বিভুরঞ্জন সরকার
শীতকালে আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতির মাঠ তুলনামূলকভাবে গরম থাকে। আমাদের দেশে বড় সব আন্দোলন-সংগ্রাম শীতের আগে-পরেই হয়েছে। এ বছর সারা দেশে শীতের প্রকোপ বেশি। শীতে মানুষ জবুথবু হয়ে আছে। তবে রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সে রকম গরম হাওয়া নেই। গত কয়েক বছর ধরেই অবশ্য এ অবস্থা চলছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিলেও হঠাৎ করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেই আন্দোলনও গতি পাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ আরও কিছু নির্বাচন নিয়ে কিছু তাপ-উত্তাপ থাকলেও তা সামগ্রিক রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতিতে বড় কোনো ঝড় তোলার মতো নয়। নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা কিছু হচ্ছে, আরও হবে, কিন্তু তাতেও রাজনীতি তেমন তেতে উঠবে বলে মনে হয় না।
উত্তাপ ছড়ানোর রাজনীতির দিন কি তাহলে দেশে শেষ হয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব এখনই এক কথায় দেওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে দেশের মানুষ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চায়। রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, আয়-উপার্জনে ব্যাঘাত না ঘটে—মানুষ সেটাও চায়। তাই এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার আগে নেতা-নেত্রীদের মানুষের মনোভাবের কথাটা বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-ধর্মঘট ইতিমধ্যে কার্যকারিতা হারিয়েছে।
মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে সরকার কোণঠাসা করে রেখেছে। সভা-সমাবেশের অনুমতি খুব একটা দেওয়া হয় না। বিএনপির নেতারা কখনো কখনো ফোঁসফাঁস করলেও ফণা তুলে ছোবল হানার সক্ষমতা হারিয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া সীমানারেখার মধ্যেই নিজেদের রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত রেখেছে। তবে বিএনপির নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন। গণমাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য প্রচারও হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা থেকে মনে হয়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থার কাছে নানা বিষয়ে নালিশ জানানোর প্রক্রিয়া বহাল আছে। মোটা টাকা ব্যয়ে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালানোর জন্য বিদেশে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের তথ্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সামনে আনছেন।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিও মূলত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা কিংবা দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। নিয়মিত রাজনৈতিক কার্যক্রম বলতে এখন শুধু পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়াকেই বোঝায়। জাতীয় রাজনীতি যখন গতিহীন, তখন তৃণমূলের রাজনীতি যে স্থবির অবস্থায় থাকবে–সেটা নিশ্চয়ই কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একটা সময় ছিল যখন রাজনীতির গতিমুখ ছিল তৃণমূলে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষের জন্য কাজ করে তৃণমূলে যাঁরা জনগণের বিশ্বস্ত নেতা হয়ে উঠতেন, তাঁরাই ধাপে ধাপে জাতীয় রাজনীতিতে ঠাঁই পেতেন। এখন ধারা বদলে গেছে। সামরিক শাসকদের কৃপায় আমাদের দেশের রাজনীতি ওপর থেকে নিচে যাওয়ার যে রীতি চালু হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।
এখন নেতা হওয়ার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন হয় না। এখনকার বেশির ভাগই হাইব্রিড নেতা। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। রাজনীতি এখন বিত্তবান হওয়ার উপায়। রাজনীতি পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা। জাতীয় রাজনীতির এই ধাক্কা তৃণমূলেও আঘাত হেনেছে। তাই তৃণমূলেও চলছে টাকার খেলা। স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনেও এখন যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয়, তা এককথায় অকল্পনীয়।
কেউ স্বীকার করতে না চাইলেও বাস্তবতা এটাই যে মাঠের বা তৃণমূলের রাজনীতি এখন চৈত্র মাসের শুকনো ডোবার মতো। সবাই অপেক্ষায় থাকেন ঢাকা থেকে নির্দেশ পাওয়ার। কেন্দ্র থেকে বাঁশির যে সুর বাজানো হয়, তা শোনার জন্য কান পেতে থাকা তৃণমূলের কেউ নিজেরা বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার গরজ বোধ করেন না। কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ নড়াচড়া করেন না। আবার কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দিলেও অনেক সময় তা কার্যকর হয় না–দলীয় কোন্দল অথবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কারণে। আওয়ামী লীগ জানে, যত দিন শেখ হাসিনা আছেন, তত দিন তাদের কোনো ভাবনা নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় দল ঢুকে গেছে সরকারে। আওয়ামী লীগের সরকার না হয়ে সরকারের আওয়ামী লীগ হয়েছে। ফলে দলটিকে আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছোট-বড় প্রায় সব নেতাই তদবির বা অন্য কোনো ধান্দায় ব্যস্ত। গত কয় বছরে তৃণমূলেরও অনেকেই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কে কীভাবে টাকা কামিয়েছেন, এলাকায় এলাকায় কান পাতলেই তা শোনা যায়। এসব শুধুই কি রটনা? অনেকেই মনে করেন, যা রটে তার কিছু না কিছু বটে!
তৃণমূলে আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতি হলো আখের গোছানোর। পাওয়া এবং খাওয়ার রাজনীতি। কিন্তু সবাই তো আর খেতে-পরতে পারছেন না। তাই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। পাওয়া গ্রুপ এবং না-পাওয়া গ্রুপের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে কেন্দ্র থেকে হুকুম দিয়েও এটা দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি এ কারণেই।
তাহলে তৃণমূলে বিএনপির অবস্থা কি ভালো? না। বিএনপির সমর্থকদেরও যেহেতু ভরসার জায়গা খালেদা জিয়া, সেহেতু তাদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা আছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। সরকারি অনুকম্পায় কারাগারের বাইরে থাকলেও তিনি আছেন হাসপাতালে এবং রাজনীতি থেকে দূরে। তাঁর অবর্তমানে দলের হাল ধরার কথা তারেক রহমানের। তারেক লন্ডনে থেকে দল চালান ভার্চুয়ালি। এতে দল কতটুকু সংহত হতে পারছে, তা কেউ বলতে পারেন না। তবে ‘কিছু একটা ঘটবে’–এই আশা ছাড়ছে না বিএনপি। সে জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন যেমন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা দেখেন, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও এতটাই বিভোর যে তাঁরা সংগঠনকে মজবুত করার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরার চেয়ে বেশি পছন্দ করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের তোয়াজ করতে। কে কাকে ল্যাং মেরে সামনে যেতে পারবেন, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিএনপিতেও চরম।
সুতরাং বলার কথা এটাই যে, এলাকায় এলাকায় দল আছে, আছে দলাদলিও। কেউ বলতে পারেন, এটাই তো রাজনীতি। দল এবং দলাদলি থাকলেই বুঝতে হবে রাজনীতি আছে। হ্যাঁ, এই অর্থে তৃণমূলে রাজনীতি আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আছে সব জায়গায়। জাতীয় পার্টির তুলনায় জামায়াতের অবস্থা কিছুটা ভালো বলেই মনে হয়। কারণ, তারা এখন কাজ করছে চুপেচাপে। আর সব দলের অবস্থা একেবারেই কাহিল। বাম দলগুলোর অবস্থানও দেশজুড়ে খুবই দুর্বল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুধু যে দেশের সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে আছে তা নয়, বাড়ি বাড়িতে আছে। এটা কোথাও কোথাও লক্ষ করা যায় যে এক পরিবারে চার রাজনৈতিক দলের সদস্যও আছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এবং জাসদ বা অন্য কোনো বাম দলের সমর্থক।
জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব সদ্ভাব না থাকলেও তৃণমূলের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রেষারেষি নেই, সেটা বলা যাবে না; তবে একধরনের গোপন সমঝোতাও আছে। আওয়ামী লীগের এ রকম সমঝোতা আছে কোথাও কোথাও জামায়াতের সঙ্গেও। এই মিলমিশের পেছনে লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলেও শোনা যায়। সরকারি দলের লোকেরা দুই পয়সা আয়-রোজগার করছেন, বিএনপি-জামায়াত তাদের সহযোগিতা করছে। এমনও শোনা যায় যে এই মর্মে গোপন সমঝোতা হচ্ছে, এখন বিএনপি-জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে পরে দরকার হলে আওয়ামী লীগও যেন সেটা পায়; অর্থাৎ তৃণমূলের রাজনীতিও আর নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নীতির রাজনীতি অবশ্য জাতীয় পর্যায়েও নেই।
তৃণমূলে সবার অলক্ষ্যে আরও একটি পরিবর্তন ঘটছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং উদাসীনতার সুযোগে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করছে। জামায়াতে ইসলামীও এই কাতারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে কৌশলী ও সুচতুর রাজনৈতিক দল জামায়াত। জামায়াত সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়, এটা অতীতে দেখা গেছে। তাদের বেড়ে ওঠার ভয়াবহ বিপদ আজ যাঁরা দেখছেন না বা ছোট করে দেখছেন, তাঁদের পরবর্তী সময়ে পস্তাতে হতে পারে। জামায়াতের সঙ্গে আজ যাঁরা কৌশলের খেলা খেলছেন, তাঁরা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, তখন হয়তো আর সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে না।
তৃণমূলের রাজনীতির ক্ষয়রোগ নিরাময় করতে হলে জাতীয় রাজনীতিতেই আগে পরিবর্তন আনতে হবে। তৃণমূলের ওপর ভর করে জাতীয় রাজনীতি, নাকি জাতীয় রাজনীতির ধারায় তৃণমূলের রাজনীতি–এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা বিভুরঞ্জন সরকার
শীতকালে আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতির মাঠ তুলনামূলকভাবে গরম থাকে। আমাদের দেশে বড় সব আন্দোলন-সংগ্রাম শীতের আগে-পরেই হয়েছে। এ বছর সারা দেশে শীতের প্রকোপ বেশি। শীতে মানুষ জবুথবু হয়ে আছে। তবে রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সে রকম গরম হাওয়া নেই। গত কয়েক বছর ধরেই অবশ্য এ অবস্থা চলছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিলেও হঠাৎ করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেই আন্দোলনও গতি পাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ আরও কিছু নির্বাচন নিয়ে কিছু তাপ-উত্তাপ থাকলেও তা সামগ্রিক রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতিতে বড় কোনো ঝড় তোলার মতো নয়। নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা কিছু হচ্ছে, আরও হবে, কিন্তু তাতেও রাজনীতি তেমন তেতে উঠবে বলে মনে হয় না।
উত্তাপ ছড়ানোর রাজনীতির দিন কি তাহলে দেশে শেষ হয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব এখনই এক কথায় দেওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে দেশের মানুষ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চায়। রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, আয়-উপার্জনে ব্যাঘাত না ঘটে—মানুষ সেটাও চায়। তাই এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার আগে নেতা-নেত্রীদের মানুষের মনোভাবের কথাটা বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-ধর্মঘট ইতিমধ্যে কার্যকারিতা হারিয়েছে।
মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে সরকার কোণঠাসা করে রেখেছে। সভা-সমাবেশের অনুমতি খুব একটা দেওয়া হয় না। বিএনপির নেতারা কখনো কখনো ফোঁসফাঁস করলেও ফণা তুলে ছোবল হানার সক্ষমতা হারিয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া সীমানারেখার মধ্যেই নিজেদের রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত রেখেছে। তবে বিএনপির নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন। গণমাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য প্রচারও হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা থেকে মনে হয়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থার কাছে নানা বিষয়ে নালিশ জানানোর প্রক্রিয়া বহাল আছে। মোটা টাকা ব্যয়ে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালানোর জন্য বিদেশে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের তথ্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সামনে আনছেন।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিও মূলত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা কিংবা দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। নিয়মিত রাজনৈতিক কার্যক্রম বলতে এখন শুধু পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়াকেই বোঝায়। জাতীয় রাজনীতি যখন গতিহীন, তখন তৃণমূলের রাজনীতি যে স্থবির অবস্থায় থাকবে–সেটা নিশ্চয়ই কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একটা সময় ছিল যখন রাজনীতির গতিমুখ ছিল তৃণমূলে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষের জন্য কাজ করে তৃণমূলে যাঁরা জনগণের বিশ্বস্ত নেতা হয়ে উঠতেন, তাঁরাই ধাপে ধাপে জাতীয় রাজনীতিতে ঠাঁই পেতেন। এখন ধারা বদলে গেছে। সামরিক শাসকদের কৃপায় আমাদের দেশের রাজনীতি ওপর থেকে নিচে যাওয়ার যে রীতি চালু হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।
এখন নেতা হওয়ার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন হয় না। এখনকার বেশির ভাগই হাইব্রিড নেতা। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। রাজনীতি এখন বিত্তবান হওয়ার উপায়। রাজনীতি পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা। জাতীয় রাজনীতির এই ধাক্কা তৃণমূলেও আঘাত হেনেছে। তাই তৃণমূলেও চলছে টাকার খেলা। স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনেও এখন যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয়, তা এককথায় অকল্পনীয়।
কেউ স্বীকার করতে না চাইলেও বাস্তবতা এটাই যে মাঠের বা তৃণমূলের রাজনীতি এখন চৈত্র মাসের শুকনো ডোবার মতো। সবাই অপেক্ষায় থাকেন ঢাকা থেকে নির্দেশ পাওয়ার। কেন্দ্র থেকে বাঁশির যে সুর বাজানো হয়, তা শোনার জন্য কান পেতে থাকা তৃণমূলের কেউ নিজেরা বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার গরজ বোধ করেন না। কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ নড়াচড়া করেন না। আবার কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দিলেও অনেক সময় তা কার্যকর হয় না–দলীয় কোন্দল অথবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কারণে। আওয়ামী লীগ জানে, যত দিন শেখ হাসিনা আছেন, তত দিন তাদের কোনো ভাবনা নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় দল ঢুকে গেছে সরকারে। আওয়ামী লীগের সরকার না হয়ে সরকারের আওয়ামী লীগ হয়েছে। ফলে দলটিকে আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছোট-বড় প্রায় সব নেতাই তদবির বা অন্য কোনো ধান্দায় ব্যস্ত। গত কয় বছরে তৃণমূলেরও অনেকেই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কে কীভাবে টাকা কামিয়েছেন, এলাকায় এলাকায় কান পাতলেই তা শোনা যায়। এসব শুধুই কি রটনা? অনেকেই মনে করেন, যা রটে তার কিছু না কিছু বটে!
তৃণমূলে আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতি হলো আখের গোছানোর। পাওয়া এবং খাওয়ার রাজনীতি। কিন্তু সবাই তো আর খেতে-পরতে পারছেন না। তাই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। পাওয়া গ্রুপ এবং না-পাওয়া গ্রুপের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে কেন্দ্র থেকে হুকুম দিয়েও এটা দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি এ কারণেই।
তাহলে তৃণমূলে বিএনপির অবস্থা কি ভালো? না। বিএনপির সমর্থকদেরও যেহেতু ভরসার জায়গা খালেদা জিয়া, সেহেতু তাদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা আছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। সরকারি অনুকম্পায় কারাগারের বাইরে থাকলেও তিনি আছেন হাসপাতালে এবং রাজনীতি থেকে দূরে। তাঁর অবর্তমানে দলের হাল ধরার কথা তারেক রহমানের। তারেক লন্ডনে থেকে দল চালান ভার্চুয়ালি। এতে দল কতটুকু সংহত হতে পারছে, তা কেউ বলতে পারেন না। তবে ‘কিছু একটা ঘটবে’–এই আশা ছাড়ছে না বিএনপি। সে জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন যেমন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা দেখেন, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও এতটাই বিভোর যে তাঁরা সংগঠনকে মজবুত করার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরার চেয়ে বেশি পছন্দ করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের তোয়াজ করতে। কে কাকে ল্যাং মেরে সামনে যেতে পারবেন, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিএনপিতেও চরম।
সুতরাং বলার কথা এটাই যে, এলাকায় এলাকায় দল আছে, আছে দলাদলিও। কেউ বলতে পারেন, এটাই তো রাজনীতি। দল এবং দলাদলি থাকলেই বুঝতে হবে রাজনীতি আছে। হ্যাঁ, এই অর্থে তৃণমূলে রাজনীতি আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আছে সব জায়গায়। জাতীয় পার্টির তুলনায় জামায়াতের অবস্থা কিছুটা ভালো বলেই মনে হয়। কারণ, তারা এখন কাজ করছে চুপেচাপে। আর সব দলের অবস্থা একেবারেই কাহিল। বাম দলগুলোর অবস্থানও দেশজুড়ে খুবই দুর্বল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুধু যে দেশের সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে আছে তা নয়, বাড়ি বাড়িতে আছে। এটা কোথাও কোথাও লক্ষ করা যায় যে এক পরিবারে চার রাজনৈতিক দলের সদস্যও আছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এবং জাসদ বা অন্য কোনো বাম দলের সমর্থক।
জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব সদ্ভাব না থাকলেও তৃণমূলের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রেষারেষি নেই, সেটা বলা যাবে না; তবে একধরনের গোপন সমঝোতাও আছে। আওয়ামী লীগের এ রকম সমঝোতা আছে কোথাও কোথাও জামায়াতের সঙ্গেও। এই মিলমিশের পেছনে লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলেও শোনা যায়। সরকারি দলের লোকেরা দুই পয়সা আয়-রোজগার করছেন, বিএনপি-জামায়াত তাদের সহযোগিতা করছে। এমনও শোনা যায় যে এই মর্মে গোপন সমঝোতা হচ্ছে, এখন বিএনপি-জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে পরে দরকার হলে আওয়ামী লীগও যেন সেটা পায়; অর্থাৎ তৃণমূলের রাজনীতিও আর নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নীতির রাজনীতি অবশ্য জাতীয় পর্যায়েও নেই।
তৃণমূলে সবার অলক্ষ্যে আরও একটি পরিবর্তন ঘটছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং উদাসীনতার সুযোগে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করছে। জামায়াতে ইসলামীও এই কাতারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে কৌশলী ও সুচতুর রাজনৈতিক দল জামায়াত। জামায়াত সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়, এটা অতীতে দেখা গেছে। তাদের বেড়ে ওঠার ভয়াবহ বিপদ আজ যাঁরা দেখছেন না বা ছোট করে দেখছেন, তাঁদের পরবর্তী সময়ে পস্তাতে হতে পারে। জামায়াতের সঙ্গে আজ যাঁরা কৌশলের খেলা খেলছেন, তাঁরা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, তখন হয়তো আর সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে না।
তৃণমূলের রাজনীতির ক্ষয়রোগ নিরাময় করতে হলে জাতীয় রাজনীতিতেই আগে পরিবর্তন আনতে হবে। তৃণমূলের ওপর ভর করে জাতীয় রাজনীতি, নাকি জাতীয় রাজনীতির ধারায় তৃণমূলের রাজনীতি–এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা বিভুরঞ্জন সরকার
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে