ড. মইনুল ইসলাম
২০২৩ সালের ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৫২তম বিজয় দিবসকে ধারণ করছে। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করে আমরা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম। যে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ডাইমেনশন বাংলাদেশের অর্থনীতির এই ইতিবাচক পরিবর্তনকে ধারণ করছে, সেগুলো নিম্নরূপ:
১. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২’ মোতাবেক ২০২২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ১৮ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, অথচ ১৯৭২ সালে এ দেশের ৮২ শতাংশ মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল।
২. ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য ১০ শতাংশের বেশি ছিল এবং ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে ওই অনুপাত ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। জিয়ার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈদেশিক অনুদান ও ঋণনির্ভরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর এ দেশের অর্থনীতির নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে জিডিপির ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের মাত্র ১ শতাংশের মতো ছিল খাদ্য সাহায্য, আর বাকি ৯৯ শতাংশই ছিল প্রকল্প ঋণ। এখন বাংলাদেশ আর পণ্য সাহায্য নেয় না। এর তাৎপর্য হলো, বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির টিকে থাকা না-থাকা এখন আর কোনোভাবেই নির্ভর করে না। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাতনির্ভর দেশ নয়; এটা এখন একটি বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশ এখন তার আমদানি ব্যয় আর রপ্তানি আয়ের ব্যবধানটা প্রায় বছর মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে পাঠানো রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বছরের পর বছর অব্যাহত চলমান প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৪. জনসংখ্যার অত্যন্ত অধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ২০২২ সালে তা সাড়ে তিন গুণের বেশি বেড়ে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২২ সালে ১ কোটি ৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। (এখনো আমরা অবশ্য প্রায় ৫৫-৬০ লাখ টন গম আমদানি করি।) মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। খাদ্যশস্য, মাছ, তরিতরকারি উৎপাদনের এই সাফল্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও পুষ্টিমান উন্নয়নে সহায়তা করছে। এটাও খুবই গুরুত্ববহ যে আকস্মিক খাদ্যসংকট মোকাবিলার জন্য ২০ লাখ টন খাদ্যশস্যের বিশাল মজুতও গড়ে তোলা হয়েছে।
৫. বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় প্রতিবছর বেড়েই চলেছে এবং দুই দশক গড়ে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশের মতো। করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগের বছর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক অভিঘাত সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম গতিশীল অর্থনীতি।
৬. ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার (৫,৫৫৬ কোটি ডলার), অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার, মানে ৭৫ দশমিক ২ কোটি ডলার। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজনির্মাণ ও কৃষিভিত্তিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাজারে ভালোই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৭. বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৫ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। চার দশক ধরে প্রতিবছর নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও ২০-২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
৮. ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের জীবন ও জীবিকাকে এই ক্ষুদ্রঋণ বেশ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২৮ শতাংশ ঋণগ্রহীতা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য, ক্ষুদ্রতর সংখ্যক ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা সাফল্যের সঙ্গে দারিদ্র্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন। দেশের দরিদ্র নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
৯. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মোতাবেক দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাকশিল্পে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশের বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হবে, তৈরি পোশাকশিল্প খাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
১০. অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘ মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) ও টার্গেট অর্জনে ২০১৫ সালের বহু আগেই বাংলাদেশ নিশ্চিত সাফল্য অর্জন করেছিল। ২০১৫-৩০ সালের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের’ প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টার্গেটগুলো পূরণে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করে চলেছে।
২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হওয়ায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:
১. মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
২. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
৩. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও সেটা পাকিস্তানের ছয় গুণের বেশি।
৪. বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
৫. বাংলাদেশে জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
৬. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
৭. বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৩ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ।
৮. বাংলাদেশে ১১৪-১১৫ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে ২৯০ রুপি লাগে। অথচ, ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।
৯. বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২২ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ।
১০. বাংলাদেশে নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
১১. বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানে ৫৯।
১২. বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানে ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না ইনশা আল্লাহ। তথ্য-উপাত্তগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে চলেছে যে ১৯৪৭-৭১ পর্যায়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে সীমাহীন বঞ্চনা, শোষণ ও পুঁজি-লুণ্ঠনের শিকার হওয়ায় ওপরের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের চেয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলাম বলেই এখন পাকিস্তানকে সব ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে দিয়েছি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৫২তম বিজয় দিবসকে ধারণ করছে। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করে আমরা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম। যে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ডাইমেনশন বাংলাদেশের অর্থনীতির এই ইতিবাচক পরিবর্তনকে ধারণ করছে, সেগুলো নিম্নরূপ:
১. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২’ মোতাবেক ২০২২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ১৮ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, অথচ ১৯৭২ সালে এ দেশের ৮২ শতাংশ মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল।
২. ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য ১০ শতাংশের বেশি ছিল এবং ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে ওই অনুপাত ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। জিয়ার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈদেশিক অনুদান ও ঋণনির্ভরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর এ দেশের অর্থনীতির নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে জিডিপির ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের মাত্র ১ শতাংশের মতো ছিল খাদ্য সাহায্য, আর বাকি ৯৯ শতাংশই ছিল প্রকল্প ঋণ। এখন বাংলাদেশ আর পণ্য সাহায্য নেয় না। এর তাৎপর্য হলো, বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির টিকে থাকা না-থাকা এখন আর কোনোভাবেই নির্ভর করে না। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাতনির্ভর দেশ নয়; এটা এখন একটি বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশ এখন তার আমদানি ব্যয় আর রপ্তানি আয়ের ব্যবধানটা প্রায় বছর মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে পাঠানো রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বছরের পর বছর অব্যাহত চলমান প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৪. জনসংখ্যার অত্যন্ত অধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ২০২২ সালে তা সাড়ে তিন গুণের বেশি বেড়ে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২২ সালে ১ কোটি ৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। (এখনো আমরা অবশ্য প্রায় ৫৫-৬০ লাখ টন গম আমদানি করি।) মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। খাদ্যশস্য, মাছ, তরিতরকারি উৎপাদনের এই সাফল্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও পুষ্টিমান উন্নয়নে সহায়তা করছে। এটাও খুবই গুরুত্ববহ যে আকস্মিক খাদ্যসংকট মোকাবিলার জন্য ২০ লাখ টন খাদ্যশস্যের বিশাল মজুতও গড়ে তোলা হয়েছে।
৫. বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় প্রতিবছর বেড়েই চলেছে এবং দুই দশক গড়ে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশের মতো। করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগের বছর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক অভিঘাত সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম গতিশীল অর্থনীতি।
৬. ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার (৫,৫৫৬ কোটি ডলার), অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার, মানে ৭৫ দশমিক ২ কোটি ডলার। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজনির্মাণ ও কৃষিভিত্তিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাজারে ভালোই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৭. বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৫ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। চার দশক ধরে প্রতিবছর নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও ২০-২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
৮. ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের জীবন ও জীবিকাকে এই ক্ষুদ্রঋণ বেশ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২৮ শতাংশ ঋণগ্রহীতা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য, ক্ষুদ্রতর সংখ্যক ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা সাফল্যের সঙ্গে দারিদ্র্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন। দেশের দরিদ্র নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
৯. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মোতাবেক দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাকশিল্পে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশের বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হবে, তৈরি পোশাকশিল্প খাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
১০. অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘ মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) ও টার্গেট অর্জনে ২০১৫ সালের বহু আগেই বাংলাদেশ নিশ্চিত সাফল্য অর্জন করেছিল। ২০১৫-৩০ সালের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের’ প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টার্গেটগুলো পূরণে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করে চলেছে।
২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হওয়ায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:
১. মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
২. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
৩. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও সেটা পাকিস্তানের ছয় গুণের বেশি।
৪. বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
৫. বাংলাদেশে জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
৬. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
৭. বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৩ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ।
৮. বাংলাদেশে ১১৪-১১৫ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে ২৯০ রুপি লাগে। অথচ, ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।
৯. বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২২ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ।
১০. বাংলাদেশে নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
১১. বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানে ৫৯।
১২. বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানে ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না ইনশা আল্লাহ। তথ্য-উপাত্তগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে চলেছে যে ১৯৪৭-৭১ পর্যায়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে সীমাহীন বঞ্চনা, শোষণ ও পুঁজি-লুণ্ঠনের শিকার হওয়ায় ওপরের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের চেয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলাম বলেই এখন পাকিস্তানকে সব ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে দিয়েছি।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে