ভাইভা বিসিএস যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মাধ্যমে ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে একজন প্রার্থীকে ২০০ নম্বরে মূল্যায়ন করা হয়। বিগত বিসিএসের নম্বরপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভাইভা কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার প্রাপ্তিতে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে কাজ করে। ভাইভায় উত্তর করার কৌশল নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন সাইফুল ইসলাম স্বপ্নীল।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেছিলেন, প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় প্রার্থীর জ্ঞান যাচাই করা হয়। যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেছেন, তাঁরাই ভাইভায় ভালো করবেন, বিষয়টি এমন নয়! ভাইভার মাধ্যমে প্রার্থীর কথা বলার ধরন, অ্যাটিটিউড, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, উপস্থাপনা, গেটআপ ইত্যাদিও দেখা হয়। কোনো প্রশ্নের উত্তর না পারলে তিনি কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন, তাঁর আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব কেমন, সেগুলো এ পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হয়।
ভাইভা বোর্ডের সদস্য কারা
পিএসসির বিজ্ঞ চেয়ারম্যান ও বিজ্ঞ সদস্যরা প্রত্যেকে বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ ছাড়া সরকারের যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা একজন সদস্য এবং বিষয়ভিত্তিক একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য থাকেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
সদ্য তোলা ৬ কপি পাসপোর্ট সাইজের সত্যায়িত ছবি। ভাইভা কার্ড, বিপিএসসি ফর্ম-১, বিপিএসসি ফর্ম-৩, অ্যাডমিট কার্ড, অ্যাপ্লিকেন্ট কপি, এনআইডি কার্ড বা জন্মনিবন্ধনের সত্যায়িত কপি, নাগরিকত্ব বা জাতীয়তা সনদ, অন্য চাকরিতে নিযুক্ত থাকলে এনওসি বা বিভাগীয় ছাড়পত্র। প্রতিটির অন্তত চার কপি রাখতে হবে।
তথ্যগত, মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি
প্রায় সব বোর্ডেই কমন কিছু প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। যেমন Introduce yourself, Academic Background, Why First Choice... etc—এগুলো আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে গেলে সুন্দরভাবে বলতে পারবেন। আপনি কটি প্রশ্ন পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনি উত্তরগুলো কীভাবে দিচ্ছেন। বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নে বুঝেশুনে উত্তর দিতে হবে।
- পছন্দক্রমের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাডার সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানুন। এ ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকা, উইকিপিডিয়া বা ভালো ভাইভা গাইডের পাশাপাশি ক্যাডারসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের সহায়তা নিতে পারেন।
- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক আলোচিত প্রতিটি ইস্যু সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখুন। আর সে জন্য প্রতিদিন কয়েকটি পত্রপত্রিকা, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, কারেন্ট নিউজ ইত্যাদি পড়ুন। বিবিসি বাংলা, ডয়চে ভেলেসহ ফেসবুক, ইউটিউবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেলে চোখ রাখুন।
- বিগত বিসিএসের গ্রুপে অনেক পরীক্ষার্থী ভাইভা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন, যেটি গ্রুপগুলোতে এখনো আছে। প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করে ধারণা নিন আপনার নিজের প্রথম পছন্দ, যাঁদের প্রথম পছন্দ ছিল তাদের কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছে। কোন বোর্ডে কোন ধরনের প্রশ্ন করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কেও ধারণা পাবেন এসব প্রশ্ন দেখে। সেভাবে প্রস্তুতি নিন।
- ভাইভা শুরু হলে প্রতিদিনই অনেকে ভাইভার প্রশ্ন গ্রুপে শেয়ার করবেন। সেসব প্রশ্ন সংগ্রহে রাখুন এবং যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনার জানা থাকবে না, সে উত্তরগুলো সে দিনই শিখে নিন।
- ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অত্যন্ত ভালোভাবে খুঁটিনাটি প্রস্তুতি নিয়ে ভাইভা বোর্ডে যাবেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ খুব ভালোভাবে পড়ুন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দু-একটি উপন্যাস পড়ে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’, ‘১৯৭১’, ‘দুই সৈনিক’ কিংবা ‘নিষিদ্ধ লোবান’-এর মতো কোনো বই পড়তে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাজারে ভালো ভাইভা গাইড আছে, সেখান থেকেও প্রস্তুতি নিন।
- মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আমার বন্ধুরা রাশেদ, গেরিলা, অনিল বাগচীর একদিন, ওরা ১১ জনসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র দেখতে পারেন। আপনার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, বধ্যভূমি, রাজাকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যাবেন। এ ছাড়া বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বাহিনী, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি, ১৫ আগস্ট, ছয় দফা, ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে যাবেন।
- জেলা তথ্যবাতায়ন থেকে নিজ জেলা, বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যাওয়া উচিত।
- লিখিত পরীক্ষার জন্য সংবিধানের যেসব ধারা পড়েছেন তার সঙ্গে আপনার পছন্দের ক্যাডারসংশ্লিষ্ট ধারা জানতে হবে। পাশাপাশি সংবিধানের প্রস্তাবনা, তফসিল, সর্বশেষ অনুচ্ছেদ, সবগুলো সংশোধনী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখুন।
- বর্তমান সরকারের সাফল্য, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ জেনে নিন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়, আপনার সুপারিশ বা পরামর্শ। ব্লু ইকোনমির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ।
- আপনি যে বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করেছেন সে বিষয়ের মৌলিক তো বটেই, সম্ভব হলে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে ভালো ধারণা রাখুন।
- জেনারেল বা উভয় ক্যাডারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বোর্ডেই ইংরেজিতে ভাইভা নেওয়া হয়, কিংবা কিছু প্রশ্ন অন্তত ইংরেজিতে করা হয়। পররাষ্ট্র যাঁদের প্রথম পছন্দ তাঁদের মোটামুটি সবাইকেই ইংরেজিতে ভাইভা দিতে হবে। আর ইংরেজিতে কথা বলার জন্য নিয়মিত অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা ফ্রেন্ড/রুমমেট/ভাইবোন বা যেকারও সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলুন। প্রয়োজনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনুশীলন করুন। ভাইভায় যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন, সেসব টপিক নিয়ে গ্রুপ স্টাডি করুন। এ ছাড়া ভাইভা প্রস্তুতির জন্য বন্ধুবান্ধব মিলে বা কোনো কোচিং সেন্টারে মক ভাইভা দিতে পারেন।
ড্রেসআপ ও গেটআপ
পুরুষেরা অবশ্যই ফরমাল হয়ে যাবেন। হালকা রঙের (সাদা/ আকাশি/এককালার) ফুলহাতা শার্ট, কালো/নেভি ব্লু প্যান্ট, টাই, ফরমাল জুতা (ফিতাওয়ালা), জুতার কালারের সঙ্গে মিলিয়ে বেল্ট। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্লেজার পরতে পারেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ যেটা মানানসই এবং পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে শাড়িই মূলত অফিশিয়াল পোশাক। পুরুষদের ক্ষেত্রে দাঁড়ি যদি সুন্নতি দাঁড়ি হয় কোনো সমস্যা নেই, না হয় ক্লিন শেভ বাঞ্ছনীয়। ভালোভাবে আয়রন করা পোশাক পরবেন, ফুলহাতা শার্ট এবং টাই পরলে বেল্টের হালকা ওপর পর্যন্ত রাখবেন। স্যুট পরলে স্যুটের হাতার বাইরে শার্টের হাতা দেখা যাবে। মেয়েরা অতিরিক্ত অলংকার পরবেন না, বেশি মেকআপের প্রয়োজন নেই।
সতর্কতা
কোনো প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে আমতা-আমতা বা আগে জানতাম স্যার, ভুলে গেছি স্যার—এসব না বলে সরাসরি বলুন স্যার আমার জানা নেই অথবা আমার জানা উচিত ছিল। ভুল কিংবা অনুমাননির্ভর তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কোনো ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। বেশি পাণ্ডিত্য জাহির করতে যাবেন না। কোনোভাবেই বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে তর্কে জড়ানো যাবে না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা যাবে না; কিংবা প্রশ্নের উত্তর মনে করতে গিয়ে বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না। আঞ্চলিকতা পরিহার ও শব্দচয়নে সাবধান থাকুন। রাজনৈতিক দর্শন প্রকাশ করা যাবে না। অতি সৌজন্যবোধ ও মাত্রাতিরিক্ত কনফিডেন্স হিতে বিপরীত হতে পারে। উত্তর দিতে গিয়ে চতুরতা কিংবা তাড়াহুড়া এড়িয়ে চলুন। ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থীরভাবে উত্তর দিন।
লেখক: ৪০তম বিসিএস,প্রভাষক, সরকারি হাজী আব্দুল বাতেন কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম।