিয় ধারা’ শব্দটি আগেও ছিল। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেস্ট সেলার, দু–চারটি সংস্করণের তকমার প্রবল প্রতাপ।
বহুল প্রচার, আর ফেসবুকে মুহুর্মুহু মুখ দেখানো তো আছেই। রয়েছে অনলাইন জরিপ, মুহূর্তেই যা বদলে দিতে পারে যেকোনো হিসাব। এমনকি লেখালেখি হয়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত সুবিধা আদায়ের মাধ্যম। এর ভেতর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী করে স্মরণ করা যায়?
গত শতাব্দীর ত্রিশ–চল্লিশের দশক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেমন, সাহিত্যের ইতিহাসেও তেমনি ঘটনাবহুল ও অবিস্মরণীয় কাল। বাংলা সাহিত্যেও এ কথা সমান সত্য। এ সময় বাংলা কবিতায় যেমন ‘আধুনিক’ ধারা সূচিত হয়, কথাসাহিত্যে তেমনি আবির্ভূত হয় ঈপ্সিত আধুনিকতা।
কবিতায় অনুবাদনির্ভর আধুনিকতার তুলনায় কথাসাহিত্য অনেক বেশি প্রাচুর্যময় ছিল। আসলে একই সময়ে কোনো একটি ভাষায় এতজন কর্মচঞ্চল ও শক্তিশালী লেখক-কবির উপস্থিতি বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশ্বস্বীকৃত ও বিপুল কর্মরাজীর মহাপুরুষ সচল থাকার পরও সে সময় রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিকতা বিস্তার লাভ করে।
বিশেষত তাঁর ভাব নির্ভরতার বিপরীতে মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বৈচিত্র্য এবং সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। আর এই ক্ষেত্রেই দক্ষতা দেখিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কাল। এর মধ্যে ৩৭টি উপন্যাস, দুই শতাধিক গল্প, কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন মানিক। এগুলো বিশ্বের যেকোনো সৃষ্টিবহুল লেখকের সমৃদ্ধ সম্ভারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তা ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর শতাধিক সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ কবিতা ও খসড়া পাওয়া যায়। অবশ্য এগুলো তাঁর যুবক বয়সেই (১৬–২১ বছর) রচিত। মৃত্যুর পরও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক অপ্রকাশিত সাহিত্য পাওয়া গেছে। তা ছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পত্রিকায় লিখতেন। যদিও লেখাগুলো পরে আর সংগ্রহ করা যায়নি। তাতেই ‘জীবনঘনিষ্ঠ কথাশিল্পী’ অভিধা তাঁর নামের সঙ্গে স্থায়ী হয়ে গেছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯০৮ সালের ১৯ মে, বঙ্গাব্দ ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৫। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মস্থল ভারতের সাঁওতাল পরগণার দুমকা শহরে তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকার তৎকালীন বিক্রমপুর মহকুমার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) মালদপিয়া গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁদের পরিবার দেশ ত্যাগ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি খুঁজে পাওয়া নিয়ে চমৎকার গল্প আছে প্রয়াত কথাশিল্পী কায়েস আহমেদের; নাম—‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালদপিয়ার রমণী মুখুজ্জে’। গল্পের কোথাও সাম্প্রদায়িকতার কথা নেই। তবু গল্পটা পড়লেই বোঝা যায় তাঁরা কেন দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
সাহিত্যের সূচনা বিচারে এ তথ্য সত্য যে, কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’ লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুরুতেই বাজিমাত। প্রথম গল্প গ্রন্থভুক্ত ‘মহাসংগম’ গল্পটি সম্পর্কে অধ্যাপক নির্মাল্য আচার্য বলেন, ‘এর তুল্য গল্প বিশ্বসাহিত্যে কদাচিৎ মিলবে।’ এই শুরুর গল্পটি ইঙ্গিত দেয়—সাহিত্যের জগতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলা হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল। সাধারণ্যে অন্তত এমন ধারণা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন হলো—সত্যি কি হঠাৎ করে লেখকের জন্ম হয়? এই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন মানিক। ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন—‘আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখক পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসলেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’
‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক মানিকের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩৪ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসটি সম্পর্কে আরেক অগ্রগণ্য ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য কিছু নন, তিনি ঔপন্যাসিক।’ পরের বছর ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। ১৯৩৫ সালে ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর গ্রন্থকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।
মনে রাখা দরকার, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক সাহিত্যের মতো ভারতবর্ষে রাজনীতিরও উত্থান–পতনের সময়। তখনই প্রকাশ হয় মানিকের প্রথম উপন্যাস। এর অন্তত একটি দিক তাঁর ‘নিজস্ব ধরন’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তা হলো, সমসাময়িক ইতিহাস ও সমাজের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যের নিবিড় যোগ। সমাজের তল খুঁজতে গিয়ে, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তাঁর রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছিল প্রায় অবধারিত। এর একটা উত্তর পাওয়া যাবে তাঁর ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে। তিনি লেখেন, ‘মার্কসবাদ যেটুকু বুঝেছি তাতেই আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে যে, আমার সৃষ্টিতে কত মিথ্যা, বিভ্রান্তি আর আবর্জনা আমি আমদানি করেছি– জীবন ও সাহিত্য এগিয়ে নেবার উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও।’
আজকের দিনে রাষ্ট্রের বিরাজনীতিকরণ প্রকল্প (বলা যায়, রাজনীতিহীনতার রাজনীতি) কিংবা রাজনীতিবিমুখ নৈনাগরিকের সময়ে দাঁড়িয়ে মানিকের এই উপলব্ধির অনুধাবন খানিকটা কঠিন। তবে অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, সেই সময় রাজনীতির ভেতরই মানুষের মুক্তির দিশা ছিল। তা ছিল মানবমুক্তি-সমাজ প্রগতির রাজনীতি। তাই রাজনৈতিক সংস্রব তাঁর সাহিত্যের মান কমিয়েছে, নিন্দুকের এমন প্রচার সত্য নয়। বরং তাঁর লেখনী এতটা উর্বর ছিল যে, সমসাময়িক বিষয়ের প্রতি সাবলীল সাড়া দিতে পেরেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর সাহিত্যে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষাতত্ত্ব ও মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা সফলভাবে যুক্ত হয়েছে। সাহিত্যে উঠে এসেছে সেসব মানুষের জীবন ও সংগ্রাম।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখক হিসেবে, সাহিত্যের প্রতি ‘সৎ’ থেকেই কমিউনিজমে আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক চর্চা তাঁর সাহিত্যকে দলীয় প্রচারপত্রে নামিয়ে আনেনি। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এ যুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে যুক্ত হন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। যুগপৎ লেখক ও রাজনীতিক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। তিনি পরবর্তীতে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’–এর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
মূলত শ্রমিক ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে দু–খণ্ডের ‘শহরতলি’ উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর সাড়া পড়ে। দাঙ্গার পটভূমিতে কলকাতার বেহাল নগরজীবন নিয়ে তাঁর প্রখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘স্বাধীনতার স্বাদ’। বাঙালি সমাজের হতাশা, গ্রামীণ জীবনের অবহেলা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অসারতা নিয়ে লেখেন শ্লেষাত্মক উপন্যাস ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’।
শব্দ নির্বাচন, উপমা ও ভাষাশৈলীর কারণে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। ‘ভিটেমাটি’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে রচিত ‘আজ কাল পরশুর গল্প’ গল্পগ্রন্থটি তাঁর বিপ্লবী চেতনার অনন্য দলিল। কোনো কোনো গল্পে তাঁর জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা ও মানসের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর অনেক উপন্যাস, গল্পই পরে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। জানিয়ে রাখা যেতে পারে, তাঁর জীবদ্দশাতেই ১৯৪৮ সালে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় এবং লেখক হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কারণে পরিবারের সঙ্গে বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এর কারণে দ্রুতই তাঁকে পেশাজীবন বেছে নিতে হয়। ১৯৩৫ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় পদে পাঁচ বছর যুক্ত থাকেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা ছেড়ে দিয়ে পরে ভাইয়ের সঙ্গে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যদিও আড়াই বছরের মাথায় তা গোটাতে হয়। পরে স্বল্পকালীন নানা পেশায় যুক্ত হলেও কোনোটাই আর স্থায়ী হয়নি। লেখক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই কেটেছে তাঁর আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাঁর এই জীবনযুদ্ধ আরও কঠিন হয়ে পড়ল। একদিকে অর্থ সংস্থানের জন্য প্রচুর পরিশ্রম, অন্যদিকে বিদ্যমান বাস্তবতায় পার্টির কাচের ক্রমবর্ধমান চাপ; সব মিলিয়ে মানিক এক ত্রিশঙ্কু দশায় পড়লেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দশা থেকে তাঁর মুক্তি মেলেনি। বলা যায়, চিকিৎসার অভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। দিনটি ছিল ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। বঙ্গাব্দ ১৭ অগ্রহায়ণ ১৩৬৩।
এমনকি এই মৃত্যুর খবরটি পর্যন্ত মানিকের পার্টি কমরেড ও লেখকদের কাছে পৌঁছানো যায়নি অর্থাভাবে। শুনতে যেমনই লাগুক এটাই সত্য। মানিকের মৃত্যুর খবর প্রথম পেয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি মানিকের স্ত্রী কমলার (ডলি) কাছে জানতে চান, তাঁকে কেন ফোন করে আগে জানানো হয়নি? কমলার উত্তর ছিল—‘তাতেও যে পাঁচ আনা লাগাত দাদা।’
এই বঙ্গে যে শুধু লিখে বাঁচা যায় না, তা কি সমাজঘনিষ্ঠ মানিক জানতেন না? জানতেন নিশ্চয়। তারপরও তিনি এই লেখালিখির জীবনই বেছে নিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আস্থাশীল মানিকের কলম–শ্রমিকের জীবন বেছে নেওয়া তো স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু শুধু এটুকুই কি? না, আরও কিছু তাড়না ছিল। কী সেই তাড়না? উত্তর জানতে মানিকেরই শরণ নেওয়া যাক। ‘লেখকের কথা ও প্রগতি সাহিত্যের আত্মকথা’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধ সংকলনে থাকা ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি, অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি, এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সম ভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।’
এবার ফেরা যাক শুরুর প্রসঙ্গে। এই সময়ে কেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা? এর উত্তর আছে ‘এই সময়’ শব্দের ভেতর। ‘এই সময়’ ও সাহিত্যকে আমরা কীভাবে দেখি, তার মীমাংসার ওপরই আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা ও তাঁর স্মরণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি দাঁড়িয়ে আছে। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ‘এই সময়’ প্রতিটি মানুষ প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতর বাস করেন। বাজার সংস্কৃতির প্রভাব, পুঁজির প্রবল চাপ, রাষ্ট্রের দুঃশাসন, বৈষম্যের ক্ষমতা চর্চা, প্রতিষ্ঠার ইঁদুর দৌড়, পণ্যের ভিড়ে বিপন্ন জীবনে স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই। সমাজের উচ্চকোটি থেকে নিম্নকোটির সবার ভেতর এই দ্বন্দ্ব আছে। ভেতরে-ভেতরে সবাই পুড়ে খাক হয়ে গেলেও প্রকাশ্যে শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে। মানুষের নির্বুদ্ধিতা, শঠতা, প্রতারণা, লোভে খোদ মানবতাই আজ বিপন্ন। যাদের সঙ্গে মিশছে, থাকছে, তাকেও মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারে না।
বিষয়টির চমৎকার তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘ধ্রুপদি যুগে উন্মাদনার ইতিহাস’ বইয়ে। বইটির আলোচনায় অমল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘উত্তর আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক’ বইতে বলছেন: ‘আমরা যাকে প্রাতিস্বিকতা বলতে অভ্যস্ত, যাকে আমরা ধরে নিই মানুষের অনড়, ধ্রুব চরিত্র বলে, সেটি মূলত কিছু সামাজিক ও নৈতিক বিধিনিষেধের প্রত্যাদেশে আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে, একজন সামাজিক প্রাণী তার নিজের কাছে বিদেশি ও বিচ্ছিন্ন।’
সেই পথ ধরে মিশেল ফুকো রীতিমতো ঘোষণা করেছেন, ‘আমাদের চিন্তার কাঠামো খুব সহজেই বলে দেয় যে, মানুষ সাম্প্রতিক সময়ের এক আবিষ্কার। আর যা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।’
এই বাস্তবতায় আমাদের তথাকথিত ‘বেস্ট সেলার’ সাহিত্যের লেখকেরা কী দিচ্ছেন? এই বাস্তবতা কি তাঁরা ধরতে পারছেন? মনে হয় না। এর কিছুই তাঁরা ব্যাখ্যা করার সাধ্য রাখেন না। তাঁরা বিদ্যমান বাস্তবতাকে উদ্যাপন করছেন। এই সাহিত্য আরও সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে চিন্তাকে। তা ছাড়া আমাদের সাহিত্য ঘুরপাক খাচ্ছে মধ্যবিত্তীয় সংকটে। যে কারণে গল্পের চরিত্রগুলো আবর্তিত হয় পলাতক ধরনের ফ্যান্টাসিতে। আর এখানেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব। তিনি এই ব্যবস্থা ও বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেন। সাহিত্যের কাজ যে নিছক আনন্দ দেওয়া নয়, বরং মনকে সমৃদ্ধ করা, চিন্তাকে জাগ্রত করা—সেই কাজ করে মানিকের সাহিত্য।
শেষটা হোক মানিকেরই ভাষ্যে। ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ভদ্র জীবনকে ভালোবাসি, ভদ্র আপনজনদেরই আপন হতে চাই, বন্ধুত্ব করি ভদ্র ঘরের ছেলেদের সঙ্গেই, এই জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে নিজস্ব করে রাখি, অথচ এই জীবনের সংকীর্ণতা, কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা, প্রকাশ্য ও মুখোশ পরা হীনতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। এই জীবন আমার আপন অথচ এই জীবন থেকেই মাঝে মাঝে পালিয়ে ছোটলোক চাষা-ভূষাদের মধ্যে গিয়ে যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচি। আবার ওই ছোটলোকদের অমার্জিত রিক্ত জীবনের রুক্ষ কঠোর নগ্ন বাস্তবতার চাপে অস্থির হয়ে নিজের জীবনে ফিরে এসে হাঁফ ছাড়ি।’
অলাত এহ্সান: গল্পকার ও সমালোচক
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
৩ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
৩ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
৩ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
৩ দিন আগে