ড. এম আবদুল আলীম
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা নিজেদের মেনিফেস্টোতে উল্লেখ করে গণআজাদী লীগ নামক রাজনৈতিক দল। এরপর তমদ্দুন মজলিশ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, ইসলামি ভ্রাতৃসংঘ প্রভৃতি সংগঠন রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। আজ এখানে তুলে ধরব ভাষা-আন্দোলনের সময়কার সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভাষা-আন্দোলনে অবদানের কথা। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে খাদ্যাভাব, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বিতা, রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক এবং মুসলিম লীগ নেতাদের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের ও সরকারি নীতির প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহসম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমদ, কেন্দ্রীয় নেত্রী আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ ভাষা-আন্দোলনে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার বাইরে ভাষা-আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপদান করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতারা। তাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী; ময়মনসিংহে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, সৈয়দ বদরুদ্দীন; পাবনায় এম মনসুর আলী, আবদুর রব বগা মিয়া, আমজাদ হোসেন; সিরাজগঞ্জে মোতাহার হোসেন তালুকদার; কুমিল্লায় জহিরুল হক, আবদুর রহমান খান; বগুড়ায় মজিবুর রহমান, শেখ আবদুল আজিজ; বরিশালে আবদুল মালেক খান; চট্টগ্রামে এম এ আজিজ; জামালপুরে তৈয়ব আলীসহ বিভিন্ন জেলার অগণিত নেতা-কর্মীর অবদানের কথা উল্লেখ করা যায়।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে বিষোদ্গার করেন। এর প্রতিবাদে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি বিবৃতি দেন। খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণার প্রতিবাদে ও ভাষা-আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুব। ওই কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, আলমাস আলী, আবদুল আওয়াল, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ। এ ছাড়া কারাগারে বন্দী অবস্থায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ‘দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা পালন করেন’ আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন: ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত...পুলিশ চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না।...বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি...পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে।’
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হন। সেখানে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, অহিউল্লাহ, আউয়ালসহ অনেকে। প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে বক্তৃতা দিলেও ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তাতে সম্পৃক্ত হন। পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতদের দেখতে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রথম তিনিই হাসপাতালে ছুটে যান। একুশে ফেব্রুয়ারি হতাহতের পর বহু নেতা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। বারবার তল্লাশি চালানো হয় নবাবপুর রোডে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। আগে-পরে গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, খান সাহেব ওসমান আলী, খয়রাত হোসেন, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেককে। একুশে ফেব্রুয়ারির পর সরকার ভাষা-আন্দোলন দমনে পুলিশি জুলুম, রাজনৈতিক দলের অফিস ও নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, অপপ্রচার; এককথায় আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এত কিছুর পরেও দমে যাননি আওয়ামী লীগের নেতারা। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বিভ্রান্তিকর প্রচারের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়: ‘পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় দেশের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গভর্নমেন্ট ও মুসলিম লীগ বিভ্রান্তিকর বিবৃতি ও রেডিও বক্তৃতা দ্বারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যে প্রচার শুরু করিয়াছে, তাহাতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কমিটি মনে করেন যে গভর্নমেন্ট জনসমর্থন লাভ ও জনসাধারণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এই আন্দোলনের সহিত পাকিস্তানবিরোধী এজেন্ট ও অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপের সংস্রব আবিষ্কারের চেষ্টা করিতেছেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা ও কর্ম্মী, বিরোধী দলের সদস্য এবং যাঁহারা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী দল ত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতেছেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ দেওয়া হইতেছে, কমিটি তাহার প্রতিবাদ করিতেছে।’ একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টি আইন পরিষদেও ভেতরে ও বাইরে সরকারি জুলুম ও দমন-পীড়নের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
ভাষা-আন্দোলনের নেতারা গ্রেপ্তার হলে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে নতুনভাবে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে জেলা ও মহকুমার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই বক্তৃতা করেন। এ বছর ২০ নভেম্বর আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ ডিসেম্বর ‘বন্দী মুক্তি দিবস’ উপলক্ষে এখানে আরেকটি জনসভা হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
ভাষা-আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। যদিও ‘ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ থাকায় ও মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতির কারণে ১৯৫৩ সালে ভাষা-আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালন বেশ কঠিন ছিল। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান প্রমুখের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ এই বার্ষিকী পালনের এক কর্মসূচি গ্রহণ করে।’ ওই কর্মসূচির মধ্যে ছিল ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে রোজা পালন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ ও আরমানিটোলা ময়দানে জনসভার আয়োজন। জনসভার পর যে মিছিল আয়োজন করা হয়, তখন পর্যন্ত তা ছিল প্রদেশের বৃহত্তম মিছিল। এ উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান বিবৃতি দেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ পালনের আহ্বান জানান।
পরবর্তীকালে বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং একুশের চেতনা লালন ও বিস্তারে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা ব্যাপক অবদান রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তথা এ দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে উজ্জ্বল ভূমিকা।
লেখক: অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা নিজেদের মেনিফেস্টোতে উল্লেখ করে গণআজাদী লীগ নামক রাজনৈতিক দল। এরপর তমদ্দুন মজলিশ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, ইসলামি ভ্রাতৃসংঘ প্রভৃতি সংগঠন রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। আজ এখানে তুলে ধরব ভাষা-আন্দোলনের সময়কার সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভাষা-আন্দোলনে অবদানের কথা। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে খাদ্যাভাব, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বিতা, রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক এবং মুসলিম লীগ নেতাদের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের ও সরকারি নীতির প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহসম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমদ, কেন্দ্রীয় নেত্রী আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ ভাষা-আন্দোলনে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার বাইরে ভাষা-আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপদান করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতারা। তাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী; ময়মনসিংহে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, সৈয়দ বদরুদ্দীন; পাবনায় এম মনসুর আলী, আবদুর রব বগা মিয়া, আমজাদ হোসেন; সিরাজগঞ্জে মোতাহার হোসেন তালুকদার; কুমিল্লায় জহিরুল হক, আবদুর রহমান খান; বগুড়ায় মজিবুর রহমান, শেখ আবদুল আজিজ; বরিশালে আবদুল মালেক খান; চট্টগ্রামে এম এ আজিজ; জামালপুরে তৈয়ব আলীসহ বিভিন্ন জেলার অগণিত নেতা-কর্মীর অবদানের কথা উল্লেখ করা যায়।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে বিষোদ্গার করেন। এর প্রতিবাদে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি বিবৃতি দেন। খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণার প্রতিবাদে ও ভাষা-আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুব। ওই কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, আলমাস আলী, আবদুল আওয়াল, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ। এ ছাড়া কারাগারে বন্দী অবস্থায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ‘দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা পালন করেন’ আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন: ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত...পুলিশ চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না।...বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি...পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে।’
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হন। সেখানে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, অহিউল্লাহ, আউয়ালসহ অনেকে। প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে বক্তৃতা দিলেও ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তাতে সম্পৃক্ত হন। পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতদের দেখতে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রথম তিনিই হাসপাতালে ছুটে যান। একুশে ফেব্রুয়ারি হতাহতের পর বহু নেতা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। বারবার তল্লাশি চালানো হয় নবাবপুর রোডে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। আগে-পরে গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, খান সাহেব ওসমান আলী, খয়রাত হোসেন, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেককে। একুশে ফেব্রুয়ারির পর সরকার ভাষা-আন্দোলন দমনে পুলিশি জুলুম, রাজনৈতিক দলের অফিস ও নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, অপপ্রচার; এককথায় আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এত কিছুর পরেও দমে যাননি আওয়ামী লীগের নেতারা। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বিভ্রান্তিকর প্রচারের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়: ‘পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় দেশের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গভর্নমেন্ট ও মুসলিম লীগ বিভ্রান্তিকর বিবৃতি ও রেডিও বক্তৃতা দ্বারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যে প্রচার শুরু করিয়াছে, তাহাতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কমিটি মনে করেন যে গভর্নমেন্ট জনসমর্থন লাভ ও জনসাধারণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এই আন্দোলনের সহিত পাকিস্তানবিরোধী এজেন্ট ও অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপের সংস্রব আবিষ্কারের চেষ্টা করিতেছেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা ও কর্ম্মী, বিরোধী দলের সদস্য এবং যাঁহারা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী দল ত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতেছেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ দেওয়া হইতেছে, কমিটি তাহার প্রতিবাদ করিতেছে।’ একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টি আইন পরিষদেও ভেতরে ও বাইরে সরকারি জুলুম ও দমন-পীড়নের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
ভাষা-আন্দোলনের নেতারা গ্রেপ্তার হলে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে নতুনভাবে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে জেলা ও মহকুমার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই বক্তৃতা করেন। এ বছর ২০ নভেম্বর আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ ডিসেম্বর ‘বন্দী মুক্তি দিবস’ উপলক্ষে এখানে আরেকটি জনসভা হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
ভাষা-আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। যদিও ‘ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ থাকায় ও মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতির কারণে ১৯৫৩ সালে ভাষা-আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালন বেশ কঠিন ছিল। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান প্রমুখের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ এই বার্ষিকী পালনের এক কর্মসূচি গ্রহণ করে।’ ওই কর্মসূচির মধ্যে ছিল ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে রোজা পালন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ ও আরমানিটোলা ময়দানে জনসভার আয়োজন। জনসভার পর যে মিছিল আয়োজন করা হয়, তখন পর্যন্ত তা ছিল প্রদেশের বৃহত্তম মিছিল। এ উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান বিবৃতি দেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ পালনের আহ্বান জানান।
পরবর্তীকালে বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং একুশের চেতনা লালন ও বিস্তারে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা ব্যাপক অবদান রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তথা এ দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে উজ্জ্বল ভূমিকা।
লেখক: অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে