ড. মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ভারত হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু বাংলাদেশি মিষ্টি বিতরণ করে, পটকা ফুটিয়ে ও মিছিল করে আনন্দ প্রকাশ করেছে। এটা নিয়ে ভারতে অত্যন্ত তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপির কিছু নেতা এই আচরণকে বাংলাদেশিদের ‘অগ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতা’ বলে অভিহিত করেছেন। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছে। তাঁরা এমনকি এটাও দাবি করেছেন, ৫২ বছর ধরে ভারতই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ভারতের করুণা না পেলে এখনো নাকি বাংলাদেশের অর্থনীতি ধসে যাবে। এসব মূর্খতাপ্রসূত একপক্ষীয় আক্রমণ যে একধরনের মানসিকতার প্রতিফলন, সেটাই সমস্যার মূল কারণ।
দুঃখজনকভাবে এই মানসিকতায় আক্রান্ত ভারতের সিংহভাগ মানুষ। বাংলাদেশ সম্পর্কে সংখ্যাগুরু ভারতীয়র এহেন ‘আধিপত্যবাদী’ আচরণ কোনো সচেতন ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন বাংলাদেশি কখনোই মেনে নিতে পারে না। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে সব প্রতিবেশী দেশের জনগণের মধ্যেই ভারতের এই ‘আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী দাদাগিরি’ ভূমিকা ক্রমবর্ধমান ‘ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট’ সৃষ্টি করে চলেছে। ভারতের জন্মশত্রু পাকিস্তান ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কথা বাদ দিলেও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এ রকম ভারতবিরোধিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৯৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও নেপালের মানুষ ভারতকে প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করে, এমনকি ঘৃণা করে থাকে। আমি ভারতীয়দের বলছি, বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখুন।
কোনো বিবেকবান বাংলাদেশিই কখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের ‘ঐতিহাসিক ধাত্রীর’ ভূমিকাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু ‘শুধু ভারত’ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বললে বাংলাদেশিদের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে কি অবমূল্যায়ন ও অস্বীকার করা হয় না? ৩০ লাখ শহীদের মৃত্যু এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে—এ কথাটা ভারতীয়রা ভুলে যায় কেন? ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যের আত্মাহুতিকে আমি কোনোমতেই ছোট করব না। শুধু প্রশ্ন করব, ওই বছরের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের কথা ভারতীয়রা ভুলে গেল কেন?
স্বাধীনতার উষালগ্নে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ভারত যেভাবে সাহায্য-সহায়তা দিয়েছে, সেটাকেও অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আর বন্ধুসুলভ ছিল না। কেন? বিশেষ করে সমরপ্রভু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক চরম বৈরিতায় পর্যবসিত হয়েছিল। স্বৈরাচার এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনামলে এবং খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ সালের মেয়াদের শাসনামলে এই দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক অতখানি বৈরী না হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে এ দেশের দীর্ঘ ১৫ বছরের বৈরী সম্পর্কের পরিবর্তে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবারও ভারত-বৈরিতা বাংলাদেশ সরকারের মূলনীতিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক ক্রমেই বন্ধুসুলভ হয়ে উঠেছে এবং এখনো সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো রয়েছে।
তারপরও বলব, বাংলাদেশের জনগণের একাংশ এখনো ভারতকে বন্ধু মনে করে না। তাদের মতে, শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে অকৃপণভাবে ভারতের দাবিগুলো মেনে নিয়ে চলেছে, তার বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা এখনো দিচ্ছে না। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষ এবং তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ এক যুগের অচলাবস্থা এই সেন্টিমেন্টকে দিন দিন উসকে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রায় সমসংখ্যক মানুষ রয়েছে, যারা এ দলকে যেমন ঘৃণা করে, তেমনিভাবে ভারতকেও ঘৃণা করে। তাদের মধ্যে যেমন বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক রয়েছে, তেমনি ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থী অন্য দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন সমর্থক এবং চীনপন্থী বাম ঘরানার মানুষও রয়েছে। অতএব ভারতের পরাজয়ে আনন্দ-উল্লাস করার মানুষের অভাব হবে না এ দেশে।
ভারতের নেতিবাচক বিষয়গুলোর মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য হলো ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং সংঘাতের বিষয়টি; বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির শাসনামলে কট্টর হিন্দুত্ববাদের জোয়ার ভারতকে মধ্যযুগের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি তাদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে রাখঢাক ছাড়াই সামনে নিয়ে আসে। নির্বাচিত হয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করে চলেছে, যার মধ্যে ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিলোপ, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি) আইন পাস এবং সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) পাস গোটা ভারতে এবং বিশ্বজুড়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সিএএ অ্যাক্টে মুসলিমদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর একই আইনে অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। এটা যে চরম বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িকতা পক্ষপাতদুষ্ট, বিবেকসম্পন্ন কেউ তা অস্বীকার করবে না। সেটা খোদ জাতিসংঘকেও ঘোষণা করতে হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে মোদি পুরোপুরি নির্বিকার। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন, হিন্দুত্ববাদী চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আফিম এখন ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করেছে। অতএব আগামী কয়েকটি নির্বাচনেও বিজেপির বিজয়ের সম্ভাবনা এই আফিমের মৌতাতে বাড়বে বৈ কমবে না।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ২০১৪ সালের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভারতের ২০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন আক্ষরিকভাবেই বৈষম্যের শিকার হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে গেছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এখনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রাণঘাতী সমস্যা হিসেবে বহাল রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের একাংশও এ রকম ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ ধারণ করে রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে দমনে তৎপর থাকায় তারা এ দেশে মাথা তুলে সমাজকে দংশন করতে পারছে না। এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমর্থকদের প্রায় সবাই কট্টর ভারতবিরোধী। জনগণের এ অংশটি এখনো পাকিস্তানপ্রেমে বুঁদ হয়ে রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের মতো পাকিস্তানপ্রেমী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে এই প্রেমকে চাগিয়ে তোলায় তৎপর রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি ভারতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তাঁর মুসলিম-নিধনকারী রাজনীতি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধিতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমার আশঙ্কা, এখন বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
উপরন্তু ৫২ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থানে উঠে এসেছে, তাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে এ দেশকে এখনো ভারতের গলগ্রহ ও করুণা-ভিক্ষুক দেশ হিসেবে যেভাবে ভারতীয়দের সংখ্যাগুরু জনগণ চিহ্নিত করে চলেছে, সেটাকে একদল অশিক্ষিত ও মূর্খ লোকের ঘৃণ্য মিথ্যাচার মনে করলে দোষণীয় বলা যাবে কি? একটা বাস্তবতা এখনো সংখ্যাগুরু ভারতীয়দের মনোজগতে হয়তো দৃঢ়মূল হয়নি যে আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের অর্থনীতি এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও ভালো করছে। আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এখন আর উল্লেখযোগ্য ঘাটতি হচ্ছে না। যেটুকু বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি রয়েছে, সেটুকু আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ থেকে প্রায় বছর মেটাতে পারছি। ভারত বাংলাদেশকে যে বৈদেশিক ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, সেগুলো সবই এমন সব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যে প্রকল্পগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের প্রয়োজনই বেশি মেটাবে। ‘ক্রস-বর্ডার কানেকটিভিটি’ বৃদ্ধির আবশ্যকতা বাংলাদেশের জন্য যতখানি প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্সের’ জন্য। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের উপকার যতখানি বাংলাদেশ পাবে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পাবে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’।
ভারত বাংলাদেশের আমদানিপণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সূত্র হলেও ওই সূত্র বিঘ্নিত বা বন্ধ হলে বিকল্প সূত্র পেতে বাংলাদেশের খুব বেশি অসুবিধে হবে না। একটা কথা ভারতীয়দের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, পারস্পরিক বাণিজ্য-সম্পর্ক দুই দেশের জন্য ‘উইন উইন প্রোপজিশন’ না হলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় না। যেহেতু বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য প্রবাহ ভারতকেই অনেক বেশি সুবিধা করে দিচ্ছে, এটাকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দয়াদাক্ষিণ্য মনে করা চরম মূর্খতা। ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই চাই আমরা। কিন্তু বন্ধুত্ব হয় দুই সমমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিবেশীর মধ্যে, পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। বিজেপির আমলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, তাচ্ছিল্য ও বিদ্বেষ যদি ভারতীয়দের মনের মধ্যে গেঁথে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের বন্ধুত্ব কখনোই দৃঢ়মূল হবে না।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্প্রতি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ভারত হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু বাংলাদেশি মিষ্টি বিতরণ করে, পটকা ফুটিয়ে ও মিছিল করে আনন্দ প্রকাশ করেছে। এটা নিয়ে ভারতে অত্যন্ত তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপির কিছু নেতা এই আচরণকে বাংলাদেশিদের ‘অগ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতা’ বলে অভিহিত করেছেন। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছে। তাঁরা এমনকি এটাও দাবি করেছেন, ৫২ বছর ধরে ভারতই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ভারতের করুণা না পেলে এখনো নাকি বাংলাদেশের অর্থনীতি ধসে যাবে। এসব মূর্খতাপ্রসূত একপক্ষীয় আক্রমণ যে একধরনের মানসিকতার প্রতিফলন, সেটাই সমস্যার মূল কারণ।
দুঃখজনকভাবে এই মানসিকতায় আক্রান্ত ভারতের সিংহভাগ মানুষ। বাংলাদেশ সম্পর্কে সংখ্যাগুরু ভারতীয়র এহেন ‘আধিপত্যবাদী’ আচরণ কোনো সচেতন ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন বাংলাদেশি কখনোই মেনে নিতে পারে না। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে সব প্রতিবেশী দেশের জনগণের মধ্যেই ভারতের এই ‘আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী দাদাগিরি’ ভূমিকা ক্রমবর্ধমান ‘ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট’ সৃষ্টি করে চলেছে। ভারতের জন্মশত্রু পাকিস্তান ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কথা বাদ দিলেও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এ রকম ভারতবিরোধিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৯৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও নেপালের মানুষ ভারতকে প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করে, এমনকি ঘৃণা করে থাকে। আমি ভারতীয়দের বলছি, বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখুন।
কোনো বিবেকবান বাংলাদেশিই কখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের ‘ঐতিহাসিক ধাত্রীর’ ভূমিকাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু ‘শুধু ভারত’ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বললে বাংলাদেশিদের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে কি অবমূল্যায়ন ও অস্বীকার করা হয় না? ৩০ লাখ শহীদের মৃত্যু এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে—এ কথাটা ভারতীয়রা ভুলে যায় কেন? ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যের আত্মাহুতিকে আমি কোনোমতেই ছোট করব না। শুধু প্রশ্ন করব, ওই বছরের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের কথা ভারতীয়রা ভুলে গেল কেন?
স্বাধীনতার উষালগ্নে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ভারত যেভাবে সাহায্য-সহায়তা দিয়েছে, সেটাকেও অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আর বন্ধুসুলভ ছিল না। কেন? বিশেষ করে সমরপ্রভু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক চরম বৈরিতায় পর্যবসিত হয়েছিল। স্বৈরাচার এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনামলে এবং খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ সালের মেয়াদের শাসনামলে এই দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক অতখানি বৈরী না হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে এ দেশের দীর্ঘ ১৫ বছরের বৈরী সম্পর্কের পরিবর্তে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবারও ভারত-বৈরিতা বাংলাদেশ সরকারের মূলনীতিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক ক্রমেই বন্ধুসুলভ হয়ে উঠেছে এবং এখনো সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো রয়েছে।
তারপরও বলব, বাংলাদেশের জনগণের একাংশ এখনো ভারতকে বন্ধু মনে করে না। তাদের মতে, শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে অকৃপণভাবে ভারতের দাবিগুলো মেনে নিয়ে চলেছে, তার বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা এখনো দিচ্ছে না। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষ এবং তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ এক যুগের অচলাবস্থা এই সেন্টিমেন্টকে দিন দিন উসকে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রায় সমসংখ্যক মানুষ রয়েছে, যারা এ দলকে যেমন ঘৃণা করে, তেমনিভাবে ভারতকেও ঘৃণা করে। তাদের মধ্যে যেমন বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক রয়েছে, তেমনি ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থী অন্য দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন সমর্থক এবং চীনপন্থী বাম ঘরানার মানুষও রয়েছে। অতএব ভারতের পরাজয়ে আনন্দ-উল্লাস করার মানুষের অভাব হবে না এ দেশে।
ভারতের নেতিবাচক বিষয়গুলোর মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য হলো ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং সংঘাতের বিষয়টি; বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির শাসনামলে কট্টর হিন্দুত্ববাদের জোয়ার ভারতকে মধ্যযুগের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি তাদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে রাখঢাক ছাড়াই সামনে নিয়ে আসে। নির্বাচিত হয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করে চলেছে, যার মধ্যে ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিলোপ, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি) আইন পাস এবং সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) পাস গোটা ভারতে এবং বিশ্বজুড়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সিএএ অ্যাক্টে মুসলিমদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর একই আইনে অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। এটা যে চরম বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িকতা পক্ষপাতদুষ্ট, বিবেকসম্পন্ন কেউ তা অস্বীকার করবে না। সেটা খোদ জাতিসংঘকেও ঘোষণা করতে হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে মোদি পুরোপুরি নির্বিকার। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন, হিন্দুত্ববাদী চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আফিম এখন ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করেছে। অতএব আগামী কয়েকটি নির্বাচনেও বিজেপির বিজয়ের সম্ভাবনা এই আফিমের মৌতাতে বাড়বে বৈ কমবে না।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ২০১৪ সালের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভারতের ২০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন আক্ষরিকভাবেই বৈষম্যের শিকার হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে গেছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এখনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রাণঘাতী সমস্যা হিসেবে বহাল রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের একাংশও এ রকম ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ ধারণ করে রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে দমনে তৎপর থাকায় তারা এ দেশে মাথা তুলে সমাজকে দংশন করতে পারছে না। এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমর্থকদের প্রায় সবাই কট্টর ভারতবিরোধী। জনগণের এ অংশটি এখনো পাকিস্তানপ্রেমে বুঁদ হয়ে রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের মতো পাকিস্তানপ্রেমী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে এই প্রেমকে চাগিয়ে তোলায় তৎপর রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি ভারতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তাঁর মুসলিম-নিধনকারী রাজনীতি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধিতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমার আশঙ্কা, এখন বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
উপরন্তু ৫২ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থানে উঠে এসেছে, তাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে এ দেশকে এখনো ভারতের গলগ্রহ ও করুণা-ভিক্ষুক দেশ হিসেবে যেভাবে ভারতীয়দের সংখ্যাগুরু জনগণ চিহ্নিত করে চলেছে, সেটাকে একদল অশিক্ষিত ও মূর্খ লোকের ঘৃণ্য মিথ্যাচার মনে করলে দোষণীয় বলা যাবে কি? একটা বাস্তবতা এখনো সংখ্যাগুরু ভারতীয়দের মনোজগতে হয়তো দৃঢ়মূল হয়নি যে আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের অর্থনীতি এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও ভালো করছে। আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এখন আর উল্লেখযোগ্য ঘাটতি হচ্ছে না। যেটুকু বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি রয়েছে, সেটুকু আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ থেকে প্রায় বছর মেটাতে পারছি। ভারত বাংলাদেশকে যে বৈদেশিক ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, সেগুলো সবই এমন সব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যে প্রকল্পগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের প্রয়োজনই বেশি মেটাবে। ‘ক্রস-বর্ডার কানেকটিভিটি’ বৃদ্ধির আবশ্যকতা বাংলাদেশের জন্য যতখানি প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্সের’ জন্য। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের উপকার যতখানি বাংলাদেশ পাবে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পাবে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’।
ভারত বাংলাদেশের আমদানিপণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সূত্র হলেও ওই সূত্র বিঘ্নিত বা বন্ধ হলে বিকল্প সূত্র পেতে বাংলাদেশের খুব বেশি অসুবিধে হবে না। একটা কথা ভারতীয়দের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, পারস্পরিক বাণিজ্য-সম্পর্ক দুই দেশের জন্য ‘উইন উইন প্রোপজিশন’ না হলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় না। যেহেতু বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য প্রবাহ ভারতকেই অনেক বেশি সুবিধা করে দিচ্ছে, এটাকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দয়াদাক্ষিণ্য মনে করা চরম মূর্খতা। ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই চাই আমরা। কিন্তু বন্ধুত্ব হয় দুই সমমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিবেশীর মধ্যে, পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। বিজেপির আমলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, তাচ্ছিল্য ও বিদ্বেষ যদি ভারতীয়দের মনের মধ্যে গেঁথে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের বন্ধুত্ব কখনোই দৃঢ়মূল হবে না।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ ঘণ্টা আগে