সেলিনা হোসেন
অসাধারণ নারী খনার কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি কৃষি চাষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে কৃষকের কাছে অবিস্মরণীয় মানবী হয়ে উঠেছিলেন। কৃষি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানকে সহ্য করতে পারেনি তাঁর শ্বশুর। তিনি তাঁর ছেলে মিহিরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন খনার জিহ্বা কেটে ফেলার জন্য। মিহির বাবার নির্দেশ পালন করেছিল। মৃত্যু হয়েছিল খনার। কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকে আছে খনার বচন। অসংখ্য কৃষিবিষয়ক বচনের পাশে তার একটি বচন এমন:
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পুণ্যদেশ।’
কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয় ফসলের উৎপাদন। এই বচন বলছে, যে রাজার রাজত্বকালে ফসল বেশি জন্মায়, সেই রাজা পুণ্যবান। কারণ ফসলের সঙ্গে যুক্ত হয় গোলাভরা ধান, থালাভরা ভাত। যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অধিকার। এরপরে আমরা স্মরণ করি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের স্কুলে এনে রক্ষণশীলতার গণ্ডি ভেঙেছিলেন। সমাজকে জেন্ডার সমতার মুখোমুখি করেছিলেন।
এভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নারী তাঁর জ্ঞান দিয়ে পরিচর্যা করেছেন সমাজকে। এগিয়েছে সমাজের স্রোত। আজকে এই ধারাবাহিকতায় স্মরণ করি একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। দুর্বার সাহসে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছিলেন দূরদর্শী চিন্তার বার্তা। সঠিক সময়ে, সঠিক পদক্ষেপ ফেলার সাহসী বার্তা তাঁকে ইতিহাসের মানুষ করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জেন্ডার সমতার ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ।
ব্যক্তিজীবন থেকে রাজনৈতিক জ্ঞানের জায়গায় তিনি জেন্ডার সমতার বলয় তৈরি করেছিলেন স্বামী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে। দুজনের পরিশীলিত জীবনের নানা সূত্রে কোথাও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের জায়গা তৈরি হয়নি। বাংলার জনজীবনে এ এক দিগন্তবিথারি উদ্ভাসন। জেন্ডার সমতার আলোয় ঝরেছে টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে অজস্র শিউলি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি রচনা করেন জেলখানায় রাজবন্দী থাকার সময়। তিনি এই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে স্ত্রী ফজিলাতুন নেছার কথা লিখেছেন: ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি”।’ একই পৃষ্ঠার এই অংশ শেষ করেছেন এভাবে: ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
জেন্ডার সমতার সূত্র থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এখানে পারিবারিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে দেশ-জাতির জন্য সময়ের ইতিহাস রচনা করার কথা দুজনই গভীরভাবে ভেবেছেন। রাজনীতির কারণে কারাবন্দী স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করেছেন সময়ের ছবি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ধরে রাখার জন্য। সম্পর্কের এই গভীর বোঝাপড়া জেন্ডার সমতার অনন্য উদাহরণ। গ্রন্থের শেষে টীকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘পাণ্ডুলিপির জন্য ব্যবহৃত খাতাগুলি ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স, ঢাকা ডিভিশন, সেন্ট্রাল জেল, ঢাকা, ৯ই জুন ১৯৬৭ ও ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ তারিখে পরীক্ষা করেন। অপরদিকে লেখককে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ থেকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, লেখক তাঁর এই আত্মজীবনীটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রচনা শুরু করেন।’ বই থেকে পাওয়া এসব তথ্য জেন্ডার আলোকে বিশ্লেষিত হওয়ার দাবি রাখে। অন্যদিকে মনে হয় রেণুর তাগাদা ছাড়া এবং খাতাগুলো প্রদান করা ছাড়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি কি রচিত হতো? বঙ্গবন্ধু পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের চিন্তা থেকে রেণুকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। পারিবারিক জীবনের সমতা অনায়াসে সত্যে তুলে ধরেছেন।
বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তিনি রেণুর কথা বলেছেন সহযোগিতার সূত্র ধরে। পড়ালেখার সময় কলকাতায় থাকাকালে খরচের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন: ‘আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময়-সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনো দিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।’ আরেক জায়গায় নিজের অসুস্থতার প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘আমার জ্বর ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে।...রেণু কয়েক দিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভালো হলো। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী।’
স্বামীর আধিপত্যের জায়গা থেকে এই পরিবারের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়নি। দুজনই বোধ ও চেতনার জায়গা থেকে একজন খনা, একজন মদনমোহন তর্কালঙ্কার হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। জেন্ডার ডিসকোর্সে তাত্ত্বিক ধারণার ঊর্ধ্বে তাঁরা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতকে বুঝিয়েছিলেন যে, কীভাবে জীবনযাপনকে মানসম্পন্ন করা যায়। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মর্যাদার জায়গা তৈরি হয়।
ব্যক্তি সম্পর্কের ঊর্ধ্বে রাজনীতির প্রসঙ্গটিও বঙ্গমাতা নিজের জ্ঞানে স্রোতের সমান্তরালে রেখেছিলেন। সাংবাদিক-লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণামূলক লেখা ‘স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুপত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘৩২ নম্বরে এলে ভাবি প্রায়ই চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। তিনি জানতেন আমি পেটুক। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্য শুধু চা এলেও আমার জন্য সঙ্গে থাকত তাঁর হাতে বানানো মিষ্টি, বিস্কিট, কখনো একটু পুডিং বা এক টুকরো কেক। একদিন ৩২ নম্বরের এই লাইব্রেরি কক্ষে বসেই বঙ্গবন্ধু ভাবিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একজন নারী ইচ্ছে করলে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারতেন।” আর জবাবে আমি বলেছিলাম, ‘‘তিনি যদি আপনার জীবন পাল্টে দিতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসও সেদিন পাল্টে যেতো।” আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিন যেমন শেখ মুজিবের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে, তেমনি হবে মুজিবের পত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছারও। তাঁকে ছাড়া বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস রবে অসম্পূর্ণ।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন: ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ কালা কিংবা আমার উপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। অনেক সময় আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’
পরিবারের আর একজন সদস্য ড. ওয়াজেদ মিয়া। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বামী। তাঁর বইয়ের নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ।’ অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়। পরিস্থিতি থমথমে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা চলছে। ড. ওয়াজেদ মিয়া ২৩শে মার্চের দুপুরের কথা লিখেছেন: ‘ওই দিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারো সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এত দিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো, কিছু তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, আলোচনা এখনো চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না। এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান।’
এভাবে আমরা বুঝে যাই তিনি ইতিহাসের মানুষ। তিনি মানবচেতনার কণ্ঠস্বর। গণমানুষের পক্ষের শক্তি। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে সঠিক অনুধাবনে নিজের করতলে বিস্তৃত রেখেছিলেন। তিনি জেন্ডার সমতার আলোকে রাজনীতির বিষয়গুলোর মোকাবিলা করেছেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; সভাপতি, বাংলা একাডেমি
অসাধারণ নারী খনার কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি কৃষি চাষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে কৃষকের কাছে অবিস্মরণীয় মানবী হয়ে উঠেছিলেন। কৃষি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানকে সহ্য করতে পারেনি তাঁর শ্বশুর। তিনি তাঁর ছেলে মিহিরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন খনার জিহ্বা কেটে ফেলার জন্য। মিহির বাবার নির্দেশ পালন করেছিল। মৃত্যু হয়েছিল খনার। কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকে আছে খনার বচন। অসংখ্য কৃষিবিষয়ক বচনের পাশে তার একটি বচন এমন:
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পুণ্যদেশ।’
কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয় ফসলের উৎপাদন। এই বচন বলছে, যে রাজার রাজত্বকালে ফসল বেশি জন্মায়, সেই রাজা পুণ্যবান। কারণ ফসলের সঙ্গে যুক্ত হয় গোলাভরা ধান, থালাভরা ভাত। যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অধিকার। এরপরে আমরা স্মরণ করি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের স্কুলে এনে রক্ষণশীলতার গণ্ডি ভেঙেছিলেন। সমাজকে জেন্ডার সমতার মুখোমুখি করেছিলেন।
এভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নারী তাঁর জ্ঞান দিয়ে পরিচর্যা করেছেন সমাজকে। এগিয়েছে সমাজের স্রোত। আজকে এই ধারাবাহিকতায় স্মরণ করি একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। দুর্বার সাহসে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছিলেন দূরদর্শী চিন্তার বার্তা। সঠিক সময়ে, সঠিক পদক্ষেপ ফেলার সাহসী বার্তা তাঁকে ইতিহাসের মানুষ করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জেন্ডার সমতার ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ।
ব্যক্তিজীবন থেকে রাজনৈতিক জ্ঞানের জায়গায় তিনি জেন্ডার সমতার বলয় তৈরি করেছিলেন স্বামী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে। দুজনের পরিশীলিত জীবনের নানা সূত্রে কোথাও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের জায়গা তৈরি হয়নি। বাংলার জনজীবনে এ এক দিগন্তবিথারি উদ্ভাসন। জেন্ডার সমতার আলোয় ঝরেছে টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে অজস্র শিউলি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি রচনা করেন জেলখানায় রাজবন্দী থাকার সময়। তিনি এই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে স্ত্রী ফজিলাতুন নেছার কথা লিখেছেন: ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি”।’ একই পৃষ্ঠার এই অংশ শেষ করেছেন এভাবে: ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
জেন্ডার সমতার সূত্র থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এখানে পারিবারিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে দেশ-জাতির জন্য সময়ের ইতিহাস রচনা করার কথা দুজনই গভীরভাবে ভেবেছেন। রাজনীতির কারণে কারাবন্দী স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করেছেন সময়ের ছবি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ধরে রাখার জন্য। সম্পর্কের এই গভীর বোঝাপড়া জেন্ডার সমতার অনন্য উদাহরণ। গ্রন্থের শেষে টীকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘পাণ্ডুলিপির জন্য ব্যবহৃত খাতাগুলি ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স, ঢাকা ডিভিশন, সেন্ট্রাল জেল, ঢাকা, ৯ই জুন ১৯৬৭ ও ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ তারিখে পরীক্ষা করেন। অপরদিকে লেখককে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ থেকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, লেখক তাঁর এই আত্মজীবনীটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রচনা শুরু করেন।’ বই থেকে পাওয়া এসব তথ্য জেন্ডার আলোকে বিশ্লেষিত হওয়ার দাবি রাখে। অন্যদিকে মনে হয় রেণুর তাগাদা ছাড়া এবং খাতাগুলো প্রদান করা ছাড়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি কি রচিত হতো? বঙ্গবন্ধু পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের চিন্তা থেকে রেণুকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। পারিবারিক জীবনের সমতা অনায়াসে সত্যে তুলে ধরেছেন।
বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তিনি রেণুর কথা বলেছেন সহযোগিতার সূত্র ধরে। পড়ালেখার সময় কলকাতায় থাকাকালে খরচের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন: ‘আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময়-সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনো দিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।’ আরেক জায়গায় নিজের অসুস্থতার প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘আমার জ্বর ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে।...রেণু কয়েক দিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভালো হলো। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী।’
স্বামীর আধিপত্যের জায়গা থেকে এই পরিবারের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়নি। দুজনই বোধ ও চেতনার জায়গা থেকে একজন খনা, একজন মদনমোহন তর্কালঙ্কার হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। জেন্ডার ডিসকোর্সে তাত্ত্বিক ধারণার ঊর্ধ্বে তাঁরা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতকে বুঝিয়েছিলেন যে, কীভাবে জীবনযাপনকে মানসম্পন্ন করা যায়। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মর্যাদার জায়গা তৈরি হয়।
ব্যক্তি সম্পর্কের ঊর্ধ্বে রাজনীতির প্রসঙ্গটিও বঙ্গমাতা নিজের জ্ঞানে স্রোতের সমান্তরালে রেখেছিলেন। সাংবাদিক-লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণামূলক লেখা ‘স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুপত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘৩২ নম্বরে এলে ভাবি প্রায়ই চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। তিনি জানতেন আমি পেটুক। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্য শুধু চা এলেও আমার জন্য সঙ্গে থাকত তাঁর হাতে বানানো মিষ্টি, বিস্কিট, কখনো একটু পুডিং বা এক টুকরো কেক। একদিন ৩২ নম্বরের এই লাইব্রেরি কক্ষে বসেই বঙ্গবন্ধু ভাবিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একজন নারী ইচ্ছে করলে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারতেন।” আর জবাবে আমি বলেছিলাম, ‘‘তিনি যদি আপনার জীবন পাল্টে দিতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসও সেদিন পাল্টে যেতো।” আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিন যেমন শেখ মুজিবের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে, তেমনি হবে মুজিবের পত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছারও। তাঁকে ছাড়া বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস রবে অসম্পূর্ণ।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন: ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ কালা কিংবা আমার উপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। অনেক সময় আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’
পরিবারের আর একজন সদস্য ড. ওয়াজেদ মিয়া। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বামী। তাঁর বইয়ের নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ।’ অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়। পরিস্থিতি থমথমে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা চলছে। ড. ওয়াজেদ মিয়া ২৩শে মার্চের দুপুরের কথা লিখেছেন: ‘ওই দিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারো সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এত দিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো, কিছু তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, আলোচনা এখনো চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না। এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান।’
এভাবে আমরা বুঝে যাই তিনি ইতিহাসের মানুষ। তিনি মানবচেতনার কণ্ঠস্বর। গণমানুষের পক্ষের শক্তি। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে সঠিক অনুধাবনে নিজের করতলে বিস্তৃত রেখেছিলেন। তিনি জেন্ডার সমতার আলোকে রাজনীতির বিষয়গুলোর মোকাবিলা করেছেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; সভাপতি, বাংলা একাডেমি
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে