মনিরা শরমিন
সিনেমার দর্শক হিসেবে আমি প্রেক্ষাগৃহপন্থী। ফলে সেদিন ক্লাস ও কাজের চাপ একটু কমতেই বড় পর্দায় ছবি দেখার আকাঙ্ক্ষায় ছুট লাগালাম। সিনেমা শুরু হতে আর এক-দুই মিনিট বাকি। আমি ছাড়া আর তেমন কাউকে আশপাশে দেখছি না। অগত্যা নিজেই দরজা ঠেলে হলে প্রবেশ করলাম। ভেতরে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার, পর্দার আলোটা পর্যন্ত জ্বলেনি তখনো। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে দেখি, পুরো প্রেক্ষাগৃহে আর কোনো মানুষ নেই। আমি চিৎকার করে উঠি, ‘কেউ কি আছেন?’ খুব সামনে থেকে কে একজন বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছি।’ আমার আতঙ্কের বোধ যায় না। এক হাতে টিকিট, আর অন্য হাতে ফোন নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। না এমন নয় যে শুধু এই অদ্ভুত আঁধারে একাকিত্বের অনুভূতি আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে, বরং রাজধানীর কেন্দ্রের এক প্রেক্ষাগৃহে এই দর্শকহীনতা আমার মধ্যে এক দ্বিধার বোধ হাজির করে।
পরে লিখতে বসে আমার মনে হতে থাকে, আমাদের দেশি চলচ্চিত্রও আদতে এ মুহূর্তে সেদিনের আমার মতো একটি দোলাচলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। যে দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে বিগত দুই দশকের দেশি চলচ্চিত্র, নিজ ইন্ডাস্ট্রি, এর অন্তর্বর্তী সংস্কৃতি-মানুষসহ সবকিছুকেই কারণে অথবা অকারণে খারিজ করার চর্চা, ইন্ডাস্ট্রির মানুষের একটি বিশাল অংশের অদক্ষতা, অসততা, কালোটাকা সাদা করার হাতিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহার, মূল এবং বিকল্পধারার দ্বন্দ্ব, সেন্সরশিপের খড়্গ এবং সর্বোপরি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের ইতিহাস। আর সামনে রয়েছে একঝাঁক স্বপ্নবাজ এবং কুশলী তরুণ নির্মাতা, নতুন গল্প, দক্ষ অভিনয়শিল্পী, নতুন নির্মাণ পদ্ধতির প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক সম্মাননা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাধ্যম হিসেবে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব। ফলে এখন হিসাব কষার সময় এসেছে।
আমরা এত দিন জেনেছি, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ঝুলিতে তেমন কোনো অর্জন নেই। এমনকি অলটাইম ব্লকব্লাস্টার বলতে যা ধরে নেওয়া হয়, তেমন কোনো চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়নি এই সময়টাতে। আমরা জেনেছি, বিগত ২০ বছরে সুপারহিট সিনেমা হাতে গুনলে মনপুরা (২০০৯), আয়নাবাজি (২০১৬), শিকারি (২০১৬), পোড়ামন ২ (২০১৮)-এর মতো মাত্র ১০-১২টার বেশি হবে না।
চলতি বছর ভারতে কোভিড মহামারির প্রকোপ কমতেই সে দেশের প্রায় ৪১% নাগরিক প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন এবং দেখছেনও। বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ২০ বছরে ১ হাজার ২৩৫ থেকে মাত্র ৬০-এ এসে থেমেছে। সব মিলিয়ে এমনই বিপন্ন বিষণ্ন ক্লিশে আলাপে আটকে গেছে দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক কথামালা।
এত নেতিবাচক আলাপের ভিড়েও ২০২১ সালে বিভিন্ন কারণে চলচ্চিত্রে দিনবদলের চিহ্ন চোখে পড়ে। যদিও কোভিডের প্রথম বছর; অর্থাৎ, ২০২০ সালে দেশি চলচ্চিত্রে স্মরণকালের মন্দা অবস্থা দেখা দেয়। টানা আট মাস প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। ২০২০ সালে তানভীর মোকাম্মেলের ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ এবং চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘বিশ্বসুন্দরী’সহ প্রায় ১২টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও কোনোটি ব্যবসাসফল হয়নি। আর এরপরই ২০২১ সালের হাত ধরে কিছুটা স্বপ্ন, আশা আর বিকল্প বাতাস নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় নতুন জমানার নতুন ধরনের চলচ্চিত্র।
ওটিটি ও দেশি কনটেন্ট: বাঁকবদলের আভাস
কোভিড মহামারি সারা বিশ্বের মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনেছে। এ সময় চলচ্চিত্রের জগতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। সারা পৃথিবীতে ওটিটির (ওভার দ্য টপ) বাজারের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। এর অবস্থান বাংলাদেশেও রমরমা হয়ে উঠছে। পরিবর্তিত মাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার দর্শকের শ্রেণিতেও পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রমিক নয়, বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণি হয়ে উঠছে চলচ্চিত্রের প্রথম দর্শক। বিজ্ঞাপনবিহীন আর স্বল্প খরচে দেখা যায় বলে দর্শকের পছন্দের তালিকায় ওটিটি এখন প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। বর্তমানে মোটামুটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা অন্তত ১০টি।
২০২০ সালে হইচই-তে প্রচারিত ‘তকদীর’ এবং বিঞ্জ-এ ‘আগস্ট ২৪’-এর মধ্য দিয়ে জনগণ দেশি সিরিজের প্রতি আলাদা মনোযোগ দিতে শুরু করে। কোভিড মহামারি চলাকালে এবং এর পরবর্তী সময়ে হইচই, নেটফ্লিক্স, জি ফাইভ ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম দেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ২০২১ সালে চরকি-এর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। প্ল্যাটফর্মটির ‘ঊনলৌকিক’ (২০২১) ‘জাগো বাহে’ (২০২১) ‘নিখোঁজ’ (২০২২)-সহ নুহাশ হুমায়ূনের হরর সিরিজ ‘ষ’ (২০২২) দর্শকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ভারতীয় চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়া তাঁর রিভিউয়ে বাংলা সেরা ওয়েব সিরিজের তালিকায় চরকির ‘ঊনলৌকিক’-এর কথা বলেছেন। শিবব্রত বর্মনের গল্পে রবিউল আলম রবি পরিচালিত এই সাইকো থ্রিলার এনথোলজির প্রথম মৌসুমে রয়েছে পাঁচটি গল্প।
এ ছাড়া সম্পূর্ণ রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায়, আঞ্চলিক শিল্পীদের নিয়ে বানানো ফিল্ম নোয়ার জনরার সিরিজ ‘শাটিকাপ’ (২০২২) বোদ্ধাশ্রেণিকে সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এরই পরম্পরায় আমরা চরকিতে সম্প্রতি মুক্তি পেতে দেখি, বাগেরহাটের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সাহস’ (২০২২)। তবে ‘শাটিকাপ’ থেকে এর নির্মাণ আলাদা।
অন্যদিকে, ওটিটির জন্যও নতুন নীতিমালা গৃহীত হতে যাচ্ছে, যাতে করে ওটিটি মাধ্যমেও সিরিজ, সিনেমা এবং যাবতীয় অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট নির্মাণে নির্মাতাদের স্বাধীনতা আগের থেকে কমবে বলে মনে করা হচ্ছে, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ সাজ্জাদ খান পরিচালিত সাহস (২০২২)।
এ ছাড়া আশফাক নিপুণের ‘সাবরিনা’ (২০২২) এবং ‘মহানগর’ (২০২১), ইমতিয়াজ সজীবের ‘রিফিউজি’ (২০২২), মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ (২০২১) সিরিজগুলো নারীকেন্দ্রিক, রাজনৈতিক এবং সংখ্যালঘু মানুষদের নিয়ে করা ভিন্নধর্মী গল্প ও বয়ানরীতির জন্য দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তরুণ নির্মাতাদের চলচ্চিত্র
করোনা-পরবর্তীকালে যেমন নয়া মাধ্যম দেশি চলচ্চিত্রের বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি এই সময়টাতে বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ নির্মাতা তাঁদের চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন বিশ্বদরবারে। বিগত বছরে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (২০২১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম কানে অফিশিয়াল মনোনয়ন পায়। সিনেমাটি এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডেও (অ্যাপসা) যৌথভাবে গ্র্যান্ড জুরি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। এদিকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ (২০২১) চলচ্চিত্র নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম চলচ্চিত্র উৎসব কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নেন। চলচ্চিত্রটি বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ও ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এনএফডিসি) থেকেও সম্মাননা পায়। গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে প্রদর্শিত হয় রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নোনা জলের কাব্য’ (২০২১)। রাশেদ এন চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ‘চন্দ্রাবতী কথা’ (২০২১)। একাধিক দেশজ ফর্ম ব্যবহার করে নির্মিত চলচ্চিত্রটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় ২৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। আর প্রসূন রহমানের ‘ঢাকা ড্রিম’ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব টরন্টোতে প্রদর্শিত হয়।
এই চলচ্চিত্রগুলোর বিকল্প গল্প এবং বয়ানরীতি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সার্বিক পরিসরে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনেছে। খুব নিকট না হলেও ভবিষ্যতে এ ধরনের চলচ্চিত্রের হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রের বাঁকবদলের আশা আমরা করতেই পারি।
শেষের কথা
সময়টা এখনো দেশি চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ অনুকূলে নেই। সিনেমা হলের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। দর্শকও হলবিমুখ। অনেকেই আবার বলছেন, নারী দর্শক বাড়াতে হবে। কারণ হিসেবে জানাচ্ছেন, নারীরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে হলে যেতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। এদিকে বরাদ্দ থাকলেও বিগত দুই বছরে কোনো ডকুমেন্টারি ফিল্মই সরকারি অনুদানের জন্য মনোনীত হয়নি। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রগুলোই বারবার সরকারি অনুদান পাচ্ছে বলে কথা উঠেছে। এ ক্ষেত্রে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রগুলোকে অনুদান এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকে সরকারি প্রণোদনা বা ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই সংকট নিরসনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
চলচ্চিত্র বাঁচাতে গ্রাম-বাংলার আপামর মানুষের গল্প, নিজস্ব বয়ানরীতি, আর একটি সংগঠিত ইন্ডাস্ট্রি এখন সময়ের দাবি। আমরা সবাই জানি, অত্যন্ত অল্প পুঁজি এবং যান্ত্রিক সহায়তা নিয়ে একঝাঁক দেশি তরুণ বিশ্বজয়ের সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সফলও হচ্ছেন তাঁরা। কে বলতে পারে, আরেকটু সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সব দোলাচলকে অতিক্রম করে এই তরুণদের হাত ধরেই পাল্টে যেতে পারে দেশি চলচ্চিত্রের গতিপথ। তখন হয়তো বাংলা ছবির এই বিষণ্নতার বয়ানগুলো বিস্মৃত হবে, আর বিশ্ব আমাদের চিনবে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ফিনিক্স পাখির মতো উত্থানের গল্পের জন্য।
লেখক: শিক্ষক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
সিনেমার দর্শক হিসেবে আমি প্রেক্ষাগৃহপন্থী। ফলে সেদিন ক্লাস ও কাজের চাপ একটু কমতেই বড় পর্দায় ছবি দেখার আকাঙ্ক্ষায় ছুট লাগালাম। সিনেমা শুরু হতে আর এক-দুই মিনিট বাকি। আমি ছাড়া আর তেমন কাউকে আশপাশে দেখছি না। অগত্যা নিজেই দরজা ঠেলে হলে প্রবেশ করলাম। ভেতরে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার, পর্দার আলোটা পর্যন্ত জ্বলেনি তখনো। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে দেখি, পুরো প্রেক্ষাগৃহে আর কোনো মানুষ নেই। আমি চিৎকার করে উঠি, ‘কেউ কি আছেন?’ খুব সামনে থেকে কে একজন বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছি।’ আমার আতঙ্কের বোধ যায় না। এক হাতে টিকিট, আর অন্য হাতে ফোন নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। না এমন নয় যে শুধু এই অদ্ভুত আঁধারে একাকিত্বের অনুভূতি আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে, বরং রাজধানীর কেন্দ্রের এক প্রেক্ষাগৃহে এই দর্শকহীনতা আমার মধ্যে এক দ্বিধার বোধ হাজির করে।
পরে লিখতে বসে আমার মনে হতে থাকে, আমাদের দেশি চলচ্চিত্রও আদতে এ মুহূর্তে সেদিনের আমার মতো একটি দোলাচলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। যে দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে বিগত দুই দশকের দেশি চলচ্চিত্র, নিজ ইন্ডাস্ট্রি, এর অন্তর্বর্তী সংস্কৃতি-মানুষসহ সবকিছুকেই কারণে অথবা অকারণে খারিজ করার চর্চা, ইন্ডাস্ট্রির মানুষের একটি বিশাল অংশের অদক্ষতা, অসততা, কালোটাকা সাদা করার হাতিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহার, মূল এবং বিকল্পধারার দ্বন্দ্ব, সেন্সরশিপের খড়্গ এবং সর্বোপরি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের ইতিহাস। আর সামনে রয়েছে একঝাঁক স্বপ্নবাজ এবং কুশলী তরুণ নির্মাতা, নতুন গল্প, দক্ষ অভিনয়শিল্পী, নতুন নির্মাণ পদ্ধতির প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক সম্মাননা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাধ্যম হিসেবে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব। ফলে এখন হিসাব কষার সময় এসেছে।
আমরা এত দিন জেনেছি, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ঝুলিতে তেমন কোনো অর্জন নেই। এমনকি অলটাইম ব্লকব্লাস্টার বলতে যা ধরে নেওয়া হয়, তেমন কোনো চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়নি এই সময়টাতে। আমরা জেনেছি, বিগত ২০ বছরে সুপারহিট সিনেমা হাতে গুনলে মনপুরা (২০০৯), আয়নাবাজি (২০১৬), শিকারি (২০১৬), পোড়ামন ২ (২০১৮)-এর মতো মাত্র ১০-১২টার বেশি হবে না।
চলতি বছর ভারতে কোভিড মহামারির প্রকোপ কমতেই সে দেশের প্রায় ৪১% নাগরিক প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন এবং দেখছেনও। বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ২০ বছরে ১ হাজার ২৩৫ থেকে মাত্র ৬০-এ এসে থেমেছে। সব মিলিয়ে এমনই বিপন্ন বিষণ্ন ক্লিশে আলাপে আটকে গেছে দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক কথামালা।
এত নেতিবাচক আলাপের ভিড়েও ২০২১ সালে বিভিন্ন কারণে চলচ্চিত্রে দিনবদলের চিহ্ন চোখে পড়ে। যদিও কোভিডের প্রথম বছর; অর্থাৎ, ২০২০ সালে দেশি চলচ্চিত্রে স্মরণকালের মন্দা অবস্থা দেখা দেয়। টানা আট মাস প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। ২০২০ সালে তানভীর মোকাম্মেলের ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ এবং চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘বিশ্বসুন্দরী’সহ প্রায় ১২টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও কোনোটি ব্যবসাসফল হয়নি। আর এরপরই ২০২১ সালের হাত ধরে কিছুটা স্বপ্ন, আশা আর বিকল্প বাতাস নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় নতুন জমানার নতুন ধরনের চলচ্চিত্র।
ওটিটি ও দেশি কনটেন্ট: বাঁকবদলের আভাস
কোভিড মহামারি সারা বিশ্বের মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনেছে। এ সময় চলচ্চিত্রের জগতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। সারা পৃথিবীতে ওটিটির (ওভার দ্য টপ) বাজারের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। এর অবস্থান বাংলাদেশেও রমরমা হয়ে উঠছে। পরিবর্তিত মাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার দর্শকের শ্রেণিতেও পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রমিক নয়, বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণি হয়ে উঠছে চলচ্চিত্রের প্রথম দর্শক। বিজ্ঞাপনবিহীন আর স্বল্প খরচে দেখা যায় বলে দর্শকের পছন্দের তালিকায় ওটিটি এখন প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। বর্তমানে মোটামুটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা অন্তত ১০টি।
২০২০ সালে হইচই-তে প্রচারিত ‘তকদীর’ এবং বিঞ্জ-এ ‘আগস্ট ২৪’-এর মধ্য দিয়ে জনগণ দেশি সিরিজের প্রতি আলাদা মনোযোগ দিতে শুরু করে। কোভিড মহামারি চলাকালে এবং এর পরবর্তী সময়ে হইচই, নেটফ্লিক্স, জি ফাইভ ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম দেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ২০২১ সালে চরকি-এর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। প্ল্যাটফর্মটির ‘ঊনলৌকিক’ (২০২১) ‘জাগো বাহে’ (২০২১) ‘নিখোঁজ’ (২০২২)-সহ নুহাশ হুমায়ূনের হরর সিরিজ ‘ষ’ (২০২২) দর্শকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ভারতীয় চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়া তাঁর রিভিউয়ে বাংলা সেরা ওয়েব সিরিজের তালিকায় চরকির ‘ঊনলৌকিক’-এর কথা বলেছেন। শিবব্রত বর্মনের গল্পে রবিউল আলম রবি পরিচালিত এই সাইকো থ্রিলার এনথোলজির প্রথম মৌসুমে রয়েছে পাঁচটি গল্প।
এ ছাড়া সম্পূর্ণ রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায়, আঞ্চলিক শিল্পীদের নিয়ে বানানো ফিল্ম নোয়ার জনরার সিরিজ ‘শাটিকাপ’ (২০২২) বোদ্ধাশ্রেণিকে সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এরই পরম্পরায় আমরা চরকিতে সম্প্রতি মুক্তি পেতে দেখি, বাগেরহাটের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সাহস’ (২০২২)। তবে ‘শাটিকাপ’ থেকে এর নির্মাণ আলাদা।
অন্যদিকে, ওটিটির জন্যও নতুন নীতিমালা গৃহীত হতে যাচ্ছে, যাতে করে ওটিটি মাধ্যমেও সিরিজ, সিনেমা এবং যাবতীয় অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট নির্মাণে নির্মাতাদের স্বাধীনতা আগের থেকে কমবে বলে মনে করা হচ্ছে, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ সাজ্জাদ খান পরিচালিত সাহস (২০২২)।
এ ছাড়া আশফাক নিপুণের ‘সাবরিনা’ (২০২২) এবং ‘মহানগর’ (২০২১), ইমতিয়াজ সজীবের ‘রিফিউজি’ (২০২২), মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ (২০২১) সিরিজগুলো নারীকেন্দ্রিক, রাজনৈতিক এবং সংখ্যালঘু মানুষদের নিয়ে করা ভিন্নধর্মী গল্প ও বয়ানরীতির জন্য দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তরুণ নির্মাতাদের চলচ্চিত্র
করোনা-পরবর্তীকালে যেমন নয়া মাধ্যম দেশি চলচ্চিত্রের বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি এই সময়টাতে বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ নির্মাতা তাঁদের চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন বিশ্বদরবারে। বিগত বছরে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (২০২১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম কানে অফিশিয়াল মনোনয়ন পায়। সিনেমাটি এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডেও (অ্যাপসা) যৌথভাবে গ্র্যান্ড জুরি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। এদিকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ (২০২১) চলচ্চিত্র নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম চলচ্চিত্র উৎসব কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নেন। চলচ্চিত্রটি বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ও ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এনএফডিসি) থেকেও সম্মাননা পায়। গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে প্রদর্শিত হয় রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নোনা জলের কাব্য’ (২০২১)। রাশেদ এন চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ‘চন্দ্রাবতী কথা’ (২০২১)। একাধিক দেশজ ফর্ম ব্যবহার করে নির্মিত চলচ্চিত্রটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় ২৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। আর প্রসূন রহমানের ‘ঢাকা ড্রিম’ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব টরন্টোতে প্রদর্শিত হয়।
এই চলচ্চিত্রগুলোর বিকল্প গল্প এবং বয়ানরীতি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সার্বিক পরিসরে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনেছে। খুব নিকট না হলেও ভবিষ্যতে এ ধরনের চলচ্চিত্রের হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রের বাঁকবদলের আশা আমরা করতেই পারি।
শেষের কথা
সময়টা এখনো দেশি চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ অনুকূলে নেই। সিনেমা হলের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। দর্শকও হলবিমুখ। অনেকেই আবার বলছেন, নারী দর্শক বাড়াতে হবে। কারণ হিসেবে জানাচ্ছেন, নারীরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে হলে যেতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। এদিকে বরাদ্দ থাকলেও বিগত দুই বছরে কোনো ডকুমেন্টারি ফিল্মই সরকারি অনুদানের জন্য মনোনীত হয়নি। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রগুলোই বারবার সরকারি অনুদান পাচ্ছে বলে কথা উঠেছে। এ ক্ষেত্রে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রগুলোকে অনুদান এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকে সরকারি প্রণোদনা বা ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই সংকট নিরসনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
চলচ্চিত্র বাঁচাতে গ্রাম-বাংলার আপামর মানুষের গল্প, নিজস্ব বয়ানরীতি, আর একটি সংগঠিত ইন্ডাস্ট্রি এখন সময়ের দাবি। আমরা সবাই জানি, অত্যন্ত অল্প পুঁজি এবং যান্ত্রিক সহায়তা নিয়ে একঝাঁক দেশি তরুণ বিশ্বজয়ের সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সফলও হচ্ছেন তাঁরা। কে বলতে পারে, আরেকটু সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সব দোলাচলকে অতিক্রম করে এই তরুণদের হাত ধরেই পাল্টে যেতে পারে দেশি চলচ্চিত্রের গতিপথ। তখন হয়তো বাংলা ছবির এই বিষণ্নতার বয়ানগুলো বিস্মৃত হবে, আর বিশ্ব আমাদের চিনবে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ফিনিক্স পাখির মতো উত্থানের গল্পের জন্য।
লেখক: শিক্ষক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে