সাইফুল মাসুম, ঢাকা
বুধবার দুপুর ১২টা। ঢাকার কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস। ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আক্কাস আলী খান ভলিয়ম বইতে নথি দেখছেন। তাঁকে ঘিরে জনাবিশেক মানুষের জটলা। সেখানে সেবাগ্রহীতাদের কাগজপত্র যাচাই করছেন মীর হাবিবুর রহমান, জাহিদ হোসেন, জিসান ও রিপন। তাঁরা কেউই ওই অফিসের কর্মচারী নন। স্থানীয় লোকজনের কাছে উমেদার নামে পরিচিত হলেও মূলত তাঁরা ‘দালাল’। রোহিতপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘিরে তৎপর এমন দালালের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন। তাঁদের কাজ ভূমি অফিসের কর্মচারীদের যোগসাজশে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা। এমনকি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও থাকে তাঁদের জিম্মায়।
শুধু রোহিতপুর নয়, দেশের প্রায় সব ভূমি অফিসেরই একই চিত্র। ঘুষ ছাড়া সেবা মেলে না কোথাও। সেখানে পা বাড়ালে জমির মালিকদের জন্য পদে পদে অপেক্ষা করে হয়রানি। এ জন্য অনেকে ভূমি অফিস এড়িয়ে চলতে চান। জরুরি প্রয়োজনে দালালেরাই হয়ে ওঠেন সমাধান।
গ্রাম এলাকায় জমির কাগজসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা সমাধানে প্রথমেই যেতে হয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। পরের ধাপে সেবা দেয় উপজেলা ভূমি অফিস। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন এসব অফিসের দেওয়া সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে—ভূমিহীনদের মাঝে কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত, খতিয়ানের ভুল সংশোধন, নামজারি ও জমাভাগ, ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণীর আপত্তি-নিষ্পত্তি, দেওয়ানি আদালতের রায় বা আদেশমূলে রেকর্ড সংশোধন, ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন নিষ্পত্তি, জমা একত্রকরণ ও বিবিধ কেসের আদেশের নকল বা সার্টিফায়েড কপি প্রদান ইত্যাদি।
এসব সেবা নিতে জমির মালিকদের অনেককেই দালালের দ্বারস্থ হতে হয় বলে স্বীকার করেছেন রোহিতপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আক্কাস আলী খান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনায় আগে থেকে দালাল চক্র জড়িত। কিছু ভূমির মালিক নামজারি করতে দালালদের দায়িত্ব দেন। তা ছাড়া কাজের চাপে পড়লে আমরাও তাঁদের সহযোগিতা নিই।’
সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে দালালেরা যে টাকা নেন, তা ভাগ-বাঁটোয়ারাও হয় নানা ধাপে। কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিসে তৎপর এক দালাল জানান, ঘুষের টাকার ৫০ শতাংশই পান সহকারী কমিশনার (ভূমি), ৩০ শতাংশ কানুনগো, সার্ভেয়ার ও নামজারি সহকারী, আর ২০ শতাংশ পান দালাল।’
এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা চাই অফিসগুলো দালালমুক্ত হোক। ভূমি ভবনের নিচে পরীক্ষামূলক কাস্টমার কেয়ার সেন্টার চালু করা হয়েছে। সেখানে বিনা মূল্যে সব কাজ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১৬১২২ নম্বরে ভূমি সেবার একটা কল সেন্টার রয়েছে, সেখানে সমস্যার কথা জানাতে পারেন। এই সিস্টেমগুলো জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেব।’
ভূমি অফিসগুলোয় সেবা পেতে কী কী ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয় তা জানতে সরেজমিনে দেশের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘুরে দেখেছেন আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিরা। প্রায় প্রতিটি ভূমি অফিসেই ঘুষ লেনদেন, চরম ভোগান্তি ও দালালের দৌরাত্ম্য চোখে পড়েছে তাঁদের।
প্রতিনিধি জানান, ঘুষ ছাড়া জমির নামজারি হয় না সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ভূমি অফিসে। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও টাকা ছাড়া ফাইল সহকারী কমিশনারের (ভূমি) টেবিলে পৌঁছায় না। কাগজপত্রে গরমিল থাকলে গুনতে হয় কয়েকগুণ বেশি টাকা।
এই অফিসে সেবা নিতে গিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন সদর উপজেলার দেবনগর গ্রামের মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, একটি জমি কিনে নামজারি করতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। সরকারি ফি ১ হাজার ২৫০ টাকা হলেও ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে বাড়তি ৩ হাজার টাকা।
যশোরের মনিরামপুরে নামজারির আবেদন নিষ্পত্তিতে ফাইলপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। সেখানে সক্রিয় দালাল প্রায় ৪০ জন। নামজারির আবেদনের সঙ্গে তাঁদের দিতে হয় বাড়তি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।
ঘুষ নেওয়ার জন্য ভয়াবহ এক কাজ করেছেন পটুয়াখালীর একটি ভূমি অফিসের দালাল। ভুক্তভোগীর নাম এম কে রানা। পটুয়াখালী শহরের সেন্টারপাড়া এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের খতিয়ানে নাম ছিল, দালাল পৃষ্ঠা ছিঁড়ে টাকার বিনিময়ে অন্য নাম ঢুকাইছে। অথচ অনলাইনে সঠিক তথ্য রয়েছে।’
খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলেন জোলাপাড়া গ্রামের মোখছেদ আলী। ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাঁর কাছ থেকে নিয়েছেন ১৭ হাজার টাকা, কিন্তু রসিদ দিয়েছেন মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকার। একই অফিসে জমির খাজনা বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন ভূমির মালিক আবুল হোসেন। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ২০ টাকার রসিদ। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইটাকুমারী ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মুকুল মিয়া বলেন, ‘কার কাছে কত টাকা নিয়েছি। সেটা আপনাদের জানার দরকার নাই।’
বরগুনা সদর ইউনিয়নের হেউলীবুনিয়া এলাকার আবদুস সাত্তার জানান, ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমির খাজনা দিতে চাইলেও তাঁর কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে ৮ হাজার টাকায় তিনি দাখিলা কেটেছেন আর দাখিলায় খাজনা জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ২২০ টাকা।
লক্ষ্মীপুর সদরের ভুক্তভোগী হারুনুর রসিদ বলেন, ‘আমার ভিটেবাড়ির নাম খারিজের জন্য প্রায় আড়াই মাস আগে ১ হাজার ১৫০ টাকার ফিসহ সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। সরকারি ফি কত টাকা জানতে চাইলে তাঁরা সঠিক তথ্য দেন না। ফলে বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে। তারপরও কাগজ পাচ্ছি না।’
ডিজিটাল সেবাও ঝুলে থাকে টাকার জন্য
ভূমি অফিসের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অনলাইনে সেবা চালু করেছে সরকার। এর মধ্যে জমির নামজারি, খাজনা ও মিসকেস সেবা অন্যতম। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনলাইনে আবেদনের পর আবার মূল কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে হয়। তখন টাকা না দিলে অনলাইনে ঝুলে থাকে ফাইল।
জমিতে কেউ নতুন মালিক হলে তাঁর নাম খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলে। অনলাইনে নামজারির জন্য প্রথমে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত () ওয়েবসাইটে ঢুকতে হবে। তারপর ৭০ টাকা ফিসহ নামজারির আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে। অনলাইনে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়ন ভূমি অফিস তদন্ত করে উপজেলা ভূমি অফিসে নাম প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু এই নাম প্রস্তাব পাঠানোর জন্য ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জমি অনুপাতে ১ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি টাকা নেন।
গাইবান্ধা ফুলছড়ি উপজেলার বাগুরিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে মদনেরপাড়া গ্রামের অনিক চন্দ্র বলেন, নামজারি জন্য অনলাইনে আবেদন করে কাগজসহ দিয়েছিলাম। কর্মকর্তা কাগজে ভুল আছে জানিয়ে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। তাঁর কথা অনুয়ায়ী অনলাইনের কপিসহ ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু তহশিলদার দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছে।’
ঘুষ গ্রহণে পিছিয়ে নেই সার্ভেয়ারও
রংপুরের বদরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সম্প্রতি ঘুষ নেওয়ায় চারটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগের মধ্যে দুটিই উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার সাবিনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ করেছেন সাবেক পৌর মেয়র উত্তম কুমার সাহা ও উপজেলার গোপালপুর নয়াপাড়া গ্রামের আবেজ উদ্দিন। উত্তম কুমার সাহা সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগে বলেন, ‘সার্ভেয়ার সাবিনা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজেই করেন না। ঘুষ পেলে তিনি অন্যায়কে ন্যায় এবং ন্যায়কে অন্যায় বলে চালান।’
ভূমিসংক্রান্ত সেবা কীভাবে সহজ করা যায় জানতে চাইলে ভূমি বিশেষজ্ঞ ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিজিটালাইজেশনের কথা বলা হচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ হয়তো প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষেরা এই সুবিধার বাইরে। দেখা যাচ্ছে, সেবার একটা অংশ ডিজিটাল করা হচ্ছে, আরেকটা অংশ করা হয়নি। এই অসংগতির কারণে শেষ পর্যন্ত ভূমি অফিসের কর্মচারীদের কাছে যেতে হয়। কর্মচারীদের বড় অংশের মধ্যে আর্থিক সুবিধা ছাড়া সেবা না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ভূমি সেবার স্বচ্ছতায় পুরো প্যাকেজকে ডিজিটালাইজড করার সুপারিশ করছি।’
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাতক্ষীরা, হবিগঞ্জ, বরগুনা, গাজীপুর, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, গাইবান্ধা, মনিরামপুর (যশোর), পীরগাছা (রংপুর), বিরামপুর (দিনাজপুর), চকরিয়া (কক্সবাজার), বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি]
বুধবার দুপুর ১২টা। ঢাকার কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস। ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আক্কাস আলী খান ভলিয়ম বইতে নথি দেখছেন। তাঁকে ঘিরে জনাবিশেক মানুষের জটলা। সেখানে সেবাগ্রহীতাদের কাগজপত্র যাচাই করছেন মীর হাবিবুর রহমান, জাহিদ হোসেন, জিসান ও রিপন। তাঁরা কেউই ওই অফিসের কর্মচারী নন। স্থানীয় লোকজনের কাছে উমেদার নামে পরিচিত হলেও মূলত তাঁরা ‘দালাল’। রোহিতপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘিরে তৎপর এমন দালালের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন। তাঁদের কাজ ভূমি অফিসের কর্মচারীদের যোগসাজশে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা। এমনকি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও থাকে তাঁদের জিম্মায়।
শুধু রোহিতপুর নয়, দেশের প্রায় সব ভূমি অফিসেরই একই চিত্র। ঘুষ ছাড়া সেবা মেলে না কোথাও। সেখানে পা বাড়ালে জমির মালিকদের জন্য পদে পদে অপেক্ষা করে হয়রানি। এ জন্য অনেকে ভূমি অফিস এড়িয়ে চলতে চান। জরুরি প্রয়োজনে দালালেরাই হয়ে ওঠেন সমাধান।
গ্রাম এলাকায় জমির কাগজসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা সমাধানে প্রথমেই যেতে হয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। পরের ধাপে সেবা দেয় উপজেলা ভূমি অফিস। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন এসব অফিসের দেওয়া সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে—ভূমিহীনদের মাঝে কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত, খতিয়ানের ভুল সংশোধন, নামজারি ও জমাভাগ, ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণীর আপত্তি-নিষ্পত্তি, দেওয়ানি আদালতের রায় বা আদেশমূলে রেকর্ড সংশোধন, ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন নিষ্পত্তি, জমা একত্রকরণ ও বিবিধ কেসের আদেশের নকল বা সার্টিফায়েড কপি প্রদান ইত্যাদি।
এসব সেবা নিতে জমির মালিকদের অনেককেই দালালের দ্বারস্থ হতে হয় বলে স্বীকার করেছেন রোহিতপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আক্কাস আলী খান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনায় আগে থেকে দালাল চক্র জড়িত। কিছু ভূমির মালিক নামজারি করতে দালালদের দায়িত্ব দেন। তা ছাড়া কাজের চাপে পড়লে আমরাও তাঁদের সহযোগিতা নিই।’
সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে দালালেরা যে টাকা নেন, তা ভাগ-বাঁটোয়ারাও হয় নানা ধাপে। কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিসে তৎপর এক দালাল জানান, ঘুষের টাকার ৫০ শতাংশই পান সহকারী কমিশনার (ভূমি), ৩০ শতাংশ কানুনগো, সার্ভেয়ার ও নামজারি সহকারী, আর ২০ শতাংশ পান দালাল।’
এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা চাই অফিসগুলো দালালমুক্ত হোক। ভূমি ভবনের নিচে পরীক্ষামূলক কাস্টমার কেয়ার সেন্টার চালু করা হয়েছে। সেখানে বিনা মূল্যে সব কাজ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১৬১২২ নম্বরে ভূমি সেবার একটা কল সেন্টার রয়েছে, সেখানে সমস্যার কথা জানাতে পারেন। এই সিস্টেমগুলো জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেব।’
ভূমি অফিসগুলোয় সেবা পেতে কী কী ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয় তা জানতে সরেজমিনে দেশের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘুরে দেখেছেন আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিরা। প্রায় প্রতিটি ভূমি অফিসেই ঘুষ লেনদেন, চরম ভোগান্তি ও দালালের দৌরাত্ম্য চোখে পড়েছে তাঁদের।
প্রতিনিধি জানান, ঘুষ ছাড়া জমির নামজারি হয় না সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ভূমি অফিসে। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও টাকা ছাড়া ফাইল সহকারী কমিশনারের (ভূমি) টেবিলে পৌঁছায় না। কাগজপত্রে গরমিল থাকলে গুনতে হয় কয়েকগুণ বেশি টাকা।
এই অফিসে সেবা নিতে গিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন সদর উপজেলার দেবনগর গ্রামের মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, একটি জমি কিনে নামজারি করতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। সরকারি ফি ১ হাজার ২৫০ টাকা হলেও ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে বাড়তি ৩ হাজার টাকা।
যশোরের মনিরামপুরে নামজারির আবেদন নিষ্পত্তিতে ফাইলপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। সেখানে সক্রিয় দালাল প্রায় ৪০ জন। নামজারির আবেদনের সঙ্গে তাঁদের দিতে হয় বাড়তি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।
ঘুষ নেওয়ার জন্য ভয়াবহ এক কাজ করেছেন পটুয়াখালীর একটি ভূমি অফিসের দালাল। ভুক্তভোগীর নাম এম কে রানা। পটুয়াখালী শহরের সেন্টারপাড়া এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের খতিয়ানে নাম ছিল, দালাল পৃষ্ঠা ছিঁড়ে টাকার বিনিময়ে অন্য নাম ঢুকাইছে। অথচ অনলাইনে সঠিক তথ্য রয়েছে।’
খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলেন জোলাপাড়া গ্রামের মোখছেদ আলী। ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাঁর কাছ থেকে নিয়েছেন ১৭ হাজার টাকা, কিন্তু রসিদ দিয়েছেন মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকার। একই অফিসে জমির খাজনা বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন ভূমির মালিক আবুল হোসেন। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ২০ টাকার রসিদ। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইটাকুমারী ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মুকুল মিয়া বলেন, ‘কার কাছে কত টাকা নিয়েছি। সেটা আপনাদের জানার দরকার নাই।’
বরগুনা সদর ইউনিয়নের হেউলীবুনিয়া এলাকার আবদুস সাত্তার জানান, ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমির খাজনা দিতে চাইলেও তাঁর কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে ৮ হাজার টাকায় তিনি দাখিলা কেটেছেন আর দাখিলায় খাজনা জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ২২০ টাকা।
লক্ষ্মীপুর সদরের ভুক্তভোগী হারুনুর রসিদ বলেন, ‘আমার ভিটেবাড়ির নাম খারিজের জন্য প্রায় আড়াই মাস আগে ১ হাজার ১৫০ টাকার ফিসহ সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। সরকারি ফি কত টাকা জানতে চাইলে তাঁরা সঠিক তথ্য দেন না। ফলে বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে। তারপরও কাগজ পাচ্ছি না।’
ডিজিটাল সেবাও ঝুলে থাকে টাকার জন্য
ভূমি অফিসের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অনলাইনে সেবা চালু করেছে সরকার। এর মধ্যে জমির নামজারি, খাজনা ও মিসকেস সেবা অন্যতম। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনলাইনে আবেদনের পর আবার মূল কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে হয়। তখন টাকা না দিলে অনলাইনে ঝুলে থাকে ফাইল।
জমিতে কেউ নতুন মালিক হলে তাঁর নাম খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলে। অনলাইনে নামজারির জন্য প্রথমে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত () ওয়েবসাইটে ঢুকতে হবে। তারপর ৭০ টাকা ফিসহ নামজারির আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে। অনলাইনে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়ন ভূমি অফিস তদন্ত করে উপজেলা ভূমি অফিসে নাম প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু এই নাম প্রস্তাব পাঠানোর জন্য ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জমি অনুপাতে ১ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি টাকা নেন।
গাইবান্ধা ফুলছড়ি উপজেলার বাগুরিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে মদনেরপাড়া গ্রামের অনিক চন্দ্র বলেন, নামজারি জন্য অনলাইনে আবেদন করে কাগজসহ দিয়েছিলাম। কর্মকর্তা কাগজে ভুল আছে জানিয়ে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। তাঁর কথা অনুয়ায়ী অনলাইনের কপিসহ ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু তহশিলদার দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছে।’
ঘুষ গ্রহণে পিছিয়ে নেই সার্ভেয়ারও
রংপুরের বদরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সম্প্রতি ঘুষ নেওয়ায় চারটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগের মধ্যে দুটিই উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার সাবিনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ করেছেন সাবেক পৌর মেয়র উত্তম কুমার সাহা ও উপজেলার গোপালপুর নয়াপাড়া গ্রামের আবেজ উদ্দিন। উত্তম কুমার সাহা সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগে বলেন, ‘সার্ভেয়ার সাবিনা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজেই করেন না। ঘুষ পেলে তিনি অন্যায়কে ন্যায় এবং ন্যায়কে অন্যায় বলে চালান।’
ভূমিসংক্রান্ত সেবা কীভাবে সহজ করা যায় জানতে চাইলে ভূমি বিশেষজ্ঞ ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিজিটালাইজেশনের কথা বলা হচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ হয়তো প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষেরা এই সুবিধার বাইরে। দেখা যাচ্ছে, সেবার একটা অংশ ডিজিটাল করা হচ্ছে, আরেকটা অংশ করা হয়নি। এই অসংগতির কারণে শেষ পর্যন্ত ভূমি অফিসের কর্মচারীদের কাছে যেতে হয়। কর্মচারীদের বড় অংশের মধ্যে আর্থিক সুবিধা ছাড়া সেবা না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ভূমি সেবার স্বচ্ছতায় পুরো প্যাকেজকে ডিজিটালাইজড করার সুপারিশ করছি।’
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাতক্ষীরা, হবিগঞ্জ, বরগুনা, গাজীপুর, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, গাইবান্ধা, মনিরামপুর (যশোর), পীরগাছা (রংপুর), বিরামপুর (দিনাজপুর), চকরিয়া (কক্সবাজার), বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি]
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে