জাহীদ রেজা নূর
বর্তমান রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করতে হলে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ২৮ অক্টোবর রাজধানীজুড়ে যে ঘটনাবলির সৃষ্টি হলো, তাতে বোঝা গেল, ক্ষমতার জন্য লড়াইটা প্রকট হয়ে উঠেছে। দেখা গেল, বিদেশি শক্তিও এখন আমাদের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। আফসোস, যে জনগণ এই দেশের মালিক, ক্ষমতার রদবদলে তার কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে।
আমরা আমাদের রাজনীতিটাকে পেশিশক্তির আস্তানা বানিয়ে ছেড়েছি। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা নানাভাবে নিজেদের পরিপুষ্ট করে তোলে। নৈতিক নানা সুবিধা নিয়ে তারা জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙুল দেখায়। এ পর্যন্ত যে কটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদের প্রত্যেকেই জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি, বরং নিজেদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। বহুদিনের আচরিত রাজনীতি-ধর্মে তাই ক্ষমতার বদল ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে না। কোন দল ক্ষমতায় এসে আখের গুছিয়ে নেবে, সেটাই যেন হয়ে উঠেছে রাজনীতির মূল লক্ষ্য। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ কার প্রতি আস্থা রাখবে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে।
২৮ অক্টোবরের সহিংসতায় একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। তাঁর প্রতি বিএনপির কর্মীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। উপর্যুপরি আঘাতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যুর জন্য কি শুধু বিএনপি দায়ী? আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করে ব্যাপারটি দেখলে আমরা বুঝতে পারব, যে অসহিষ্ণুতা রাজনীতির মাঠকে প্রায় অমানবিক করে তুলেছে, সেই অসহিষ্ণুতারই শিকার হয়েছেন কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম। একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলকে কেন সভা করতে হবে, কেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না, সেটাই এখন অন্যতম বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারছে না কেন, তা তলিয়ে দেখা উচিত। রাজনীতিতে পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে, সংলাপ চলবে না—এগুলো কোনো কাজের কথা নয়।
ভিন্নভাবে সংকটটার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। আমাদের দেশে যে দুটি বড় ধরনের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তার পেছনে জনগণের সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল আগরতলা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিচারের মাধ্যমে কড়া শাস্তি দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল আইয়ুব খান। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই ষড়যন্ত্র টের পেয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ ফুঁসে উঠেছিল। একে একে আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে যখন হত্যা করে পাকিস্তানি পেটোয়া বাহিনী, তখন আর কাউকে ঘরে বসিয়ে রাখা যায়নি। ছাত্র-শিক্ষক, কামার-মুটে-মাঝি, কৃষক-শ্রমিকসহ বাংলার আপামর জনতার প্রত্যেকেই রাজপথে নেমে রুখে দাঁড়িয়েছিল আইয়ুবশাহীকে। তখন জনগণ জানত, তারা কী চায়।
জনৈতিক দলের ভাবনায়ও থাকত ক্ষমতা হাতে পেলে কীভাবে গড়ে তুলবে দেশ। আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত করারই ষড়যন্ত্র করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে এই মামলা চালানো হয়। জনগণের চোখে ধোঁকা দিতে পারেনি সরকার। স্বাধিকার আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যই যে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসাতে চাইছেন, সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারল জনসাধারণ। ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’ বলে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়েছে ছাত্র, কৃষক-শ্রমিকেরা। সে সময় জনতা জানত, তারা কী চায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯০ সালে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান দেখেছে এই বাংলা। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একত্র হয়েছিল গোটা দেশ। সে সময়ও জনগণের কাছে অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কোনো দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। সরলভাবে বললে শহীদ নূর হোসেনের ভাষাতেই বলতে হয়, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। হ্যাঁ, অধরা গণতন্ত্রকে হাতের মুঠোয় আনার প্রত্যয় নিয়েই জনতা সেদিন নেমে এসেছিল রাস্তায়। এরশাদের পতন হয়েছিল। সেদিনও জনতা জানত, তারা কী চায়।
এ দুটি গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে মিলিয়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের দিকে তাকিয়ে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানের দিকে যাচ্ছে কি দেশ—এ রকম একটি প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে। কিন্তু এ কথা তো সত্য, আজকের জনগণ জানে না, তারা কী চায়। আগের দুটি গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এটাই সেই গণ-অভ্যুত্থানগুলোর সঙ্গে এবারের আন্দোলনের মূল পার্থক্য। জনগণকে কেউ আস্থায় রাখতে পারেনি। জনগণ জানে না, তারা কী চায়।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। তাই আওয়ামী লীগের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল ভোটদাতা জনগণের, সেই প্রত্যাশা পূরণের অধিকার পায়নি আওয়ামী লীগ। একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পায়। বলা বাহুল্য, নানা প্রতিকূলতার কারণে আওয়ামী লীগ জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। বরং তাদের সেই শাসনামলে মানুষের প্রত্যাশার অনেকটাই পূরণ হয়নি।
অন্যদিকে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলটি মোটেই জনগণের জন্য স্বপ্নপূরণের অপরূপ সুযোগ এনে দেয়নি, বরং মাগুরা নির্বাচনের মতো একটি প্রহসনের নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার পাঁয়তারাই করতে দেখা গেছে বিএনপিকে। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত ঘাতক-দালালদের নির্মূলের আন্দোলনের ব্যাপারেও বিএনপি সরকারের ছিল ন্যক্কারজনক ভূমিকা। ফলে জনগণের কাছে দেওয়া পরীক্ষায় তারাও পাস করতে পারেনি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ দল সরকারে অধিষ্ঠিত। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেই নির্বাচনগুলোয় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল কম। বিরোধী দলের অভিযোগ, প্রথমটিতে যা-ও একটু জনগণ নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছে, পরেরটিতে ভোট হয়েছে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই। এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করে থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এ দুই দলের কারও প্রতিই পূর্ণাঙ্গ আস্থা নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না জনগণ। আবার বলছি, বিগত দুই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণ জানত, তারা কী চায়, কিন্তু এবার জনগণের সামনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের সুশাসনহীনতার তাসগুলো খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। জনতা বুঝতে পারছে, রাজনীতিতে ক্ষমতার বদলই মানুষের ভাগ্যের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায় না, বরং কখনো কখনো তা আরও গভীর সংকটের জন্ম দেয়। আমাদের স্বাধীন দেশের ইতিহাসে বারবার বিশ্বাস ভঙ্গের আবর্তে পড়ে জনগণ প্রচলিত নিয়মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে করিয়ে দিতে চাই, গণতন্ত্রের অর্থ শুধু নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র আরও ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে সমাজে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় গণতন্ত্রের অন্য সব উপাদানের কথা ভাবাই যাচ্ছে না। সবচেয়ে সহজ যে বিষয়, সেই নির্বাচনকেই প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না, বাকিটা তো বহু দূরের ব্যাপার। আজ তাই জনগণের ভোটদানের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা খুবই সত্য, ভোটারবিহীন নির্বাচন গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে পারে না। নিজের ভোটটি নিজে দেবে—এই নিশ্চয়তাটুকু জনগণকে দিতে হবে। নইলে কোন গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে? ভোটারবিহীন নির্বাচন হলে সেই গণতন্ত্রের সঙ্গে স্বৈরশাসনের পার্থক্য আর থাকে কোথায়? পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, ক্ষমতাসীন দলগুলো জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। এ রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কবে শেষ এসেছিল, তা মনে করা কঠিন।
তাই এই সংকটকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেবে দেখতে হবে, তারা কীভাবে জনগণের মনে তাদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনবে। রাজনীতির মূল কথা যদি হয় জনগণের সেবা, তাহলে জনগণের কাছেই ফিরে আসতে হবে তাদের। জনগণই ঠিক করবে, কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে দেশ শাসনের ভার। অতীতে ২০০১ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতা ছাড়ার আগে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য যে পটভূমি তৈরি করেছিল বিএনপি, সে কথাও দেশবাসী ভুলে যায়নি। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এমন এক রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে এবং বিএনপি যেন যেকোনো প্রকারে ক্ষমতায় আসতে পারে, তা নিশ্চিত হতে পারে। ফলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতাকেই কেবল বড় করে দেখেছে, এ রকম সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছালে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।
এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভুল স্বীকার করে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে আদর্শগত রাজনীতির ধারায় ফিরতে পারে। নইলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ উপাখ্যানের শেষ হবে না। হরতাল, অগ্নি-সংযোগ, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে কেবল, কিন্তু দেশ থাকবে গণতন্ত্র থেকে হাজার মাইল দূরে।
এই সংকটকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে। আর সে সত্যের কাছে আসতে হলে নিজেদের ‘ইগো’ ভুলে জনতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার ক্ষমতা। নইলে শুধু লুটেপুটে খাওয়ার সংস্কৃতির বশংবদ হয়ে থাকবে গোটা রাজনীতি। রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে বাইরের দেশগুলো, দেশের জনগণ নয়। এর চেয়ে নতজানু অবস্থা আর কিছুই হতে পারে না।
বর্তমান রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করতে হলে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ২৮ অক্টোবর রাজধানীজুড়ে যে ঘটনাবলির সৃষ্টি হলো, তাতে বোঝা গেল, ক্ষমতার জন্য লড়াইটা প্রকট হয়ে উঠেছে। দেখা গেল, বিদেশি শক্তিও এখন আমাদের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। আফসোস, যে জনগণ এই দেশের মালিক, ক্ষমতার রদবদলে তার কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে।
আমরা আমাদের রাজনীতিটাকে পেশিশক্তির আস্তানা বানিয়ে ছেড়েছি। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা নানাভাবে নিজেদের পরিপুষ্ট করে তোলে। নৈতিক নানা সুবিধা নিয়ে তারা জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙুল দেখায়। এ পর্যন্ত যে কটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদের প্রত্যেকেই জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি, বরং নিজেদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। বহুদিনের আচরিত রাজনীতি-ধর্মে তাই ক্ষমতার বদল ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে না। কোন দল ক্ষমতায় এসে আখের গুছিয়ে নেবে, সেটাই যেন হয়ে উঠেছে রাজনীতির মূল লক্ষ্য। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ কার প্রতি আস্থা রাখবে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে।
২৮ অক্টোবরের সহিংসতায় একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। তাঁর প্রতি বিএনপির কর্মীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। উপর্যুপরি আঘাতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যুর জন্য কি শুধু বিএনপি দায়ী? আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করে ব্যাপারটি দেখলে আমরা বুঝতে পারব, যে অসহিষ্ণুতা রাজনীতির মাঠকে প্রায় অমানবিক করে তুলেছে, সেই অসহিষ্ণুতারই শিকার হয়েছেন কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম। একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলকে কেন সভা করতে হবে, কেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না, সেটাই এখন অন্যতম বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারছে না কেন, তা তলিয়ে দেখা উচিত। রাজনীতিতে পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে, সংলাপ চলবে না—এগুলো কোনো কাজের কথা নয়।
ভিন্নভাবে সংকটটার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। আমাদের দেশে যে দুটি বড় ধরনের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তার পেছনে জনগণের সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল আগরতলা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিচারের মাধ্যমে কড়া শাস্তি দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল আইয়ুব খান। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই ষড়যন্ত্র টের পেয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ ফুঁসে উঠেছিল। একে একে আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে যখন হত্যা করে পাকিস্তানি পেটোয়া বাহিনী, তখন আর কাউকে ঘরে বসিয়ে রাখা যায়নি। ছাত্র-শিক্ষক, কামার-মুটে-মাঝি, কৃষক-শ্রমিকসহ বাংলার আপামর জনতার প্রত্যেকেই রাজপথে নেমে রুখে দাঁড়িয়েছিল আইয়ুবশাহীকে। তখন জনগণ জানত, তারা কী চায়।
জনৈতিক দলের ভাবনায়ও থাকত ক্ষমতা হাতে পেলে কীভাবে গড়ে তুলবে দেশ। আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত করারই ষড়যন্ত্র করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে এই মামলা চালানো হয়। জনগণের চোখে ধোঁকা দিতে পারেনি সরকার। স্বাধিকার আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যই যে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসাতে চাইছেন, সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারল জনসাধারণ। ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’ বলে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়েছে ছাত্র, কৃষক-শ্রমিকেরা। সে সময় জনতা জানত, তারা কী চায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯০ সালে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান দেখেছে এই বাংলা। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একত্র হয়েছিল গোটা দেশ। সে সময়ও জনগণের কাছে অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কোনো দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। সরলভাবে বললে শহীদ নূর হোসেনের ভাষাতেই বলতে হয়, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। হ্যাঁ, অধরা গণতন্ত্রকে হাতের মুঠোয় আনার প্রত্যয় নিয়েই জনতা সেদিন নেমে এসেছিল রাস্তায়। এরশাদের পতন হয়েছিল। সেদিনও জনতা জানত, তারা কী চায়।
এ দুটি গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে মিলিয়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের দিকে তাকিয়ে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানের দিকে যাচ্ছে কি দেশ—এ রকম একটি প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে। কিন্তু এ কথা তো সত্য, আজকের জনগণ জানে না, তারা কী চায়। আগের দুটি গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এটাই সেই গণ-অভ্যুত্থানগুলোর সঙ্গে এবারের আন্দোলনের মূল পার্থক্য। জনগণকে কেউ আস্থায় রাখতে পারেনি। জনগণ জানে না, তারা কী চায়।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। তাই আওয়ামী লীগের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল ভোটদাতা জনগণের, সেই প্রত্যাশা পূরণের অধিকার পায়নি আওয়ামী লীগ। একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পায়। বলা বাহুল্য, নানা প্রতিকূলতার কারণে আওয়ামী লীগ জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। বরং তাদের সেই শাসনামলে মানুষের প্রত্যাশার অনেকটাই পূরণ হয়নি।
অন্যদিকে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলটি মোটেই জনগণের জন্য স্বপ্নপূরণের অপরূপ সুযোগ এনে দেয়নি, বরং মাগুরা নির্বাচনের মতো একটি প্রহসনের নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার পাঁয়তারাই করতে দেখা গেছে বিএনপিকে। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত ঘাতক-দালালদের নির্মূলের আন্দোলনের ব্যাপারেও বিএনপি সরকারের ছিল ন্যক্কারজনক ভূমিকা। ফলে জনগণের কাছে দেওয়া পরীক্ষায় তারাও পাস করতে পারেনি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ দল সরকারে অধিষ্ঠিত। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেই নির্বাচনগুলোয় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল কম। বিরোধী দলের অভিযোগ, প্রথমটিতে যা-ও একটু জনগণ নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছে, পরেরটিতে ভোট হয়েছে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই। এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করে থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এ দুই দলের কারও প্রতিই পূর্ণাঙ্গ আস্থা নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না জনগণ। আবার বলছি, বিগত দুই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণ জানত, তারা কী চায়, কিন্তু এবার জনগণের সামনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের সুশাসনহীনতার তাসগুলো খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। জনতা বুঝতে পারছে, রাজনীতিতে ক্ষমতার বদলই মানুষের ভাগ্যের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায় না, বরং কখনো কখনো তা আরও গভীর সংকটের জন্ম দেয়। আমাদের স্বাধীন দেশের ইতিহাসে বারবার বিশ্বাস ভঙ্গের আবর্তে পড়ে জনগণ প্রচলিত নিয়মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে করিয়ে দিতে চাই, গণতন্ত্রের অর্থ শুধু নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র আরও ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে সমাজে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় গণতন্ত্রের অন্য সব উপাদানের কথা ভাবাই যাচ্ছে না। সবচেয়ে সহজ যে বিষয়, সেই নির্বাচনকেই প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না, বাকিটা তো বহু দূরের ব্যাপার। আজ তাই জনগণের ভোটদানের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা খুবই সত্য, ভোটারবিহীন নির্বাচন গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে পারে না। নিজের ভোটটি নিজে দেবে—এই নিশ্চয়তাটুকু জনগণকে দিতে হবে। নইলে কোন গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে? ভোটারবিহীন নির্বাচন হলে সেই গণতন্ত্রের সঙ্গে স্বৈরশাসনের পার্থক্য আর থাকে কোথায়? পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, ক্ষমতাসীন দলগুলো জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। এ রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কবে শেষ এসেছিল, তা মনে করা কঠিন।
তাই এই সংকটকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেবে দেখতে হবে, তারা কীভাবে জনগণের মনে তাদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনবে। রাজনীতির মূল কথা যদি হয় জনগণের সেবা, তাহলে জনগণের কাছেই ফিরে আসতে হবে তাদের। জনগণই ঠিক করবে, কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে দেশ শাসনের ভার। অতীতে ২০০১ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতা ছাড়ার আগে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য যে পটভূমি তৈরি করেছিল বিএনপি, সে কথাও দেশবাসী ভুলে যায়নি। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এমন এক রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে এবং বিএনপি যেন যেকোনো প্রকারে ক্ষমতায় আসতে পারে, তা নিশ্চিত হতে পারে। ফলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতাকেই কেবল বড় করে দেখেছে, এ রকম সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছালে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।
এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভুল স্বীকার করে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে আদর্শগত রাজনীতির ধারায় ফিরতে পারে। নইলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ উপাখ্যানের শেষ হবে না। হরতাল, অগ্নি-সংযোগ, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে কেবল, কিন্তু দেশ থাকবে গণতন্ত্র থেকে হাজার মাইল দূরে।
এই সংকটকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে। আর সে সত্যের কাছে আসতে হলে নিজেদের ‘ইগো’ ভুলে জনতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার ক্ষমতা। নইলে শুধু লুটেপুটে খাওয়ার সংস্কৃতির বশংবদ হয়ে থাকবে গোটা রাজনীতি। রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে বাইরের দেশগুলো, দেশের জনগণ নয়। এর চেয়ে নতজানু অবস্থা আর কিছুই হতে পারে না।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে