মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
ফেব্রুয়ারি ফিরে এসেছে। ’৫২-র ফেব্রুয়ারিতে গড়া আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি উৎসর্গকৃত শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর মাস। এবার ৭২তম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা মাসব্যাপী স্মরণ করতে যাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে মাসব্যাপী স্মরণ করার একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি মুসলিম লীগের সম্মেলন শেষে পল্টনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সুরেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে আবার ছাত্র ও রাজনৈতিক সমাজ প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইনসভা পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সে কারণে আইনসভা পরিষদের সদস্যদের কাছে দাবিনামা উত্থাপনের জন্য সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সরকারি ঘোষণা আসে পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির। এই ঘোষণার পরই ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে এবং বিপক্ষে মত থাকলেও পরদিন সকালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যুবক, কর্মজীবী, সাধারণ মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমবেত হন। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা চলে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন ও সভাপতি গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিলে সবাই তা সমর্থন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১০ জন ১০ জন করে মিছিলসহ আইন পরিষদ সভার দিকে অগ্রসর হওয়ার। ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে তৎকালীন সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে আকস্মিকভাবে গুলি বর্ষিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন বরকত, জব্বার ও রফিক। গুরুতর আহত হন আব্দুস সালাম, যিনি মৃত্যুবরণ করেন ৭ এপ্রিল। তা ছাড়া শফিউর মৃত্যুবরণ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি।
পুলিশের আকস্মিক গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় সমবেত মিছিলকারীরা। কিন্তু আন্দোলন বন্ধ না হয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি জানানো হতে থাকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সংগঠিত হলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে। ঢাকায় নির্মিত হয় একটি শহীদ মিনার। সেটি ভেঙে দেওয়া হয় সরকারি বাহিনীর পক্ষ থেকে। কিন্তু শহীদ মিনার ভাঙলেও ছাত্র, তরুণ, যুবক, সাধারণ মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ কবিতা রচনা করলে সেটি প্রভাতফেরির গানরূপে গৃহীত হয়। শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি লেখেন। চট্টগ্রামের তরুণ কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী লেখেন ‘কাঁদতে আসিনি’ কবিতাটি। অসংখ্য তরুণ, ছাত্র জেলে গেছেন, কিন্তু দমে যাননি ভয়ভীতি প্রদর্শনে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইতিপূর্বে কোনো দেশ বা জাতিকে এভাবে রক্ত দিতে হয়নি।
অথচ মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার জনগণকে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল চল্লিশের দশকে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তেই রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে—এটি তারাই চাপিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতিবাদও হয় তাৎক্ষণিকভাবে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেই প্রতিবাদের ভাষা চরমভাবে উপেক্ষা করে। স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখে ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে বলেন, ‘লেট মি মেক ইট ভেরি ক্লিয়ার টু ইউ, ইট ইজ নো ডাউট দ্যাট দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান ইজ গোয়িং টু বি উর্দু অ্যান্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ। এনিওয়ান হু ট্রাইজ টু মিসলিড ইউ ইজ রিয়েলি দ্য এনিমি অব পাকিস্তান।’ এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রায় অনুরূপ বার্তাই দেন। ঘটনাস্থলেই এর প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। ’৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের ঢেউ গোটা জাতির মননে যে ছাপ ফেলেছিল, তা ’৫২তে ঝড়ের বেগ সৃষ্টি করেছিল। ফলে কোনো বাধাই কেউ মানেনি। সবকিছু উপেক্ষা করে মাতৃভাষা বাংলার জন্য ছাত্র, যুবক ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
একুশের শহীদদের স্মরণে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যরা। সে বছরই হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী রচনা করেন ‘কবর’ নাটক। সব মিলিয়ে ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুনভাবে ঘটা শুরু হয়। পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারারও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ শুরু হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সেটিই ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ’৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সুতরাং ২১ ফেব্রুয়ারি গোটা বাঙালি জাতিকে আপন ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাষ্ট্রচিন্তায় বেড়ে ওঠা এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের চেতনায় প্রস্তুত করে। এই সমগ্র চেতনাই হচ্ছে ’৫২-র ফেব্রুয়ারির আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল।
স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পর বাংলা ও বাঙালির সম্মুখযাত্রা ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রত্যাশিত চরিত্রে। বাঙালি জাতি আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে, যেমনিভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত জাতি-রাষ্ট্রগুলো অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা, দীক্ষা, গবেষণা, রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন-আদালত, প্রশাসনসহ সবকিছুই চলবে। তাতে মেধা, মনন ও প্রজ্ঞার বিস্তার ঘটবে গোটা জাতির মধ্যে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব রাষ্ট্রই এমনটি অনুসরণ করে থাকে। মাতৃভাষায় চিন্তার গভীরতা ও বিস্তার যত বেশি অর্জন করতে পারে, অন্য ভাষায় তা যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ মাইকেল মধুসূদনই দিয়ে গেছেন, বলেও গেছেন। কিন্তু আমরা এসব জ্ঞান বা উপদেশকে খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। যে কারণে এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষা ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে বসেছে। ইংরেজি মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাংলা নয়, আরবি ভাষার মাধ্যমেই পাঠদানের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তাতে খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীই ভাষা দক্ষতায় কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হচ্ছেন। অফিস-আদালতে এখন বাংলা ও ইংরেজির মিশেল চলছে। প্রমিত বাংলা চর্চার চেষ্টা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বইমেলার আয়োজন নিয়ে তোড়জোড় দেখি। ঢাকার বাইরে খুব বেশি বইমেলার আয়োজন হয় না। ঢাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু ভালো সাহিত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার প্রয়োজনীয় মানসম্মত বইপুস্তক খুব একটা প্রকাশিত হয় না। আমাদের প্রকাশনা জগৎটাই চলছে নিয়মনীতির যথেচ্ছাচারে। ফলে নতুন নতুন যেসব বইয়ের খবর প্রচারিত হয়, সেসবের মধ্যে নির্ভর করার মতো মানসম্মত বই থাকে না। অনেকেই নাম কুড়াতে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করেন। এ দিয়ে তো ফেব্রুয়ারির মেলার সমৃদ্ধি অর্জন নিয়ে গর্ব করা যায় না। বিরাট বিরাট প্যাভিলিয়ন এখন মেলার দৃষ্টি কাড়ছে, কিন্তু ভালো বই কোথায়? ভালো পাঠক কোথায়? সব জায়গায় যেন অভাব-অভিযোগ বেড়েই চলেছে। আসলে আমরা যাচ্ছি কোন পথে, কোথায়? ২১ ফেব্রুয়ারির পথে আমাদের এখন কতটা খুঁজে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে মৌলিক গবেষণা হতে পারে। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ ধারণ করার পথে আমরা কতটা রয়েছি—এই প্রশ্নগুলো দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। শিক্ষায় মাতৃভাষার বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষায় প্রমিত মাতৃভাষার চর্চা হ্রাস পেতে বসেছে, গ্রাস করেছে বিদেশি ভাষা। শহরগুলোতে নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই হচ্ছে বিদেশি ভাষায় অধ্যয়ন করার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলা এখন যেন হতদরিদ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্যই নিবু নিবু প্রদীপ জ্বালিয়ে চলছে। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পাস করেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ, লিখন ও পঠনদক্ষতায় বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে ওপরের দিকে এদের যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও প্রযুক্তি, অনলাইনের এই যুগে মাতৃভাষায় মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া দিনে দিনে দুরূহ হয়ে উঠেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ভাবা খুবই জরুরি।
ফেব্রুয়ারি ফিরে এসেছে। ’৫২-র ফেব্রুয়ারিতে গড়া আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি উৎসর্গকৃত শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর মাস। এবার ৭২তম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা মাসব্যাপী স্মরণ করতে যাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে মাসব্যাপী স্মরণ করার একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি মুসলিম লীগের সম্মেলন শেষে পল্টনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সুরেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে আবার ছাত্র ও রাজনৈতিক সমাজ প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইনসভা পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সে কারণে আইনসভা পরিষদের সদস্যদের কাছে দাবিনামা উত্থাপনের জন্য সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সরকারি ঘোষণা আসে পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির। এই ঘোষণার পরই ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে এবং বিপক্ষে মত থাকলেও পরদিন সকালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যুবক, কর্মজীবী, সাধারণ মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমবেত হন। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা চলে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন ও সভাপতি গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিলে সবাই তা সমর্থন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১০ জন ১০ জন করে মিছিলসহ আইন পরিষদ সভার দিকে অগ্রসর হওয়ার। ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে তৎকালীন সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে আকস্মিকভাবে গুলি বর্ষিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন বরকত, জব্বার ও রফিক। গুরুতর আহত হন আব্দুস সালাম, যিনি মৃত্যুবরণ করেন ৭ এপ্রিল। তা ছাড়া শফিউর মৃত্যুবরণ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি।
পুলিশের আকস্মিক গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় সমবেত মিছিলকারীরা। কিন্তু আন্দোলন বন্ধ না হয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি জানানো হতে থাকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সংগঠিত হলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে। ঢাকায় নির্মিত হয় একটি শহীদ মিনার। সেটি ভেঙে দেওয়া হয় সরকারি বাহিনীর পক্ষ থেকে। কিন্তু শহীদ মিনার ভাঙলেও ছাত্র, তরুণ, যুবক, সাধারণ মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ কবিতা রচনা করলে সেটি প্রভাতফেরির গানরূপে গৃহীত হয়। শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি লেখেন। চট্টগ্রামের তরুণ কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী লেখেন ‘কাঁদতে আসিনি’ কবিতাটি। অসংখ্য তরুণ, ছাত্র জেলে গেছেন, কিন্তু দমে যাননি ভয়ভীতি প্রদর্শনে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইতিপূর্বে কোনো দেশ বা জাতিকে এভাবে রক্ত দিতে হয়নি।
অথচ মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার জনগণকে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল চল্লিশের দশকে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তেই রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে—এটি তারাই চাপিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতিবাদও হয় তাৎক্ষণিকভাবে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেই প্রতিবাদের ভাষা চরমভাবে উপেক্ষা করে। স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখে ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে বলেন, ‘লেট মি মেক ইট ভেরি ক্লিয়ার টু ইউ, ইট ইজ নো ডাউট দ্যাট দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান ইজ গোয়িং টু বি উর্দু অ্যান্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ। এনিওয়ান হু ট্রাইজ টু মিসলিড ইউ ইজ রিয়েলি দ্য এনিমি অব পাকিস্তান।’ এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রায় অনুরূপ বার্তাই দেন। ঘটনাস্থলেই এর প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। ’৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের ঢেউ গোটা জাতির মননে যে ছাপ ফেলেছিল, তা ’৫২তে ঝড়ের বেগ সৃষ্টি করেছিল। ফলে কোনো বাধাই কেউ মানেনি। সবকিছু উপেক্ষা করে মাতৃভাষা বাংলার জন্য ছাত্র, যুবক ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
একুশের শহীদদের স্মরণে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যরা। সে বছরই হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী রচনা করেন ‘কবর’ নাটক। সব মিলিয়ে ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুনভাবে ঘটা শুরু হয়। পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারারও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ শুরু হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সেটিই ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ’৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সুতরাং ২১ ফেব্রুয়ারি গোটা বাঙালি জাতিকে আপন ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাষ্ট্রচিন্তায় বেড়ে ওঠা এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের চেতনায় প্রস্তুত করে। এই সমগ্র চেতনাই হচ্ছে ’৫২-র ফেব্রুয়ারির আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল।
স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পর বাংলা ও বাঙালির সম্মুখযাত্রা ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রত্যাশিত চরিত্রে। বাঙালি জাতি আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে, যেমনিভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত জাতি-রাষ্ট্রগুলো অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা, দীক্ষা, গবেষণা, রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন-আদালত, প্রশাসনসহ সবকিছুই চলবে। তাতে মেধা, মনন ও প্রজ্ঞার বিস্তার ঘটবে গোটা জাতির মধ্যে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব রাষ্ট্রই এমনটি অনুসরণ করে থাকে। মাতৃভাষায় চিন্তার গভীরতা ও বিস্তার যত বেশি অর্জন করতে পারে, অন্য ভাষায় তা যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ মাইকেল মধুসূদনই দিয়ে গেছেন, বলেও গেছেন। কিন্তু আমরা এসব জ্ঞান বা উপদেশকে খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। যে কারণে এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষা ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে বসেছে। ইংরেজি মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাংলা নয়, আরবি ভাষার মাধ্যমেই পাঠদানের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তাতে খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীই ভাষা দক্ষতায় কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হচ্ছেন। অফিস-আদালতে এখন বাংলা ও ইংরেজির মিশেল চলছে। প্রমিত বাংলা চর্চার চেষ্টা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বইমেলার আয়োজন নিয়ে তোড়জোড় দেখি। ঢাকার বাইরে খুব বেশি বইমেলার আয়োজন হয় না। ঢাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু ভালো সাহিত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার প্রয়োজনীয় মানসম্মত বইপুস্তক খুব একটা প্রকাশিত হয় না। আমাদের প্রকাশনা জগৎটাই চলছে নিয়মনীতির যথেচ্ছাচারে। ফলে নতুন নতুন যেসব বইয়ের খবর প্রচারিত হয়, সেসবের মধ্যে নির্ভর করার মতো মানসম্মত বই থাকে না। অনেকেই নাম কুড়াতে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করেন। এ দিয়ে তো ফেব্রুয়ারির মেলার সমৃদ্ধি অর্জন নিয়ে গর্ব করা যায় না। বিরাট বিরাট প্যাভিলিয়ন এখন মেলার দৃষ্টি কাড়ছে, কিন্তু ভালো বই কোথায়? ভালো পাঠক কোথায়? সব জায়গায় যেন অভাব-অভিযোগ বেড়েই চলেছে। আসলে আমরা যাচ্ছি কোন পথে, কোথায়? ২১ ফেব্রুয়ারির পথে আমাদের এখন কতটা খুঁজে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে মৌলিক গবেষণা হতে পারে। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ ধারণ করার পথে আমরা কতটা রয়েছি—এই প্রশ্নগুলো দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। শিক্ষায় মাতৃভাষার বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষায় প্রমিত মাতৃভাষার চর্চা হ্রাস পেতে বসেছে, গ্রাস করেছে বিদেশি ভাষা। শহরগুলোতে নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই হচ্ছে বিদেশি ভাষায় অধ্যয়ন করার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলা এখন যেন হতদরিদ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্যই নিবু নিবু প্রদীপ জ্বালিয়ে চলছে। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পাস করেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ, লিখন ও পঠনদক্ষতায় বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে ওপরের দিকে এদের যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও প্রযুক্তি, অনলাইনের এই যুগে মাতৃভাষায় মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া দিনে দিনে দুরূহ হয়ে উঠেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ভাবা খুবই জরুরি।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে