সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ভোট ছাড়া কোনো প্রার্থী যে জিতেছেন, এমনটা কেউ বলতে পারবেন না; সবাই বিপুলসংখ্যক ভোট পেয়ে জিতেছেন, তবে ভোট দিতে ভোটারদের দিনের আলোয় ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, তাঁদের পরিশ্রম লাঘব করতে প্রশাসনের লোকেরা আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনের প্রধান পর্যন্ত একটি বেফাঁস মন্তব্যে ঘটনার সত্যতা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা একটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রীতি বটে; কিন্তু মাছের সাইজ যদি বেখাপ্পা রকমের বড় হয়, তবে বেচারা শাকদের অসুবিধা ঘটে, মাছের সর্বাংশ ঢেকে রাখতে তারা ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছিল।
বাংলাদেশের বড় মাপের মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র আঁধার রাতের ওই নির্বাচন যে মেনে নেয়নি তা নয়, মেনে নিয়েছিল। কারণ মেনে না নিলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা, কিন্তু তবু তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও নিজেদের বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল্যায়নে বিরূপ মন্তব্য না করে পারেনি। মন্তব্যটা এ রকমের, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ গত ডিসেম্বর মাসে অকল্পনীয় একপেশে সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য টানা তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়েছে। ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু বিবেচিত হয়নি। বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, জাল ভোট প্রদানসহ অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনের আগে প্রচারণার সময় হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও সহিংসতার কারণে বিরোধী অনেক প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের মিছিল-সমাবেশ ও স্বাধীনভাবে প্রচারণা কঠিন হয়ে পড়ার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।’ এসব পর্যবেক্ষণ মার্কিন সরকারের, তবে দেশের ভেতর থেকে আমরা যাঁরা নির্বাচনের গোটা প্রক্রিয়া দেখেছি এবং অনুভব করেছি, তাদের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ও প্রসারিত এবং অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে এ তথ্যও দেওয়া ছিল, ‘আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের তাদের পর্যবেক্ষণ মিশন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ “অ্যাক্রিডিশন” (অনুমতিপত্র) ও ভিসা দেয়নি।’ বলা হয়েছিল, ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ২২টি এনজিওর মধ্যে মাত্র ৭টিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।’ এটা তো মিথ্যা নয়, সারা বিশ্বের একটি দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নজির কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এযাবৎ প্রমাণ করতে পারেনি। মার্কিনিদের নিজেদের দেশে মানবাধিকার দুর্দশা যা-ই হোক না কেন, অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে রাষ্ট্রটি বেশ সরব থাকে; আমাদের ব্যাপারেও বিলক্ষণ সচেতন দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তার একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকায় উল্লেখ রয়েছে: ‘বেআইনি বা বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন, সরকার বা তার পক্ষে বেআইনি বা পরোয়ানা ছাড়া আটক, কঠোর ও জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ কারাগার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বন্দী, ব্যক্তিগত বিষয়ে বেআইনি হস্তক্ষেপ, সেন্সরশিপ, সাইট ব্লক ও আপত্তিকর বিবৃতি এবং এনজিও কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠন করার অধিকারের ওপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিধিনিষেধ, স্বাধীনভাবে চলাফেরার ওপর উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ, অবাধ ও সুষ্ঠু এবং প্রকৃত নির্বাচন না হওয়া, দুর্নীতি ও মানব পাচার।’ তালিকাটা ছোট নয়। তালিকা এখানেই শেষ ছিল না, দেখা যাচ্ছে, এ তথ্যও রয়েছে যা বাংলাদেশে বলবৎ আছে, ‘স্বতন্ত্র শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিকদের ওপর বিধিনিষেধ ও ভয়ংকর মাত্রায় শিশুশ্রম।’ কৃষকের মানবাধিকার কোন দশায় আছে তার উল্লেখ অবশ্য নেই, দলবদ্ধধর্ষণ ও শিশুধর্ষণ বাদ পড়েছে, বোধ করি ধরে নিয়েছে এসব তো আছেই, চলবেই। ভাবছে বোধ করি যে উল্লেখ করাটা অপ্রাসঙ্গিক।
আমেরিকার ওই পর্যবেক্ষণ-প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাও চলে এসেছে। বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তা বাহিনী যেসব নিপীড়নমূলক কাজ করে, সেগুলোর জন্য দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ আবার এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে দায়ের করা মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে এবং আরও অনেক বিরোধী রাজনীতিকের নামে মামলা রয়েছে। প্রতিবেদনের মতে, নির্বাচনের আগে পুলিশ নাকি প্রায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার বিএনপির সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল। শুধু বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে অন্তত ৮৬টি মামলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, তদন্তকারীরা বলেছেন, ‘মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা এসব মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গও বাদ যায়নি। বলা হয়েছে, ‘সরকারের সমালোচনাকারী গণমাধ্যমগুলো নেতিবাচক চাপের মধ্যে রয়েছে।
তারা বিজ্ঞাপন হারিয়েছে’ এবং ‘এ কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় সেন্সরশিপ আরোপ করেছেন। সরকার টেলিভিশনগুলোর সম্পাদকীয় নীতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।’ প্রতিবেদনপ্রণেতারা অবশ্য এটা খেয়াল করেননি যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে গণমাধ্যমের প্রায় সবটাই এখন সরকার-সমর্থক। তাদের মালিকেরা হয় ব্যবসায়ী, নয়তো সরকারি দলের লোক, কেউ কেউ আবার দুটোই।
আমাদের শাসনকর্তারা বলবেন, বলছেনও যে এই সব মন্তব্য যারা করে, তাদের চোখ দুটো ঘোলা, যে জন্য আমাদের উন্নতি ওদের চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে উন্নতি যে হচ্ছে সেটা কি পুঁজিবাদী বিশ্ব অস্বীকার করে? মোটেই না। উন্নতির তারা প্রশংসা করে, মাঝেমধ্যে এমনকি সানন্দে পিঠ চাপড়ে পর্যন্ত দেয়। এই উন্নতিতে তারা বাংলাদেশের সহযোগী ও পরামর্শদাতা; কিন্তু নিজেদের দেশের জনগণকে তারা এটা জানাতে চায় যে তারা সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে প্রহরারত, তাই কোন দেশে কতটা গণতন্ত্র বিচ্যুতি ঘটছে, সেটা বিশ্ববাসীকে তারা জানাবেই, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না। তা ছাড়া উন্নতিকামী দেশগুলোতে যদি পুঁজিবাদী ঘরানার গণতন্ত্রও না থাকে, তাহলে ওই সব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না এবং এমন অঘটনও ঘটতে পারে যে সেখানকার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা হয়তো বিপ্লব-টিপ্লবই ঘটিয়ে ছাড়বে।
তা আমেরিকানরা যে উদ্দেশ্যেই তদন্ত চালাক, তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যেসব তথ্য ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলোর যথার্থতা বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে কি? আর এই প্রতিবেদন যেহেতু বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো একটি মিত্র দেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র যে বানানো কথা বলবে না, এটাও যেহেতু স্বীকৃত সত্য, প্রতিবেদনটি প্রকাশের ফলে তাই বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উজ্জ্বলতা কতটা বৃদ্ধি পেল তা অনুমান করা মোটেই দুঃসাধ্য নয়। একাত্তরের যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা দেশবাসীর জন্য যে সম্মান বয়ে এনেছিল তা ক্রমাগত মলিন হয়েছে এবং এখন বাংলাদেশ কোন সম্মানের আসনে রয়েছে, এর একটা ছবি ওই প্রতিবেদনে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেদনটি সবাই হয়তো পড়েছেন, তবু এটি উদ্ধৃত করলাম চলমান ইতিহাসকে স্মরণে রাখার জন্য; ইতিহাস তো কেবল অতীতে নেই, রয়েছে বর্তমানেও। তদুপরি বালুতে মুখ লুকিয়ে রেখে ঝড় বইছে না—এ রকমের ধারণা করাটা উটপাখির জন্য শোভনীয় হলেও মানুষের জন্য নিশ্চয়ই অশোভনীয়।
প্রতিবেদনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। আসতেই হবে। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে তা সেই ত্রুটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি আঘাত করে, আঘাত করে তাকে দুর্বল করে দেয়। সরকারের জবাবদিহির দায় সংকুচিত হয়ে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, জনজীবনে হতাশা ও পরাজিতের মনোভাব দেখা দেয়। যুদ্ধ করে বাংলাদেশের যে মানুষেরা সব ধরনের মারণাস্ত্রে সজ্জিত ও সর্বাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১ লাখ হানাদারের এক বাহিনীকে হাঁকিয়ে দিলেন, যুদ্ধ শেষে নিজের দেশে তাঁরা যদি নিজেদের শাসকদের কাছে হেরে গেছেন বলে ধরে নেন, তবে তাঁদের পক্ষে দারিদ্র্যের, পরিবেশের ও বিশ্বব্যবস্থার বৈরিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব হবে—এমন ভরসা থাকে কি? একটির পর আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের পরাজয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে। আর নদীর পানিতে যদি দূষণ দেখা দেয়, তবে তার শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে না পড়ে পারে না। গত জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব অন্য সব নির্বাচনেও গিয়ে পড়েছিল বৈকি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ভোট ছাড়া কোনো প্রার্থী যে জিতেছেন, এমনটা কেউ বলতে পারবেন না; সবাই বিপুলসংখ্যক ভোট পেয়ে জিতেছেন, তবে ভোট দিতে ভোটারদের দিনের আলোয় ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, তাঁদের পরিশ্রম লাঘব করতে প্রশাসনের লোকেরা আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনের প্রধান পর্যন্ত একটি বেফাঁস মন্তব্যে ঘটনার সত্যতা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা একটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রীতি বটে; কিন্তু মাছের সাইজ যদি বেখাপ্পা রকমের বড় হয়, তবে বেচারা শাকদের অসুবিধা ঘটে, মাছের সর্বাংশ ঢেকে রাখতে তারা ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছিল।
বাংলাদেশের বড় মাপের মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র আঁধার রাতের ওই নির্বাচন যে মেনে নেয়নি তা নয়, মেনে নিয়েছিল। কারণ মেনে না নিলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা, কিন্তু তবু তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও নিজেদের বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল্যায়নে বিরূপ মন্তব্য না করে পারেনি। মন্তব্যটা এ রকমের, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ গত ডিসেম্বর মাসে অকল্পনীয় একপেশে সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য টানা তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়েছে। ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু বিবেচিত হয়নি। বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, জাল ভোট প্রদানসহ অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনের আগে প্রচারণার সময় হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও সহিংসতার কারণে বিরোধী অনেক প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের মিছিল-সমাবেশ ও স্বাধীনভাবে প্রচারণা কঠিন হয়ে পড়ার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।’ এসব পর্যবেক্ষণ মার্কিন সরকারের, তবে দেশের ভেতর থেকে আমরা যাঁরা নির্বাচনের গোটা প্রক্রিয়া দেখেছি এবং অনুভব করেছি, তাদের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ও প্রসারিত এবং অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে এ তথ্যও দেওয়া ছিল, ‘আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের তাদের পর্যবেক্ষণ মিশন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ “অ্যাক্রিডিশন” (অনুমতিপত্র) ও ভিসা দেয়নি।’ বলা হয়েছিল, ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ২২টি এনজিওর মধ্যে মাত্র ৭টিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।’ এটা তো মিথ্যা নয়, সারা বিশ্বের একটি দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নজির কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এযাবৎ প্রমাণ করতে পারেনি। মার্কিনিদের নিজেদের দেশে মানবাধিকার দুর্দশা যা-ই হোক না কেন, অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে রাষ্ট্রটি বেশ সরব থাকে; আমাদের ব্যাপারেও বিলক্ষণ সচেতন দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তার একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকায় উল্লেখ রয়েছে: ‘বেআইনি বা বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন, সরকার বা তার পক্ষে বেআইনি বা পরোয়ানা ছাড়া আটক, কঠোর ও জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ কারাগার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বন্দী, ব্যক্তিগত বিষয়ে বেআইনি হস্তক্ষেপ, সেন্সরশিপ, সাইট ব্লক ও আপত্তিকর বিবৃতি এবং এনজিও কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠন করার অধিকারের ওপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিধিনিষেধ, স্বাধীনভাবে চলাফেরার ওপর উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ, অবাধ ও সুষ্ঠু এবং প্রকৃত নির্বাচন না হওয়া, দুর্নীতি ও মানব পাচার।’ তালিকাটা ছোট নয়। তালিকা এখানেই শেষ ছিল না, দেখা যাচ্ছে, এ তথ্যও রয়েছে যা বাংলাদেশে বলবৎ আছে, ‘স্বতন্ত্র শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিকদের ওপর বিধিনিষেধ ও ভয়ংকর মাত্রায় শিশুশ্রম।’ কৃষকের মানবাধিকার কোন দশায় আছে তার উল্লেখ অবশ্য নেই, দলবদ্ধধর্ষণ ও শিশুধর্ষণ বাদ পড়েছে, বোধ করি ধরে নিয়েছে এসব তো আছেই, চলবেই। ভাবছে বোধ করি যে উল্লেখ করাটা অপ্রাসঙ্গিক।
আমেরিকার ওই পর্যবেক্ষণ-প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাও চলে এসেছে। বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তা বাহিনী যেসব নিপীড়নমূলক কাজ করে, সেগুলোর জন্য দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ আবার এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে দায়ের করা মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে এবং আরও অনেক বিরোধী রাজনীতিকের নামে মামলা রয়েছে। প্রতিবেদনের মতে, নির্বাচনের আগে পুলিশ নাকি প্রায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার বিএনপির সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল। শুধু বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে অন্তত ৮৬টি মামলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, তদন্তকারীরা বলেছেন, ‘মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা এসব মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গও বাদ যায়নি। বলা হয়েছে, ‘সরকারের সমালোচনাকারী গণমাধ্যমগুলো নেতিবাচক চাপের মধ্যে রয়েছে।
তারা বিজ্ঞাপন হারিয়েছে’ এবং ‘এ কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় সেন্সরশিপ আরোপ করেছেন। সরকার টেলিভিশনগুলোর সম্পাদকীয় নীতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।’ প্রতিবেদনপ্রণেতারা অবশ্য এটা খেয়াল করেননি যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে গণমাধ্যমের প্রায় সবটাই এখন সরকার-সমর্থক। তাদের মালিকেরা হয় ব্যবসায়ী, নয়তো সরকারি দলের লোক, কেউ কেউ আবার দুটোই।
আমাদের শাসনকর্তারা বলবেন, বলছেনও যে এই সব মন্তব্য যারা করে, তাদের চোখ দুটো ঘোলা, যে জন্য আমাদের উন্নতি ওদের চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে উন্নতি যে হচ্ছে সেটা কি পুঁজিবাদী বিশ্ব অস্বীকার করে? মোটেই না। উন্নতির তারা প্রশংসা করে, মাঝেমধ্যে এমনকি সানন্দে পিঠ চাপড়ে পর্যন্ত দেয়। এই উন্নতিতে তারা বাংলাদেশের সহযোগী ও পরামর্শদাতা; কিন্তু নিজেদের দেশের জনগণকে তারা এটা জানাতে চায় যে তারা সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে প্রহরারত, তাই কোন দেশে কতটা গণতন্ত্র বিচ্যুতি ঘটছে, সেটা বিশ্ববাসীকে তারা জানাবেই, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না। তা ছাড়া উন্নতিকামী দেশগুলোতে যদি পুঁজিবাদী ঘরানার গণতন্ত্রও না থাকে, তাহলে ওই সব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না এবং এমন অঘটনও ঘটতে পারে যে সেখানকার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা হয়তো বিপ্লব-টিপ্লবই ঘটিয়ে ছাড়বে।
তা আমেরিকানরা যে উদ্দেশ্যেই তদন্ত চালাক, তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যেসব তথ্য ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলোর যথার্থতা বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে কি? আর এই প্রতিবেদন যেহেতু বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো একটি মিত্র দেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র যে বানানো কথা বলবে না, এটাও যেহেতু স্বীকৃত সত্য, প্রতিবেদনটি প্রকাশের ফলে তাই বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উজ্জ্বলতা কতটা বৃদ্ধি পেল তা অনুমান করা মোটেই দুঃসাধ্য নয়। একাত্তরের যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা দেশবাসীর জন্য যে সম্মান বয়ে এনেছিল তা ক্রমাগত মলিন হয়েছে এবং এখন বাংলাদেশ কোন সম্মানের আসনে রয়েছে, এর একটা ছবি ওই প্রতিবেদনে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেদনটি সবাই হয়তো পড়েছেন, তবু এটি উদ্ধৃত করলাম চলমান ইতিহাসকে স্মরণে রাখার জন্য; ইতিহাস তো কেবল অতীতে নেই, রয়েছে বর্তমানেও। তদুপরি বালুতে মুখ লুকিয়ে রেখে ঝড় বইছে না—এ রকমের ধারণা করাটা উটপাখির জন্য শোভনীয় হলেও মানুষের জন্য নিশ্চয়ই অশোভনীয়।
প্রতিবেদনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। আসতেই হবে। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে তা সেই ত্রুটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি আঘাত করে, আঘাত করে তাকে দুর্বল করে দেয়। সরকারের জবাবদিহির দায় সংকুচিত হয়ে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, জনজীবনে হতাশা ও পরাজিতের মনোভাব দেখা দেয়। যুদ্ধ করে বাংলাদেশের যে মানুষেরা সব ধরনের মারণাস্ত্রে সজ্জিত ও সর্বাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১ লাখ হানাদারের এক বাহিনীকে হাঁকিয়ে দিলেন, যুদ্ধ শেষে নিজের দেশে তাঁরা যদি নিজেদের শাসকদের কাছে হেরে গেছেন বলে ধরে নেন, তবে তাঁদের পক্ষে দারিদ্র্যের, পরিবেশের ও বিশ্বব্যবস্থার বৈরিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব হবে—এমন ভরসা থাকে কি? একটির পর আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের পরাজয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে। আর নদীর পানিতে যদি দূষণ দেখা দেয়, তবে তার শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে না পড়ে পারে না। গত জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব অন্য সব নির্বাচনেও গিয়ে পড়েছিল বৈকি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
১১ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
১১ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
১১ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
১২ ঘণ্টা আগে