মানবর্দ্ধন পাল
‘ভাঙল মিলনমেলা ভাঙল।’ ফেব্রুয়ারি মাসের আটাশ দিনের একুশের বইমেলা এবার একত্রিশ দিনে শেষ হলো। লিপইয়ারের ও প্রকাশকদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে বেড়েছে মোট তিন দিন। পাঠক ও প্রকাশকেরা সানন্দে উপভোগ করেছেন বাড়তি চব্বিশ প্রহর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মারক বাঙালির চেতনার উৎসব, প্রাণের উৎসব, মননের উৎসব একুশের বইমেলা। আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্বাধীনতার মর্মমূল ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে এই একুশের বইমেলা। তাই এর ভাবসম্পদ এবং গুরুত্ব অন্য কোনো মেলার মতো নয়। একুশের বইমেলা কেবল বই-বাণিজ্যের মেলা নয়, বইয়ের বিপণনের মেলা নয়, প্রকাশনার বিজ্ঞাপনও নয়—তা মাসব্যাপী বাঙালির মনন-সম্ভারের মহোৎসব। এর সোনালি ফসল আমাদের মেধা-সাম্রাজ্যের ধীমান কবি-লেখকদের চেতনার ফুল। বাঙালির অন্যতম অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার উৎসব পয়লা বৈশাখের মতোই একুশের বইমেলা আজ পরিণত হয়েছে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষের মহোৎসবে।
স্বাধীনতার পর থেকে বায়ান্ন বছরে শিক্ষামনস্ক ও সংস্কৃতিমান বাঙালির প্রাণের উৎসব হয়ে উঠেছে একুশের বইমেলা। এই বইমেলা ভাষা আন্দোলনের স্মারক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন। একুশের রক্তস্নাত চেতনায় ঋদ্ধ এই বইমেলা। জাতীয় মননের প্রতীক হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বইমেলা এখন বিশ্ব বাঙালির অন্যতম আকর্ষণ। তাই প্রচুর প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক-পাঠক বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দেশে আসেন। এ উপলক্ষে আসেন ভিনদেশি বাঙালি কবি-লেখকেরাও—বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের। তাঁদের বইও এ দেশের প্রকাশকেরা কেউ কেউ ছাপেন বলে তাঁদের আগমন হয় স্বতঃস্ফূর্ত। তাতে আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে একুশের বইমেলা।
আমি মফস্বলের মানুষ, তবে প্রতিবছরই বইমেলায় যাই। করোনাকালের দুই বছর ছাড়া বিশ বছর ধরে বইমেলায় নিয়মিত যাচ্ছি। নিজের বইয়ের প্রকাশনা থাক বা না-থাক, বইমেলায় যাই একাধিক কারণে। নতুন বই সাধ্যমতো কেনা তো আছেই, স্টল ঘুরে দেখার মধ্যেও আছে আনন্দ! বইয়ের বিষয়, লেখক-পরিচিতি, ফ্ল্যাপের বক্তব্য, প্রচ্ছদশিল্পীর নাম, প্রচ্ছদের রং-ডিজাইন, নতুন বইয়ের গন্ধ ইত্যাদি সবই আমাকে আকর্ষণ করে। উপরি পাওনা হিসেবে মিলে যায় অনেক খ্যাতিমান লেখকের দেখাও। এবার যেমন পাওয়া গেল লন্ডনপ্রবাসী খ্যাতিমান এক লেখক দম্পতিকে—সেলিম জাহান ও শামীম আজাদ। একজন জাতিসংঘের অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মধুক্ষরা গদ্যশিল্পী, অন্যজন কবিতায় এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত। দেখা হলো কথাশিল্পী মোহিত কামাল এবং আমেরিকাপ্রবাসী আহমদ মাযহারের সঙ্গেও। দেখা হলো নারী-মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক লিনু হকের সঙ্গে। ভারতীয় কবি-বন্ধুদের মধ্যে দেখা হলো কলকাতার কাজল চক্রবর্তী, শান্তিময় মুখোপাধ্যায় ও ত্রিপুরার দিলীপ দাসের সঙ্গে। দেখা ও কথা হলো টিভিতে টক শোর পরিচিত মুখ নজরুল কবীরের সঙ্গে। তা ছাড়া প্রতিবছর বইমেলায় পরিচিত হওয়া যায় অদেখা কিন্তু পাঠসঙ্গী খ্যাতিমান লেখক ও নবীন কবি-লেখকদের সঙ্গে। উপরি পাওনা থাকে দু-চারজনের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সৌজন্যসংখ্যা। এসবের আকর্ষণই প্রতিবছর আমাকে টেনে নিয়ে যায় বইমেলায়।
একটা সময় গেছে, প্রতি শুক্রবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দল বেঁধে মেলায় গিয়ে গভীর রাতে ফিরেছি বইয়ের বোঝা নিয়ে। মেলা থেকে আমি তাৎক্ষণিক বই খুব কমই কিনি। টেঁকের জোর কম বলে দেখে, চেখে এবং বুঝে বই কেনাই আমার স্বভাব। সবাই কিংবা অনেকেই হয়তো তেমনিভাবেই কেনেন। তবে আমি ঘনিষ্ঠ ও কাছের বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে কিনি, যাতে উভয়েই ব্যবহার করতে পারি। এ কারণে প্রথম দিন মেলায় গিয়ে প্যাভিলিয়ন ও বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে শুধু ক্যাটালগ সংগ্রহ করি। বাসায় এসে প্রয়োজন ও পছন্দের বইয়ের একটি তালিকা তৈরি করি। এরপর মেলার শেষ সপ্তাহে তালিকা ধরে বই কিনি। তাতে অর্থের কিছুটা সাশ্রয়ও হয়। পছন্দের সব বইই তো কেনা হয় না, দাম এবং সংগতির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়!
প্রমথ চৌধুরীর সেই আপ্তবাক্যটি সবাই জানেন—বই কিনে কেউ কোনো দিন দেউলিয়া হয় না। এই একুশ শতকের মূল্যস্ফীতির যুগে বাস করলে তিনি কী বলতেন জানি না! তবে বই কিনে তিনি জ্ঞানের অমূল্য সম্পদ অর্জনের কথা ভেবেই সে কথা বলেছিলেন। বিত্তবান, ব্যবসায়ী, কোটিপতি, মিল-কারকানার মালিকেরা বই পড়েন না, কেনেনও না। নিরক্ষর দীনদরিদ্র নিম্নবর্গের মানুষেরও বই কেনার সংগতি নেই। এ কথা সেই যুগেও যেমন সত্য ছিল, এখনো তা-ই। এবার একুশে পদকপ্রাপ্ত ক্ষণজন্মা জিয়াউল হক বা পলান সরকার কজনই বা হতে পারেন! তাঁরা তো যুগে-যুগে জন্মগ্রহণ করেন না!
বই কেনেন মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, ছোট চাকরিজীবী এবং সচেতন শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের একাংশ। অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এখন আর বই পড়ে না! প্রাইভেট পড়া ও পড়ানোর ইঁদুরদৌড়ে তারা এখন এমন ব্যস্ত থাকে যে ‘আউট বই’ পড়ার তাদের সময় কোথায়! আমার পঁয়ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বহুবার অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে একবার বইমেলায় যাওয়ার। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। শিক্ষকদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাইনি! অথচ প্রতিবছর দেখেছি, শিক্ষাসফরের নামে বনভোজনে কলেজ ফান্ডের অর্থ ব্যয়ে তাদের উদ্বাহু নৃত্য!
বইমেলা তো মূলত লেখক-পাঠক ও প্রকাশকদের বৎসরান্তিক মিলনমেলা। প্রকাশকের হাত ধরে লেখকের সৃজনশীল কর্ম পাঠকের কাছে উৎসবের মাধ্যমে পৌঁছে দেয় বইমেলা। বইমেলা তো বাণিজ্য মেলার মতো বিচিত্র পণ্যের সমাহারে উজ্জ্বল নয় যে সব ধরনের মানুষের সমাগম হবে! পাঠের প্রতি আকর্ষণ, বই সংগ্রহের মোহ এবং জ্ঞানার্জনের স্পৃহা না থাকলে তো বইমেলার প্রতি সবার উৎসাহ থাকার কথা নয়! তবু লক্ষ করা যায়, উপচেপড়া ভিড়ে মেলাপ্রাঙ্গণ ধূলিধূসর ও টালমাটাল! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এত বড় মেলাপ্রাঙ্গণ, তবু যেন ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! কিন্তু ভেতরের সত্য তেমন সুখকর নয়!
অধিকাংশ প্রকাশকই বলে থাকেন, ক্রেতা নেই, বেচাবিক্রি নেই, গ্রাহক নেই। ব্যবসায়ীদের ধর্মই অসন্তুষ্টি। ভালো বেচাবিক্রি হলেও তাঁরা স্বীকার করেন না। বলেন, ‘চলছে মোটামুটি!’ কিন্তু এ কথা সত্যি যে মেলা মানে তো শুধু বিপণিবিতানে গ্রাহকদের কেনাবেচা নয়, দর্শনার্থীদের স্থানও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাংসের চেয়ে আলু বেশি হলে ব্যঞ্জন যেমন স্বাদ হারায়, তেমনি ক্রেতার চেয়ে দর্শক বেশি হলেও মেলা মাহাত্ম্য হারায়। সেই দর্শকেরা যদি গ্রন্থদর্শক হতো, তবে আপত্তির তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু অধিকাংশ দর্শকের মধ্যে তা-ও লক্ষ করা যায় না! বই নেড়েচেড়ে দেখার মধ্যেও যে আনন্দ আছে, তাও অনেক দর্শকের মধ্যে অনুপস্থিত। অনেকে বইমেলায় যায় দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করতে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতে, রেস্টুরেন্টে চা-নাশতা খেতে, জটলা করে সেলফি তুলতে এবং সস্তা বিনোদনের লক্ষ্যে। সেদিন স্বচক্ষেই দেখলাম, একদল তরুণী জনৈক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে দেখে স্টলে ঢুকে তাঁর বইসহ লেখকের সঙ্গে ছবি তুলে বইটি রেখে দিব্যি চলে গেল। এসবের কারণে প্রকৃত বইপ্রেমিকেরা নির্বিঘ্নে দেখে-চেখে-বুঝে বই সংগ্রহ করতে পারেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই সব দর্শককে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বইমেলার চেতনা, গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য বিঘ্নিত না হয়ে পারে না।
ক্রমান্বয়ে বইমেলায় প্রকাশক বাড়ছে, স্টল বাড়ছে এবং বাড়ছে মেলার পরিধিও। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় এই, অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শকদের সংখ্যাও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে! ফলে সামগ্রিকভাবে বই বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়েনি। তাই একটি জরিপে জানা যায়, বেরোনোর পথে মেলায় আসা মানুষদের মধ্যে মাত্র ৭ ভাগের হাতে বইয়ের প্যাকেট দেখা যায়! এই জরিপের তথ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দুর্ভাবনায় আক্রান্ত করে বৈকি! বাঙালি বই কিনে না, কিন্তু লাইন ধরে সিনেমার টিকিট কিনে—এই সত্য সৈয়দ মুজতবা আলী বহু বছর আগেই অনুধাবন করেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশন বোধ করি এখনো ধারাবাহিকভাবে চলছে। তাই বইমেলায় গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শকেরা রেস্টুরেন্টে হাজার টাকা খরচ করবে কিন্তু দুই শ টাকা দিয়ে একটি বই কিনবে না! রবীন্দ্রনাথ না কিনুক, গোপাল ভাঁড়ের রঙ্গরসিকতা বই তো কেনা যায়! বিভূতিভূষণের বই না কিনুক, বাল্যশিক্ষা-জাতীয় একটি শিশুতোষ বইও তো কেনা যায় পরিবারের শিশুটির জন্য! কিন্তু না, প্রতিদিন ঘুরেফিরে, আড্ডা মেরে, চা-পানি খেয়ে চলে আসবে! আমি এমন একাধিক পরিবারের কথা জানি, যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভোরে সপরিবারে বইমেলায় গিয়ে ঘুরেফিরে, খেয়েদেয়ে রাতে ফিরে এসেছে, কিন্তু একটি বইও কেনেনি। অবশ্য প্রকৃত বিনোদনের দুর্ভিক্ষের এই নগরে-মহানগরে সাধারণের জন্য কীই-বা আছে! তবু বইমেলার এক মাসে যে পরিমাণ মানুষ মেলায় প্রবেশ করেছে, তারা সবাই যদি একটি করেও বই কিনত; তবে কোনো প্রকাশকের কাছে কোনো বই থাকত কি না, সন্দেহ!
লেখক: মানবর্দ্ধন পাল, গ্রন্থকার, অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক
‘ভাঙল মিলনমেলা ভাঙল।’ ফেব্রুয়ারি মাসের আটাশ দিনের একুশের বইমেলা এবার একত্রিশ দিনে শেষ হলো। লিপইয়ারের ও প্রকাশকদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে বেড়েছে মোট তিন দিন। পাঠক ও প্রকাশকেরা সানন্দে উপভোগ করেছেন বাড়তি চব্বিশ প্রহর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মারক বাঙালির চেতনার উৎসব, প্রাণের উৎসব, মননের উৎসব একুশের বইমেলা। আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্বাধীনতার মর্মমূল ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে এই একুশের বইমেলা। তাই এর ভাবসম্পদ এবং গুরুত্ব অন্য কোনো মেলার মতো নয়। একুশের বইমেলা কেবল বই-বাণিজ্যের মেলা নয়, বইয়ের বিপণনের মেলা নয়, প্রকাশনার বিজ্ঞাপনও নয়—তা মাসব্যাপী বাঙালির মনন-সম্ভারের মহোৎসব। এর সোনালি ফসল আমাদের মেধা-সাম্রাজ্যের ধীমান কবি-লেখকদের চেতনার ফুল। বাঙালির অন্যতম অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার উৎসব পয়লা বৈশাখের মতোই একুশের বইমেলা আজ পরিণত হয়েছে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষের মহোৎসবে।
স্বাধীনতার পর থেকে বায়ান্ন বছরে শিক্ষামনস্ক ও সংস্কৃতিমান বাঙালির প্রাণের উৎসব হয়ে উঠেছে একুশের বইমেলা। এই বইমেলা ভাষা আন্দোলনের স্মারক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন। একুশের রক্তস্নাত চেতনায় ঋদ্ধ এই বইমেলা। জাতীয় মননের প্রতীক হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বইমেলা এখন বিশ্ব বাঙালির অন্যতম আকর্ষণ। তাই প্রচুর প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক-পাঠক বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দেশে আসেন। এ উপলক্ষে আসেন ভিনদেশি বাঙালি কবি-লেখকেরাও—বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের। তাঁদের বইও এ দেশের প্রকাশকেরা কেউ কেউ ছাপেন বলে তাঁদের আগমন হয় স্বতঃস্ফূর্ত। তাতে আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে একুশের বইমেলা।
আমি মফস্বলের মানুষ, তবে প্রতিবছরই বইমেলায় যাই। করোনাকালের দুই বছর ছাড়া বিশ বছর ধরে বইমেলায় নিয়মিত যাচ্ছি। নিজের বইয়ের প্রকাশনা থাক বা না-থাক, বইমেলায় যাই একাধিক কারণে। নতুন বই সাধ্যমতো কেনা তো আছেই, স্টল ঘুরে দেখার মধ্যেও আছে আনন্দ! বইয়ের বিষয়, লেখক-পরিচিতি, ফ্ল্যাপের বক্তব্য, প্রচ্ছদশিল্পীর নাম, প্রচ্ছদের রং-ডিজাইন, নতুন বইয়ের গন্ধ ইত্যাদি সবই আমাকে আকর্ষণ করে। উপরি পাওনা হিসেবে মিলে যায় অনেক খ্যাতিমান লেখকের দেখাও। এবার যেমন পাওয়া গেল লন্ডনপ্রবাসী খ্যাতিমান এক লেখক দম্পতিকে—সেলিম জাহান ও শামীম আজাদ। একজন জাতিসংঘের অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মধুক্ষরা গদ্যশিল্পী, অন্যজন কবিতায় এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত। দেখা হলো কথাশিল্পী মোহিত কামাল এবং আমেরিকাপ্রবাসী আহমদ মাযহারের সঙ্গেও। দেখা হলো নারী-মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক লিনু হকের সঙ্গে। ভারতীয় কবি-বন্ধুদের মধ্যে দেখা হলো কলকাতার কাজল চক্রবর্তী, শান্তিময় মুখোপাধ্যায় ও ত্রিপুরার দিলীপ দাসের সঙ্গে। দেখা ও কথা হলো টিভিতে টক শোর পরিচিত মুখ নজরুল কবীরের সঙ্গে। তা ছাড়া প্রতিবছর বইমেলায় পরিচিত হওয়া যায় অদেখা কিন্তু পাঠসঙ্গী খ্যাতিমান লেখক ও নবীন কবি-লেখকদের সঙ্গে। উপরি পাওনা থাকে দু-চারজনের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সৌজন্যসংখ্যা। এসবের আকর্ষণই প্রতিবছর আমাকে টেনে নিয়ে যায় বইমেলায়।
একটা সময় গেছে, প্রতি শুক্রবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দল বেঁধে মেলায় গিয়ে গভীর রাতে ফিরেছি বইয়ের বোঝা নিয়ে। মেলা থেকে আমি তাৎক্ষণিক বই খুব কমই কিনি। টেঁকের জোর কম বলে দেখে, চেখে এবং বুঝে বই কেনাই আমার স্বভাব। সবাই কিংবা অনেকেই হয়তো তেমনিভাবেই কেনেন। তবে আমি ঘনিষ্ঠ ও কাছের বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে কিনি, যাতে উভয়েই ব্যবহার করতে পারি। এ কারণে প্রথম দিন মেলায় গিয়ে প্যাভিলিয়ন ও বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে শুধু ক্যাটালগ সংগ্রহ করি। বাসায় এসে প্রয়োজন ও পছন্দের বইয়ের একটি তালিকা তৈরি করি। এরপর মেলার শেষ সপ্তাহে তালিকা ধরে বই কিনি। তাতে অর্থের কিছুটা সাশ্রয়ও হয়। পছন্দের সব বইই তো কেনা হয় না, দাম এবং সংগতির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়!
প্রমথ চৌধুরীর সেই আপ্তবাক্যটি সবাই জানেন—বই কিনে কেউ কোনো দিন দেউলিয়া হয় না। এই একুশ শতকের মূল্যস্ফীতির যুগে বাস করলে তিনি কী বলতেন জানি না! তবে বই কিনে তিনি জ্ঞানের অমূল্য সম্পদ অর্জনের কথা ভেবেই সে কথা বলেছিলেন। বিত্তবান, ব্যবসায়ী, কোটিপতি, মিল-কারকানার মালিকেরা বই পড়েন না, কেনেনও না। নিরক্ষর দীনদরিদ্র নিম্নবর্গের মানুষেরও বই কেনার সংগতি নেই। এ কথা সেই যুগেও যেমন সত্য ছিল, এখনো তা-ই। এবার একুশে পদকপ্রাপ্ত ক্ষণজন্মা জিয়াউল হক বা পলান সরকার কজনই বা হতে পারেন! তাঁরা তো যুগে-যুগে জন্মগ্রহণ করেন না!
বই কেনেন মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, ছোট চাকরিজীবী এবং সচেতন শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের একাংশ। অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এখন আর বই পড়ে না! প্রাইভেট পড়া ও পড়ানোর ইঁদুরদৌড়ে তারা এখন এমন ব্যস্ত থাকে যে ‘আউট বই’ পড়ার তাদের সময় কোথায়! আমার পঁয়ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বহুবার অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে একবার বইমেলায় যাওয়ার। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। শিক্ষকদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাইনি! অথচ প্রতিবছর দেখেছি, শিক্ষাসফরের নামে বনভোজনে কলেজ ফান্ডের অর্থ ব্যয়ে তাদের উদ্বাহু নৃত্য!
বইমেলা তো মূলত লেখক-পাঠক ও প্রকাশকদের বৎসরান্তিক মিলনমেলা। প্রকাশকের হাত ধরে লেখকের সৃজনশীল কর্ম পাঠকের কাছে উৎসবের মাধ্যমে পৌঁছে দেয় বইমেলা। বইমেলা তো বাণিজ্য মেলার মতো বিচিত্র পণ্যের সমাহারে উজ্জ্বল নয় যে সব ধরনের মানুষের সমাগম হবে! পাঠের প্রতি আকর্ষণ, বই সংগ্রহের মোহ এবং জ্ঞানার্জনের স্পৃহা না থাকলে তো বইমেলার প্রতি সবার উৎসাহ থাকার কথা নয়! তবু লক্ষ করা যায়, উপচেপড়া ভিড়ে মেলাপ্রাঙ্গণ ধূলিধূসর ও টালমাটাল! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এত বড় মেলাপ্রাঙ্গণ, তবু যেন ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! কিন্তু ভেতরের সত্য তেমন সুখকর নয়!
অধিকাংশ প্রকাশকই বলে থাকেন, ক্রেতা নেই, বেচাবিক্রি নেই, গ্রাহক নেই। ব্যবসায়ীদের ধর্মই অসন্তুষ্টি। ভালো বেচাবিক্রি হলেও তাঁরা স্বীকার করেন না। বলেন, ‘চলছে মোটামুটি!’ কিন্তু এ কথা সত্যি যে মেলা মানে তো শুধু বিপণিবিতানে গ্রাহকদের কেনাবেচা নয়, দর্শনার্থীদের স্থানও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাংসের চেয়ে আলু বেশি হলে ব্যঞ্জন যেমন স্বাদ হারায়, তেমনি ক্রেতার চেয়ে দর্শক বেশি হলেও মেলা মাহাত্ম্য হারায়। সেই দর্শকেরা যদি গ্রন্থদর্শক হতো, তবে আপত্তির তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু অধিকাংশ দর্শকের মধ্যে তা-ও লক্ষ করা যায় না! বই নেড়েচেড়ে দেখার মধ্যেও যে আনন্দ আছে, তাও অনেক দর্শকের মধ্যে অনুপস্থিত। অনেকে বইমেলায় যায় দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করতে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতে, রেস্টুরেন্টে চা-নাশতা খেতে, জটলা করে সেলফি তুলতে এবং সস্তা বিনোদনের লক্ষ্যে। সেদিন স্বচক্ষেই দেখলাম, একদল তরুণী জনৈক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে দেখে স্টলে ঢুকে তাঁর বইসহ লেখকের সঙ্গে ছবি তুলে বইটি রেখে দিব্যি চলে গেল। এসবের কারণে প্রকৃত বইপ্রেমিকেরা নির্বিঘ্নে দেখে-চেখে-বুঝে বই সংগ্রহ করতে পারেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই সব দর্শককে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বইমেলার চেতনা, গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য বিঘ্নিত না হয়ে পারে না।
ক্রমান্বয়ে বইমেলায় প্রকাশক বাড়ছে, স্টল বাড়ছে এবং বাড়ছে মেলার পরিধিও। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় এই, অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শকদের সংখ্যাও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে! ফলে সামগ্রিকভাবে বই বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়েনি। তাই একটি জরিপে জানা যায়, বেরোনোর পথে মেলায় আসা মানুষদের মধ্যে মাত্র ৭ ভাগের হাতে বইয়ের প্যাকেট দেখা যায়! এই জরিপের তথ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দুর্ভাবনায় আক্রান্ত করে বৈকি! বাঙালি বই কিনে না, কিন্তু লাইন ধরে সিনেমার টিকিট কিনে—এই সত্য সৈয়দ মুজতবা আলী বহু বছর আগেই অনুধাবন করেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশন বোধ করি এখনো ধারাবাহিকভাবে চলছে। তাই বইমেলায় গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শকেরা রেস্টুরেন্টে হাজার টাকা খরচ করবে কিন্তু দুই শ টাকা দিয়ে একটি বই কিনবে না! রবীন্দ্রনাথ না কিনুক, গোপাল ভাঁড়ের রঙ্গরসিকতা বই তো কেনা যায়! বিভূতিভূষণের বই না কিনুক, বাল্যশিক্ষা-জাতীয় একটি শিশুতোষ বইও তো কেনা যায় পরিবারের শিশুটির জন্য! কিন্তু না, প্রতিদিন ঘুরেফিরে, আড্ডা মেরে, চা-পানি খেয়ে চলে আসবে! আমি এমন একাধিক পরিবারের কথা জানি, যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভোরে সপরিবারে বইমেলায় গিয়ে ঘুরেফিরে, খেয়েদেয়ে রাতে ফিরে এসেছে, কিন্তু একটি বইও কেনেনি। অবশ্য প্রকৃত বিনোদনের দুর্ভিক্ষের এই নগরে-মহানগরে সাধারণের জন্য কীই-বা আছে! তবু বইমেলার এক মাসে যে পরিমাণ মানুষ মেলায় প্রবেশ করেছে, তারা সবাই যদি একটি করেও বই কিনত; তবে কোনো প্রকাশকের কাছে কোনো বই থাকত কি না, সন্দেহ!
লেখক: মানবর্দ্ধন পাল, গ্রন্থকার, অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২১ ঘণ্টা আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে