হাসান মামুন
রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় ছিল। এর আওতায় হেমায়েতপুরে একটি ‘কমপ্লায়েন্ট’ বা মানসম্মত চামড়াশিল্প নগর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি যথাসময়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিল এবং তাতে এর ব্যয়ও যাচ্ছিল বেড়ে। এ ধরনের প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণেই লেগে যায় দীর্ঘ সময়। তারপর শিল্পের জন্য জরুরি সেবাগুলো নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জও থাকে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংস্থাটি এর যোগ্য কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য উঠেছে অনেক পরে—যখন প্রায় ২০ বছর লেগে গেল প্রকল্পটি কোনোমতে সম্পন্ন করতে। কথা ছিল, দুই বছরের মধ্যেই এর কাজ শেষ হবে।
চামড়াশিল্প নগর গড়ে তুলতে বিরাট দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি হাজারীবাগের অনিচ্ছুক ট্যানারিগুলোকে ওখানে নিয়ে যাওয়াটাও ছিল চ্যালেঞ্জের। শেষ পর্যন্ত তাদের হেমায়েতপুরে যেতে বাধ্য করা হয় বিদ্যুৎসহ সেবাসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। কিন্তু ট্যানারিগুলো সেখানে গিয়ে নতুনভাবে কার্যক্রম শুরুর পর দেখা গেল, কমপ্লায়েন্ট চামড়াশিল্প নগরের জন্য জরুরি কাজটিই সম্পন্ন হয়নি। যথাযথভাবে হয়নি সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ। এর বাস্তবায়ন নিয়েও হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে এর কাজ দেওয়া হয়েছিল শিল্পনগরটি গড়ে তোলার একপর্যায়ে। আশ্চর্যের কথা, এর পরিকল্পনায় নাকি সিইটিপির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে এর অপরিহার্যতা সামনে এলে ট্যানারির মালিকেরা এটির ব্যয় নির্বাহে সম্মত হননি। সরকার অতঃপর কাঁধে তুলে নেয় এর দায়িত্ব। কিন্তু চীনা ঠিকাদার দফায় দফায় সময় নিয়েও কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করেনি। এ প্রশ্নও ওঠে, এই কাজের তদারকিতে নিয়োজিতরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন কি না? আর এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন না করে কীভাবে সরে পড়ল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সেটাও এক রহস্য।
ট্যানারির উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বিশেষত কোরবানির ঈদের পর সারা বছরের কমপক্ষে অর্ধেক পশুর চামড়া একযোগে প্রক্রিয়াজাত করার সময় সিইটিপিটি উৎপাদিত তরল বর্জ্য পরিশোধনে অক্ষম হয়ে পড়ে। কেননা, এর পরিশোধন ক্ষমতা ওই সময়ের চাহিদার প্রায় অর্ধেক। এ অবস্থায় বাকি বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই প্রকৃতিতে নিক্ষেপ করতে হচ্ছে। তাতে যথারীতি দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী। বুড়িগঙ্গা ও এর পার্শ্ববর্তী জনপদকে দূষণ থেকে রক্ষায় ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে নেওয়া হলেও দেখা যাচ্ছে ফলাফল প্রায় অভিন্ন। ট্যানারিতে তৈরি হওয়া কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনাও ওখানে নিশ্চিত করা যায়নি। কোরবানির ঈদ বাদে অন্য সময় ট্যানারিগুলোয় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ চলাকালে এ নিয়ে অবশ্য তেমন আলোচনা হতে দেখা যায় না। তখনো কি সিইটিপি তরল বর্জ্য পরিশোধনের চাহিদা পূরণ করতে পারে না? এর কার্যক্রম দেখভালের জন্য নিয়োজিত কোম্পানি কতটা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে, সেটা অবশ্য বলতে পারবে ট্যানারি-সংশ্লিষ্টরাই। তারা বলে চলেছে, আর কয়েক শ কোটি টাকা সরকার খরচ করলেই সিইটিপির অসম্পূর্ণতা দূর করা যাবে। তাতে শিল্পনগরটি কমপ্লায়েন্ট বলে বিবেচিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। মূলত এ কারণেই নাকি বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রভাবশালী সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ মিলছে না। এ কারণে ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোয় হেমায়েতপুরের ট্যানারিগুলো পারছে না চামড়া রপ্তানি করতে। বাধ্য হয়ে চীনসহ যেসব দেশে এটা রপ্তানি করতে হচ্ছে, সেখানে প্রাপ্য দামের অর্ধেকও মিলছে না। চামড়াশিল্প নগরের বাইরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই কেবল এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে এবং ভালো দামে পণ্য রপ্তানি করছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যগুলোয়। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান নাকি এই সনদপ্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের কাজটি তাদের করতে হচ্ছে নিজ উদ্যোগে। হেমায়েতপুরে জড়ো হওয়া ট্যানারিগুলোরও অগত্যা এই প্রক্রিয়ায় যাওয়া প্রয়োজন। সেটা হতে পারে নিজেদের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে তোলার মাধ্যমে।
সরকারের তরফ থেকে বিসিক বলছে, ট্যানারিগুলোর দায়িত্ব রয়েছে কারখানার অভ্যন্তরীণ শর্ত পূরণ করে পশ্চিমা ক্রেতাগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা। এর মধ্যে শ্রম পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। ট্যানারিতে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, কর্মঘণ্টা প্রভৃতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে রাসায়নিক ও পানি ব্যবহৃত হয় ট্যানারিতে, তার মান ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার শর্তও রয়েছে ক্রেতাগোষ্ঠীর। কম পানি ব্যবহৃত হলে তরল বর্জ্যও কম উৎপাদিত হয়; তাতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ওপর চাপ পড়ে কম। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রযুক্তি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের বিষয় রয়েছে। আছে নতুন বিনিয়োগের প্রশ্ন। বিনিয়োগের প্রশ্ন এলেই ব্যাংকঋণের প্রসঙ্গ আসে। বেশ কিছু ট্যানারি প্রতিষ্ঠান তো দীর্ঘদিনের ঋণখেলাপি। অবশ্য বলা হয়, হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের সময় দীর্ঘদিন স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে না পারায় তাদের ঋণখেলাপি হয়ে পড়তে হয়েছে। হাজারীবাগে রেখে আসা তাদের জমির বিষয়টির নিষ্পত্তিও এখন পর্যন্ত করা হয়নি। হেমায়েতপুরেও জমির লিজ আটকে থাকায় ওটাকে বন্ধক রেখে তারা পারছে না নতুন ঋণ নিতে। কোরবানির ঈদ এলে প্রায় প্রতিবার এমন খবরও বেরোয়, ট্যানারিগুলোর হাতে যথেষ্ট অর্থকড়ি নেই কাঁচা চামড়া সংগ্রহের। তাদের কাছে নাকি অনেক পাওনা আটকে আছে আড়তদারদের। আড়তদারদের কাছে আবার টাকাপয়সা পায় রাজধানীসহ প্রত্যন্ত এলাকার চামড়া সংগ্রহকারীরা। এভাবে একটা বকেয়ার চক্রেও ঘুরপাক খাচ্ছে খাতটি। অথচ বেশ কয়েক বছর বলা যায় পানির দামে কোরবানির পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়ে অটোমেটিক চলে আসছে হেমায়েতপুরে কেন্দ্রীভূত ট্যানারিগুলোয়। মাঝে তো দাম এত পড়ে গিয়েছিল যে লোকে কোরবানির চামড়া রাস্তায় ফেলে দেয়; গর্তে পুঁতে ফেলে। তখনো অনেক চামড়া নিশ্চয়ই অত্যন্ত কম দামে কিনতে পেরেছিল ট্যানারিগুলো। সেসব প্রক্রিয়াজাত করে তারা নিশ্চয়ই বিক্রি করেছে। দেশেও রয়েছে এর ভালো চাহিদা। জুতাসহ চামড়াপণ্য উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের সবাই পশ্চিমে রপ্তানি করতে না পারলেও দেশের বাজারে ঠিকই বিক্রি করতে পারছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আবার পশ্চিমা ক্রেতাগোষ্ঠীর শর্ত মেনে বিদেশি কমপ্লায়েন্ট কারখানা থেকে চামড়া এনে পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করছে। এ কারণে পাকা চামড়ার আমদানিও হচ্ছে বেশ। আর এটা হলো দুর্ভাগ্যজনক। পরিবেশসম্মতভাবে কাজটা করা যাচ্ছে না বলে এত সহজলভ্য চামড়ার দেশে উল্টো সেটা আমদানি করতে মূল্যবান বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে।
কোরবানির পশুর একাংশও এখন আর সীমান্তপথে আনতে হয় না। দেশে উৎপাদিত পশু এ সময়ে বরং অবিক্রীত থেকে যায়। সারা বছর জবাই হওয়া গরু-ছাগলও ‘চাহিদামতো’ উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। এর চামড়াও কম দামে মিলছে; যেহেতু এগুলো সীমান্তপথে পাচার হতেও পারছে না। পাচার হলে কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠা কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোয় তা ভালো দামে বিক্রি হতে পারত! এ অবস্থায় অর্থাৎ ‘আবদ্ধ বাজার সুবিধা’ পেয়েও আমাদের সিংহভাগ ট্যানারি প্রতিষ্ঠান পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যর্থ বলে এর ভালো দাম পাচ্ছে না। কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারে নন-সিরিয়াস দেশে আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানিতে একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। এই চামড়া আবার চীনের মতো দেশ থেকে পরিপূর্ণভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে রপ্তানি হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোয়। এমনকি ঘুরেফিরে চলে আসছে এ দেশে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে! এদিকে বেশ কয়েক বছর কমবেশি এক বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানিতে আটকে আছি আমরা। সেখানে চামড়ার হিস্যা আবার কম। এ অবস্থায়ও আমরা অবশ্য স্বপ্ন দেখছি ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানিতে সক্ষম হয়ে ওঠার। এটা অর্জন করা অবশ্য অসম্ভব নয়। কিন্তু সে জন্য তো সরকার ও বেসরকারি খাতকে তার দায়িত্ব বুঝে অবহেলিত কাজগুলো করতে, অর্থাৎ শর্ত পূরণে এগিয়ে আসতে হবে।
গেল কোরবানির ঈদের আগ দিয়ে অবশ্য চামড়া খাতে একটি পৃথক ‘কর্তৃপক্ষ’ গঠনে আইন প্রণয়নের খবর দেওয়া হলো। সেটা হতে কত সময় লাগবে, কে জানে! তবে একটা কর্তৃপক্ষ হলে সম্ভাবনাময় এ খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়াটা হয়তো সহজ হবে। তার আগে অবশ্য এ দায়দায়িত্ব নির্ণয় করা জরুরি যে কেন একটিমাত্র কমপ্লায়েন্ট চামড়াশিল্প নগর গড়ে তুলতে এত কাণ্ড হলো! তারপরও কেন এত ঘাটতি রয়ে গেল, যে কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকা চামড়ার বিশ্ববাজার ধরতে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ? যে খাতে অনেক বেশি মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ের সুযোগ ছিল—এতগুলো বছরেও কেন আমরা তা নিতে পারলাম না, সেটা কি এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রশ্ন?
লেখক: হাসান মামুন, সাংবাদিক, বিশ্লেষক
রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় ছিল। এর আওতায় হেমায়েতপুরে একটি ‘কমপ্লায়েন্ট’ বা মানসম্মত চামড়াশিল্প নগর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি যথাসময়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিল এবং তাতে এর ব্যয়ও যাচ্ছিল বেড়ে। এ ধরনের প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণেই লেগে যায় দীর্ঘ সময়। তারপর শিল্পের জন্য জরুরি সেবাগুলো নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জও থাকে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংস্থাটি এর যোগ্য কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য উঠেছে অনেক পরে—যখন প্রায় ২০ বছর লেগে গেল প্রকল্পটি কোনোমতে সম্পন্ন করতে। কথা ছিল, দুই বছরের মধ্যেই এর কাজ শেষ হবে।
চামড়াশিল্প নগর গড়ে তুলতে বিরাট দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি হাজারীবাগের অনিচ্ছুক ট্যানারিগুলোকে ওখানে নিয়ে যাওয়াটাও ছিল চ্যালেঞ্জের। শেষ পর্যন্ত তাদের হেমায়েতপুরে যেতে বাধ্য করা হয় বিদ্যুৎসহ সেবাসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। কিন্তু ট্যানারিগুলো সেখানে গিয়ে নতুনভাবে কার্যক্রম শুরুর পর দেখা গেল, কমপ্লায়েন্ট চামড়াশিল্প নগরের জন্য জরুরি কাজটিই সম্পন্ন হয়নি। যথাযথভাবে হয়নি সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ। এর বাস্তবায়ন নিয়েও হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে এর কাজ দেওয়া হয়েছিল শিল্পনগরটি গড়ে তোলার একপর্যায়ে। আশ্চর্যের কথা, এর পরিকল্পনায় নাকি সিইটিপির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে এর অপরিহার্যতা সামনে এলে ট্যানারির মালিকেরা এটির ব্যয় নির্বাহে সম্মত হননি। সরকার অতঃপর কাঁধে তুলে নেয় এর দায়িত্ব। কিন্তু চীনা ঠিকাদার দফায় দফায় সময় নিয়েও কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করেনি। এ প্রশ্নও ওঠে, এই কাজের তদারকিতে নিয়োজিতরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন কি না? আর এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন না করে কীভাবে সরে পড়ল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সেটাও এক রহস্য।
ট্যানারির উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বিশেষত কোরবানির ঈদের পর সারা বছরের কমপক্ষে অর্ধেক পশুর চামড়া একযোগে প্রক্রিয়াজাত করার সময় সিইটিপিটি উৎপাদিত তরল বর্জ্য পরিশোধনে অক্ষম হয়ে পড়ে। কেননা, এর পরিশোধন ক্ষমতা ওই সময়ের চাহিদার প্রায় অর্ধেক। এ অবস্থায় বাকি বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই প্রকৃতিতে নিক্ষেপ করতে হচ্ছে। তাতে যথারীতি দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী। বুড়িগঙ্গা ও এর পার্শ্ববর্তী জনপদকে দূষণ থেকে রক্ষায় ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে নেওয়া হলেও দেখা যাচ্ছে ফলাফল প্রায় অভিন্ন। ট্যানারিতে তৈরি হওয়া কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনাও ওখানে নিশ্চিত করা যায়নি। কোরবানির ঈদ বাদে অন্য সময় ট্যানারিগুলোয় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ চলাকালে এ নিয়ে অবশ্য তেমন আলোচনা হতে দেখা যায় না। তখনো কি সিইটিপি তরল বর্জ্য পরিশোধনের চাহিদা পূরণ করতে পারে না? এর কার্যক্রম দেখভালের জন্য নিয়োজিত কোম্পানি কতটা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে, সেটা অবশ্য বলতে পারবে ট্যানারি-সংশ্লিষ্টরাই। তারা বলে চলেছে, আর কয়েক শ কোটি টাকা সরকার খরচ করলেই সিইটিপির অসম্পূর্ণতা দূর করা যাবে। তাতে শিল্পনগরটি কমপ্লায়েন্ট বলে বিবেচিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। মূলত এ কারণেই নাকি বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রভাবশালী সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ মিলছে না। এ কারণে ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোয় হেমায়েতপুরের ট্যানারিগুলো পারছে না চামড়া রপ্তানি করতে। বাধ্য হয়ে চীনসহ যেসব দেশে এটা রপ্তানি করতে হচ্ছে, সেখানে প্রাপ্য দামের অর্ধেকও মিলছে না। চামড়াশিল্প নগরের বাইরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই কেবল এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে এবং ভালো দামে পণ্য রপ্তানি করছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যগুলোয়। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান নাকি এই সনদপ্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের কাজটি তাদের করতে হচ্ছে নিজ উদ্যোগে। হেমায়েতপুরে জড়ো হওয়া ট্যানারিগুলোরও অগত্যা এই প্রক্রিয়ায় যাওয়া প্রয়োজন। সেটা হতে পারে নিজেদের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে তোলার মাধ্যমে।
সরকারের তরফ থেকে বিসিক বলছে, ট্যানারিগুলোর দায়িত্ব রয়েছে কারখানার অভ্যন্তরীণ শর্ত পূরণ করে পশ্চিমা ক্রেতাগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা। এর মধ্যে শ্রম পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। ট্যানারিতে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, কর্মঘণ্টা প্রভৃতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে রাসায়নিক ও পানি ব্যবহৃত হয় ট্যানারিতে, তার মান ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার শর্তও রয়েছে ক্রেতাগোষ্ঠীর। কম পানি ব্যবহৃত হলে তরল বর্জ্যও কম উৎপাদিত হয়; তাতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ওপর চাপ পড়ে কম। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রযুক্তি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের বিষয় রয়েছে। আছে নতুন বিনিয়োগের প্রশ্ন। বিনিয়োগের প্রশ্ন এলেই ব্যাংকঋণের প্রসঙ্গ আসে। বেশ কিছু ট্যানারি প্রতিষ্ঠান তো দীর্ঘদিনের ঋণখেলাপি। অবশ্য বলা হয়, হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের সময় দীর্ঘদিন স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে না পারায় তাদের ঋণখেলাপি হয়ে পড়তে হয়েছে। হাজারীবাগে রেখে আসা তাদের জমির বিষয়টির নিষ্পত্তিও এখন পর্যন্ত করা হয়নি। হেমায়েতপুরেও জমির লিজ আটকে থাকায় ওটাকে বন্ধক রেখে তারা পারছে না নতুন ঋণ নিতে। কোরবানির ঈদ এলে প্রায় প্রতিবার এমন খবরও বেরোয়, ট্যানারিগুলোর হাতে যথেষ্ট অর্থকড়ি নেই কাঁচা চামড়া সংগ্রহের। তাদের কাছে নাকি অনেক পাওনা আটকে আছে আড়তদারদের। আড়তদারদের কাছে আবার টাকাপয়সা পায় রাজধানীসহ প্রত্যন্ত এলাকার চামড়া সংগ্রহকারীরা। এভাবে একটা বকেয়ার চক্রেও ঘুরপাক খাচ্ছে খাতটি। অথচ বেশ কয়েক বছর বলা যায় পানির দামে কোরবানির পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়ে অটোমেটিক চলে আসছে হেমায়েতপুরে কেন্দ্রীভূত ট্যানারিগুলোয়। মাঝে তো দাম এত পড়ে গিয়েছিল যে লোকে কোরবানির চামড়া রাস্তায় ফেলে দেয়; গর্তে পুঁতে ফেলে। তখনো অনেক চামড়া নিশ্চয়ই অত্যন্ত কম দামে কিনতে পেরেছিল ট্যানারিগুলো। সেসব প্রক্রিয়াজাত করে তারা নিশ্চয়ই বিক্রি করেছে। দেশেও রয়েছে এর ভালো চাহিদা। জুতাসহ চামড়াপণ্য উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের সবাই পশ্চিমে রপ্তানি করতে না পারলেও দেশের বাজারে ঠিকই বিক্রি করতে পারছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আবার পশ্চিমা ক্রেতাগোষ্ঠীর শর্ত মেনে বিদেশি কমপ্লায়েন্ট কারখানা থেকে চামড়া এনে পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করছে। এ কারণে পাকা চামড়ার আমদানিও হচ্ছে বেশ। আর এটা হলো দুর্ভাগ্যজনক। পরিবেশসম্মতভাবে কাজটা করা যাচ্ছে না বলে এত সহজলভ্য চামড়ার দেশে উল্টো সেটা আমদানি করতে মূল্যবান বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে।
কোরবানির পশুর একাংশও এখন আর সীমান্তপথে আনতে হয় না। দেশে উৎপাদিত পশু এ সময়ে বরং অবিক্রীত থেকে যায়। সারা বছর জবাই হওয়া গরু-ছাগলও ‘চাহিদামতো’ উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। এর চামড়াও কম দামে মিলছে; যেহেতু এগুলো সীমান্তপথে পাচার হতেও পারছে না। পাচার হলে কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠা কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোয় তা ভালো দামে বিক্রি হতে পারত! এ অবস্থায় অর্থাৎ ‘আবদ্ধ বাজার সুবিধা’ পেয়েও আমাদের সিংহভাগ ট্যানারি প্রতিষ্ঠান পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যর্থ বলে এর ভালো দাম পাচ্ছে না। কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারে নন-সিরিয়াস দেশে আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানিতে একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। এই চামড়া আবার চীনের মতো দেশ থেকে পরিপূর্ণভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে রপ্তানি হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোয়। এমনকি ঘুরেফিরে চলে আসছে এ দেশে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে! এদিকে বেশ কয়েক বছর কমবেশি এক বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানিতে আটকে আছি আমরা। সেখানে চামড়ার হিস্যা আবার কম। এ অবস্থায়ও আমরা অবশ্য স্বপ্ন দেখছি ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানিতে সক্ষম হয়ে ওঠার। এটা অর্জন করা অবশ্য অসম্ভব নয়। কিন্তু সে জন্য তো সরকার ও বেসরকারি খাতকে তার দায়িত্ব বুঝে অবহেলিত কাজগুলো করতে, অর্থাৎ শর্ত পূরণে এগিয়ে আসতে হবে।
গেল কোরবানির ঈদের আগ দিয়ে অবশ্য চামড়া খাতে একটি পৃথক ‘কর্তৃপক্ষ’ গঠনে আইন প্রণয়নের খবর দেওয়া হলো। সেটা হতে কত সময় লাগবে, কে জানে! তবে একটা কর্তৃপক্ষ হলে সম্ভাবনাময় এ খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়াটা হয়তো সহজ হবে। তার আগে অবশ্য এ দায়দায়িত্ব নির্ণয় করা জরুরি যে কেন একটিমাত্র কমপ্লায়েন্ট চামড়াশিল্প নগর গড়ে তুলতে এত কাণ্ড হলো! তারপরও কেন এত ঘাটতি রয়ে গেল, যে কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকা চামড়ার বিশ্ববাজার ধরতে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ? যে খাতে অনেক বেশি মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ের সুযোগ ছিল—এতগুলো বছরেও কেন আমরা তা নিতে পারলাম না, সেটা কি এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রশ্ন?
লেখক: হাসান মামুন, সাংবাদিক, বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে