জাহীদ রেজা নূর
আজ ২০ মে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক দিন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে এই বাংলার মানুষদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল, তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ এই ২০ মে। এই দিনে খুলনার চুকনগরে ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড। সবচেয়ে কম পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, ২০ মে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে জেনোসাইড ঘটেছিল, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসতে শুরু করেছে। তবে এ কথা বলা যায়, এই স্বীকৃতির জন্য বিশ্ব দরবারে আমাদের পক্ষ থেকে যতটা গুরুত্বসহকারে বিষয়টি উপস্থাপনের দরকার ছিল, ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। গত দুই বছরে জেনোসাইড নিয়ে কাজ করে, এমন বেশ কয়েকটি সংগঠন থেকে বাংলাদেশের জেনোসাইড স্বীকৃতি পাওয়ায় এ কথা বলা যায়, বিভিন্ন দেশের মানুষ এখন আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, কসোভোর পাশাপাশি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইডের কথাও জানতে পারছে।
২.
চুকনগরে এই যে ১০ হাজার বা তার চেয়েও বেশি মানুষ এক দিনে লাশ হয়ে গেল, তাদের পরিবার-পরিজন এখন কেমন আছে? কাছের মানুষেরা তাদের কাহিনি শুনেছে বেঁচে যাওয়া মানুষের কাছ থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান শুনলে বোঝা যায়, কী ভীতিকর পরিবেশ ছিল সেটি। মার্চ মাসের ২৫ তারিখে যে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়েছিল, এরই ধারাবাহিকতায় ঘটেছিল এই হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানি বাহিনীকে জেনারেল তথা কর্তাব্যক্তিরা যে নির্দেশ দিয়েছিল, তার সরল অনুবাদ হলো, যেখানে যাকে দেখা যাবে, তাকেই হত্যা করতে হবে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী, আওয়ামী লীগের সমর্থক, হিন্দু জনগোষ্ঠী—তারাই ছিল এই হত্যাযজ্ঞের সরল টার্গেট।
সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর এই বাংলায় আসলে শেখ মুজিবের দেশে পরিণত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। এরপর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার চাবিকাঠি ছিল শুধু পশ্চিমা শাসকদের হাতে। তারা সেই চাবিকাঠির ব্যবহার করেনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে কেবল সময়ক্ষেপণ করেছে। ভেতরে-ভেতরে বাংলাকে শায়েস্তা করার কথা ভেবেছে এবং বিমানে করে সৈন্য এনে জড়ো করেছে ক্যান্টনমেন্টে ক্যান্টনমেন্টে।
জড়ো হওয়া এই সৈন্যরা জানত, বাঙালি হত্যা করা হলে কেউ তাদের জবাবদিহি করতে বলবে না; বরং যে যত বেশি মানুষ হত্যা করবে, তার তত বেশি উন্নতির সম্ভাবনা থাকবে। পাকিস্তানি বাহিনীর মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য আর কিছুর প্রয়োজন হয় না, জেনারেলরা বাঙালি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করত, তা মাথায় রাখলেই বোঝা যাবে, ঘৃণা ছাড়া বাঙালিদের জন্য তাদের মনে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। বাঙালি মুসলমানদের তারা খাঁটি মুসলমান বলে মনে করত না। তারা ছিল আশরাফ, বাঙালি মুসলমান ছিল আতরাফ—এই ছিল তাদের ধারণা। আর হিন্দুদের তারা সরাসরি ঘৃণা করত।
তাই ভারতে শরণার্থী হওয়ার জন্য চুকনগরে জড়ো হওয়া মানুষদের ওপর যখন নির্বিচারে গুলি চালাল পাকিস্তানিরা, তখন তারা প্রত্যক্ষভাবেই জেনোসাইড রচনায় অংশ নিয়েছিল। সে সময় তারা হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার করেনি। জড়ো হওয়া মানুষদের সবাইকে ভেবেছে টার্গেট এবং সহজ টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর ছিল না।
৩.
কেউ কেউ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত জেনোসাইডকে হিন্দুনিধনযজ্ঞ বলে মূল ঘটনাকে আড়াল করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এটা যে জাতিগতভাবে বাঙালিদের সমূলে নিধন করার চেষ্টা ছিল, সে কথা বুঝতে হবে। ১৯৭১ সাল মোটেই হিন্দু-মুসলিম বিরোধ থেকে উদ্ভূত হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের হত্যা করছে—ঘটনা এমন ছিল না। নিজেদের অলক্ষ্য জেনোসাইডের শর্ত পালন করেই পাকিস্তানিরা নেমেছিল হত্যাকাণ্ডে। জাতিগতভাবে আংশিক বা সমূলে উৎপাটন করার অভিপ্রায় ছিল পাকিস্তানিদের। তাই মুসলিম-অধ্যুষিত একটি ভূখণ্ডে তারা যখন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তখন বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করার প্রশ্নই আসে না। মার্চের পরের দুই মাস ভারতে যারা উদ্বাস্তু হয়েছে, তাদের ৯৫ শতাংশই ছিল মুসলমান—নাইন মান্থস টু ফ্রিডম ছবিতেই এই তথ্যের সত্যতা রয়েছে। পরে অবশ্য যুদ্ধ আরও সামনের দিকে গড়াতে থাকলে উদ্বাস্তুদের পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন সত্যিই হিন্দু জনগোষ্ঠীর শরণার্থী হওয়ার পরিমাণ ছিল বেশি। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে হিন্দু-মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।
এটা যে শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীকে হত্যা করার ঘটনা ছিল না, তার একটি ছোট উদাহরণ হলো, খ্যাতিমান যেসব বুদ্ধিজীবীকে মার্চ মাসে এবং ডিসেম্বরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। যে নারীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের দায়িত্ব নিয়েছিল তারা, তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদ ছিল না। জাতিগতভাবেই তারা বাঙালিদের এই ভূখণ্ড থেকে উৎপাটন করতে চেয়েছিল। ফলে যদি কেউ এই জেনোসাইডকে হিন্দুনিধনযজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে, তাদের এ কথা বলায় কোনো অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
চুকনগরে ২০ মে যারা সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য জড়ো হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু—এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাই বলে শুধু হিন্দুরাই টার্গেট ছিল, এ কথা বলা ঘোরতর অন্যায়। এটা যারা বলে, তাদের সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে কোনো জেনোসাইড হয়নি, তা প্রমাণ করা; অর্থাৎ জাতিগতভাবে নিধনযজ্ঞ চালানো হয়নি—এটাই তারা বোঝাতে চায়। এদের কাছ থেকে দূরে থাকা খুবই প্রয়োজন।
৪.
মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত একটি বই আছে ‘১৯৭১: চুকনগরে গণহত্যা’ নামে। সেই বইটিতে চুকনগর জেনোসাইডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান রয়েছে। সেই সাক্ষাৎকারগুলো পড়লে বোঝা যাবে, কত অনায়াসে একটি জায়গাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন, লাশের সংখ্যাধিক্যের কারণে নদীর স্রোত থেমে গিয়েছিল। লাশগুলো সরতে পারছিল না। জোয়ার-ভাটায় একবার এদিকে, একবার ওদিকে যাচ্ছিল। এরপর ডাঙায় স্তূপ হয়ে পড়ে ছিল। পাকিস্তানিরা কাউকে কাউকে দায়িত্ব দিয়েছিল সেই লাশ সরিয়ে ফেলার। সে বর্ণনাও পাওয়া যাবে বইটিতে।
জীবন যে থেমে থাকে না, তার এক মহতী গল্প আছে এই চুকনগর ট্র্যাজেডির মধ্যে। এখানে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলব। আগে যে পত্রিকায় কাজ করতাম, সেই পত্রিকায় খুলনা থেকে একটি ফিচার এসেছিল চুকনগরের জেনোসাইড নিয়ে। লেখাটি পড়তে গিয়ে এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল আমার। এরশাদ মোড়ল আর সুন্দরীর ঘটনাটি লক্ষ করলাম অবাক বিস্ময়ে। ২০ মে সকালে এরশাদ মোড়ল তাঁর বাবা চিকন মোড়লের সঙ্গে খেতে ঘাস কাটছিলেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রাক আর একটি জিপ আসে। বাবা এরশাদকে দ্রুত সরে যেতে বলেন। চিকন আলীর হাতে ছিল কাস্তে। তিনি কাস্তে উঁচু করে ধরলে পাকিস্তানিরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তো জড়ো হওয়া মানুষদের গুলি করে মারতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। লাশের পর লাশ জমতে থাকে সেখানে।
পাকিস্তানিরা চলে গেলে এরশাদ মোড়ল আসেন বাবাকে খুঁজতে। বাবাকে না পেলেও তিনি দেখতে পান নিহত এক হিন্দু গৃহবধূর বুকে ছয় মাসের এক শিশুকে। শিশুটিকে নিয়ে এসে তিনি এক হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দেন।
এই কাহিনিটি চলচ্চিত্রের গল্পকেও হার মানায়। আমি সেই প্রতিনিধিকে বলেছিলাম, পরের বছর যেন শুধু এরশাদ মোড়ল আর সুন্দরীকে নিয়ে একটি ফিচার পাঠান। সে ফিচারটি ছাপা হয়েছিল পরের বছর।
বিশাল হত্যাযজ্ঞের বিপরীতে এই মানবিক কাহিনি বুঝিয়ে দেয়, মানুষ আসলে পরাস্ত হওয়ার নয়। চুকনগরে ঘটেছিল একটি স্থানে অতি অল্প সময়ে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। আর সেখানেই জয়ী হয়েছিল মানবতা।
পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরের দল তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। পরাজিত হয়েছে তারা। কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা আজও দেশের ক্ষতি করার জন্য জোট বাঁধছে। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে তারা অবজ্ঞা করছে। প্রশ্ন তুলছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
এদের প্রতিহত করতে হলে ইতিহাস-জ্ঞান যেমন থাকতে হবে, তেমনি যৌক্তিক মননে ঋদ্ধ করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। সে কাজটা করা হলে চুকনগর ট্র্যাজেডির গুরুত্ব বুঝবে মানুষ এবং কেন জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দরকার, সেটাও অনুধাবন করতে পারবে।
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা
আজ ২০ মে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক দিন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে এই বাংলার মানুষদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল, তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ এই ২০ মে। এই দিনে খুলনার চুকনগরে ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড। সবচেয়ে কম পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, ২০ মে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে জেনোসাইড ঘটেছিল, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসতে শুরু করেছে। তবে এ কথা বলা যায়, এই স্বীকৃতির জন্য বিশ্ব দরবারে আমাদের পক্ষ থেকে যতটা গুরুত্বসহকারে বিষয়টি উপস্থাপনের দরকার ছিল, ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। গত দুই বছরে জেনোসাইড নিয়ে কাজ করে, এমন বেশ কয়েকটি সংগঠন থেকে বাংলাদেশের জেনোসাইড স্বীকৃতি পাওয়ায় এ কথা বলা যায়, বিভিন্ন দেশের মানুষ এখন আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, কসোভোর পাশাপাশি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইডের কথাও জানতে পারছে।
২.
চুকনগরে এই যে ১০ হাজার বা তার চেয়েও বেশি মানুষ এক দিনে লাশ হয়ে গেল, তাদের পরিবার-পরিজন এখন কেমন আছে? কাছের মানুষেরা তাদের কাহিনি শুনেছে বেঁচে যাওয়া মানুষের কাছ থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান শুনলে বোঝা যায়, কী ভীতিকর পরিবেশ ছিল সেটি। মার্চ মাসের ২৫ তারিখে যে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়েছিল, এরই ধারাবাহিকতায় ঘটেছিল এই হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানি বাহিনীকে জেনারেল তথা কর্তাব্যক্তিরা যে নির্দেশ দিয়েছিল, তার সরল অনুবাদ হলো, যেখানে যাকে দেখা যাবে, তাকেই হত্যা করতে হবে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী, আওয়ামী লীগের সমর্থক, হিন্দু জনগোষ্ঠী—তারাই ছিল এই হত্যাযজ্ঞের সরল টার্গেট।
সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর এই বাংলায় আসলে শেখ মুজিবের দেশে পরিণত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। এরপর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার চাবিকাঠি ছিল শুধু পশ্চিমা শাসকদের হাতে। তারা সেই চাবিকাঠির ব্যবহার করেনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে কেবল সময়ক্ষেপণ করেছে। ভেতরে-ভেতরে বাংলাকে শায়েস্তা করার কথা ভেবেছে এবং বিমানে করে সৈন্য এনে জড়ো করেছে ক্যান্টনমেন্টে ক্যান্টনমেন্টে।
জড়ো হওয়া এই সৈন্যরা জানত, বাঙালি হত্যা করা হলে কেউ তাদের জবাবদিহি করতে বলবে না; বরং যে যত বেশি মানুষ হত্যা করবে, তার তত বেশি উন্নতির সম্ভাবনা থাকবে। পাকিস্তানি বাহিনীর মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য আর কিছুর প্রয়োজন হয় না, জেনারেলরা বাঙালি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করত, তা মাথায় রাখলেই বোঝা যাবে, ঘৃণা ছাড়া বাঙালিদের জন্য তাদের মনে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। বাঙালি মুসলমানদের তারা খাঁটি মুসলমান বলে মনে করত না। তারা ছিল আশরাফ, বাঙালি মুসলমান ছিল আতরাফ—এই ছিল তাদের ধারণা। আর হিন্দুদের তারা সরাসরি ঘৃণা করত।
তাই ভারতে শরণার্থী হওয়ার জন্য চুকনগরে জড়ো হওয়া মানুষদের ওপর যখন নির্বিচারে গুলি চালাল পাকিস্তানিরা, তখন তারা প্রত্যক্ষভাবেই জেনোসাইড রচনায় অংশ নিয়েছিল। সে সময় তারা হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার করেনি। জড়ো হওয়া মানুষদের সবাইকে ভেবেছে টার্গেট এবং সহজ টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর ছিল না।
৩.
কেউ কেউ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত জেনোসাইডকে হিন্দুনিধনযজ্ঞ বলে মূল ঘটনাকে আড়াল করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এটা যে জাতিগতভাবে বাঙালিদের সমূলে নিধন করার চেষ্টা ছিল, সে কথা বুঝতে হবে। ১৯৭১ সাল মোটেই হিন্দু-মুসলিম বিরোধ থেকে উদ্ভূত হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের হত্যা করছে—ঘটনা এমন ছিল না। নিজেদের অলক্ষ্য জেনোসাইডের শর্ত পালন করেই পাকিস্তানিরা নেমেছিল হত্যাকাণ্ডে। জাতিগতভাবে আংশিক বা সমূলে উৎপাটন করার অভিপ্রায় ছিল পাকিস্তানিদের। তাই মুসলিম-অধ্যুষিত একটি ভূখণ্ডে তারা যখন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তখন বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করার প্রশ্নই আসে না। মার্চের পরের দুই মাস ভারতে যারা উদ্বাস্তু হয়েছে, তাদের ৯৫ শতাংশই ছিল মুসলমান—নাইন মান্থস টু ফ্রিডম ছবিতেই এই তথ্যের সত্যতা রয়েছে। পরে অবশ্য যুদ্ধ আরও সামনের দিকে গড়াতে থাকলে উদ্বাস্তুদের পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন সত্যিই হিন্দু জনগোষ্ঠীর শরণার্থী হওয়ার পরিমাণ ছিল বেশি। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে হিন্দু-মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।
এটা যে শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীকে হত্যা করার ঘটনা ছিল না, তার একটি ছোট উদাহরণ হলো, খ্যাতিমান যেসব বুদ্ধিজীবীকে মার্চ মাসে এবং ডিসেম্বরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। যে নারীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের দায়িত্ব নিয়েছিল তারা, তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদ ছিল না। জাতিগতভাবেই তারা বাঙালিদের এই ভূখণ্ড থেকে উৎপাটন করতে চেয়েছিল। ফলে যদি কেউ এই জেনোসাইডকে হিন্দুনিধনযজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে, তাদের এ কথা বলায় কোনো অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
চুকনগরে ২০ মে যারা সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য জড়ো হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু—এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাই বলে শুধু হিন্দুরাই টার্গেট ছিল, এ কথা বলা ঘোরতর অন্যায়। এটা যারা বলে, তাদের সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে কোনো জেনোসাইড হয়নি, তা প্রমাণ করা; অর্থাৎ জাতিগতভাবে নিধনযজ্ঞ চালানো হয়নি—এটাই তারা বোঝাতে চায়। এদের কাছ থেকে দূরে থাকা খুবই প্রয়োজন।
৪.
মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত একটি বই আছে ‘১৯৭১: চুকনগরে গণহত্যা’ নামে। সেই বইটিতে চুকনগর জেনোসাইডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান রয়েছে। সেই সাক্ষাৎকারগুলো পড়লে বোঝা যাবে, কত অনায়াসে একটি জায়গাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন, লাশের সংখ্যাধিক্যের কারণে নদীর স্রোত থেমে গিয়েছিল। লাশগুলো সরতে পারছিল না। জোয়ার-ভাটায় একবার এদিকে, একবার ওদিকে যাচ্ছিল। এরপর ডাঙায় স্তূপ হয়ে পড়ে ছিল। পাকিস্তানিরা কাউকে কাউকে দায়িত্ব দিয়েছিল সেই লাশ সরিয়ে ফেলার। সে বর্ণনাও পাওয়া যাবে বইটিতে।
জীবন যে থেমে থাকে না, তার এক মহতী গল্প আছে এই চুকনগর ট্র্যাজেডির মধ্যে। এখানে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলব। আগে যে পত্রিকায় কাজ করতাম, সেই পত্রিকায় খুলনা থেকে একটি ফিচার এসেছিল চুকনগরের জেনোসাইড নিয়ে। লেখাটি পড়তে গিয়ে এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল আমার। এরশাদ মোড়ল আর সুন্দরীর ঘটনাটি লক্ষ করলাম অবাক বিস্ময়ে। ২০ মে সকালে এরশাদ মোড়ল তাঁর বাবা চিকন মোড়লের সঙ্গে খেতে ঘাস কাটছিলেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রাক আর একটি জিপ আসে। বাবা এরশাদকে দ্রুত সরে যেতে বলেন। চিকন আলীর হাতে ছিল কাস্তে। তিনি কাস্তে উঁচু করে ধরলে পাকিস্তানিরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তো জড়ো হওয়া মানুষদের গুলি করে মারতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। লাশের পর লাশ জমতে থাকে সেখানে।
পাকিস্তানিরা চলে গেলে এরশাদ মোড়ল আসেন বাবাকে খুঁজতে। বাবাকে না পেলেও তিনি দেখতে পান নিহত এক হিন্দু গৃহবধূর বুকে ছয় মাসের এক শিশুকে। শিশুটিকে নিয়ে এসে তিনি এক হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দেন।
এই কাহিনিটি চলচ্চিত্রের গল্পকেও হার মানায়। আমি সেই প্রতিনিধিকে বলেছিলাম, পরের বছর যেন শুধু এরশাদ মোড়ল আর সুন্দরীকে নিয়ে একটি ফিচার পাঠান। সে ফিচারটি ছাপা হয়েছিল পরের বছর।
বিশাল হত্যাযজ্ঞের বিপরীতে এই মানবিক কাহিনি বুঝিয়ে দেয়, মানুষ আসলে পরাস্ত হওয়ার নয়। চুকনগরে ঘটেছিল একটি স্থানে অতি অল্প সময়ে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। আর সেখানেই জয়ী হয়েছিল মানবতা।
পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরের দল তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। পরাজিত হয়েছে তারা। কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা আজও দেশের ক্ষতি করার জন্য জোট বাঁধছে। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে তারা অবজ্ঞা করছে। প্রশ্ন তুলছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
এদের প্রতিহত করতে হলে ইতিহাস-জ্ঞান যেমন থাকতে হবে, তেমনি যৌক্তিক মননে ঋদ্ধ করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। সে কাজটা করা হলে চুকনগর ট্র্যাজেডির গুরুত্ব বুঝবে মানুষ এবং কেন জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দরকার, সেটাও অনুধাবন করতে পারবে।
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে