মামুনুর রশীদ
একটা প্রবল অস্থিরতা বিরাজ করছে রাজনীতিতে। যার প্রভাব এসে পড়েছে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে। মানুষ একধরনের আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। খবরের কাগজে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সর্বত্রই নির্বাচনের সংবাদ। দুই বৃহৎ দলের প্রতিক্রিয়া প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। দুই দলই অনমনীয়। মাঝখান থেকে মানুষ একটা সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে।
এই ধরনের সংকট অতীতেও বহুবার হয়েছে। যাঁদের বয়স সত্তরোর্ধ্ব, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে সংঘাত দেখেছেন। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময়গুলো ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। তারপর আইয়ুব খানের সময়ে জেল-জুলুম, নির্যাতন এবং রাজপথের সংঘাত—এসবও পুরো একাত্তর সাল পর্যন্ত ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এরপর ২৫ মার্চের রাত, যেখান থেকে এক শ্বাসরুদ্ধকর নির্যাতন নেমে এসেছিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। নিজ দেশের শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের যুদ্ধ। পাকিস্তানের বিখ্যাত বিচারপতি কায়ানি পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছিলেন। তা হলো, ‘আমি আমার সেনাবাহিনীর জন্য গর্ববোধ করি, যারা তাদের মাতৃভূমিকে দখল করে ফেলেছে।’ এই মাতৃভূমি দখল করার পাঁয়তারা হিসেবে তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
অবশ্য নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর তথাকথিত পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছিল কিন্তু এই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অবসান হয়নি, অনিশ্চিত দিনগুলো তখনো ছিল। চারদিকে প্রত্যাশা ব্যাপক এবং সেই সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়ে অসহিষ্ণুতা। পরিস্থিতি গড়িয়ে গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে। সেনাবাহিনীর কতিপয় তরুণ অফিসার দেশটাকে দখল করে ফেললেন।
সেই পথ ধরেই পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশে চলে এল সামরিক শাসন। সেই পুরোনো পদবি আবার শুনতে পাওয়া গেল—চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ডেপুটি চিফ মার্শাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, জোনাল মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইত্যাদি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা একেবারেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সামরিক শাসনকে আশ্রয় দিলেন এবং একজন বিচারপতি প্রধান সামরিক শাসকও হয়ে গেলেন। পরবর্তীকালে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। সামরিক শাসনামলে সংবিধান এবং মানবাধিকার স্থগিত থাকে। কিন্তু বাংলার মানুষ কখনোই সামরিক শাসনকে মেনে নেয়নি। দেশের স্বার্থে কৃষক, শ্রমিক, সংস্কৃতিকর্মী সবাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলন মানেই যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে, তাদের সঙ্গে সংঘাত। ১৫টি বছর নির্যাতন, নিপীড়ন সংঘাত শেষে সামরিক শাসনের অবসান হয়। কিন্তু সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় যে একাত্তরের ঘাতকেরা পুনর্বাসিত হয়েছিল, তাদের অগ্রযাত্রা চলতেই থাকল। অতএব নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত হলো না।
পৃথিবীর সব দেশেই সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়ে থাকে কিন্তু জনগণকে জিম্মি করে কোনো আন্দোলন বেশি দূর এগোতে পারে না। নেপালে দীর্ঘ দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে কিন্তু পর্যটক এবং সাধারণ মানুষ সেখানে নিরাপদে থেকেছে। থাইল্যান্ডেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন হয় কিন্তু জনজীবনে তার তেমন প্রভাব পড়ে না। তবে জনগণের একটা বড় অংশ যখন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখনই সরকারের পতন ঘটে যায়। বাংলাদেশে সবকিছুই জনগণকে স্পর্শ করে যায়। গাড়ি পোড়ানো থেকে শুরু করে নানান ধরনের সহিংসতা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়।
এবারের চিত্রটি একটু ভিন্ন। দুই দলই একই দিনে কর্মসূচি দিচ্ছে। কিন্তু তেমন কোনো মুখোমুখি সংঘাত দেখা যাচ্ছে না। তার একটা কারণ আছে, হয়তো সেটাই বড় কারণ যে বিদেশি কূটনীতিকেরা খুব নিবিড়ভাবে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার এবং বিরোধী দল দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানকে শান্তিপূর্ণ বলে প্রমাণ করতে চাইছে। ফলাফলে অর্থনীতি মন্থর হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগ কমছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের নিয়ন্ত্রণ কারও কাছে থাকছে না।
এটা সবে আগস্ট মাস। যদি ডিসেম্বরে নির্বাচন হয় তাহলে আরও তিনটি মাস বাকি আছে। এর মধ্যে নানান ধরনের গুজব প্রতিদিন পল্লবিত হতে থাকবে এবং দুই দলের মুখপাত্ররা তাঁদের বক্তব্য দিয়েই যাবেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য যাঁরা রাজনীতিক, তাঁরা সব সময়ই সমঝোতার পথ খোলা রাখেন। আলোচনাই গণতন্ত্রের মুখ্য শক্তি। সেই আলোচনাকে পরিহার করে দুটি দল যদি আলাদাভাবে তাদের বক্তব্য দিতেই থাকে, তাহলে দুটি সমান্তরালে তারা এগিয়ে যাবে, কিন্তু কোনো ফয়সালা হবে না। সাধারণ মানুষ দেশ পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, একটা নির্বাচিত সরকার চায় এবং সেই সঙ্গে একটি বিরোধী দলও চায়। সরকার এবং বিরোধী দল সংসদে বসে তর্ক-বিতর্ক করে কখনো সমঝোতায় পৌঁছাবে, কখনো আন্দোলনের পথ বেছে নেবে।
আমাদের সংসদের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ কক্ষটি কখনোই বিরোধী দলের জন্য আরামদায়ক হলো না। কিছুদিন পরেই তারা রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। সংসদ পরিত্যক্ত হয়। একতরফা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংসদের কার্যক্রম চলে। এই ধরনের আপসহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনমনে একটা চিরন্তন হতাশার সৃষ্টি করে। সব সময়ই আন্দোলনের মূল স্লোগান থাকে ‘এক দফা’। সরকারের পতন এবং ক্ষমতায় আরোহণ। এর মধ্যে কত যে সামাজিক সংকট ঘটে যায়, তা নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা থাকে না। সরকার তার নিজস্ব প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর বিরোধী দল আন্দোলনে একই বক্তব্য দিতে থাকে। বিরোধী দলের বক্তব্যে দেশের অন্য কোনো বিষয় স্থান পায় না। যেসব জায়গায় সরকারের দুর্বলতা আছে, সেগুলো নিয়েও কোনো কথা তারা বলে না। মূল্যবোধের যে কত বড় অবক্ষয় হয়েছে, মিডিয়া কীভাবে মানুষকে অস্থির করে দিচ্ছে, তা নিয়ে কোনো কথা তারা বলে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে কী করা যায়, ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে, সে বিষয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
এসব ক্ষেত্রে চিরদিনই সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে বাম দলগুলো; বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির লাগাতার কোনো আন্দোলন না থাকায় তারা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে না। খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মাঝেই তাদের আনাগোনা। অথচ একদা এই বাম দলগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত রচনা করেছিল এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং তার পরে বাম দলগুলোই ঐক্যবদ্ধ শক্তি হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু ক্রমেই তা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। যুক্তি-তর্ক, শিক্ষা-দীক্ষায়, আচার-আচরণে—সব দিক থেকে বাম দলের কর্মীরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। মানুষ কোনো যৌক্তিক সমাধান চাইলে তাঁদের কাছে যেত। কিন্তু কালক্রমে এমন বৃত্তাবদ্ধ হয়ে গেল যে একটা নিষ্ক্রিয়তা তাঁদের গ্রাস করে ফেলল।
সম্প্রতি কিছু কিছু ভাঙন আরও হতাশার দিকে নিয়ে গেল। প্রায় প্রতিটি বাম দলই নিজেদের মধ্যে ভাঙনের কাজটি সমাপ্ত করেছে। তার ভেতরেও ক্ষমতার বিষয়টি আছে এবং সামন্তবাদী চেতনা নিয়ে বাম দল করা যায় না—এটাও প্রমাণিত হয়েছে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষা-দীক্ষার সমস্যা তো আছেই। আর এই শিক্ষা-দীক্ষা দেশের সামগ্রিক রাজনীতিকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করছে না। মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পেশিশক্তি।
প্রতিদিনই পত্রিকায় দেখা যায় দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই, যেখানে কোনো যুক্তিতর্ক নেই, আছে দখলের নিষ্ঠুর পাঁয়তারা। এর মধ্যে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কৌশলটি দুই মুখ্য দলের মধ্যেই এসে গেছে। আজ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতির কোনো আভাস পাওয়া যায় না। স্কুল-কলেজে সংস্কৃতিরচর্চা একেবারেই বিবর্জিত। কিন্তু মাদ্রাসায় ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা একটা বড় শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অধিকাংশ নারী হিজাব-বোরকার অন্তরালে চলে গেছেন। বেগম রোকেয়া যে অন্ধকার দেখেছিলেন এবং যেই অন্ধকার থেকে নারীসমাজকে জাগানোর প্রয়োজন বোধ করেছিলেন, সেই অন্ধকার আবার গ্রাস করছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময়ই বাম ধারার ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনীতি করে গেছে। তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো ছিল সক্রিয়। সংখ্যার দিক থেকে এই সংগঠনগুলো এগিয়ে থাকলেও গুণগত কোনো উৎকর্ষ দেখা যায় না।
মানুষকে ভয়শূন্য এবং স্বপ্নের দিকে নিয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে একটা সুবাতাস বইয়ে দিতে পারত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে হয়তো কোনো সামাজিক আন্দোলনই এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
একটা প্রবল অস্থিরতা বিরাজ করছে রাজনীতিতে। যার প্রভাব এসে পড়েছে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে। মানুষ একধরনের আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। খবরের কাগজে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সর্বত্রই নির্বাচনের সংবাদ। দুই বৃহৎ দলের প্রতিক্রিয়া প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। দুই দলই অনমনীয়। মাঝখান থেকে মানুষ একটা সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে।
এই ধরনের সংকট অতীতেও বহুবার হয়েছে। যাঁদের বয়স সত্তরোর্ধ্ব, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে সংঘাত দেখেছেন। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময়গুলো ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। তারপর আইয়ুব খানের সময়ে জেল-জুলুম, নির্যাতন এবং রাজপথের সংঘাত—এসবও পুরো একাত্তর সাল পর্যন্ত ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এরপর ২৫ মার্চের রাত, যেখান থেকে এক শ্বাসরুদ্ধকর নির্যাতন নেমে এসেছিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। নিজ দেশের শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের যুদ্ধ। পাকিস্তানের বিখ্যাত বিচারপতি কায়ানি পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছিলেন। তা হলো, ‘আমি আমার সেনাবাহিনীর জন্য গর্ববোধ করি, যারা তাদের মাতৃভূমিকে দখল করে ফেলেছে।’ এই মাতৃভূমি দখল করার পাঁয়তারা হিসেবে তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
অবশ্য নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর তথাকথিত পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছিল কিন্তু এই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অবসান হয়নি, অনিশ্চিত দিনগুলো তখনো ছিল। চারদিকে প্রত্যাশা ব্যাপক এবং সেই সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়ে অসহিষ্ণুতা। পরিস্থিতি গড়িয়ে গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে। সেনাবাহিনীর কতিপয় তরুণ অফিসার দেশটাকে দখল করে ফেললেন।
সেই পথ ধরেই পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশে চলে এল সামরিক শাসন। সেই পুরোনো পদবি আবার শুনতে পাওয়া গেল—চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ডেপুটি চিফ মার্শাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, জোনাল মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইত্যাদি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা একেবারেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সামরিক শাসনকে আশ্রয় দিলেন এবং একজন বিচারপতি প্রধান সামরিক শাসকও হয়ে গেলেন। পরবর্তীকালে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। সামরিক শাসনামলে সংবিধান এবং মানবাধিকার স্থগিত থাকে। কিন্তু বাংলার মানুষ কখনোই সামরিক শাসনকে মেনে নেয়নি। দেশের স্বার্থে কৃষক, শ্রমিক, সংস্কৃতিকর্মী সবাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলন মানেই যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে, তাদের সঙ্গে সংঘাত। ১৫টি বছর নির্যাতন, নিপীড়ন সংঘাত শেষে সামরিক শাসনের অবসান হয়। কিন্তু সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় যে একাত্তরের ঘাতকেরা পুনর্বাসিত হয়েছিল, তাদের অগ্রযাত্রা চলতেই থাকল। অতএব নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত হলো না।
পৃথিবীর সব দেশেই সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়ে থাকে কিন্তু জনগণকে জিম্মি করে কোনো আন্দোলন বেশি দূর এগোতে পারে না। নেপালে দীর্ঘ দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে কিন্তু পর্যটক এবং সাধারণ মানুষ সেখানে নিরাপদে থেকেছে। থাইল্যান্ডেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন হয় কিন্তু জনজীবনে তার তেমন প্রভাব পড়ে না। তবে জনগণের একটা বড় অংশ যখন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখনই সরকারের পতন ঘটে যায়। বাংলাদেশে সবকিছুই জনগণকে স্পর্শ করে যায়। গাড়ি পোড়ানো থেকে শুরু করে নানান ধরনের সহিংসতা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়।
এবারের চিত্রটি একটু ভিন্ন। দুই দলই একই দিনে কর্মসূচি দিচ্ছে। কিন্তু তেমন কোনো মুখোমুখি সংঘাত দেখা যাচ্ছে না। তার একটা কারণ আছে, হয়তো সেটাই বড় কারণ যে বিদেশি কূটনীতিকেরা খুব নিবিড়ভাবে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার এবং বিরোধী দল দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানকে শান্তিপূর্ণ বলে প্রমাণ করতে চাইছে। ফলাফলে অর্থনীতি মন্থর হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগ কমছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের নিয়ন্ত্রণ কারও কাছে থাকছে না।
এটা সবে আগস্ট মাস। যদি ডিসেম্বরে নির্বাচন হয় তাহলে আরও তিনটি মাস বাকি আছে। এর মধ্যে নানান ধরনের গুজব প্রতিদিন পল্লবিত হতে থাকবে এবং দুই দলের মুখপাত্ররা তাঁদের বক্তব্য দিয়েই যাবেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য যাঁরা রাজনীতিক, তাঁরা সব সময়ই সমঝোতার পথ খোলা রাখেন। আলোচনাই গণতন্ত্রের মুখ্য শক্তি। সেই আলোচনাকে পরিহার করে দুটি দল যদি আলাদাভাবে তাদের বক্তব্য দিতেই থাকে, তাহলে দুটি সমান্তরালে তারা এগিয়ে যাবে, কিন্তু কোনো ফয়সালা হবে না। সাধারণ মানুষ দেশ পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, একটা নির্বাচিত সরকার চায় এবং সেই সঙ্গে একটি বিরোধী দলও চায়। সরকার এবং বিরোধী দল সংসদে বসে তর্ক-বিতর্ক করে কখনো সমঝোতায় পৌঁছাবে, কখনো আন্দোলনের পথ বেছে নেবে।
আমাদের সংসদের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ কক্ষটি কখনোই বিরোধী দলের জন্য আরামদায়ক হলো না। কিছুদিন পরেই তারা রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। সংসদ পরিত্যক্ত হয়। একতরফা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংসদের কার্যক্রম চলে। এই ধরনের আপসহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনমনে একটা চিরন্তন হতাশার সৃষ্টি করে। সব সময়ই আন্দোলনের মূল স্লোগান থাকে ‘এক দফা’। সরকারের পতন এবং ক্ষমতায় আরোহণ। এর মধ্যে কত যে সামাজিক সংকট ঘটে যায়, তা নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা থাকে না। সরকার তার নিজস্ব প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর বিরোধী দল আন্দোলনে একই বক্তব্য দিতে থাকে। বিরোধী দলের বক্তব্যে দেশের অন্য কোনো বিষয় স্থান পায় না। যেসব জায়গায় সরকারের দুর্বলতা আছে, সেগুলো নিয়েও কোনো কথা তারা বলে না। মূল্যবোধের যে কত বড় অবক্ষয় হয়েছে, মিডিয়া কীভাবে মানুষকে অস্থির করে দিচ্ছে, তা নিয়ে কোনো কথা তারা বলে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে কী করা যায়, ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে, সে বিষয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
এসব ক্ষেত্রে চিরদিনই সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে বাম দলগুলো; বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির লাগাতার কোনো আন্দোলন না থাকায় তারা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে না। খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মাঝেই তাদের আনাগোনা। অথচ একদা এই বাম দলগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত রচনা করেছিল এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং তার পরে বাম দলগুলোই ঐক্যবদ্ধ শক্তি হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু ক্রমেই তা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। যুক্তি-তর্ক, শিক্ষা-দীক্ষায়, আচার-আচরণে—সব দিক থেকে বাম দলের কর্মীরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। মানুষ কোনো যৌক্তিক সমাধান চাইলে তাঁদের কাছে যেত। কিন্তু কালক্রমে এমন বৃত্তাবদ্ধ হয়ে গেল যে একটা নিষ্ক্রিয়তা তাঁদের গ্রাস করে ফেলল।
সম্প্রতি কিছু কিছু ভাঙন আরও হতাশার দিকে নিয়ে গেল। প্রায় প্রতিটি বাম দলই নিজেদের মধ্যে ভাঙনের কাজটি সমাপ্ত করেছে। তার ভেতরেও ক্ষমতার বিষয়টি আছে এবং সামন্তবাদী চেতনা নিয়ে বাম দল করা যায় না—এটাও প্রমাণিত হয়েছে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষা-দীক্ষার সমস্যা তো আছেই। আর এই শিক্ষা-দীক্ষা দেশের সামগ্রিক রাজনীতিকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করছে না। মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পেশিশক্তি।
প্রতিদিনই পত্রিকায় দেখা যায় দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই, যেখানে কোনো যুক্তিতর্ক নেই, আছে দখলের নিষ্ঠুর পাঁয়তারা। এর মধ্যে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কৌশলটি দুই মুখ্য দলের মধ্যেই এসে গেছে। আজ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতির কোনো আভাস পাওয়া যায় না। স্কুল-কলেজে সংস্কৃতিরচর্চা একেবারেই বিবর্জিত। কিন্তু মাদ্রাসায় ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা একটা বড় শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অধিকাংশ নারী হিজাব-বোরকার অন্তরালে চলে গেছেন। বেগম রোকেয়া যে অন্ধকার দেখেছিলেন এবং যেই অন্ধকার থেকে নারীসমাজকে জাগানোর প্রয়োজন বোধ করেছিলেন, সেই অন্ধকার আবার গ্রাস করছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময়ই বাম ধারার ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনীতি করে গেছে। তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো ছিল সক্রিয়। সংখ্যার দিক থেকে এই সংগঠনগুলো এগিয়ে থাকলেও গুণগত কোনো উৎকর্ষ দেখা যায় না।
মানুষকে ভয়শূন্য এবং স্বপ্নের দিকে নিয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে একটা সুবাতাস বইয়ে দিতে পারত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে হয়তো কোনো সামাজিক আন্দোলনই এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে