বিভুরঞ্জন সরকার
গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের দেশে একধরনের আদিখ্যেতা আছে। আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলি বটে, তবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি আমাদের প্রকৃত আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। আমাদের কাছে গণতন্ত্র হলো পাঁচ বছর পর ভোট দিতে পারা।
ভোট দিয়ে কাউকে জিতিয়ে বা কাউকে হারিয়ে দিতে পারলেই আমরা খুশি। যাঁদের আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি, তাঁরা আচার-আচরণে কতটুকু গণতান্ত্রিক তা আর আমাদের দেখার বিষয় নয়। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে দেখুন। দল পরিচালনায় গণতন্ত্রের তেমন চর্চা আছে কি? দলের সম্মেলন নিয়মিত হয় না। নির্ধারিত সময়ের পরে যদিওবা সম্মেলন হয়, কিন্তু কমিটি গঠন হয় না। সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা চেয়ারপারসন ও মহাসচিব নির্বাচন করে পুরো কমিটি গঠনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনের পর দিন।
সম্মেলনে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠন করা হয় না কেন? দলীয় সভাগুলোতে দলপ্রধানের ইচ্ছার বাইরে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত কি গ্রহণ করা হয়? আলোচনা হয়, বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মত দেন এবং তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় দলীয় প্রধানের ওপর। এটা কেমন গণতন্ত্র? আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্র হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে বিএনপি ক্লান্তিহীন। বিএনপি কবে, কীভাবে গণতন্ত্রকে উজ্জীবিত করেছে, সে প্রশ্ন করা যাবে না। মোটাদাগে আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গণতন্ত্র মানে একে অপরের লাগামহীন বিরোধিতা করা। বিএনপি গণতন্ত্র বলতে বোঝে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো। আর আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র হলো বিএনপিকে যেকোনোভাবে প্রতিরোধ করা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই কার্যত শক্তি প্রয়োগের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। ভোটের মাঠেও কিন্তু এই শক্তির প্রতিযোগিতাই বড় হয়ে ওঠে। একসময় রাজনৈতিক দলগুলোতে কিছুটা হলেও নীতি-আদর্শের প্রতিযোগিতা ছিল। দিন দিন সেটা কমে আসছে। এখন প্রতিযোগিতা অর্থের। আগে রাজনীতিবিদেরা ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা নিয়ে দল চালালেও ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত হতেন না। কারণ মনে করা হতো রাজনীতি ও ব্যবসা এক নয়। ব্যবসার মূল লক্ষ্য মুনাফা আর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ। এখন রাজনীতিই হয়েছে ব্যবসা। তাই ব্যবসায়ীরা আর চাঁদা দিয়ে মন্ত্রী লালনপালন না করে নিজেরাই মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে যোগ দিয়েছেন।
জনকল্যাণ এখন আর রাজনীতির লক্ষ্য নয়। রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতা আর ক্ষমতা মানেই দুর্নীতি। এই যে বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের লুটপাটের বিরুদ্ধে এত গলা ফাটাচ্ছে, এটা কি এ জন্য যে তারা ক্ষমতায় গিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে? না, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।
তারা ক্ষমতার বাইরে থাকায় বড় ধরনের দুর্নীতি করতে পারছে না। এখন মনোনয়ন দিয়ে কিংবা দলের পদ বিক্রি করে সবাই তো দুর্নীতি করতে পারছে না। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে এখন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ যেমন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তেমনি বিএনপির লোকজনও হতে চান। সে জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে যেকোনো উপায়ে টেনে নামানোর জন্য বিএনপির এত আকুলতা। কেউ যদি মনে করে থাকেন, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কিংবা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য, তাহলে ভুল ভাবছেন।
প্রতিযোগিতাটা ভালো হওয়ার জন্য নয়। প্রতিযোগিতা হচ্ছে, ওরা খেয়ে খেয়ে পেট ফুলিয়ে ঢোল করছে, আর আমরা না খেয়ে কেমন হালকা-পাতলা হয়ে ঘুরছি।
খাওয়া না-খাওয়া ও পাওয়া না-পাওয়ার লড়াই শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি করছে, তা কিন্তু নয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরও কিন্তু এই লড়াই চলছে। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থেকেও যাঁরা ভাগ্য বদলাতে পারেননি, না-পাওয়া, না-খাওয়ার দলে আছেন, এখন তাঁরা পাওয়া, খাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নির্বাচন এলে প্রার্থী হওয়ার জন্য এখন লোকের অভাব হয় না। একজনকে মনোনয়ন দিলে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান।
এরপর শুরু হয় টাকার খেলা। এই যে সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো, অনেকটাই একতরফা ও পাতানো নির্বাচন, অথচ কত কাণ্ডই না ঘটল। আওয়ামী লীগের চিরবৈরী বিএনপি নির্বাচনে ছিল না। এরপরও কেন্দ্র দখল, জাল ভোট কি হয়নি? ‘আমরা আর মামুরা’ মিলে যে প্রতিযোগিতা, তাতেও অভিযোগের শেষ নেই। পরাজিত হলেই কারচুপি আর জিতলে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন।
কেউ হারতে না চাইলে গণতন্ত্র কীভাবে সংহত হবে? ভোটের জন্য, অর্থাৎ ভোটের অধিকারের জন্য এখন অনেকেই কত আলাপ-বিলাপ করছেন। ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ যদি আবার বাধামুক্ত হয়, তাহলে কি দেশে মানুষের আর কোনো সমস্যা-সংকট থাকবে না? ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি থাকবে না? শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে? নাকি আওয়ামী লীগের খারাপের বদলে বিএনপির খারাপটা মেনে নেওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে?
আমাদের একটি প্রবণতা হলো এক দলের শাসন বছরের পর বছর চললে বিরক্ত লাগে। সে জন্য আমরা শাসক দল বদলাতে চাই কিন্তু অব্যবস্থা বদলাতে চাই না। গণতন্ত্র সীমিত হোক কিন্তু শাসনটা ভালো হোক, অন্যায় অনিয়ম কমুক—এ কথা জোর দিয়ে বলার মুরোদ কিংবা সাহস আমাদের অনেকেরই নেই।
অথচ মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ কিংবা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান—দুজনই উদার গণতন্ত্রের পথ পরিহার করে লিমিটেড ডেমোক্রেসি, অর্থাৎ সীমিত গণতন্ত্রের পথেই হেঁটেছেন। তাঁরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদার ছিলেন, গণতন্ত্রের প্রশ্নে ছিলেন অনুদার। কিন্তু তাতে কি এমন ক্ষতি হয়েছে? বরং সিঙ্গাপুরে এখন তিন হাজার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সদর দপ্তর, অন্যদিকে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গণতন্ত্রের নিট ফলাফল হচ্ছে ঢাকায় একটিও মাল্টিন্যাশনালের হেড অফিস নেই। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ানের সময়ে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের চর্চা হলে দেশটি আরও কত দূর এগিয়ে যেত অথবা পিছিয়ে পড়ত, সে কথা না বলে অন্তত এটুকু তো বলা যায়—গণতন্ত্রের চর্চা করে আমরাই কর্মসংস্থানের জন্য ওই দেশে যাচ্ছি, ওরা আমাদের দেশে আসছে না।
প্রাকৃতিক সম্পদহীন একটি বন্দর-রাষ্ট্রের যে চোখধাঁধানো সমৃদ্ধি, এর মূলে রয়েছে লি কুয়ানের বাস্তববাদিতা, গণতন্ত্র বলি আর একনায়কতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদই বলি—বাস্তববাদিতাই আসল কথা। বাস্তববাদিতার কারণে গণতন্ত্রচর্চা ছাড়াই এশিয়ায়, বিশেষ করে চীন ও তাইওয়ান তরতর করে এগিয়ে গেছে। এরা হয়তো ভেবে দেখেছে, গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক প্রক্রিয়ার দরকার হয়, তাতে বিলম্ব ঘটে।আবার ভোট-রাজনীতি করতে হয় বলে জনকল্যাণকর অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না; তাই সীমিত গণতন্ত্রই আমাদের ভালো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, সীমিত গণতন্ত্র আবার কী? গণতন্ত্র তো অখণ্ড। সীমিত গণতন্ত্র বোধ হয় এমন তন্ত্র, যেখানে মানুষ কথা বলতে পারবে না এমন নয়, তবে সুশাসনের পথে যিনি বাধা হয়ে উঠতে চাইবেন, তাঁকে প্রতিহত করা হবে।
আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক বলে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান তাঁর শাসনকালের গোড়া থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর এবং অনমনীয়। কোনো ধরনের অনিয়মকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অগ্রসর না হলে, আইন বা ব্যবস্থা মেনে না চললে একটি দেশ উন্নত হতে পারে না, সভ্য হতে পারে না। সিঙ্গাপুরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো সুযোগ নেই।
লি তাঁর সহযোগীদেরও এতটুকু ছাড় দিতেন না। উপযুক্ত, দক্ষ, বিষয়-অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তাঁদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা দেওয়া হতো। বিনিময়ে তাঁদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হতো শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে।
লির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেহ চেয়াং ওয়ানকে জাতীয় উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। তেহর বিরুদ্ধে শেষ দিকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলে তিনি লিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা বা দুর্নীতি দমন সংস্থা যেন একটু নমনীয়তা দেখায়।
লি তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী তেহকে বলেছিলেন, তদন্ত সংস্থার কাজে হস্তক্ষেপ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাকে সে দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে সিস্টেম ভেঙে পড়বে। আর সিস্টেম একবার ভেঙে পড়লে, সিঙ্গাপুরও আর অগ্রসর হবে না। তেহ যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। বাসায় ফিরে একটি সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৮৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর। নোটে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিজেই নিজের সর্বোচ্চ শাস্তি বেছে নেওয়ার কথা লিখেছিলেন।
প্রিয় সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে বেদনাবিদ্ধ হলেও লি তাঁর শোকবাণীতে বলেছিলেন, দেশের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে মন্ত্রী হলেই কারও আইন, বিচার বা তদন্ত-প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার অধিকার তৈরি হয় না। তেহর প্রতি তিনি নমনীয়তা দেখালে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ত।
তাতে হয়তো তেহর জীবন কিছুটা দীর্ঘ হতো, কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ত সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা। ব্যক্তির প্রতি আবেগ বা ভালোবাসা না দেখিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছিলেন বলেই লির সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট দেশ হয়েও বড় দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে।
আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর মনোভাব দেখাতে পারবে? বিএনপি বা অন্য কোনো দলের কিংবা নির্দলের সরকার পারবে? আমরা বিরুদ্ধ মত বন্ধ করতে কঠোরতা দেখাই আর দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতি উদারতা দেখাই। মানুষের অভিজ্ঞতা তিক্ত বলেই এখন পরিবর্তনের হাওয়ায় তারা উন্মাতাল হয়ে ওঠে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের দেশে একধরনের আদিখ্যেতা আছে। আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলি বটে, তবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি আমাদের প্রকৃত আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। আমাদের কাছে গণতন্ত্র হলো পাঁচ বছর পর ভোট দিতে পারা।
ভোট দিয়ে কাউকে জিতিয়ে বা কাউকে হারিয়ে দিতে পারলেই আমরা খুশি। যাঁদের আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি, তাঁরা আচার-আচরণে কতটুকু গণতান্ত্রিক তা আর আমাদের দেখার বিষয় নয়। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে দেখুন। দল পরিচালনায় গণতন্ত্রের তেমন চর্চা আছে কি? দলের সম্মেলন নিয়মিত হয় না। নির্ধারিত সময়ের পরে যদিওবা সম্মেলন হয়, কিন্তু কমিটি গঠন হয় না। সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা চেয়ারপারসন ও মহাসচিব নির্বাচন করে পুরো কমিটি গঠনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনের পর দিন।
সম্মেলনে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠন করা হয় না কেন? দলীয় সভাগুলোতে দলপ্রধানের ইচ্ছার বাইরে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত কি গ্রহণ করা হয়? আলোচনা হয়, বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মত দেন এবং তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় দলীয় প্রধানের ওপর। এটা কেমন গণতন্ত্র? আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্র হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে বিএনপি ক্লান্তিহীন। বিএনপি কবে, কীভাবে গণতন্ত্রকে উজ্জীবিত করেছে, সে প্রশ্ন করা যাবে না। মোটাদাগে আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গণতন্ত্র মানে একে অপরের লাগামহীন বিরোধিতা করা। বিএনপি গণতন্ত্র বলতে বোঝে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো। আর আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র হলো বিএনপিকে যেকোনোভাবে প্রতিরোধ করা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই কার্যত শক্তি প্রয়োগের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। ভোটের মাঠেও কিন্তু এই শক্তির প্রতিযোগিতাই বড় হয়ে ওঠে। একসময় রাজনৈতিক দলগুলোতে কিছুটা হলেও নীতি-আদর্শের প্রতিযোগিতা ছিল। দিন দিন সেটা কমে আসছে। এখন প্রতিযোগিতা অর্থের। আগে রাজনীতিবিদেরা ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা নিয়ে দল চালালেও ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত হতেন না। কারণ মনে করা হতো রাজনীতি ও ব্যবসা এক নয়। ব্যবসার মূল লক্ষ্য মুনাফা আর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ। এখন রাজনীতিই হয়েছে ব্যবসা। তাই ব্যবসায়ীরা আর চাঁদা দিয়ে মন্ত্রী লালনপালন না করে নিজেরাই মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে যোগ দিয়েছেন।
জনকল্যাণ এখন আর রাজনীতির লক্ষ্য নয়। রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতা আর ক্ষমতা মানেই দুর্নীতি। এই যে বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের লুটপাটের বিরুদ্ধে এত গলা ফাটাচ্ছে, এটা কি এ জন্য যে তারা ক্ষমতায় গিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে? না, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।
তারা ক্ষমতার বাইরে থাকায় বড় ধরনের দুর্নীতি করতে পারছে না। এখন মনোনয়ন দিয়ে কিংবা দলের পদ বিক্রি করে সবাই তো দুর্নীতি করতে পারছে না। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে এখন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ যেমন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তেমনি বিএনপির লোকজনও হতে চান। সে জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে যেকোনো উপায়ে টেনে নামানোর জন্য বিএনপির এত আকুলতা। কেউ যদি মনে করে থাকেন, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কিংবা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য, তাহলে ভুল ভাবছেন।
প্রতিযোগিতাটা ভালো হওয়ার জন্য নয়। প্রতিযোগিতা হচ্ছে, ওরা খেয়ে খেয়ে পেট ফুলিয়ে ঢোল করছে, আর আমরা না খেয়ে কেমন হালকা-পাতলা হয়ে ঘুরছি।
খাওয়া না-খাওয়া ও পাওয়া না-পাওয়ার লড়াই শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি করছে, তা কিন্তু নয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরও কিন্তু এই লড়াই চলছে। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থেকেও যাঁরা ভাগ্য বদলাতে পারেননি, না-পাওয়া, না-খাওয়ার দলে আছেন, এখন তাঁরা পাওয়া, খাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নির্বাচন এলে প্রার্থী হওয়ার জন্য এখন লোকের অভাব হয় না। একজনকে মনোনয়ন দিলে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান।
এরপর শুরু হয় টাকার খেলা। এই যে সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো, অনেকটাই একতরফা ও পাতানো নির্বাচন, অথচ কত কাণ্ডই না ঘটল। আওয়ামী লীগের চিরবৈরী বিএনপি নির্বাচনে ছিল না। এরপরও কেন্দ্র দখল, জাল ভোট কি হয়নি? ‘আমরা আর মামুরা’ মিলে যে প্রতিযোগিতা, তাতেও অভিযোগের শেষ নেই। পরাজিত হলেই কারচুপি আর জিতলে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন।
কেউ হারতে না চাইলে গণতন্ত্র কীভাবে সংহত হবে? ভোটের জন্য, অর্থাৎ ভোটের অধিকারের জন্য এখন অনেকেই কত আলাপ-বিলাপ করছেন। ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ যদি আবার বাধামুক্ত হয়, তাহলে কি দেশে মানুষের আর কোনো সমস্যা-সংকট থাকবে না? ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি থাকবে না? শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে? নাকি আওয়ামী লীগের খারাপের বদলে বিএনপির খারাপটা মেনে নেওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে?
আমাদের একটি প্রবণতা হলো এক দলের শাসন বছরের পর বছর চললে বিরক্ত লাগে। সে জন্য আমরা শাসক দল বদলাতে চাই কিন্তু অব্যবস্থা বদলাতে চাই না। গণতন্ত্র সীমিত হোক কিন্তু শাসনটা ভালো হোক, অন্যায় অনিয়ম কমুক—এ কথা জোর দিয়ে বলার মুরোদ কিংবা সাহস আমাদের অনেকেরই নেই।
অথচ মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ কিংবা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান—দুজনই উদার গণতন্ত্রের পথ পরিহার করে লিমিটেড ডেমোক্রেসি, অর্থাৎ সীমিত গণতন্ত্রের পথেই হেঁটেছেন। তাঁরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদার ছিলেন, গণতন্ত্রের প্রশ্নে ছিলেন অনুদার। কিন্তু তাতে কি এমন ক্ষতি হয়েছে? বরং সিঙ্গাপুরে এখন তিন হাজার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সদর দপ্তর, অন্যদিকে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গণতন্ত্রের নিট ফলাফল হচ্ছে ঢাকায় একটিও মাল্টিন্যাশনালের হেড অফিস নেই। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ানের সময়ে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের চর্চা হলে দেশটি আরও কত দূর এগিয়ে যেত অথবা পিছিয়ে পড়ত, সে কথা না বলে অন্তত এটুকু তো বলা যায়—গণতন্ত্রের চর্চা করে আমরাই কর্মসংস্থানের জন্য ওই দেশে যাচ্ছি, ওরা আমাদের দেশে আসছে না।
প্রাকৃতিক সম্পদহীন একটি বন্দর-রাষ্ট্রের যে চোখধাঁধানো সমৃদ্ধি, এর মূলে রয়েছে লি কুয়ানের বাস্তববাদিতা, গণতন্ত্র বলি আর একনায়কতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদই বলি—বাস্তববাদিতাই আসল কথা। বাস্তববাদিতার কারণে গণতন্ত্রচর্চা ছাড়াই এশিয়ায়, বিশেষ করে চীন ও তাইওয়ান তরতর করে এগিয়ে গেছে। এরা হয়তো ভেবে দেখেছে, গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক প্রক্রিয়ার দরকার হয়, তাতে বিলম্ব ঘটে।আবার ভোট-রাজনীতি করতে হয় বলে জনকল্যাণকর অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না; তাই সীমিত গণতন্ত্রই আমাদের ভালো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, সীমিত গণতন্ত্র আবার কী? গণতন্ত্র তো অখণ্ড। সীমিত গণতন্ত্র বোধ হয় এমন তন্ত্র, যেখানে মানুষ কথা বলতে পারবে না এমন নয়, তবে সুশাসনের পথে যিনি বাধা হয়ে উঠতে চাইবেন, তাঁকে প্রতিহত করা হবে।
আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক বলে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান তাঁর শাসনকালের গোড়া থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর এবং অনমনীয়। কোনো ধরনের অনিয়মকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অগ্রসর না হলে, আইন বা ব্যবস্থা মেনে না চললে একটি দেশ উন্নত হতে পারে না, সভ্য হতে পারে না। সিঙ্গাপুরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো সুযোগ নেই।
লি তাঁর সহযোগীদেরও এতটুকু ছাড় দিতেন না। উপযুক্ত, দক্ষ, বিষয়-অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তাঁদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা দেওয়া হতো। বিনিময়ে তাঁদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হতো শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে।
লির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেহ চেয়াং ওয়ানকে জাতীয় উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। তেহর বিরুদ্ধে শেষ দিকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলে তিনি লিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা বা দুর্নীতি দমন সংস্থা যেন একটু নমনীয়তা দেখায়।
লি তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী তেহকে বলেছিলেন, তদন্ত সংস্থার কাজে হস্তক্ষেপ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাকে সে দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে সিস্টেম ভেঙে পড়বে। আর সিস্টেম একবার ভেঙে পড়লে, সিঙ্গাপুরও আর অগ্রসর হবে না। তেহ যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। বাসায় ফিরে একটি সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৮৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর। নোটে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিজেই নিজের সর্বোচ্চ শাস্তি বেছে নেওয়ার কথা লিখেছিলেন।
প্রিয় সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে বেদনাবিদ্ধ হলেও লি তাঁর শোকবাণীতে বলেছিলেন, দেশের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে মন্ত্রী হলেই কারও আইন, বিচার বা তদন্ত-প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার অধিকার তৈরি হয় না। তেহর প্রতি তিনি নমনীয়তা দেখালে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ত।
তাতে হয়তো তেহর জীবন কিছুটা দীর্ঘ হতো, কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ত সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা। ব্যক্তির প্রতি আবেগ বা ভালোবাসা না দেখিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছিলেন বলেই লির সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট দেশ হয়েও বড় দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে।
আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর মনোভাব দেখাতে পারবে? বিএনপি বা অন্য কোনো দলের কিংবা নির্দলের সরকার পারবে? আমরা বিরুদ্ধ মত বন্ধ করতে কঠোরতা দেখাই আর দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতি উদারতা দেখাই। মানুষের অভিজ্ঞতা তিক্ত বলেই এখন পরিবর্তনের হাওয়ায় তারা উন্মাতাল হয়ে ওঠে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে