রাশেদ নিজাম, ঢাকা
এখানে সবকিছু চলে হাতের ইশারায়– কি দিনের আলোয়, কি রাতের অন্ধকারে। প্রায় পাঁচ শ বছরের পুরোনো এই রাজধানী ঢাকায় যাঁর সামান্য যাতায়াত আছে, তাঁর কাছে বিষয়টি নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে দিন দিন কমতে থাকা গতির শহরকে আরও গতিহীন করে দিচ্ছে মানুষের হাতের ইশারা।
বিষয়টা আরেকটু সহজ করা যাক। রাজধানী ঢাকার সড়ক সংযোগগুলোতে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে ১১০টি। এগুলোর একটিতে শুধু লাল-সবুজ বাতি জ্বলে-নেভে, বাকি সব অন্ধকার। সড়কে আরও আছে ৫৫০টির মতো স্থান, যেখানে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাত নেড়ে গাড়ি চলা ও থামার সংকেত দেন। সব মিলিয়ে এই সাড়ে ছয় শতাধিক স্থানে দায়িত্ব পালন করেন ২ হাজার ৭০০ পুলিশ সদস্য।
এবার খরচের হিসাবটা একটু দেখা যেতে পারে। সরকারি বেতন স্কেল অনুসারে এসব ট্রাফিক কনস্টেবলের পেছনে শুধু বেতন-ভাতা বাবদ মাসে ব্যয় হয় ৭০ কোটি টাকা। বছরে ৮৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছর শুধু যানবাহন চলাচলের ইশারা দিতেই এই বিপুল টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাস্তায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যবস্থা করা গেলে যে খরচ হতো, তা এ তুলনায় খুবই কম।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, অঙ্কটা এত সহজ হলে ঢাকার রাস্তায় যান চলাচলের জন্য কেন স্বয়ংক্রিয় সংকেতের ব্যবস্থা করা হয় না। এই প্রশ্নে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আগের প্রকল্প শেষ, নতুন প্রকল্প হলেই সব ঠিক হবে। আর ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের ভাষায়, ঢাকায় রাস্তার চেয়ে যানবাহন বেশি। সে কারণে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। দুঃখের বিষয় হলো, এই বক্তব্যের বাইরে আছে একটি বিশেষ চক্রের হাত। যারা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হোক, তা কোনোভাবেই চায় না। এদের কেউ সরাসরি লাভ খায়, আর কেউ দুধ থেকে আস্তে করে মাখনটা তুলে নেয়।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, গত দুই দশকে শুধু ট্রাফিক ইন্টারসেকশন আর সিগন্যাল স্থাপনেই খরচ হয়েছে প্রায় পৌনে দুই শ কোটি টাকা। তথ্য হচ্ছে, ২০১৪ সালে পুরো ব্যবস্থাই ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কখনো তা বুঝে নেয়নি। ২০১৯ সালের পরে ঢাকার রাজপথের কোনো ট্রাফিক লাইটই মেরামত করা হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বললেন, এখন বাংলাদেশ ছাড়া সম্ভবত কোথাও হাত দেখিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। সবাই আছে শুধু নতুন প্রকল্পের পেছনে, কিন্তু কে চালাবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেই।
লাইটের সাতকাহন
ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ের দায়িত্ব ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। তাদের নেতৃত্বে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (ডিইউটিপি) আওতায় ৭০টি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। এর আগেই ঢাকায় প্রায় ১৫টি মোড়ে ট্রাফিক লাইট ছিল। সেগুলোও এই প্রজেক্টের আওতায় আধুনিক হয়ে যায়। যেখানে খরচ হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো এক বছরও টেকেনি।
এরপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১২-২৩ অর্থবছরে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় আবার ২৯টি ইন্টারসেকশনে বসানো হয় সিগন্যাল বাতি। এবার বরাদ্দ হয় ১১২ কোটি টাকা। এ কাজে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রিমোট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়। এই ৯৯টি বাতি দিয়ে ২০১৪ সালে নেওয়া হয় নতুন এক উদ্যোগ। প্রথমে ছুটির দিনে সিগন্যাল বাতি মেনে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল সিগন্যাল বাতি মেনে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা চালুর কিছুক্ষণ পরেই ভেঙে পড়ে। এরপর থেকেই সিগন্যাল বাতি মেনে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার ঢাকার ৪৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করার উদ্যোগ নিয়েছিল কেস প্রকল্প থেকে, যা শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। সেই প্রকল্প শেষ হয়ে যায় ওই বছরের ৩০ জুন। মূলত এরপর থেকে শুধু গুলশান ২-এ একটি বাতি ছাড়া আর কোথাও কোনো বাতি সচল নেই।
জানা গেছে, তিন বছর ধরে দুই সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক বিভাগ খোঁজই নেয়নি, রাস্তার লাইটগুলো আছে কি না। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা উত্তর সিটিতে এ মুহূর্তে আছেন দুজন, তাঁদের একজন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে, আর দক্ষিণে আছেন চারজন। তাঁরা এ নিয়ে আর মাথা ঘামান না।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার মুহম্মদ রকিবুল হাসান বলেন, ‘আমাদের এ বিষয়ে এখন কোনো অবস্থান নেই। আর তেমন কিছু জানিও না।’
ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম
ঢাকার চারটি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম বসানোর আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল ডিটিসিএ। ২০১৬ সালের শুরুতে এর ব্যয় ছিল ৩৭ কোটি টাকা, পরে ব্যয় হয় ৫২ কোটি টাকা। ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ নামের প্রকল্পে ঢাকার চার ইন্টারসেকশনে পরীক্ষামূলকভাবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস) নিয়ে কাজ করে ডিটিসিএ। গত বছরের জুনে এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ জন্য মহাখালী, গুলশান ১ এবং দক্ষিণ সিটির পল্টন ও সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স ইন্টারসেকশনে নতুন করে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। অবশ্য উত্তরের দুটিতে সিসি ক্যামেরা, ভেহিকল ও ইমেজ ডিটেক্টর, সিগন্যাল বাতি লাগানো হয়। কিন্তু দক্ষিণের দুটিতে কিছুই করা হয়নি। জাপান থেকে আনা হয় আইটিএস সফটওয়্যারের কাজের জন্য দুটি বিশেষ কম্পিউটার। কিন্তু স্থাপনের আগেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গোডাউন থেকে সেগুলো চুরি হয়ে যায়। আর সফটওয়্যারের অভাবে উত্তর সিটির মহাখালী ও গুলশান ১ ইন্টারসেকশনে অলস দাঁড়িয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ট্রাফিক লাইট।
জানতে চাইলে ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক ও অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক (টিএমপিটিআই) মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, নতুন করে সফটওয়্যার আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
নতুন প্রজেক্ট আর হাতে চলা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এভাবে ব্যয় হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা, কিন্তু কোনো কিছুই সেই অর্থে কাজে আসেনি।
কত পুলিশ কাজ করে
ডিএমপির হিসাবে, ট্রাফিক বিভাগে লোকবল ৪ হাজার ২২১ জন। আছেন ৩ হাজার ৭৫০ জন। তাঁদের মধ্যে সার্জেন্ট ৮৫০ জন।
কর্মকর্তা ছাড়া শুধু ট্রাফিক সিগন্যালেই দায়িত্ব পালন করেন ২ হাজার ৭০০ কনস্টেবল। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল (১৬ হাজার ৭০০ থেকে ৩৬ হাজার ২৫২ টাকা) হিসাবে প্রতি মাসে তাঁদের বেতন-ভাতা যাচ্ছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকবার দাবির পরে ২০১৪ সালের মার্চে সিদ্ধান্ত হয় পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা তাদের দায়িত্বে দেওয়ার। কিন্তু ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ এক সভায় তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁদের বিভাগ এখনো প্রস্তুত নয়। এরপর থেকে ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, ‘যে অবস্থায় আছে, তার থেকে উন্নতি করতে হলে সেমি অটোমেটিক পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এতে হয়তো অবস্থার উন্নতি হবে।’ অথচ সিটি করপোরেশনের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার ২১টি সেমি অটোমেটিক সিগন্যালের জন্য রিমোট কিনে দেওয়া হয়েছিল ট্রাফিক পুলিশকে। তারা সেগুলো হারিয়ে ফেলেছে।
ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছে একই ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ছিল, কেন হাতের ইশারায় গাড়ি চলে। কবে নাগাদ পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল চলবে। দুই মেয়রই বলেছেন, প্রযুক্তিনির্ভর কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা আসছে। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কবে সেটা হবে, তা আর বলতে পারেননি দুজনে। ঢাকার মানুষের প্রশ্ন, আদৌ কি তা হবে।
সব প্রকল্প ভুয়া
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তিনবার প্রকল্প করা হয়েছে। কোনোটাই কার্যকর হয়নি। শুধু প্রকল্প মোটাতাজা হয়েছে। একবার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), একবার সোলার প্যানেল আবার রিমোট কন্ট্রোল পদ্ধতি। সব প্রকল্পই ভুয়া। যারা এই প্রকল্প নিয়েছে, তারা নিজেদের লাভের জন্য নিয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়া, লোকবল তৈরি করা ছাড়া শুধু নতুন প্রকল্প নিলেই চলবে না। তিনি বলেন, রাস্তায় পুলিশই আইন মানে না, পুলিশকে আইন মানাবে কে? সবুজ বাতি থামিয়ে সমানে তারা চলে যাচ্ছে। ভিআইপি মুভমেন্টে লালের মধ্যে গাড়ি যাচ্ছে। মানুষ এদের রোল মডেল হিসেবেই দেখে। অথচ টাকা গেল, বিদ্যুৎ গেল, জ্বালানি গেল। জনগণের পয়সায় নেওয়া প্রকল্প ভেস্তে গেল, কোনো জবাবদিহি নেই। প্রতিবার নিজেদের সুবিধার জন্য নতুন প্রকল্প নেবেন মেয়র সাহেবরা। এতে টাকা নষ্ট হবে। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার পরে তাঁরা সেটা স্বীকারও করবেন না।
এখানে সবকিছু চলে হাতের ইশারায়– কি দিনের আলোয়, কি রাতের অন্ধকারে। প্রায় পাঁচ শ বছরের পুরোনো এই রাজধানী ঢাকায় যাঁর সামান্য যাতায়াত আছে, তাঁর কাছে বিষয়টি নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে দিন দিন কমতে থাকা গতির শহরকে আরও গতিহীন করে দিচ্ছে মানুষের হাতের ইশারা।
বিষয়টা আরেকটু সহজ করা যাক। রাজধানী ঢাকার সড়ক সংযোগগুলোতে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে ১১০টি। এগুলোর একটিতে শুধু লাল-সবুজ বাতি জ্বলে-নেভে, বাকি সব অন্ধকার। সড়কে আরও আছে ৫৫০টির মতো স্থান, যেখানে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাত নেড়ে গাড়ি চলা ও থামার সংকেত দেন। সব মিলিয়ে এই সাড়ে ছয় শতাধিক স্থানে দায়িত্ব পালন করেন ২ হাজার ৭০০ পুলিশ সদস্য।
এবার খরচের হিসাবটা একটু দেখা যেতে পারে। সরকারি বেতন স্কেল অনুসারে এসব ট্রাফিক কনস্টেবলের পেছনে শুধু বেতন-ভাতা বাবদ মাসে ব্যয় হয় ৭০ কোটি টাকা। বছরে ৮৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছর শুধু যানবাহন চলাচলের ইশারা দিতেই এই বিপুল টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাস্তায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যবস্থা করা গেলে যে খরচ হতো, তা এ তুলনায় খুবই কম।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, অঙ্কটা এত সহজ হলে ঢাকার রাস্তায় যান চলাচলের জন্য কেন স্বয়ংক্রিয় সংকেতের ব্যবস্থা করা হয় না। এই প্রশ্নে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আগের প্রকল্প শেষ, নতুন প্রকল্প হলেই সব ঠিক হবে। আর ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের ভাষায়, ঢাকায় রাস্তার চেয়ে যানবাহন বেশি। সে কারণে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। দুঃখের বিষয় হলো, এই বক্তব্যের বাইরে আছে একটি বিশেষ চক্রের হাত। যারা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হোক, তা কোনোভাবেই চায় না। এদের কেউ সরাসরি লাভ খায়, আর কেউ দুধ থেকে আস্তে করে মাখনটা তুলে নেয়।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, গত দুই দশকে শুধু ট্রাফিক ইন্টারসেকশন আর সিগন্যাল স্থাপনেই খরচ হয়েছে প্রায় পৌনে দুই শ কোটি টাকা। তথ্য হচ্ছে, ২০১৪ সালে পুরো ব্যবস্থাই ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কখনো তা বুঝে নেয়নি। ২০১৯ সালের পরে ঢাকার রাজপথের কোনো ট্রাফিক লাইটই মেরামত করা হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বললেন, এখন বাংলাদেশ ছাড়া সম্ভবত কোথাও হাত দেখিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। সবাই আছে শুধু নতুন প্রকল্পের পেছনে, কিন্তু কে চালাবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেই।
লাইটের সাতকাহন
ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ের দায়িত্ব ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। তাদের নেতৃত্বে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (ডিইউটিপি) আওতায় ৭০টি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। এর আগেই ঢাকায় প্রায় ১৫টি মোড়ে ট্রাফিক লাইট ছিল। সেগুলোও এই প্রজেক্টের আওতায় আধুনিক হয়ে যায়। যেখানে খরচ হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো এক বছরও টেকেনি।
এরপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১২-২৩ অর্থবছরে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় আবার ২৯টি ইন্টারসেকশনে বসানো হয় সিগন্যাল বাতি। এবার বরাদ্দ হয় ১১২ কোটি টাকা। এ কাজে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রিমোট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়। এই ৯৯টি বাতি দিয়ে ২০১৪ সালে নেওয়া হয় নতুন এক উদ্যোগ। প্রথমে ছুটির দিনে সিগন্যাল বাতি মেনে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল সিগন্যাল বাতি মেনে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা চালুর কিছুক্ষণ পরেই ভেঙে পড়ে। এরপর থেকেই সিগন্যাল বাতি মেনে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার ঢাকার ৪৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করার উদ্যোগ নিয়েছিল কেস প্রকল্প থেকে, যা শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। সেই প্রকল্প শেষ হয়ে যায় ওই বছরের ৩০ জুন। মূলত এরপর থেকে শুধু গুলশান ২-এ একটি বাতি ছাড়া আর কোথাও কোনো বাতি সচল নেই।
জানা গেছে, তিন বছর ধরে দুই সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক বিভাগ খোঁজই নেয়নি, রাস্তার লাইটগুলো আছে কি না। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা উত্তর সিটিতে এ মুহূর্তে আছেন দুজন, তাঁদের একজন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে, আর দক্ষিণে আছেন চারজন। তাঁরা এ নিয়ে আর মাথা ঘামান না।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার মুহম্মদ রকিবুল হাসান বলেন, ‘আমাদের এ বিষয়ে এখন কোনো অবস্থান নেই। আর তেমন কিছু জানিও না।’
ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম
ঢাকার চারটি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম বসানোর আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল ডিটিসিএ। ২০১৬ সালের শুরুতে এর ব্যয় ছিল ৩৭ কোটি টাকা, পরে ব্যয় হয় ৫২ কোটি টাকা। ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ নামের প্রকল্পে ঢাকার চার ইন্টারসেকশনে পরীক্ষামূলকভাবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস) নিয়ে কাজ করে ডিটিসিএ। গত বছরের জুনে এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ জন্য মহাখালী, গুলশান ১ এবং দক্ষিণ সিটির পল্টন ও সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স ইন্টারসেকশনে নতুন করে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। অবশ্য উত্তরের দুটিতে সিসি ক্যামেরা, ভেহিকল ও ইমেজ ডিটেক্টর, সিগন্যাল বাতি লাগানো হয়। কিন্তু দক্ষিণের দুটিতে কিছুই করা হয়নি। জাপান থেকে আনা হয় আইটিএস সফটওয়্যারের কাজের জন্য দুটি বিশেষ কম্পিউটার। কিন্তু স্থাপনের আগেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গোডাউন থেকে সেগুলো চুরি হয়ে যায়। আর সফটওয়্যারের অভাবে উত্তর সিটির মহাখালী ও গুলশান ১ ইন্টারসেকশনে অলস দাঁড়িয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ট্রাফিক লাইট।
জানতে চাইলে ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক ও অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক (টিএমপিটিআই) মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, নতুন করে সফটওয়্যার আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
নতুন প্রজেক্ট আর হাতে চলা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এভাবে ব্যয় হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা, কিন্তু কোনো কিছুই সেই অর্থে কাজে আসেনি।
কত পুলিশ কাজ করে
ডিএমপির হিসাবে, ট্রাফিক বিভাগে লোকবল ৪ হাজার ২২১ জন। আছেন ৩ হাজার ৭৫০ জন। তাঁদের মধ্যে সার্জেন্ট ৮৫০ জন।
কর্মকর্তা ছাড়া শুধু ট্রাফিক সিগন্যালেই দায়িত্ব পালন করেন ২ হাজার ৭০০ কনস্টেবল। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল (১৬ হাজার ৭০০ থেকে ৩৬ হাজার ২৫২ টাকা) হিসাবে প্রতি মাসে তাঁদের বেতন-ভাতা যাচ্ছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকবার দাবির পরে ২০১৪ সালের মার্চে সিদ্ধান্ত হয় পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা তাদের দায়িত্বে দেওয়ার। কিন্তু ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ এক সভায় তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁদের বিভাগ এখনো প্রস্তুত নয়। এরপর থেকে ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, ‘যে অবস্থায় আছে, তার থেকে উন্নতি করতে হলে সেমি অটোমেটিক পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এতে হয়তো অবস্থার উন্নতি হবে।’ অথচ সিটি করপোরেশনের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার ২১টি সেমি অটোমেটিক সিগন্যালের জন্য রিমোট কিনে দেওয়া হয়েছিল ট্রাফিক পুলিশকে। তারা সেগুলো হারিয়ে ফেলেছে।
ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছে একই ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ছিল, কেন হাতের ইশারায় গাড়ি চলে। কবে নাগাদ পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল চলবে। দুই মেয়রই বলেছেন, প্রযুক্তিনির্ভর কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা আসছে। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কবে সেটা হবে, তা আর বলতে পারেননি দুজনে। ঢাকার মানুষের প্রশ্ন, আদৌ কি তা হবে।
সব প্রকল্প ভুয়া
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তিনবার প্রকল্প করা হয়েছে। কোনোটাই কার্যকর হয়নি। শুধু প্রকল্প মোটাতাজা হয়েছে। একবার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), একবার সোলার প্যানেল আবার রিমোট কন্ট্রোল পদ্ধতি। সব প্রকল্পই ভুয়া। যারা এই প্রকল্প নিয়েছে, তারা নিজেদের লাভের জন্য নিয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়া, লোকবল তৈরি করা ছাড়া শুধু নতুন প্রকল্প নিলেই চলবে না। তিনি বলেন, রাস্তায় পুলিশই আইন মানে না, পুলিশকে আইন মানাবে কে? সবুজ বাতি থামিয়ে সমানে তারা চলে যাচ্ছে। ভিআইপি মুভমেন্টে লালের মধ্যে গাড়ি যাচ্ছে। মানুষ এদের রোল মডেল হিসেবেই দেখে। অথচ টাকা গেল, বিদ্যুৎ গেল, জ্বালানি গেল। জনগণের পয়সায় নেওয়া প্রকল্প ভেস্তে গেল, কোনো জবাবদিহি নেই। প্রতিবার নিজেদের সুবিধার জন্য নতুন প্রকল্প নেবেন মেয়র সাহেবরা। এতে টাকা নষ্ট হবে। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার পরে তাঁরা সেটা স্বীকারও করবেন না।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে