সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের প্রত্যাশাটা এমনিতে খুবই সাধারণ। পাঠক সংবাদ চায়। কিন্তু সংবাদ তো নানা ধরনের হয়। কোন সংবাদ চায় সে? পাঠক চায় তার নিজের পক্ষের সংবাদ। সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতার কথাটা খুব চালু আছে। নিরপেক্ষতা কিন্তু মোটেই সম্ভব নয়। ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধটা প্রতিনিয়ত চলছে, সেখানে কেউ যদি বলেন, তিনি কোনো পক্ষে নেই, তিনি নিরপেক্ষ; তাহলে বুঝতে হবে, জ্ঞাতে হোক কি অজ্ঞাতেই হোক, তিনি প্রতারণা করছেন, অপরের সঙ্গে তো অবশ্যই, নিজের সঙ্গেও হয়তো। পাঠক চায়, সংবাদপত্র থাকবে ন্যায়ের পক্ষে; এবং পাঠক মনে করে যে, সে নিজেও ন্যায়ের পক্ষেই রয়েছে।
কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে যাওয়াটা তো সহজ নয়। কারণ, অন্যায় অত্যন্ত শক্তিশালী। রাষ্ট্র ও সমাজ কখনো কখনো অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কেবল তা-ই নয়, ওই দুই ব্যবস্থা নিজেরাও অন্যায় করে। আর সংবাদপত্র নিজেও জানে এবং মানে যে, সে এসেছে ব্যবসা করতে। ব্যবসা করতে গেলে সামাজিক শাসন মান্য করাটা ভালো, আর রাষ্ট্রকে চটানো তো কোনো মতেই উচিত নয়। চটানো আসলে সম্ভবও নয়। সংবাদপত্র পাঠকের কাছে যেতে চায়, পাঠকের জন্যই তো তার আত্মপ্রকাশ, কিন্তু সংবাদপত্রকে চোখ রাখতে হয় রাষ্ট্রের দিকে। রাষ্ট্র আবার সমাজেরও রক্ষক। রাষ্ট্র প্রকাশ পায় সরকারের মধ্য দিয়ে, সংবাদপত্র তাই সরকারকে মেনে চলে।
সংবাদপত্র জনপ্রিয় হতে চায়, কিন্তু ভয় পায় সরকারের অপ্রিয় হতে। পাঠকের কাছে যাওয়া প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে। সাহিত্যের ইতিহাসে এটা বেশ আলোচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের একজন প্রধান লেখক হচ্ছেন স্যামুয়েল জনসন। তিনি ঠিক করেছিলেন, ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি অভিধান প্রণয়ন করবেন। অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রমের কাজ। পরিশ্রমে তাঁর ভয় ছিল না, শঙ্কা ছিল প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ নিয়ে। তখন পর্যন্ত লেখকেরা বড় লোকদের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভর করতে বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। সে সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভালো একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন লর্ড চেস্টারফিল্ড। চেস্টারফিল্ডের কাছে জনসন তাঁর পরিকল্পনাটি পেশ করেন। যে কারণেই হোক, চেস্টারফিল্ড সাড়া দেননি।
জনসনের ছিল অদম্য উৎসাহ; তিনি দমলেন না; বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠকের কাছে অভিধানের জন্য
অগ্রিম গ্রাহক চাঁদা চাইলেন। সাড়া তিনি পেয়েছিলেনও। অভিধানটি প্রকাশিত হবার পর ওটির গুণপনার প্রশংসা করে লর্ড চেস্টারফিল্ড পর পর দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন পত্রিকায়। প্রতিক্রিয়ায় জনসন একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে চেস্টারফিল্ডকে সম্বোধন করে তিনি বলেন, সমর্থনটা একটু দেরিতে এল। এটা তখন পাইনি যখন একাকী ছিলাম। এখন পাচ্ছি যখন দরকার নেই। এই চিঠিতে ইংরেজি সাহিত্যের জন্য বিত্তবানদের পৃষ্ঠপোষকতা খোঁজার রীতির শেষবিদায়ের ঘণ্টা ধ্বনিত হয়েছিল বলে প্রসিদ্ধি আছে। মুষ্টিমেয়কে ছেড়ে সাহিত্য চলে গেল অজানা-অচেনা পাঠকদের কাছে। তারপর থেকে পাঠকই প্রধান ভরসা। জনসন পাঠক পেয়েছিলেন। সময়টা ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের। সামন্তবাদের সীমা পার হয়ে প্রকাশনা চলে যাচ্ছিল মধ্যবিত্ত পাঠকের কাছে, বাজারের ভেতর দিয়ে।
পুঁজিবাদ এখন আর তখনকার অবস্থায় নেই, এখন সে রীতিমতো নৃশংস। বাজার এখন জবরদস্ত। কিন্তু তবু বাজার মোটেই স্থিতিশীল নয়; বিশেষ করে সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে এখন পাঠকের চেয়ে বেশি দরকার বিজ্ঞাপনের। বিজ্ঞাপন বাড়ানোর জন্য পাঠকপ্রিয়তার প্রয়োজন হয় বৈকি; কিন্তু বিজ্ঞাপনই হচ্ছে লক্ষ্য, পাঠক-প্রাপ্তি বিজ্ঞাপন বৃদ্ধির উপায়।
বিজ্ঞাপন যদিও লক্ষ্য, তবু পাঠক না থাকলে বিজ্ঞাপন আসবে না; আর বিজ্ঞাপন না এলে সংবাদপত্রও চলবে না। ব্যবস্থা এটাই। পাঠককে তাই উপেক্ষা করার উপায় নেই। পাঠকের জন্যও ওই উপেক্ষণীয় না হওয়াটাই একমাত্র ভরসা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকার ও ব্যবসায়ীদের হাতে, তবে কিছুটা হলেও পাঠকের হাতেও।
জানা যায়, পাঠক পছন্দ করে অপরাধের খবর। ফৌজদারি অপরাধ হলে পাঠকের রসনা তৃপ্ত হয়; রাজনৈতিক অপরাধও কম সুস্বাদু নয়। এর ভেতরের রহস্যটা অবশ্য এই যে পাঠকের রুচি তৈরিতে সংবাদপত্রের বড় একটা ভূমিকা থাকে। পাঠক আসলে অপরাধের খবর চায় না, তাকে ওই খবর সরবরাহ করে আসক্তি তৈরি করা হয়, যার ফলে সে পছন্দের আর ওই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। অপরাধের খবরই তার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। খোরাক না পেলে ভেতরে-ভেতরে সে হতাশ হয়।
প্রকৃত খবর হলো, রাষ্ট্র ও সমাজের অসুখের কারণেই নাগরিকেরা অসুস্থ। এই নাগরিকেরাই তো সংবাদপত্রের পাঠক। তারা আশার খবর চায়। আশার খবর মানে কী? সেটা হলো অপরাধীর শাস্তির খবর। হ্যাঁ, তাই। এবং অপরাধ যে নির্মূল হবে, পাঠক চায় এ রকম আশ্বাসও। কিন্তু অপরাধীর শাস্তির খবর তো পাওয়া যায় না। অপরাধের খবর পাওয়া যায়, কিন্তু অপরাধীর কী শাস্তি হলো, সেটা জানা যায় না। নতুন অপরাধের খবর এসে অপরাধের পুরাতন খবরকে ম্লান করে দেয়। আর মূল যে অপরাধী, রাষ্ট্র ও সমাজ—তারা তো চিহ্নিতই হয় না। রাষ্ট্র ও সমাজের শাস্তিটা অন্য কিছু নয়, রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন আনা ভিন্ন। পরিবর্তন আসার চেষ্টা যে চলে না, তা নয়। চলে। ওই চেষ্টাতেই আশা থাকার কথা, এমন আশ্বাস থাকার কথা যে মানুষ লড়ছে ব্যবস্থা বদলানোর জন্য এবং ব্যবস্থা বদলাবে বৈকি। কিন্তু সেসব খবর পত্রিকায় আসে না। ওই বিষয়ে খবরকে উপেক্ষা করা হয়, কখনো কখনো বিকৃতও করা হয়। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, সংবাদপত্রের যাঁরা মালিক, তাঁরা ব্যবস্থার পক্ষে থাকেন। ব্যবস্থা তাঁদেরকে সুবিধা দেয়। ব্যবস্থাটা বদলে গেলে তাঁদের ভীষণ অসুবিধা; আম ও ছালা একসঙ্গে লোপাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। সেটা তাঁরা চাইবেন কেন? কোন দুঃখে? পরিবর্তন আসুক, এটা তাঁরা মোটেই চান না।
এমনকি সাধারণ যে অপরাধগুলো, যাদের রমরমা বর্ণনা পাঠককে আমোদ-আরাম ইত্যাদি দিতে চায়, সেগুলোর অভ্যন্তরে যে রহস্য রয়েছে, যেসব কার্যকারণে তারা সংঘটিত, তাদেরও উন্মোচন ঘটে না। অন্ধকার অন্ধকারেই রয়ে যায়; অপরাধ বাড়তে থাকে—সংখ্যায় যেমন, মাত্রাতেও তেমনই।
ভেতরে অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনাগ্রহটা চমৎকারভাবে প্রকাশ পায় পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। সম্পাদকীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; সেখানে থাকার কথা পত্রিকাটির অবস্থানের হদিস। গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কেবল খবর দেওয়ার দক্ষতার কারণে নয়; সঙ্গে থাকে খবরের ব্যাখ্যাও। সেটা খবরে থাকবে, থাকবে সম্পাদকীয়তে। ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য গভীরে যেতে হয়; প্রয়োজন হয় জ্ঞানের ও গবেষণার; এবং স্থির থাকতে হয় দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সবচেয়ে কম পঠিত অংশ হলো সম্পাদকীয়; দায়সারাভাবে লেখা হয়, রাখতে হয় তাই যেন রাখা; সত্য উন্মোচন থাকে না, ব্যাখ্যা আসে না ঘটনাবলির, দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পাওয়া যায় না। বক্তব্য থাকে নিষ্প্রাণ, লেখার ধরন যান্ত্রিক। অনেক কথা বলা হয়, কোনো কথা না বলে। ফলে পড়ার আগেই পাঠক অনুমান করতে পারেন, ভেতরে কী আছে। সেই অনুমান যে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এমন নয়। উপসম্পাদকীয়ের ব্যাপারেও একই কথা। পাঠক লেখকের নাম দেখে, এবং বুঝে নেয় ভেতরে কী আছে। চোখ বোলায়; পড়তে আগ্রহী হয় না। সম্পাদকীয় পাতাতে জনমতের প্রতিফলন থাকার কথা; চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে। চিঠিপত্রও আসে না, চিঠিপত্রকে যে উৎসাহ দেওয়া হয় এমন নয়।
পাঠকের জন্য সংবাদপত্রের একটা বড় আকর্ষণ হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্র। ব্যঙ্গচিত্র সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ওপর কৌতুককর মন্তব্য থাকে। সেখানে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পায়। ব্যঙ্গচিত্র তখনই সার্থক হয়, যখন ভেতরে থাকে কী ঘটা উচিত ছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকে। যা ঘটছে তাকে মাপা দরকার ওই মানদণ্ডে। ওসব মাপা-টাপা এখন অনুপস্থিত। পত্রিকা থেকে ব্যঙ্গচিত্র উঠেই গেছে। কৌতুক দেওয়ার জন্য নানা রকম ইয়ার্কি-ফাজলামি থাকে, সেগুলো আড্ডাবাজির মতোই অর্থহীন। দাগ কাটে না, কৌতুকের সৃষ্টি করে না। আর আছে রংঢং। মানুষের জীবনে রঙের অভাব, পত্রিকাগুলো আসে রঙিন হয়ে। হ্যাঁ, ফটোজার্নালিজম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষ ফটোগ্রাফাররা আছেন, তাঁরা ছবি তোলেনও, কিন্তু অনেক ছবিই ছাপা হয় না বলে ধারণা করা যায়, নইলে ছবিগুলো এমন গতানুগতিক হবে কেন?
ওদিকে সংবাদপত্রের পাতায় সংবাদের জন্য বরাদ্দ জায়গা তো কেবলই সংকুচিত হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের ধাক্কায়। বিজ্ঞাপন প্রথম পাতাকে পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলছে। মনে হচ্ছে, খবর যা দেওয়া হয়, তা হচ্ছে বিজ্ঞাপন প্রচারের অজুহাত। মালিকের চোখ বিজ্ঞাপনের দিকে, সংবাদের দিকে নয়। এখানে রয়েছে পুঁজিবাদের চরম প্রকাশ। বিজ্ঞাপন পাঠকের রুচি তৈরিতেও কাজ করছে।
খবরের কাগজের কাছে পাঠকের এত সব প্রত্যাশার কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার, অর্থাৎ সরকারের ওপর সামাজিক নজরদারির অভাব। নজরদারি দরকার জবাবদিহি তৈরি করার জন্য। কাজটা আইন পরিষদের করার কথা। আইন পরিষদ সেটা করতে পারে না। কারণ, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে সরকারি দলের; কাজেই যত সমালোচনা হোক, সরকার তার ইচ্ছা অনুযায়ী এগিয়ে যায়। নজরদারি করতে পারে বিচার বিভাগ। কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে অসমর্থ হয়। এ জন্যই সংবাদপত্রের কাজে প্রত্যাশা থাকে যে তারা খবর দেবে, খবরের পেছনের খবর বের করে আনবে, সরকারের কাজের সমালোচনা করবে, জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে, এবং সহায়তা দেবে জনমত সংগঠনে।
বড় প্রত্যাশাটা অবশ্য দাঁড়ায় এই যে সংবাদপত্র পুঁজিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে বলবে। নদীতে ঢেউ থাকে, বালুও থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে বালুতে পরিণত করতে চায়, ঢেউকে বাদ দিয়ে। কারণ, বালুকে পণ্য করা যায়, ঢেউকে তা করা যায় না। মানুষের প্রত্যাশা হলো, সংবাদপত্র ঢেউয়ের পক্ষে দাঁড়াবে। প্রত্যাশাটা বিশেষভাবে এই কারণে যে, বালুর দৌরাত্ম্য এখন সর্বপ্লাবী হয়ে উঠছে; ঢেউগুলো কেবলই মার খাচ্ছে, বালুর হাতে, অর্থাৎ বালুর ব্যবসায়ীদের হাতে।
দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রথম বর্ষপূর্তিতে পত্রিকাসংশ্লিষ্ট সবাইকে, পাশাপাশি পত্রিকার পাঠকদের জানাই অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। পত্রিকাটি অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাক, এটা কাঙ্ক্ষিতভাবেই প্রত্যাশা করছি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের প্রত্যাশাটা এমনিতে খুবই সাধারণ। পাঠক সংবাদ চায়। কিন্তু সংবাদ তো নানা ধরনের হয়। কোন সংবাদ চায় সে? পাঠক চায় তার নিজের পক্ষের সংবাদ। সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতার কথাটা খুব চালু আছে। নিরপেক্ষতা কিন্তু মোটেই সম্ভব নয়। ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধটা প্রতিনিয়ত চলছে, সেখানে কেউ যদি বলেন, তিনি কোনো পক্ষে নেই, তিনি নিরপেক্ষ; তাহলে বুঝতে হবে, জ্ঞাতে হোক কি অজ্ঞাতেই হোক, তিনি প্রতারণা করছেন, অপরের সঙ্গে তো অবশ্যই, নিজের সঙ্গেও হয়তো। পাঠক চায়, সংবাদপত্র থাকবে ন্যায়ের পক্ষে; এবং পাঠক মনে করে যে, সে নিজেও ন্যায়ের পক্ষেই রয়েছে।
কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে যাওয়াটা তো সহজ নয়। কারণ, অন্যায় অত্যন্ত শক্তিশালী। রাষ্ট্র ও সমাজ কখনো কখনো অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কেবল তা-ই নয়, ওই দুই ব্যবস্থা নিজেরাও অন্যায় করে। আর সংবাদপত্র নিজেও জানে এবং মানে যে, সে এসেছে ব্যবসা করতে। ব্যবসা করতে গেলে সামাজিক শাসন মান্য করাটা ভালো, আর রাষ্ট্রকে চটানো তো কোনো মতেই উচিত নয়। চটানো আসলে সম্ভবও নয়। সংবাদপত্র পাঠকের কাছে যেতে চায়, পাঠকের জন্যই তো তার আত্মপ্রকাশ, কিন্তু সংবাদপত্রকে চোখ রাখতে হয় রাষ্ট্রের দিকে। রাষ্ট্র আবার সমাজেরও রক্ষক। রাষ্ট্র প্রকাশ পায় সরকারের মধ্য দিয়ে, সংবাদপত্র তাই সরকারকে মেনে চলে।
সংবাদপত্র জনপ্রিয় হতে চায়, কিন্তু ভয় পায় সরকারের অপ্রিয় হতে। পাঠকের কাছে যাওয়া প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে। সাহিত্যের ইতিহাসে এটা বেশ আলোচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের একজন প্রধান লেখক হচ্ছেন স্যামুয়েল জনসন। তিনি ঠিক করেছিলেন, ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি অভিধান প্রণয়ন করবেন। অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রমের কাজ। পরিশ্রমে তাঁর ভয় ছিল না, শঙ্কা ছিল প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ নিয়ে। তখন পর্যন্ত লেখকেরা বড় লোকদের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভর করতে বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। সে সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভালো একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন লর্ড চেস্টারফিল্ড। চেস্টারফিল্ডের কাছে জনসন তাঁর পরিকল্পনাটি পেশ করেন। যে কারণেই হোক, চেস্টারফিল্ড সাড়া দেননি।
জনসনের ছিল অদম্য উৎসাহ; তিনি দমলেন না; বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠকের কাছে অভিধানের জন্য
অগ্রিম গ্রাহক চাঁদা চাইলেন। সাড়া তিনি পেয়েছিলেনও। অভিধানটি প্রকাশিত হবার পর ওটির গুণপনার প্রশংসা করে লর্ড চেস্টারফিল্ড পর পর দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন পত্রিকায়। প্রতিক্রিয়ায় জনসন একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে চেস্টারফিল্ডকে সম্বোধন করে তিনি বলেন, সমর্থনটা একটু দেরিতে এল। এটা তখন পাইনি যখন একাকী ছিলাম। এখন পাচ্ছি যখন দরকার নেই। এই চিঠিতে ইংরেজি সাহিত্যের জন্য বিত্তবানদের পৃষ্ঠপোষকতা খোঁজার রীতির শেষবিদায়ের ঘণ্টা ধ্বনিত হয়েছিল বলে প্রসিদ্ধি আছে। মুষ্টিমেয়কে ছেড়ে সাহিত্য চলে গেল অজানা-অচেনা পাঠকদের কাছে। তারপর থেকে পাঠকই প্রধান ভরসা। জনসন পাঠক পেয়েছিলেন। সময়টা ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের। সামন্তবাদের সীমা পার হয়ে প্রকাশনা চলে যাচ্ছিল মধ্যবিত্ত পাঠকের কাছে, বাজারের ভেতর দিয়ে।
পুঁজিবাদ এখন আর তখনকার অবস্থায় নেই, এখন সে রীতিমতো নৃশংস। বাজার এখন জবরদস্ত। কিন্তু তবু বাজার মোটেই স্থিতিশীল নয়; বিশেষ করে সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে এখন পাঠকের চেয়ে বেশি দরকার বিজ্ঞাপনের। বিজ্ঞাপন বাড়ানোর জন্য পাঠকপ্রিয়তার প্রয়োজন হয় বৈকি; কিন্তু বিজ্ঞাপনই হচ্ছে লক্ষ্য, পাঠক-প্রাপ্তি বিজ্ঞাপন বৃদ্ধির উপায়।
বিজ্ঞাপন যদিও লক্ষ্য, তবু পাঠক না থাকলে বিজ্ঞাপন আসবে না; আর বিজ্ঞাপন না এলে সংবাদপত্রও চলবে না। ব্যবস্থা এটাই। পাঠককে তাই উপেক্ষা করার উপায় নেই। পাঠকের জন্যও ওই উপেক্ষণীয় না হওয়াটাই একমাত্র ভরসা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকার ও ব্যবসায়ীদের হাতে, তবে কিছুটা হলেও পাঠকের হাতেও।
জানা যায়, পাঠক পছন্দ করে অপরাধের খবর। ফৌজদারি অপরাধ হলে পাঠকের রসনা তৃপ্ত হয়; রাজনৈতিক অপরাধও কম সুস্বাদু নয়। এর ভেতরের রহস্যটা অবশ্য এই যে পাঠকের রুচি তৈরিতে সংবাদপত্রের বড় একটা ভূমিকা থাকে। পাঠক আসলে অপরাধের খবর চায় না, তাকে ওই খবর সরবরাহ করে আসক্তি তৈরি করা হয়, যার ফলে সে পছন্দের আর ওই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। অপরাধের খবরই তার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। খোরাক না পেলে ভেতরে-ভেতরে সে হতাশ হয়।
প্রকৃত খবর হলো, রাষ্ট্র ও সমাজের অসুখের কারণেই নাগরিকেরা অসুস্থ। এই নাগরিকেরাই তো সংবাদপত্রের পাঠক। তারা আশার খবর চায়। আশার খবর মানে কী? সেটা হলো অপরাধীর শাস্তির খবর। হ্যাঁ, তাই। এবং অপরাধ যে নির্মূল হবে, পাঠক চায় এ রকম আশ্বাসও। কিন্তু অপরাধীর শাস্তির খবর তো পাওয়া যায় না। অপরাধের খবর পাওয়া যায়, কিন্তু অপরাধীর কী শাস্তি হলো, সেটা জানা যায় না। নতুন অপরাধের খবর এসে অপরাধের পুরাতন খবরকে ম্লান করে দেয়। আর মূল যে অপরাধী, রাষ্ট্র ও সমাজ—তারা তো চিহ্নিতই হয় না। রাষ্ট্র ও সমাজের শাস্তিটা অন্য কিছু নয়, রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন আনা ভিন্ন। পরিবর্তন আসার চেষ্টা যে চলে না, তা নয়। চলে। ওই চেষ্টাতেই আশা থাকার কথা, এমন আশ্বাস থাকার কথা যে মানুষ লড়ছে ব্যবস্থা বদলানোর জন্য এবং ব্যবস্থা বদলাবে বৈকি। কিন্তু সেসব খবর পত্রিকায় আসে না। ওই বিষয়ে খবরকে উপেক্ষা করা হয়, কখনো কখনো বিকৃতও করা হয়। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, সংবাদপত্রের যাঁরা মালিক, তাঁরা ব্যবস্থার পক্ষে থাকেন। ব্যবস্থা তাঁদেরকে সুবিধা দেয়। ব্যবস্থাটা বদলে গেলে তাঁদের ভীষণ অসুবিধা; আম ও ছালা একসঙ্গে লোপাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। সেটা তাঁরা চাইবেন কেন? কোন দুঃখে? পরিবর্তন আসুক, এটা তাঁরা মোটেই চান না।
এমনকি সাধারণ যে অপরাধগুলো, যাদের রমরমা বর্ণনা পাঠককে আমোদ-আরাম ইত্যাদি দিতে চায়, সেগুলোর অভ্যন্তরে যে রহস্য রয়েছে, যেসব কার্যকারণে তারা সংঘটিত, তাদেরও উন্মোচন ঘটে না। অন্ধকার অন্ধকারেই রয়ে যায়; অপরাধ বাড়তে থাকে—সংখ্যায় যেমন, মাত্রাতেও তেমনই।
ভেতরে অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনাগ্রহটা চমৎকারভাবে প্রকাশ পায় পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। সম্পাদকীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; সেখানে থাকার কথা পত্রিকাটির অবস্থানের হদিস। গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কেবল খবর দেওয়ার দক্ষতার কারণে নয়; সঙ্গে থাকে খবরের ব্যাখ্যাও। সেটা খবরে থাকবে, থাকবে সম্পাদকীয়তে। ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য গভীরে যেতে হয়; প্রয়োজন হয় জ্ঞানের ও গবেষণার; এবং স্থির থাকতে হয় দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সবচেয়ে কম পঠিত অংশ হলো সম্পাদকীয়; দায়সারাভাবে লেখা হয়, রাখতে হয় তাই যেন রাখা; সত্য উন্মোচন থাকে না, ব্যাখ্যা আসে না ঘটনাবলির, দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পাওয়া যায় না। বক্তব্য থাকে নিষ্প্রাণ, লেখার ধরন যান্ত্রিক। অনেক কথা বলা হয়, কোনো কথা না বলে। ফলে পড়ার আগেই পাঠক অনুমান করতে পারেন, ভেতরে কী আছে। সেই অনুমান যে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এমন নয়। উপসম্পাদকীয়ের ব্যাপারেও একই কথা। পাঠক লেখকের নাম দেখে, এবং বুঝে নেয় ভেতরে কী আছে। চোখ বোলায়; পড়তে আগ্রহী হয় না। সম্পাদকীয় পাতাতে জনমতের প্রতিফলন থাকার কথা; চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে। চিঠিপত্রও আসে না, চিঠিপত্রকে যে উৎসাহ দেওয়া হয় এমন নয়।
পাঠকের জন্য সংবাদপত্রের একটা বড় আকর্ষণ হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্র। ব্যঙ্গচিত্র সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ওপর কৌতুককর মন্তব্য থাকে। সেখানে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পায়। ব্যঙ্গচিত্র তখনই সার্থক হয়, যখন ভেতরে থাকে কী ঘটা উচিত ছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকে। যা ঘটছে তাকে মাপা দরকার ওই মানদণ্ডে। ওসব মাপা-টাপা এখন অনুপস্থিত। পত্রিকা থেকে ব্যঙ্গচিত্র উঠেই গেছে। কৌতুক দেওয়ার জন্য নানা রকম ইয়ার্কি-ফাজলামি থাকে, সেগুলো আড্ডাবাজির মতোই অর্থহীন। দাগ কাটে না, কৌতুকের সৃষ্টি করে না। আর আছে রংঢং। মানুষের জীবনে রঙের অভাব, পত্রিকাগুলো আসে রঙিন হয়ে। হ্যাঁ, ফটোজার্নালিজম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষ ফটোগ্রাফাররা আছেন, তাঁরা ছবি তোলেনও, কিন্তু অনেক ছবিই ছাপা হয় না বলে ধারণা করা যায়, নইলে ছবিগুলো এমন গতানুগতিক হবে কেন?
ওদিকে সংবাদপত্রের পাতায় সংবাদের জন্য বরাদ্দ জায়গা তো কেবলই সংকুচিত হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের ধাক্কায়। বিজ্ঞাপন প্রথম পাতাকে পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলছে। মনে হচ্ছে, খবর যা দেওয়া হয়, তা হচ্ছে বিজ্ঞাপন প্রচারের অজুহাত। মালিকের চোখ বিজ্ঞাপনের দিকে, সংবাদের দিকে নয়। এখানে রয়েছে পুঁজিবাদের চরম প্রকাশ। বিজ্ঞাপন পাঠকের রুচি তৈরিতেও কাজ করছে।
খবরের কাগজের কাছে পাঠকের এত সব প্রত্যাশার কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার, অর্থাৎ সরকারের ওপর সামাজিক নজরদারির অভাব। নজরদারি দরকার জবাবদিহি তৈরি করার জন্য। কাজটা আইন পরিষদের করার কথা। আইন পরিষদ সেটা করতে পারে না। কারণ, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে সরকারি দলের; কাজেই যত সমালোচনা হোক, সরকার তার ইচ্ছা অনুযায়ী এগিয়ে যায়। নজরদারি করতে পারে বিচার বিভাগ। কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে অসমর্থ হয়। এ জন্যই সংবাদপত্রের কাজে প্রত্যাশা থাকে যে তারা খবর দেবে, খবরের পেছনের খবর বের করে আনবে, সরকারের কাজের সমালোচনা করবে, জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে, এবং সহায়তা দেবে জনমত সংগঠনে।
বড় প্রত্যাশাটা অবশ্য দাঁড়ায় এই যে সংবাদপত্র পুঁজিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে বলবে। নদীতে ঢেউ থাকে, বালুও থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে বালুতে পরিণত করতে চায়, ঢেউকে বাদ দিয়ে। কারণ, বালুকে পণ্য করা যায়, ঢেউকে তা করা যায় না। মানুষের প্রত্যাশা হলো, সংবাদপত্র ঢেউয়ের পক্ষে দাঁড়াবে। প্রত্যাশাটা বিশেষভাবে এই কারণে যে, বালুর দৌরাত্ম্য এখন সর্বপ্লাবী হয়ে উঠছে; ঢেউগুলো কেবলই মার খাচ্ছে, বালুর হাতে, অর্থাৎ বালুর ব্যবসায়ীদের হাতে।
দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রথম বর্ষপূর্তিতে পত্রিকাসংশ্লিষ্ট সবাইকে, পাশাপাশি পত্রিকার পাঠকদের জানাই অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। পত্রিকাটি অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাক, এটা কাঙ্ক্ষিতভাবেই প্রত্যাশা করছি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে