শাইখ সিরাজ
রাজধানীতে ডেঙ্গু এক আতঙ্কের নাম। পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। আর এ বছর ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ২৩ হাজারের বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, মারা গেছে ৮০ জনের ওপরে। শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের ৫০টি জেলায়ও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশেও ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে। যেকোনো দুর্যোগেই প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে সচেতন করা।
আমরা টেলিভিশনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে ফিলার তৈরি করে প্রচার করছি। ডেঙ্গু নিয়ে টেলিভিশন, পত্রিকায় নানান প্রচার অভিযান চলছে। কিন্তু কে জানে কেন মশার বিস্তারের খড়্গটা এসে পড়ে ছাদকৃষির ওপর। বছর তিনেক আগেও ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন চরমে, মিরপুর থেকে এক গৃহিণী আমাকে ই-মেইলে লিখলেন ছাদকৃষিতে এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে—এমন অভিযোগে তাঁর ছাদকৃষি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। শুধু মিরপুর থেকে নয়, যাত্রাবাড়ী থেকে একজন ফোনে জানালেন প্রতিবেশীরা তাঁর ছাদকৃষিকে মশার বংশবিস্তারের জন্য দায়ী করছেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদ ফোন দিয়ে জানালেন, তিনিও তাঁর ছাদকৃষি গবেষণা নিয়ে প্রতিবেশীদের রোষে পড়েছেন।
ছাদকৃষি নিয়ে কাজ করছি সেই আশির দশক থেকে। তখন বলতাম, ‘ছাদবাগান’। কারণ সে সময় এটা যতটা না ছিল প্রয়োজনের, তার চেয়ে বেশি ছিল শখ বা বিলাসের। কিন্তু বর্তমান সময়ে যখন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রশ্ন উঠেছে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে, এমনকি এই সময়ে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে—যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বসবাসযোগ্য প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৯। তখন সেটা আর শখ বা বিলাসের পর্যায়ে নেই। সারা বিশ্বই এখন ছাদকৃষি বা নগরকৃষির বিষয়টিতে সচেতন ও সোচ্চার। তাই ছাদকৃষি হয়ে উঠেছে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
চ্যানেল আইয়ে আমি প্রায় ২৫০টির ওপর ছাদকৃষি পর্ব প্রচার করেছি। দেশের বিভিন্ন শহরের ছাদকৃষি দেখেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে একটুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাঁরা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যাঁর নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে, তাঁরা নিজেদের ছাদে একস্তর বা দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন। আবার যাঁদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তাঁরা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের একপাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এই ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে ও নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন।
একচিলতে ছাদের একদিকে চাষ হচ্ছে ফুল, অন্যদিকে ফল, বাদ যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় সবজির আবাদও। সঙ্গে ছাদের এক কোণে নানান ঔষধি গাছ-গাছড়াও লাগাচ্ছেন অনেকে। অনেকেই গাছের পাশাপাশি মাছের চাষও করছেন ছাদে। ছাদকৃষির ভূমিকা অর্থনৈতিকভাবে যতটুকু, তার চেয়েও বেশি সামাজিক মেলবন্ধনে। কৃষির চর্চা মানসিক প্রশান্তি দেয়। কৃষির সান্নিধ্য মনের বর্জ্য দূর করে।
যাহোক, এডিস মশার বিস্তারে ছাদকৃষি বিষয়টিও এখন আলোচনা-সমালোচনায় এসেছে। ছাদকৃষি ও ছাদভিত্তিক মাছ চাষের প্রকল্পে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে—এমন আশঙ্কায় জনমনে ছাদকৃষি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণ বলছে ভিন্ন কথা। পরিকল্পিত ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৈরি ছাদকৃষিতে এমন ঝুঁকির আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাঁরা ছাদকৃষি করেন, তাঁদের ছাদ অপেক্ষা বাগানবিহীন ছাদ বেশি অপরিষ্কার ও অধিক ঝুঁকিসম্পন্ন। কারণ ছাদকৃষি উদ্যোক্তারা নিয়মিত ছাদে যান এবং ছাদে লাগানো গাছপালার যত্ন ও পরিচর্যা করেন। যাঁরা সত্যিকার অর্থে ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের ছাদের টবে কখনোই পানি জমে থাকে না। কারণ তাঁরা জানেন টবে পানি জমলে গাছের ক্ষতি, গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে যে ছাদে ছাদকৃষি নেই, সেই ছাদে কেউ তদারকি ও পরিচর্যা করে না, যার ফলে ছাদ থাকে অপরিচ্ছন্ন।
গত কয়েক বছরে আমি তিন শতাধিক বাড়ির ছাদে গিয়েছি, যাঁরা ছাদকৃষি করেন। ছাদে এমন কোনো টব বা ড্রাম দেখিনি যেখানে পানি জমে আছে। তারপরও যাঁরা ছাদকৃষি করছেন, তাঁদের প্রতি পরামর্শ থাকবে ছাদকৃষির টবের মাটি প্রস্তুতির সময় যদি ৫ শতাংশ মাটি, ৮০ শতাংশ নারকেলের ছোবড়া বা তুষ, ১০ শতাংশ বালু এবং ৫ শতাংশ জৈব সার দিয়ে প্রস্তুত করেন, তাহলে অল্প পানি ব্যবহারেই টব অনেক সময় ধরে ভেজা থাকবে। টবের নিচে ছিদ্র থাকলে পানি কখনোই জমে থাকবে না। ছোট ও লতাজাতীয় গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে তলানি ও পাশে ছিদ্রযুক্ত ঝুলন্ত টব ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া টবের পাশাপাশি একদিকে ঢালু অবকাঠামো তৈরি করেও গাছ লাগানো যেতে পারে অথবা টব বসানোর ভিত্তিটি সামান্য একদিকে ঢালু রাখা যেতে পারে। এর ফলে টবে আর পানি জমার সুযোগ থাকবে না। ছাদে লাগানোর জন্য উপযুক্ত গাছ নির্ধারণেও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। যে গাছগুলো কম পানিতে হয়, যেমন ড্রাগন, অ্যালোভেরা, মরিচ, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি প্রজাতির গাছ ছাদে বেশি লাগাতে পারেন। অপরদিকে অতিরিক্ত ঝোপ সৃষ্টি করে এমন প্রজাতির গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকুন। আপনারা হয়তো জানেন, কিছু প্রজাতির গাছ যেমন লেবুগাছ, গাঁদাফুল, লেমন গ্রাসের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। তাই ছাদে অন্যান্য গাছের সারির মাঝে মাঝে মশা তাড়ানোর জন্য এ ধরনের গাছ লাগাতে পারেন।
ছাদে মাছের ট্যাংকে বা চৌবাচ্চায় এডিস মশার ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। মাছের ট্যাংকের পানিতে মাছ বেশির ভাগ সময়ই চলমান থাকে, যার ফলে পানিতে স্রোত ও ঘূর্ণন তৈরি হয়। আমার বাসার ছাদেও ছোটখাটো একটা ছাদকৃষি আছে। আমার স্ত্রী পারু সারা দিনই তা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বলা বাহুল্য সতেজ ও নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ এবং সবুজের সান্নিধ্যে মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্যই এই ছাদকৃষির আয়োজন। অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে ছাদকৃষি হওয়ায় ছাদের ট্যাংকে কিছু মাছেরও চাষ করা হচ্ছে। সেখানে আমি লক্ষ করেছি, এডিস মশা যেহেতু বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে, তাই মাছ চাষের ট্যাংকে এদের ডিম পাড়ার আশঙ্কা নেই। এতেও যদি ঝুঁকি থেকে যায়, তবে ট্যাংকে বা চৌবাচ্চায় অ্যারেটর ব্যবহার করা বা মোটর দিয়ে কৃত্রিম পানির স্রোত বা ঝরনা তৈরি করা যেতে পারে। এতে মশা জন্মানোর ঝুঁকি যেমন কমবে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ছাদের সৌন্দর্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশকনিধনে গাপ্পি, মসকুইটো ফিশ ও অন্যান্য লার্ভাভুক মাছ নালা-নর্দমা বা বদ্ধ জলাশয়ে ছাড়ার নজির দেখা যায়। কারণ, মশার ডিম ও লার্ভাএদের অতি প্রিয় খাদ্য। এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ফিশারিজ অর্গানাইজেশন সে দেশে নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গাপ্পি, মসকুইটো ফিশ ছাড়াও আমাদের দেশীয় খলিশা মাছ মশার ডিম ও লার্ভা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গাপ্পি মাছ আমদানি করা হয়েছিল মশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই, যা এখন একটি জনপ্রিয় অ্যাকুরিয়াম মাছ। অবিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মশকনিধনে বাংলাদেশের নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় বিভিন্ন ড্রেনের ও নর্দমার প্রচণ্ড নোংরা পানিতে প্রচুর পরিমাণ ‘মশাভুক মাছ’ পাওয়া গিয়েছিল, যার ওপর পরীক্ষার ফলস্বরূপ মশকনিধনে এসব মশাভুক মাছের ব্যবহারের চিন্তা আরও জোরদার হয় আমাদের দেশে। তাই এ ধরনের মাছের প্রজাতি এডিস মশা থেকে বাঁচতে ছাদকৃষিতে লালন করা যেতে পারে। গাছে পানি সরবরাহের জন্য নালা বা চ্যানেল তৈরি করেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে সেসব নালা বা চ্যানেলে গাপ্পি ও অন্যান্য লার্ভাভুক মাছ ছাড়া যেতে পারে।
আমরা অধিকাংশই নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করি না। নিজের বাড়ির আঙিনা ও চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা নাগরিক দায়িত্ব। যেকোনো সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি দরকার তা হলো, সবার সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ।
ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের সচেতন থাকতে হবে যেন ছাদের কোথাও টবে বা ড্রামে পানি না জমে থাকে। ছাদকৃষিকে ডেঙ্গুর ঝুঁকিমুক্ত রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। যেখানে এসি, রেফ্রিজারেটরের জমা পানিতে মশা জন্মানোর ঝুঁকি থাকার পরেও তার ব্যবহার নিয়ে মানুষের নেতিবাচক চিন্তা নেই, সেখানে ছাদবাগানের ঝুঁকি চিন্তা করে এতে নিরুৎসাহিত হওয়া অবশ্যই যুক্তিযুক্ত নয়।
সরকার ছাদকৃষি নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চলছে নানাবিধ গবেষণা, পৌর-দপ্তরও ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে। সর্বোপরি সবার সহযোগিতায় ছাদকৃষি নগর সবুজায়নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ছাদকৃষি যেমন আমাদের শহরের জন্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই
রাজধানীতে ডেঙ্গু এক আতঙ্কের নাম। পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। আর এ বছর ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ২৩ হাজারের বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, মারা গেছে ৮০ জনের ওপরে। শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের ৫০টি জেলায়ও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশেও ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে। যেকোনো দুর্যোগেই প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে সচেতন করা।
আমরা টেলিভিশনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে ফিলার তৈরি করে প্রচার করছি। ডেঙ্গু নিয়ে টেলিভিশন, পত্রিকায় নানান প্রচার অভিযান চলছে। কিন্তু কে জানে কেন মশার বিস্তারের খড়্গটা এসে পড়ে ছাদকৃষির ওপর। বছর তিনেক আগেও ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন চরমে, মিরপুর থেকে এক গৃহিণী আমাকে ই-মেইলে লিখলেন ছাদকৃষিতে এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে—এমন অভিযোগে তাঁর ছাদকৃষি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। শুধু মিরপুর থেকে নয়, যাত্রাবাড়ী থেকে একজন ফোনে জানালেন প্রতিবেশীরা তাঁর ছাদকৃষিকে মশার বংশবিস্তারের জন্য দায়ী করছেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদ ফোন দিয়ে জানালেন, তিনিও তাঁর ছাদকৃষি গবেষণা নিয়ে প্রতিবেশীদের রোষে পড়েছেন।
ছাদকৃষি নিয়ে কাজ করছি সেই আশির দশক থেকে। তখন বলতাম, ‘ছাদবাগান’। কারণ সে সময় এটা যতটা না ছিল প্রয়োজনের, তার চেয়ে বেশি ছিল শখ বা বিলাসের। কিন্তু বর্তমান সময়ে যখন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রশ্ন উঠেছে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে, এমনকি এই সময়ে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে—যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বসবাসযোগ্য প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৯। তখন সেটা আর শখ বা বিলাসের পর্যায়ে নেই। সারা বিশ্বই এখন ছাদকৃষি বা নগরকৃষির বিষয়টিতে সচেতন ও সোচ্চার। তাই ছাদকৃষি হয়ে উঠেছে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
চ্যানেল আইয়ে আমি প্রায় ২৫০টির ওপর ছাদকৃষি পর্ব প্রচার করেছি। দেশের বিভিন্ন শহরের ছাদকৃষি দেখেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে একটুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাঁরা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যাঁর নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে, তাঁরা নিজেদের ছাদে একস্তর বা দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন। আবার যাঁদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তাঁরা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের একপাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এই ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে ও নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন।
একচিলতে ছাদের একদিকে চাষ হচ্ছে ফুল, অন্যদিকে ফল, বাদ যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় সবজির আবাদও। সঙ্গে ছাদের এক কোণে নানান ঔষধি গাছ-গাছড়াও লাগাচ্ছেন অনেকে। অনেকেই গাছের পাশাপাশি মাছের চাষও করছেন ছাদে। ছাদকৃষির ভূমিকা অর্থনৈতিকভাবে যতটুকু, তার চেয়েও বেশি সামাজিক মেলবন্ধনে। কৃষির চর্চা মানসিক প্রশান্তি দেয়। কৃষির সান্নিধ্য মনের বর্জ্য দূর করে।
যাহোক, এডিস মশার বিস্তারে ছাদকৃষি বিষয়টিও এখন আলোচনা-সমালোচনায় এসেছে। ছাদকৃষি ও ছাদভিত্তিক মাছ চাষের প্রকল্পে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে—এমন আশঙ্কায় জনমনে ছাদকৃষি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণ বলছে ভিন্ন কথা। পরিকল্পিত ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৈরি ছাদকৃষিতে এমন ঝুঁকির আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাঁরা ছাদকৃষি করেন, তাঁদের ছাদ অপেক্ষা বাগানবিহীন ছাদ বেশি অপরিষ্কার ও অধিক ঝুঁকিসম্পন্ন। কারণ ছাদকৃষি উদ্যোক্তারা নিয়মিত ছাদে যান এবং ছাদে লাগানো গাছপালার যত্ন ও পরিচর্যা করেন। যাঁরা সত্যিকার অর্থে ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের ছাদের টবে কখনোই পানি জমে থাকে না। কারণ তাঁরা জানেন টবে পানি জমলে গাছের ক্ষতি, গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে যে ছাদে ছাদকৃষি নেই, সেই ছাদে কেউ তদারকি ও পরিচর্যা করে না, যার ফলে ছাদ থাকে অপরিচ্ছন্ন।
গত কয়েক বছরে আমি তিন শতাধিক বাড়ির ছাদে গিয়েছি, যাঁরা ছাদকৃষি করেন। ছাদে এমন কোনো টব বা ড্রাম দেখিনি যেখানে পানি জমে আছে। তারপরও যাঁরা ছাদকৃষি করছেন, তাঁদের প্রতি পরামর্শ থাকবে ছাদকৃষির টবের মাটি প্রস্তুতির সময় যদি ৫ শতাংশ মাটি, ৮০ শতাংশ নারকেলের ছোবড়া বা তুষ, ১০ শতাংশ বালু এবং ৫ শতাংশ জৈব সার দিয়ে প্রস্তুত করেন, তাহলে অল্প পানি ব্যবহারেই টব অনেক সময় ধরে ভেজা থাকবে। টবের নিচে ছিদ্র থাকলে পানি কখনোই জমে থাকবে না। ছোট ও লতাজাতীয় গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে তলানি ও পাশে ছিদ্রযুক্ত ঝুলন্ত টব ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া টবের পাশাপাশি একদিকে ঢালু অবকাঠামো তৈরি করেও গাছ লাগানো যেতে পারে অথবা টব বসানোর ভিত্তিটি সামান্য একদিকে ঢালু রাখা যেতে পারে। এর ফলে টবে আর পানি জমার সুযোগ থাকবে না। ছাদে লাগানোর জন্য উপযুক্ত গাছ নির্ধারণেও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। যে গাছগুলো কম পানিতে হয়, যেমন ড্রাগন, অ্যালোভেরা, মরিচ, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি প্রজাতির গাছ ছাদে বেশি লাগাতে পারেন। অপরদিকে অতিরিক্ত ঝোপ সৃষ্টি করে এমন প্রজাতির গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকুন। আপনারা হয়তো জানেন, কিছু প্রজাতির গাছ যেমন লেবুগাছ, গাঁদাফুল, লেমন গ্রাসের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। তাই ছাদে অন্যান্য গাছের সারির মাঝে মাঝে মশা তাড়ানোর জন্য এ ধরনের গাছ লাগাতে পারেন।
ছাদে মাছের ট্যাংকে বা চৌবাচ্চায় এডিস মশার ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। মাছের ট্যাংকের পানিতে মাছ বেশির ভাগ সময়ই চলমান থাকে, যার ফলে পানিতে স্রোত ও ঘূর্ণন তৈরি হয়। আমার বাসার ছাদেও ছোটখাটো একটা ছাদকৃষি আছে। আমার স্ত্রী পারু সারা দিনই তা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বলা বাহুল্য সতেজ ও নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ এবং সবুজের সান্নিধ্যে মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্যই এই ছাদকৃষির আয়োজন। অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে ছাদকৃষি হওয়ায় ছাদের ট্যাংকে কিছু মাছেরও চাষ করা হচ্ছে। সেখানে আমি লক্ষ করেছি, এডিস মশা যেহেতু বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে, তাই মাছ চাষের ট্যাংকে এদের ডিম পাড়ার আশঙ্কা নেই। এতেও যদি ঝুঁকি থেকে যায়, তবে ট্যাংকে বা চৌবাচ্চায় অ্যারেটর ব্যবহার করা বা মোটর দিয়ে কৃত্রিম পানির স্রোত বা ঝরনা তৈরি করা যেতে পারে। এতে মশা জন্মানোর ঝুঁকি যেমন কমবে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ছাদের সৌন্দর্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশকনিধনে গাপ্পি, মসকুইটো ফিশ ও অন্যান্য লার্ভাভুক মাছ নালা-নর্দমা বা বদ্ধ জলাশয়ে ছাড়ার নজির দেখা যায়। কারণ, মশার ডিম ও লার্ভাএদের অতি প্রিয় খাদ্য। এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ফিশারিজ অর্গানাইজেশন সে দেশে নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গাপ্পি, মসকুইটো ফিশ ছাড়াও আমাদের দেশীয় খলিশা মাছ মশার ডিম ও লার্ভা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গাপ্পি মাছ আমদানি করা হয়েছিল মশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই, যা এখন একটি জনপ্রিয় অ্যাকুরিয়াম মাছ। অবিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মশকনিধনে বাংলাদেশের নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় বিভিন্ন ড্রেনের ও নর্দমার প্রচণ্ড নোংরা পানিতে প্রচুর পরিমাণ ‘মশাভুক মাছ’ পাওয়া গিয়েছিল, যার ওপর পরীক্ষার ফলস্বরূপ মশকনিধনে এসব মশাভুক মাছের ব্যবহারের চিন্তা আরও জোরদার হয় আমাদের দেশে। তাই এ ধরনের মাছের প্রজাতি এডিস মশা থেকে বাঁচতে ছাদকৃষিতে লালন করা যেতে পারে। গাছে পানি সরবরাহের জন্য নালা বা চ্যানেল তৈরি করেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে সেসব নালা বা চ্যানেলে গাপ্পি ও অন্যান্য লার্ভাভুক মাছ ছাড়া যেতে পারে।
আমরা অধিকাংশই নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করি না। নিজের বাড়ির আঙিনা ও চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা নাগরিক দায়িত্ব। যেকোনো সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি দরকার তা হলো, সবার সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ।
ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের সচেতন থাকতে হবে যেন ছাদের কোথাও টবে বা ড্রামে পানি না জমে থাকে। ছাদকৃষিকে ডেঙ্গুর ঝুঁকিমুক্ত রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। যেখানে এসি, রেফ্রিজারেটরের জমা পানিতে মশা জন্মানোর ঝুঁকি থাকার পরেও তার ব্যবহার নিয়ে মানুষের নেতিবাচক চিন্তা নেই, সেখানে ছাদবাগানের ঝুঁকি চিন্তা করে এতে নিরুৎসাহিত হওয়া অবশ্যই যুক্তিযুক্ত নয়।
সরকার ছাদকৃষি নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চলছে নানাবিধ গবেষণা, পৌর-দপ্তরও ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে। সর্বোপরি সবার সহযোগিতায় ছাদকৃষি নগর সবুজায়নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ছাদকৃষি যেমন আমাদের শহরের জন্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে