আবু তাহের খান
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আয়োজন অব্যাহত আছে, যা ঘোষণা অনুযায়ী ১৭ মার্চ শেষ হওয়ার কথা। এই সময়ের মধ্যে স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলেও কিছু কিছু বিষয় আবার অনালোচিত বা স্বল্পালোচিতও থেকে গেছে, যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের ভূমিকা ও অবদানের বিষয়টি অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর দেওয়া ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের যে সূচনা, এর পর থেকে গত ৭৪ বছরে এই ভূখণ্ডে যা যা ঘটেছে এর মধ্যে বাঙালি তার সবচেয়ে কঠিন সময়টি পার করেছে ১৯৭১-এর নয় মাস। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ ও এর মূল্যায়নের যেকোনো আলোচনায় ওই নয় মাসকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনে ওই নয় মাসকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে প্রদত্ত দিকনির্দেশনা অনুসরণপূর্বক ২৬ মার্চ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী নয় মাসে বাঙালি জাতি যে শৌর্য-বীর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল এবং তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে নানা তথ্যভিত্তিক আলোচনাও যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সেই সাহসিকতাপূর্ণ কাজগুলো একটি আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করাটা মোটেও সহজ ছিল না। অথচ সেই অ-সহজ কাজটিই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রায় প্রবাদসম নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহকর্মীরা, বিশেষত জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। অন্যদের সঙ্গে নিয়ে এই চার নেতা সেদিন যে প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, সেই সরকার তার সাংগঠনিক দক্ষতা, কূটনৈতিক বিচক্ষণতা এবং সর্বোপরি একটি পূর্ণাঙ্গ ধাঁচের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের আপামর জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিল। আর সেই আস্থা অর্জিত হওয়ার কারণেই সর্বস্ব ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সেদিন মুহূর্তের জন্যও কোনোরূপ হতাশায় ভোগেনি বা কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্বের সংকটে পড়েনি; বরং প্রতিমুহূর্তে তাদের সাহস ও প্রত্যয় দৃঢ় থেকে ক্রমান্বয়ে দৃঢ়তর হয়েছে এবং সে কারণেই বলা যেতে পারে যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র নয় মাসের মধ্যেই যে দেশ তার বিজয় অর্জন করতে পেরেছিল, সেটি কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না; বরং এর পেছনে ছিল তৎকালীন প্রবাসী সরকারের মেধাবী, দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিশ্রমী তৎপরতা।
যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষকে তার আগ্রহ ও যোগ্যতা অনুযায়ী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক কাজে যুক্ত করে তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় অংশকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল পরিকল্পনা সেল। শিক্ষকদের যুক্ত করা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং তাঁদের কাউকে কাউকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল। আমলাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। চিকিৎসক ও অনুরূপ পেশাজীবীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল আহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ শরণার্থীদের জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা। শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে পরিচালনা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। মোটকথা, অন্য দেশের ভূমিতে অবস্থান করে পরিচালিত হলেও একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারের প্রায় সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিই ওই প্রবাসী সরকারের ছিল।
প্রবাসী সরকারের আরেকটি বড় শক্তির জায়গা ছিল এর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের সাহস, অঙ্গীকার ও দৃঢ়চিত্ততা এবং সর্বোপরি তাঁদের ব্যক্তিগত ত্যাগ ও নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা।
ইতিহাসের তথ্য জানাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতায় অবস্থানকালে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক দিনের জন্যও একই শহরে অবস্থানকারী তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। নিজ হাতে ধোয়া গেঞ্জি-পাঞ্জাবি অফিসকক্ষের পেছনের খালি জায়গায় শুকাতে দিয়ে অপেক্ষা করেছেন পরবর্তী পরিধানের জন্য। শরণার্থীরা আশ্রয়শিবিরে যে খাবার খেতেন, তিনিও খেতেন সেই একই খাবার। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সরকার-সদস্যরা কি এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন বা তাঁদের চর্চায় কি এসবের উপস্থিতি রয়েছে?
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কোটি শরণার্থীর জন্য ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়, যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ পরিচালনার লক্ষ্যে সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী ও ব্যক্তিদের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সর্বোপরি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসংবলিত একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মিত ধাঁচের সরকার পরিচালনার কাজটি সেদিনের প্রবাসী সরকার কীভাবে এত নিপুণ দক্ষতায় করতে সক্ষম হয়েছিল, তা ইতিহাসের এক পরম বিস্ময়। কিন্তু সেদিন সেটি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো গবেষণামূলক কাজ বা এর ফলাফল কি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ বছরে পাওয়া গেল? অথচ সে ধরনের গবেষণার ফলাফল বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বহুলাংশে সহায়ক হতে পারত। প্রবাসী সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এবং এর রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ও অবদান নিয়ে সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেবে? এ বিষয়ে এক বা একাধিক অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও ভাবা যেতে পারে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য প্রহসনের বিচারসহ নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল দেশটির তৎকালীন সামরিক সরকার। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষা করা ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, যে চ্যালেঞ্জ সেদিন তারা নানা কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পরিপূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময়ের আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বর অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে দেশের অভ্যন্তরের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকার বিশ্বজনমতকে বাংলাদেশের পক্ষে এতটাই সংগঠিত করতে পেরেছিল যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের হত্যা-নির্যাতন শেষের দিকে অনেকখানিই কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল। এ বিষয়গুলো নিয়েও স্বাধীন দেশে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা, আলোচনা ও অধ্যয়ন হওয়া উচিত বলে মনে করি। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনব্যবস্থার আর কোন কোন অনুষঙ্গ আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে, তা-ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা প্রয়োজন; যাতে সেসব অনুসরণ করে আমরা উপকৃত হতে পারি।
সব মিলিয়ে প্রস্তাব এই যে বিলম্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের ভূমিকা ও অবদানের নানা দিক নিয়ে আরও ব্যাপকভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন ও গবেষণা হওয়া উচিত, যাতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের এ মহামূল্যবান অধ্যায়টির কোনো অংশ অবহেলা ও উপেক্ষায় হারিয়ে না যায়। আর সেটি শুরু করার জন্য স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ ক্ষণটি একটি চমৎকার উপলক্ষ হতে পারে বলে মনে করি।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা, শিল্প মন্ত্রণালয়
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আয়োজন অব্যাহত আছে, যা ঘোষণা অনুযায়ী ১৭ মার্চ শেষ হওয়ার কথা। এই সময়ের মধ্যে স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলেও কিছু কিছু বিষয় আবার অনালোচিত বা স্বল্পালোচিতও থেকে গেছে, যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের ভূমিকা ও অবদানের বিষয়টি অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর দেওয়া ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের যে সূচনা, এর পর থেকে গত ৭৪ বছরে এই ভূখণ্ডে যা যা ঘটেছে এর মধ্যে বাঙালি তার সবচেয়ে কঠিন সময়টি পার করেছে ১৯৭১-এর নয় মাস। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ ও এর মূল্যায়নের যেকোনো আলোচনায় ওই নয় মাসকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনে ওই নয় মাসকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে প্রদত্ত দিকনির্দেশনা অনুসরণপূর্বক ২৬ মার্চ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী নয় মাসে বাঙালি জাতি যে শৌর্য-বীর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল এবং তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে নানা তথ্যভিত্তিক আলোচনাও যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সেই সাহসিকতাপূর্ণ কাজগুলো একটি আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করাটা মোটেও সহজ ছিল না। অথচ সেই অ-সহজ কাজটিই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রায় প্রবাদসম নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহকর্মীরা, বিশেষত জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। অন্যদের সঙ্গে নিয়ে এই চার নেতা সেদিন যে প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, সেই সরকার তার সাংগঠনিক দক্ষতা, কূটনৈতিক বিচক্ষণতা এবং সর্বোপরি একটি পূর্ণাঙ্গ ধাঁচের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের আপামর জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিল। আর সেই আস্থা অর্জিত হওয়ার কারণেই সর্বস্ব ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সেদিন মুহূর্তের জন্যও কোনোরূপ হতাশায় ভোগেনি বা কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্বের সংকটে পড়েনি; বরং প্রতিমুহূর্তে তাদের সাহস ও প্রত্যয় দৃঢ় থেকে ক্রমান্বয়ে দৃঢ়তর হয়েছে এবং সে কারণেই বলা যেতে পারে যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র নয় মাসের মধ্যেই যে দেশ তার বিজয় অর্জন করতে পেরেছিল, সেটি কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না; বরং এর পেছনে ছিল তৎকালীন প্রবাসী সরকারের মেধাবী, দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিশ্রমী তৎপরতা।
যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষকে তার আগ্রহ ও যোগ্যতা অনুযায়ী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক কাজে যুক্ত করে তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় অংশকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল পরিকল্পনা সেল। শিক্ষকদের যুক্ত করা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং তাঁদের কাউকে কাউকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল। আমলাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। চিকিৎসক ও অনুরূপ পেশাজীবীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল আহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ শরণার্থীদের জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা। শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে পরিচালনা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। মোটকথা, অন্য দেশের ভূমিতে অবস্থান করে পরিচালিত হলেও একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারের প্রায় সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিই ওই প্রবাসী সরকারের ছিল।
প্রবাসী সরকারের আরেকটি বড় শক্তির জায়গা ছিল এর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের সাহস, অঙ্গীকার ও দৃঢ়চিত্ততা এবং সর্বোপরি তাঁদের ব্যক্তিগত ত্যাগ ও নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা।
ইতিহাসের তথ্য জানাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতায় অবস্থানকালে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক দিনের জন্যও একই শহরে অবস্থানকারী তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। নিজ হাতে ধোয়া গেঞ্জি-পাঞ্জাবি অফিসকক্ষের পেছনের খালি জায়গায় শুকাতে দিয়ে অপেক্ষা করেছেন পরবর্তী পরিধানের জন্য। শরণার্থীরা আশ্রয়শিবিরে যে খাবার খেতেন, তিনিও খেতেন সেই একই খাবার। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সরকার-সদস্যরা কি এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন বা তাঁদের চর্চায় কি এসবের উপস্থিতি রয়েছে?
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কোটি শরণার্থীর জন্য ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়, যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ পরিচালনার লক্ষ্যে সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী ও ব্যক্তিদের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সর্বোপরি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসংবলিত একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মিত ধাঁচের সরকার পরিচালনার কাজটি সেদিনের প্রবাসী সরকার কীভাবে এত নিপুণ দক্ষতায় করতে সক্ষম হয়েছিল, তা ইতিহাসের এক পরম বিস্ময়। কিন্তু সেদিন সেটি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো গবেষণামূলক কাজ বা এর ফলাফল কি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ বছরে পাওয়া গেল? অথচ সে ধরনের গবেষণার ফলাফল বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বহুলাংশে সহায়ক হতে পারত। প্রবাসী সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এবং এর রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ও অবদান নিয়ে সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেবে? এ বিষয়ে এক বা একাধিক অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও ভাবা যেতে পারে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য প্রহসনের বিচারসহ নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল দেশটির তৎকালীন সামরিক সরকার। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষা করা ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, যে চ্যালেঞ্জ সেদিন তারা নানা কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পরিপূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময়ের আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বর অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে দেশের অভ্যন্তরের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকার বিশ্বজনমতকে বাংলাদেশের পক্ষে এতটাই সংগঠিত করতে পেরেছিল যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের হত্যা-নির্যাতন শেষের দিকে অনেকখানিই কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল। এ বিষয়গুলো নিয়েও স্বাধীন দেশে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা, আলোচনা ও অধ্যয়ন হওয়া উচিত বলে মনে করি। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনব্যবস্থার আর কোন কোন অনুষঙ্গ আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে, তা-ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা প্রয়োজন; যাতে সেসব অনুসরণ করে আমরা উপকৃত হতে পারি।
সব মিলিয়ে প্রস্তাব এই যে বিলম্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের ভূমিকা ও অবদানের নানা দিক নিয়ে আরও ব্যাপকভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন ও গবেষণা হওয়া উচিত, যাতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের এ মহামূল্যবান অধ্যায়টির কোনো অংশ অবহেলা ও উপেক্ষায় হারিয়ে না যায়। আর সেটি শুরু করার জন্য স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ ক্ষণটি একটি চমৎকার উপলক্ষ হতে পারে বলে মনে করি।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা, শিল্প মন্ত্রণালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে