রুশা চৌধুরী
‘গান তুমি হও বিশ্রী গরম ভুলিয়ে দেওয়া বৃষ্টি, ভাঙাচোরা জীবনটাকে হঠাৎ লাগে মিষ্টি!’ বাঙালির ভালোবাসার কথা বলতে গেলে অনেক কিছুর সঙ্গে যেই নামটা উচ্চারণ করতে হবে তা হচ্ছে, গান!
আটপৌরে বাঙালির জীবনে ‘গান’ শুধু ‘শুদ্ধ সংগীত’ হয়ে না থেকে একেবারে অন্দরমহলে পাকাপোক্ত স্থান করে তাদের অমৃতের পুত্র-কন্যা করে তুলেছে।
যদি একটু পেছনে তাকাই, প্রত্যেক বাঙালির মনের মধ্যে গুনগুন করে উঠত সেই ছেলেভোলানো গান, ‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো...’! যে মানুষ জীবনে এক লাইনও সুরে গায়নি কখনো, সে-ও এই সুরটা ঠিক গাইতে পারবে।
ছেলেবেলাটা সুখ বা দুঃখ যা দিয়েই মোড়ানো থাকুক না কেন, ‘আয় খুকু আয়’—গানের সুরে বুড়ি হয়ে যাওয়া মেয়েটিও বলবে...‘জানি না কজনে আমার মতো, মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়!’ এই পিছু ডাকটাই বেঁধে রাখে, আগলে রাখে পুরো জীবনটাকে।
স্কুল বা বাড়ির উঠোনে ‘ওপেনটি বায়স্কোপ’ ছড়াটাও সুরে সুরেই গাওয়া হতো আমাদের ছোটবেলায়।
‘লেখা পড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ আওড়ে বড় হওয়া বাঙালির জীবনটাকে সহজ করে নেওয়ার আশ্রয় এ গান! যে ধর্মেরই হোক সব প্রার্থনা সুরে সুরেই প্রাণ পায় বাঙালির কাছে। হামদ-নাত, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, শ্যামাসংগীত, মাইজভান্ডারি থেকে বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ধামাইল, গম্ভীরা, পালা, মৈমনসিংহ-গীতিকা, আসামকেন্দ্রিক গানগুলো বলে দেয়, সুর আর গান কতটা ঘিরে রেখেছে আমাদের জীবন।
যে মাকে নিয়ে বাঙালির প্রথম ভালোবাসা প্রাণ পায়, সেই মায়ের হাসি তাই গানের সুরে ‘চাঁদের মুখে ঝরে’, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’। বাঙালির তাই অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশে সুরের কাছে আশ্রয় খোঁজা—এ যেন ‘তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে’!
এই অসুরের দাপটে ব্যস্ত জীবনে গানটাই যেন আজও মানুষকে খোকা-খুকি করে তরুণ বানিয়ে রাখতে পারে। আঁতুড় থেকে ছেলেভোলানো সুর, প্রথম প্রেম বা বিচ্ছেদ, বিরহ-মিলনে, কাজে-অকাজে, ভ্রমণে-বিলাসে, প্রতিবাদে-অনশনে, মুক্তিতে-ভক্তিতে—সবটায় বাঙালি গানকে সঙ্গে নিয়েই চলে।
উত্তরবঙ্গের অভিমানী নারী যখন সুর করে গেয়ে ওঠেন, ‘ও কী ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু...’। উত্তরের বাতাস সুর বয়ে আনে, ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া’।
অন্যদিকে দল বেঁধে এক দল গায়, ‘বিন্নি ধানের ভাত আন্দিমো ক্ষীর পাকামো রসি, সিদোল পোড়া ভত্তা খাইমেন শীতল পাটিত বসি’!
বড় দালানের ছাদ পিটাতে পিটাতে ক্লান্ত হতে না চাওয়া মানুষগুলো তখন গায়, ‘সারা দিন পিটি কার দালানের ছাদ গো, সারা দিন পিটি’!
ঢেঁকিতে ধান ভানার দিনগুলো হারিয়ে গেলেও দু-একজন আজও ঢেঁকির গায়ে পা দিয়ে সুর তোলে, ‘ধান ভানি আর করি কাম, বাড়িতে আইল নয়া ধান, রইদেতে শুকাইয়া ধান, ঢেঁকি পাড়ায় ফুলজান’।
আরেক প্রান্তে দল বেঁধে নারীরা তখন প্রিয় কাউকে বিদায় জানিয়ে গান, ‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু, যাবেন ইবার শহরে, আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দেবে না পা ডহরে’।
আজও প্রবল তাপে ক্লিষ্ট বাঙালি প্রার্থনার সুরে গেয়ে ওঠে, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে ছায়া দে রে তুই’। শুকিয়ে আসা নদীর তীরে আর তখন কেউ গেয়ে ওঠে, ‘হলুদ কনের ভাদু তুমি হলুদ কেন মাখ না, শাশুড়ি ননদের ঘরে হলুদ মাখা সাজে না’! উন্মত্ত পদ্মার বুকে আজও বিরহী খুঁজে বেড়ায় সেই রাঙা পা, যা সেই কোনকালে সে হারিয়ে ফেলেছিল।
এভাবেই যাপিত জীবনের প্রেম, বিরহ, হাসি-কান্না, পার্বণ, আচার, দুঃখ, আনন্দ—সবকিছুকেই সুরে সাজায় বাঙালি। আর সুরের এই আচ্ছন্নতা চলমান রাখে জীবনকে।
আর ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ যেমন ভাঙে বাঙালি, তেমনি ভোরবেলা খালি পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ দিনের কাছে ফিরে যায়।
সেই ‘গ্রামোফোন’ নামের যন্ত্রটি বাঙালিকে যতটা আটকে ফেলেছিল আর কোনো যন্ত্র ততটা হয়তো পারেনি।
রঙিন চাকতি ছোট হলো, ফিতে বন্দী হলো চাকতিতে, তারপর আরও সহজলভ্য হয়ে আঙুলের ডগাতেই ঘুমঘোর ভেঙে মনোহর আজ একদম কানের পাশে মনের আঙিনায়। ‘হিজ মাস্টার ভয়েসে’র সেই বিষণ্ন কুকুরটা আজও যেন চোখে চোখ রেখে বসে থাকে, কানে সেই সব জীবন জড়িয়ে রাখা সুর।
ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাসে, নবীন প্রেমের উল্লাসে, বেড়ে ওঠার উদ্দীপনায়, বৃদ্ধ বয়সের আক্ষেপে বাঙালির জীবনে গান ছিল, আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। লালন-রবীন্দ্রনাথ, গীতগোবিন্দ, রাধারমণ, নজরুল, লোকগীতি থেকে নাম না-জানা মানুষটিও কোথায় যেন সুরের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেয়।
জীবনের পাতাগুলো তাই সুরের ধারায় সিক্ত থাকুক, এই সুরটুকুর জোরেই হয়তো আটপৌরে বাঙালি তার হাজারো না-পাওয়াকে পাওয়ার আলোয় ভরিয়ে নেয়!
লেখক: আবৃত্তিশিল্পী
‘গান তুমি হও বিশ্রী গরম ভুলিয়ে দেওয়া বৃষ্টি, ভাঙাচোরা জীবনটাকে হঠাৎ লাগে মিষ্টি!’ বাঙালির ভালোবাসার কথা বলতে গেলে অনেক কিছুর সঙ্গে যেই নামটা উচ্চারণ করতে হবে তা হচ্ছে, গান!
আটপৌরে বাঙালির জীবনে ‘গান’ শুধু ‘শুদ্ধ সংগীত’ হয়ে না থেকে একেবারে অন্দরমহলে পাকাপোক্ত স্থান করে তাদের অমৃতের পুত্র-কন্যা করে তুলেছে।
যদি একটু পেছনে তাকাই, প্রত্যেক বাঙালির মনের মধ্যে গুনগুন করে উঠত সেই ছেলেভোলানো গান, ‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো...’! যে মানুষ জীবনে এক লাইনও সুরে গায়নি কখনো, সে-ও এই সুরটা ঠিক গাইতে পারবে।
ছেলেবেলাটা সুখ বা দুঃখ যা দিয়েই মোড়ানো থাকুক না কেন, ‘আয় খুকু আয়’—গানের সুরে বুড়ি হয়ে যাওয়া মেয়েটিও বলবে...‘জানি না কজনে আমার মতো, মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়!’ এই পিছু ডাকটাই বেঁধে রাখে, আগলে রাখে পুরো জীবনটাকে।
স্কুল বা বাড়ির উঠোনে ‘ওপেনটি বায়স্কোপ’ ছড়াটাও সুরে সুরেই গাওয়া হতো আমাদের ছোটবেলায়।
‘লেখা পড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ আওড়ে বড় হওয়া বাঙালির জীবনটাকে সহজ করে নেওয়ার আশ্রয় এ গান! যে ধর্মেরই হোক সব প্রার্থনা সুরে সুরেই প্রাণ পায় বাঙালির কাছে। হামদ-নাত, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, শ্যামাসংগীত, মাইজভান্ডারি থেকে বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ধামাইল, গম্ভীরা, পালা, মৈমনসিংহ-গীতিকা, আসামকেন্দ্রিক গানগুলো বলে দেয়, সুর আর গান কতটা ঘিরে রেখেছে আমাদের জীবন।
যে মাকে নিয়ে বাঙালির প্রথম ভালোবাসা প্রাণ পায়, সেই মায়ের হাসি তাই গানের সুরে ‘চাঁদের মুখে ঝরে’, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’। বাঙালির তাই অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশে সুরের কাছে আশ্রয় খোঁজা—এ যেন ‘তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে’!
এই অসুরের দাপটে ব্যস্ত জীবনে গানটাই যেন আজও মানুষকে খোকা-খুকি করে তরুণ বানিয়ে রাখতে পারে। আঁতুড় থেকে ছেলেভোলানো সুর, প্রথম প্রেম বা বিচ্ছেদ, বিরহ-মিলনে, কাজে-অকাজে, ভ্রমণে-বিলাসে, প্রতিবাদে-অনশনে, মুক্তিতে-ভক্তিতে—সবটায় বাঙালি গানকে সঙ্গে নিয়েই চলে।
উত্তরবঙ্গের অভিমানী নারী যখন সুর করে গেয়ে ওঠেন, ‘ও কী ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু...’। উত্তরের বাতাস সুর বয়ে আনে, ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া’।
অন্যদিকে দল বেঁধে এক দল গায়, ‘বিন্নি ধানের ভাত আন্দিমো ক্ষীর পাকামো রসি, সিদোল পোড়া ভত্তা খাইমেন শীতল পাটিত বসি’!
বড় দালানের ছাদ পিটাতে পিটাতে ক্লান্ত হতে না চাওয়া মানুষগুলো তখন গায়, ‘সারা দিন পিটি কার দালানের ছাদ গো, সারা দিন পিটি’!
ঢেঁকিতে ধান ভানার দিনগুলো হারিয়ে গেলেও দু-একজন আজও ঢেঁকির গায়ে পা দিয়ে সুর তোলে, ‘ধান ভানি আর করি কাম, বাড়িতে আইল নয়া ধান, রইদেতে শুকাইয়া ধান, ঢেঁকি পাড়ায় ফুলজান’।
আরেক প্রান্তে দল বেঁধে নারীরা তখন প্রিয় কাউকে বিদায় জানিয়ে গান, ‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু, যাবেন ইবার শহরে, আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দেবে না পা ডহরে’।
আজও প্রবল তাপে ক্লিষ্ট বাঙালি প্রার্থনার সুরে গেয়ে ওঠে, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে ছায়া দে রে তুই’। শুকিয়ে আসা নদীর তীরে আর তখন কেউ গেয়ে ওঠে, ‘হলুদ কনের ভাদু তুমি হলুদ কেন মাখ না, শাশুড়ি ননদের ঘরে হলুদ মাখা সাজে না’! উন্মত্ত পদ্মার বুকে আজও বিরহী খুঁজে বেড়ায় সেই রাঙা পা, যা সেই কোনকালে সে হারিয়ে ফেলেছিল।
এভাবেই যাপিত জীবনের প্রেম, বিরহ, হাসি-কান্না, পার্বণ, আচার, দুঃখ, আনন্দ—সবকিছুকেই সুরে সাজায় বাঙালি। আর সুরের এই আচ্ছন্নতা চলমান রাখে জীবনকে।
আর ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ যেমন ভাঙে বাঙালি, তেমনি ভোরবেলা খালি পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ দিনের কাছে ফিরে যায়।
সেই ‘গ্রামোফোন’ নামের যন্ত্রটি বাঙালিকে যতটা আটকে ফেলেছিল আর কোনো যন্ত্র ততটা হয়তো পারেনি।
রঙিন চাকতি ছোট হলো, ফিতে বন্দী হলো চাকতিতে, তারপর আরও সহজলভ্য হয়ে আঙুলের ডগাতেই ঘুমঘোর ভেঙে মনোহর আজ একদম কানের পাশে মনের আঙিনায়। ‘হিজ মাস্টার ভয়েসে’র সেই বিষণ্ন কুকুরটা আজও যেন চোখে চোখ রেখে বসে থাকে, কানে সেই সব জীবন জড়িয়ে রাখা সুর।
ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাসে, নবীন প্রেমের উল্লাসে, বেড়ে ওঠার উদ্দীপনায়, বৃদ্ধ বয়সের আক্ষেপে বাঙালির জীবনে গান ছিল, আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। লালন-রবীন্দ্রনাথ, গীতগোবিন্দ, রাধারমণ, নজরুল, লোকগীতি থেকে নাম না-জানা মানুষটিও কোথায় যেন সুরের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেয়।
জীবনের পাতাগুলো তাই সুরের ধারায় সিক্ত থাকুক, এই সুরটুকুর জোরেই হয়তো আটপৌরে বাঙালি তার হাজারো না-পাওয়াকে পাওয়ার আলোয় ভরিয়ে নেয়!
লেখক: আবৃত্তিশিল্পী
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে