অজয় দাশগুপ্ত
তখন আমরা তরুণ। আমাদের দেশের শিশুসাহিত্যের মূল আশ্রয় তখন দৈনিক পত্রিকার শিশুপাতা। সে এক তুমুল প্রতিযোগিতার সময়। একদিকে সংবাদের খেলাঘর, অন্যদিকে ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসর। মাঝখানে পূর্বদেশ পত্রিকার চাঁদের হাট। কচি-কাঁচার আসরের দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান। যাঁর পোশাকি নাম কেউ জানত না। তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল দাদাভাই। আসরের পরিচালক দাদাভাই ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিসত্তাকে। দাদাভাইয়ের চিঠি নামে তিনি প্রতি হপ্তায় কচি-কাঁচার আসরে যে চিঠিটি লিখতেন তার অবদান অসামান্য। গৎবাঁধা কোনো চিঠির পরিবর্তে সেই চিঠি ছিল তথ্য আর নতুন ধারণায় ঠাসা। তেমনি এক চিঠিতে প্রথম জেনেছিলাম সুবীর নন্দীর কথা। গায়ক সুবীর নন্দীও তখন তরুণ। সিলেট ভ্রমণকালে দাদাভাইয়ের সফরসঙ্গী তরুণ সুবীর নন্দী তাঁকে সারা রাস্তা গান শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর গানে মুগ্ধ দাদাভাই সেদিন লিখেছিলেন এই তরুণের মধ্যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অপার সম্ভাবনা। এই ছেলে যে একদিন গান গেয়ে দেশ মজাবে, সে বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল কুণ্ঠাহীন। বলা বাহুল্য, সেই আগাম বাণী সত্য হয়েছিল। সুবীর নন্দী বাংলাদেশে শুধু বিখ্যাত গায়কই হননি, বাংলা গানেও তাঁর গায়কি আর সুরের খেলার জন্য বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন। আজ দাদাভাই ও সুবীর নন্দী কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু ইতিহাস রয়ে গেছে। রয়ে গেছে গান ও সাহিত্যের সেই শিল্পবন্ধন।
এর পরের ইতিহাস বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগমনের ইতিহাস। বাংলা গান বাঙালির প্রাণ। আমরা এমন এক জাতি যারা জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব বিষয়ে গানের চর্চা করি। বিয়ের আসরে যেমন গান অপরিহার্য, তেমনি সামান্য ছাদ ঢালাইয়ের কাজেও আমাদের দেশের মানুষ গানের এস্তেমাল করে। গানের এমন বহুগামিতার কথা বাণিজ্য-কর্তাদের অজানা কিছু না। তাঁরা যখন থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্য করতে মন দিলেন, তখন কোনো বিষয়ই আর বাণিজ্যের বাইরে থাকল না। সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-বাজনা সব চলে গেল তাঁদের দখলে। কী দেখলাম আমরা? আগে গানের চর্চা হতো বাড়িতে। ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম আর গানের গলায় মূর্ত হয়ে উঠত বাঙালির সন্ধ্যা। সেই গান একলাফে ঘর, বারান্দা, পাড়া-মহল্লার স্টেজ ছাড়িয়ে চলে গেল বোকা বাক্সে। শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতার নামে শিল্পী ধরে এনে তাঁদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা। প্রতিযোগিতা খারাপ কিছু না; বরং সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়। আমরা বোকাসোকা আমজনতা। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তেমন কিছুই হতে চলেছে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগল না। চ্যানেলে চ্যানেলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গানের প্রতিযোগিতা পরিণত হলো যুদ্ধে। সবকিছুর মতো হুজুগে বাঙালি গানের বেলায় পিছিয়ে থাকবে কোন দুঃখে? প্রায় প্রতিটি চ্যানেল যখন এমন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ, তখন সত্যিকারের বিচারক ও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব তো থাকবেই। সেই অভাব পূরণের জন্য, বলা ভালো শূন্যস্থান পূরণের জন্য অশিল্পী, অগায়ক, অবিবেচক বিচারক গান বিষয়ে ধারণাহীন মানুষদের ধরে এনে শুরু হলো নয়া কাণ্ড। সবাই জানেন টিভির ব্যবসা নির্ভর করে বিজ্ঞাপন আর টিআরপির ওপর। বিজ্ঞাপনদাতাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি টিআরপি বাড়াতে শুরু হয়ে গিয়েছিল অপকৌশল।
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই ধারা, এই প্রবাহ চলল ওপার বাংলায়। এখন আমাদের বাংলাদেশে গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোর হিড়িক কমেছে। কারণ সর্বনাশ যা করার তা করে দিয়ে গেছে অপ প্রক্রিয়া। সাধনা ও মনোযোগের জায়গা থেকে গান এসে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন এক জায়গায়। যেখানে সন্জীদা খাতুন বা অদিতি মহসিনের দরকার পড়ে না। যন্ত্র আর যন্ত্রী থাকলেই হয়। সঙ্গে জুটেছে ডিজিটাল ভূতের আশীর্বাদ। সেই ভূত নাকি এখন কণ্ঠও ঠিক করে দেয়! কিছুদিন আগে প্রিয় গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তির একটা আলোচনা দেখছিলাম। উপমহাদেশের বিখ্যাত এই গায়িকা হিন্দি, বাংলাসহ রবীন্দ্রনাথের গানে সমান জনপ্রিয়। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, তাঁরা কত কষ্ট করে, কতটা মেহনত করে গান শিখতেন। ভুলচুক হলে গুরু বা ওস্তাদেরা কতটা কঠিন হতেন। কারণ তখন সবার মনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করত—গান মানে একটি সাধনার জন্ম দেওয়া। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি বলছিলেন, এই যে গানের কণ্ঠ থেকে বিকৃতি বা উচ্চারণ—সবকিছু যন্ত্রনির্ভর, এই নির্ভরতাই একদিন গানের বারোটা বাজাবে।
তাঁর কথা যে কতটা সত্যি, সেটা আমরা আমাদের দেশের চ্যানেলে বিজয়ী হওয়া এক তরুণ এবং ওপার বাংলার সারেগামাপা শোয়ে বিখ্যাত হয়ে আসা দেশের আরেক তরুণের পরিণতি দেখলেই বুঝতে পারব। প্রথমজন নোলক বাবু। টিভি চ্যানেলের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা নোলক বাবু তারকা হয়ে বেরোলেন বটে, কিন্তু গানের ভাঁড়ার বা শেখার জগৎ তো শূন্য। তারপর যা হয়, মাদক, নারী—সব মিলিয়ে অন্ধকার এক জগৎ। অতঃপর হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ছিল। তা না হলে কি এতগুলো প্রতিযোগী ডিঙিয়ে প্রথম হতে পারে কেউ? কিন্তু পরিচর্যা আর শেখার গাফিলতিতে সবই গরল ভেল। আজ নোলক বাবুর নাম জানে না কেউ। পরেরজন সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম।
নোবেল নামের যুবকটি খারাপ গাইতেন না। আমি বহুবার তাঁর গান শুনেছি। জি বাংলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান সারেগামাপা। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। উভয় বাংলার নামে হলেও মূলত ওপার বাংলার দর্শক-শ্রোতা আর প্রতিযোগীদের জন্য এই অনুষ্ঠান। কিন্তু বাণিজ্য ঠিক বোঝে কোনটা করতে হবে আর কোনটা না। ওরা জানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তাদের বস্তাবন্দী সিরিয়াল আর এই অনুষ্ঠানটি বিপুল জনপ্রিয়। অতএব, তাদের এই বাংলা মানে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিযোগী রাখা দরকার। তাতে বাংলাদেশের দর্শকদের পাওয়া সহজ হবে। গড়ে উঠবে সস্তা জনমত। ভোট বা সমর্থনের নামে মোবাইল কোম্পানিগুলোর টু পাইস কামানোর পাশাপাশি টিআরপিও চড়বে শীর্ষে। নোবেল গেলেন বাংলাদেশ থেকে। গোড়াতে বিনয়ী ভদ্র ছেলেটি অনেক সময় যখন অকারণ আনুকূল্য পাচ্ছিলেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল এই রাজনীতি ছেলেটির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। যারা বাণিজ্যের নামে তারুণ্যের প্রতিভাকে হয় অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করে, তাদের এসবে কিছু যায়-আসে না। মাশুল দেয় তরুণ-তরুণীরা। এর বেলায়ও তাই হয়েছে। লাই পেয়ে মাথায় ওঠা নোবেল প্রথমেই কলকাতার ওপর একহাত নিয়েছেন। তারপর এমন অবস্থা, আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় সংগীত বদলানোর ব্যাপারে বালখিল্য মত দিয়ে কোটি মানুষকে আহত করেছেন। সবশেষে মদ খেয়ে গানের আসরে দর্শক-শ্রোতাদের হাতে অপমান! ছেলেটি এখন আছেন ঘোর বিপদে। খবরে দেখলাম তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টা নোবেল বা যুব সমাজ না ভেবে আপনি যদি সত্যিকারের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করেন, দেখবেন এরা উচ্চাভিলাষী এবং শিকার। শিকার বাণিজ্যের। শিকার সমাজের অশুভ শক্তির। যারা আমাদের দেশের গান-বাজনা, সংস্কৃতির বারোটা বাজায়, তারাই বছর বছর এমন নোলক-নোবেল পয়দা করে। যাঁরা গান গাইবার আগেই প্রচারের জোরে গায়ক। শিল্পী হয়ে ওঠার আগেই কারাগারে কিংবা সমাজচ্যুত। এই ভয়াবহ বাস্তবতা অন্য অভিভাবকদের শঙ্কিত করে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের গানের জগতে পাঠাতে ভাববেন বা চিন্তা করবেন—এটাই স্বাভাবিক।
দেশের গান, বাঙালির গান, সংস্কৃতি বাঁচাতে এসব অপ প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য বন্ধ করা জরুরি। সংস্কৃতি জীবনভর বয়ে চলা এক বিষয়। এটা এক শ মিটার দৌড় না যে দড়ি ছুঁলেই কেল্লা ফতে। সাধনা, সময় ও ধৈর্যের ভেতর দিয়ে আবার কি গড়ে উঠবে সুস্থ ভুবন? আমরা
সেই প্রত্যাশায় থাকলাম।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
তখন আমরা তরুণ। আমাদের দেশের শিশুসাহিত্যের মূল আশ্রয় তখন দৈনিক পত্রিকার শিশুপাতা। সে এক তুমুল প্রতিযোগিতার সময়। একদিকে সংবাদের খেলাঘর, অন্যদিকে ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসর। মাঝখানে পূর্বদেশ পত্রিকার চাঁদের হাট। কচি-কাঁচার আসরের দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান। যাঁর পোশাকি নাম কেউ জানত না। তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল দাদাভাই। আসরের পরিচালক দাদাভাই ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিসত্তাকে। দাদাভাইয়ের চিঠি নামে তিনি প্রতি হপ্তায় কচি-কাঁচার আসরে যে চিঠিটি লিখতেন তার অবদান অসামান্য। গৎবাঁধা কোনো চিঠির পরিবর্তে সেই চিঠি ছিল তথ্য আর নতুন ধারণায় ঠাসা। তেমনি এক চিঠিতে প্রথম জেনেছিলাম সুবীর নন্দীর কথা। গায়ক সুবীর নন্দীও তখন তরুণ। সিলেট ভ্রমণকালে দাদাভাইয়ের সফরসঙ্গী তরুণ সুবীর নন্দী তাঁকে সারা রাস্তা গান শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর গানে মুগ্ধ দাদাভাই সেদিন লিখেছিলেন এই তরুণের মধ্যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অপার সম্ভাবনা। এই ছেলে যে একদিন গান গেয়ে দেশ মজাবে, সে বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল কুণ্ঠাহীন। বলা বাহুল্য, সেই আগাম বাণী সত্য হয়েছিল। সুবীর নন্দী বাংলাদেশে শুধু বিখ্যাত গায়কই হননি, বাংলা গানেও তাঁর গায়কি আর সুরের খেলার জন্য বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন। আজ দাদাভাই ও সুবীর নন্দী কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু ইতিহাস রয়ে গেছে। রয়ে গেছে গান ও সাহিত্যের সেই শিল্পবন্ধন।
এর পরের ইতিহাস বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগমনের ইতিহাস। বাংলা গান বাঙালির প্রাণ। আমরা এমন এক জাতি যারা জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব বিষয়ে গানের চর্চা করি। বিয়ের আসরে যেমন গান অপরিহার্য, তেমনি সামান্য ছাদ ঢালাইয়ের কাজেও আমাদের দেশের মানুষ গানের এস্তেমাল করে। গানের এমন বহুগামিতার কথা বাণিজ্য-কর্তাদের অজানা কিছু না। তাঁরা যখন থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্য করতে মন দিলেন, তখন কোনো বিষয়ই আর বাণিজ্যের বাইরে থাকল না। সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-বাজনা সব চলে গেল তাঁদের দখলে। কী দেখলাম আমরা? আগে গানের চর্চা হতো বাড়িতে। ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম আর গানের গলায় মূর্ত হয়ে উঠত বাঙালির সন্ধ্যা। সেই গান একলাফে ঘর, বারান্দা, পাড়া-মহল্লার স্টেজ ছাড়িয়ে চলে গেল বোকা বাক্সে। শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতার নামে শিল্পী ধরে এনে তাঁদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা। প্রতিযোগিতা খারাপ কিছু না; বরং সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়। আমরা বোকাসোকা আমজনতা। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তেমন কিছুই হতে চলেছে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগল না। চ্যানেলে চ্যানেলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গানের প্রতিযোগিতা পরিণত হলো যুদ্ধে। সবকিছুর মতো হুজুগে বাঙালি গানের বেলায় পিছিয়ে থাকবে কোন দুঃখে? প্রায় প্রতিটি চ্যানেল যখন এমন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ, তখন সত্যিকারের বিচারক ও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব তো থাকবেই। সেই অভাব পূরণের জন্য, বলা ভালো শূন্যস্থান পূরণের জন্য অশিল্পী, অগায়ক, অবিবেচক বিচারক গান বিষয়ে ধারণাহীন মানুষদের ধরে এনে শুরু হলো নয়া কাণ্ড। সবাই জানেন টিভির ব্যবসা নির্ভর করে বিজ্ঞাপন আর টিআরপির ওপর। বিজ্ঞাপনদাতাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি টিআরপি বাড়াতে শুরু হয়ে গিয়েছিল অপকৌশল।
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই ধারা, এই প্রবাহ চলল ওপার বাংলায়। এখন আমাদের বাংলাদেশে গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোর হিড়িক কমেছে। কারণ সর্বনাশ যা করার তা করে দিয়ে গেছে অপ প্রক্রিয়া। সাধনা ও মনোযোগের জায়গা থেকে গান এসে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন এক জায়গায়। যেখানে সন্জীদা খাতুন বা অদিতি মহসিনের দরকার পড়ে না। যন্ত্র আর যন্ত্রী থাকলেই হয়। সঙ্গে জুটেছে ডিজিটাল ভূতের আশীর্বাদ। সেই ভূত নাকি এখন কণ্ঠও ঠিক করে দেয়! কিছুদিন আগে প্রিয় গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তির একটা আলোচনা দেখছিলাম। উপমহাদেশের বিখ্যাত এই গায়িকা হিন্দি, বাংলাসহ রবীন্দ্রনাথের গানে সমান জনপ্রিয়। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, তাঁরা কত কষ্ট করে, কতটা মেহনত করে গান শিখতেন। ভুলচুক হলে গুরু বা ওস্তাদেরা কতটা কঠিন হতেন। কারণ তখন সবার মনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করত—গান মানে একটি সাধনার জন্ম দেওয়া। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি বলছিলেন, এই যে গানের কণ্ঠ থেকে বিকৃতি বা উচ্চারণ—সবকিছু যন্ত্রনির্ভর, এই নির্ভরতাই একদিন গানের বারোটা বাজাবে।
তাঁর কথা যে কতটা সত্যি, সেটা আমরা আমাদের দেশের চ্যানেলে বিজয়ী হওয়া এক তরুণ এবং ওপার বাংলার সারেগামাপা শোয়ে বিখ্যাত হয়ে আসা দেশের আরেক তরুণের পরিণতি দেখলেই বুঝতে পারব। প্রথমজন নোলক বাবু। টিভি চ্যানেলের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা নোলক বাবু তারকা হয়ে বেরোলেন বটে, কিন্তু গানের ভাঁড়ার বা শেখার জগৎ তো শূন্য। তারপর যা হয়, মাদক, নারী—সব মিলিয়ে অন্ধকার এক জগৎ। অতঃপর হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ছিল। তা না হলে কি এতগুলো প্রতিযোগী ডিঙিয়ে প্রথম হতে পারে কেউ? কিন্তু পরিচর্যা আর শেখার গাফিলতিতে সবই গরল ভেল। আজ নোলক বাবুর নাম জানে না কেউ। পরেরজন সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম।
নোবেল নামের যুবকটি খারাপ গাইতেন না। আমি বহুবার তাঁর গান শুনেছি। জি বাংলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান সারেগামাপা। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। উভয় বাংলার নামে হলেও মূলত ওপার বাংলার দর্শক-শ্রোতা আর প্রতিযোগীদের জন্য এই অনুষ্ঠান। কিন্তু বাণিজ্য ঠিক বোঝে কোনটা করতে হবে আর কোনটা না। ওরা জানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তাদের বস্তাবন্দী সিরিয়াল আর এই অনুষ্ঠানটি বিপুল জনপ্রিয়। অতএব, তাদের এই বাংলা মানে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিযোগী রাখা দরকার। তাতে বাংলাদেশের দর্শকদের পাওয়া সহজ হবে। গড়ে উঠবে সস্তা জনমত। ভোট বা সমর্থনের নামে মোবাইল কোম্পানিগুলোর টু পাইস কামানোর পাশাপাশি টিআরপিও চড়বে শীর্ষে। নোবেল গেলেন বাংলাদেশ থেকে। গোড়াতে বিনয়ী ভদ্র ছেলেটি অনেক সময় যখন অকারণ আনুকূল্য পাচ্ছিলেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল এই রাজনীতি ছেলেটির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। যারা বাণিজ্যের নামে তারুণ্যের প্রতিভাকে হয় অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করে, তাদের এসবে কিছু যায়-আসে না। মাশুল দেয় তরুণ-তরুণীরা। এর বেলায়ও তাই হয়েছে। লাই পেয়ে মাথায় ওঠা নোবেল প্রথমেই কলকাতার ওপর একহাত নিয়েছেন। তারপর এমন অবস্থা, আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় সংগীত বদলানোর ব্যাপারে বালখিল্য মত দিয়ে কোটি মানুষকে আহত করেছেন। সবশেষে মদ খেয়ে গানের আসরে দর্শক-শ্রোতাদের হাতে অপমান! ছেলেটি এখন আছেন ঘোর বিপদে। খবরে দেখলাম তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টা নোবেল বা যুব সমাজ না ভেবে আপনি যদি সত্যিকারের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করেন, দেখবেন এরা উচ্চাভিলাষী এবং শিকার। শিকার বাণিজ্যের। শিকার সমাজের অশুভ শক্তির। যারা আমাদের দেশের গান-বাজনা, সংস্কৃতির বারোটা বাজায়, তারাই বছর বছর এমন নোলক-নোবেল পয়দা করে। যাঁরা গান গাইবার আগেই প্রচারের জোরে গায়ক। শিল্পী হয়ে ওঠার আগেই কারাগারে কিংবা সমাজচ্যুত। এই ভয়াবহ বাস্তবতা অন্য অভিভাবকদের শঙ্কিত করে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের গানের জগতে পাঠাতে ভাববেন বা চিন্তা করবেন—এটাই স্বাভাবিক।
দেশের গান, বাঙালির গান, সংস্কৃতি বাঁচাতে এসব অপ প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য বন্ধ করা জরুরি। সংস্কৃতি জীবনভর বয়ে চলা এক বিষয়। এটা এক শ মিটার দৌড় না যে দড়ি ছুঁলেই কেল্লা ফতে। সাধনা, সময় ও ধৈর্যের ভেতর দিয়ে আবার কি গড়ে উঠবে সুস্থ ভুবন? আমরা
সেই প্রত্যাশায় থাকলাম।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে