মহিউদ্দিন খান মোহন
মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত এই বইমেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের মিলনমেলায় রূপ নেয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শোকাবহ স্মৃতি স্মরণে এই মেলার প্রচলন শুরু হলেও এখন তা এক ‘উৎসবে’ রূপ নিয়েছে।
প্রকাশকেরা এই মেলা সামনে রেখে বই প্রকাশ করেন, লেখকেরাও বছর ধরে প্রস্তুতি নেন মেলায় নতুন বই বাজারে আনার। প্রতিবছর তিন-চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয় এই মেলা উপলক্ষে। এই এক মাসে যত বই প্রকাশিত হয়, সারা বছর এর এক-দশমাংশ হয় কি না, সন্দেহ। তবে সেই সব বইয়ের কত শতাংশ মানসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিবছরই নতুন নতুন লেখকের আবির্ভাব হয় এই মেলা মৌসুমে। তবে নতুন কয়েক শ লেখকের আগমন হলেও অধিকাংশই একটি বা দুটি বই প্রকাশের পর কালের অতলগহ্বরে হারিয়ে যান।
শোনা যায়, ‘নাম কেনা’র জন্য অনেকে বই লিখে প্রকাশকদের টাকা দিয়ে তা প্রকাশ করে থাকেন। একশ্রেণির প্রকাশকও লোকসানের ঝুঁকি না থাকায় সাগ্রহে সেসব বই প্রকাশ করে থাকেন। আর কথিত লেখক টাকার বিপরীতে প্রকাশকপ্রদত্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ বই নিয়ে বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করে ‘লেখক’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। অনেকে এই প্রবণতাকে সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতে অবক্ষয়ের ধারা বলে অভিহিত করে থাকেন। সমাজের সর্বত্র যখন অবক্ষয়ের রাজত্ব, তখন সাহিত্য ও প্রকাশনা জগৎ এর বাইরে থাকবে কেন?
আমরা চলতি ভাষায় যাকে ‘একুশে বইমেলা’ বলি, তার দাপ্তরিক নাম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। স্বাধীনতার পরপরই এই মেলার প্রচলন শুরু। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জালাল ফিরোজের ‘অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস’ গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সাল থেকে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশনা একুশ উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রয় করে আসছিল।
১৯৭৪ সালে একুশ উপলক্ষে একাডেমিতে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একাডেমির বই প্রদর্শিত হয়। ১৯৭৫ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে একাডেমির গেটের কাছে খোলা আকাশের নিচে একুশ উপলক্ষে মুক্তধারা একাডেমির কাছে বই বিক্রির অনুমতি চায়।
একাডেমি অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে মুক্তধারা, আহমদ পাবলিশিং হাউস, নওরোজ, চলন্তিকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান অনুরূপভাবে বই বিক্রি করে এবং এ ব্যবস্থা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই একাডেমির প্রকাশন মুদ্রণ বিক্রয় বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছিল।
১৯৭৮ সালে একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকীর নির্দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একাডেমির প্রকাশনা, মুদ্রণ ও বিক্রয় বিভাগ একুশ উপলক্ষে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে। ১৯৭৯ সালে একাডেমির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহযোগিতায় অনুমোদিত ব্যবস্থা হিসেবে একাডেমির প্রাঙ্গণে পূর্ণাঙ্গ ২১-এর গ্রন্থমেলা শুরু হয়। ১৯৮৫তে (মতান্তরে ১৯৮৪) গ্রন্থমেলার নামকরণ করা হয় “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”।’ (পৃষ্ঠা: ৫১)
গ্রন্থমেলা বলি আর বইমেলা বলি, এর ব্যঞ্জনা একই। এই বইমেলা বাংলাদেশের সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশের সবচেয়ে বড় মৌসুম। শুরুতে বইমেলার পরিসর ছোট ছিল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ছিল এর বিস্তৃতি। বর্ধমান হাউসের পশ্চিম পাশের পুকুরের চারধার ঘিরে বসত বইয়ের স্টল। হাঁটাচলারও প্রশস্ত পথ ছিল। বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক, প্রকাশক আর বইপ্রেমীদের কলরবে পুরো একাডেমি প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকত মাসজুড়ে। আশির দশকে আমরা যখন নবীন যুবক এবং লেখালেখির পোকা যাদের মাথায় বাসা বেঁধেছে, তারা উন্মুখ হয়ে থাকতাম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আগমন অপেক্ষায়। বই কেনা এবং লেখকদের সান্নিধ্যে আসাই ছিল পরম কাঙ্ক্ষিত।
সে সময় প্রতিদিন একবার বইমেলায় না গেলে যেন পেটের ভাত হজম হতো না। ১৯৮৩ সাল থেকে পুরো আশির দশক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ ছিল বাংলাদেশ। একুশের বইমেলা সেই আন্দোলনে নতুন শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছে। সে সময় একটি স্লোগান খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। বাস্তবিক অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার দ্রোহ থেকেই একুশের জন্ম।
আমরা কয়েকজন তরুণ সে সময় ‘প্রতিধ্বনি’ নামে একটি একুশে সংকলন বের করতাম। সম্পাদক ছিলাম আমি, নির্বাহী সম্পাদক বন্ধু সদ্য প্রয়াত মাহমুদ হাদী। অখ্যাত ও নবীন লেখকদের পাশাপাশি কবি শামসুর রাহমান, কবি সিকদার আমিনুল হক, ফারুক মাহমুদ, সমুদ্র গুপ্ত, হেলাল হাফিজ, আবু সালেহ, মুশাররফ করিম, মাশুক চৌধুরী, মাহবুব হাসান, প্রখ্যাত সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, সালাহউদ্দিন চৌধুরী, শেখ নূরুল ইসলাম, প্রমুখ বিশিষ্ট কবি ও লেখক সেই সংকলনে লেখা দিয়ে আমাদের কৃতার্থ করেছেন। লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল আমার।
অমর একুশে বইমেলা ছিল আমাদের প্রাণের স্পন্দন। আমরা সেই স্পন্দনের স্পর্শ অনুভব করতে মেলায় যেতাম। আগের তুলনায় মেলার পরিসর এখন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে তা আজ সম্প্রসারিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। স্টলের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বইমেলা যেন তার সেই আকর্ষণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে।
রাজনীতি একে গ্রাস করেছে। অভিযোগ রয়েছে দলীয়করণের। সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত প্রকাশকেরা স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে হন বৈষম্যের শিকার। এর প্রতিবাদে অভিজাত প্রকাশনী সূচিপত্র কয়েক বছর ধরে মেলায় স্টল নেয় না। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখকদের বই প্রদর্শন ও বিক্রয় অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ। অথচ একুশের চেতনা এ কথা বলে না। কিন্তু সেই চেতনা আজ অনেকটাই উপেক্ষিত।
তবে এবার একুশে বইমেলায় যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল, তাকে ন্যক্কারজনক বললেও কম বলা হয়। অসম বয়সের এক দম্পতিকে কেন্দ্র করে মেলায় আসা তরুণদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মেলার সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্যকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। তিশা নামের মেয়েটিকে মুশতাক নামের বৃদ্ধ লোকটির বিয়ে করা ইসলামি শরিয়ত বা দেশের প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ কাজ নয়
। তবে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে শোভন-অশোভন বলে একটি বিষয় আছে। মুশতাক-তিশার বিয়ে অবৈধ না হলেও সমাজ তা ভালোভাবে নেয়নি। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে নিন্দা-ধিক্কারের ঝড় তুলেছে। এই নিন্দা-ধিক্কারের অগ্নিকুণ্ডে ঘৃতাহুতি দেন মুশতাক-তিশা নিজেরাই। মুশতাক তাঁর বালিকা বধূর নামে লেখা বই নিয়ে মেলায় গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তরুণদের। দুই দিন এই দম্পতিকে বিক্ষোভের মুখে মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন তাঁরা।
অপরদিকে করোনাকালে উৎকট দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও কারাভোগী ডা. সাবরিনা শারমিন তাঁর হাজতবাস সময়ের স্মৃতিচারণামূলক বই নিয়ে মেলায় গিয়ে বাধিয়েছেন আরেক ফ্যাসাদ। নানা কেলেঙ্কারির নায়িকা সাবরিনা বিভিন্ন মিডিয়ায় এখন এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছেন, যেন মহৎ কোনো কাজ করতে গিয়ে তিনি কারাবাসী হয়েছিলেন।
অথচ তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির মামলা বিচারাধীন। কতটা নির্লজ্জ হলে ‘একে চুরি, তার ওপর সিনাজুরি’র মতো একজন অপরাধী বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে সদম্ভে চলাফেরা করতে পারে, ভাবলে অবাক হতে হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ঠিকই বলেছিলেন, ‘সবকিছু চলে যাবে নষ্টদের দখলে’।
মুশতাক-তিশা আর সাবরিনাদের কায়কারবার সে কথাকে সত্য প্রমাণ করে। হতাশার কথা, নষ্টরা এখন একুশে বইমেলার মতো জাতীয় অহংকারের অঙ্গনকে দখল করতে উদ্যত হয়েছে।
এসব অব্যবস্থা, অরাজকতা, নষ্টামি-ভ্রষ্টামিতে নষ্ট পরিবেশের কারণে আমার বইমেলায় যেতে ইচ্ছে করছে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত এই বইমেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের মিলনমেলায় রূপ নেয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শোকাবহ স্মৃতি স্মরণে এই মেলার প্রচলন শুরু হলেও এখন তা এক ‘উৎসবে’ রূপ নিয়েছে।
প্রকাশকেরা এই মেলা সামনে রেখে বই প্রকাশ করেন, লেখকেরাও বছর ধরে প্রস্তুতি নেন মেলায় নতুন বই বাজারে আনার। প্রতিবছর তিন-চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয় এই মেলা উপলক্ষে। এই এক মাসে যত বই প্রকাশিত হয়, সারা বছর এর এক-দশমাংশ হয় কি না, সন্দেহ। তবে সেই সব বইয়ের কত শতাংশ মানসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিবছরই নতুন নতুন লেখকের আবির্ভাব হয় এই মেলা মৌসুমে। তবে নতুন কয়েক শ লেখকের আগমন হলেও অধিকাংশই একটি বা দুটি বই প্রকাশের পর কালের অতলগহ্বরে হারিয়ে যান।
শোনা যায়, ‘নাম কেনা’র জন্য অনেকে বই লিখে প্রকাশকদের টাকা দিয়ে তা প্রকাশ করে থাকেন। একশ্রেণির প্রকাশকও লোকসানের ঝুঁকি না থাকায় সাগ্রহে সেসব বই প্রকাশ করে থাকেন। আর কথিত লেখক টাকার বিপরীতে প্রকাশকপ্রদত্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ বই নিয়ে বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করে ‘লেখক’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। অনেকে এই প্রবণতাকে সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতে অবক্ষয়ের ধারা বলে অভিহিত করে থাকেন। সমাজের সর্বত্র যখন অবক্ষয়ের রাজত্ব, তখন সাহিত্য ও প্রকাশনা জগৎ এর বাইরে থাকবে কেন?
আমরা চলতি ভাষায় যাকে ‘একুশে বইমেলা’ বলি, তার দাপ্তরিক নাম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। স্বাধীনতার পরপরই এই মেলার প্রচলন শুরু। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জালাল ফিরোজের ‘অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস’ গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সাল থেকে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশনা একুশ উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রয় করে আসছিল।
১৯৭৪ সালে একুশ উপলক্ষে একাডেমিতে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একাডেমির বই প্রদর্শিত হয়। ১৯৭৫ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে একাডেমির গেটের কাছে খোলা আকাশের নিচে একুশ উপলক্ষে মুক্তধারা একাডেমির কাছে বই বিক্রির অনুমতি চায়।
একাডেমি অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে মুক্তধারা, আহমদ পাবলিশিং হাউস, নওরোজ, চলন্তিকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান অনুরূপভাবে বই বিক্রি করে এবং এ ব্যবস্থা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই একাডেমির প্রকাশন মুদ্রণ বিক্রয় বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছিল।
১৯৭৮ সালে একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকীর নির্দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একাডেমির প্রকাশনা, মুদ্রণ ও বিক্রয় বিভাগ একুশ উপলক্ষে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে। ১৯৭৯ সালে একাডেমির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহযোগিতায় অনুমোদিত ব্যবস্থা হিসেবে একাডেমির প্রাঙ্গণে পূর্ণাঙ্গ ২১-এর গ্রন্থমেলা শুরু হয়। ১৯৮৫তে (মতান্তরে ১৯৮৪) গ্রন্থমেলার নামকরণ করা হয় “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”।’ (পৃষ্ঠা: ৫১)
গ্রন্থমেলা বলি আর বইমেলা বলি, এর ব্যঞ্জনা একই। এই বইমেলা বাংলাদেশের সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশের সবচেয়ে বড় মৌসুম। শুরুতে বইমেলার পরিসর ছোট ছিল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ছিল এর বিস্তৃতি। বর্ধমান হাউসের পশ্চিম পাশের পুকুরের চারধার ঘিরে বসত বইয়ের স্টল। হাঁটাচলারও প্রশস্ত পথ ছিল। বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক, প্রকাশক আর বইপ্রেমীদের কলরবে পুরো একাডেমি প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকত মাসজুড়ে। আশির দশকে আমরা যখন নবীন যুবক এবং লেখালেখির পোকা যাদের মাথায় বাসা বেঁধেছে, তারা উন্মুখ হয়ে থাকতাম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আগমন অপেক্ষায়। বই কেনা এবং লেখকদের সান্নিধ্যে আসাই ছিল পরম কাঙ্ক্ষিত।
সে সময় প্রতিদিন একবার বইমেলায় না গেলে যেন পেটের ভাত হজম হতো না। ১৯৮৩ সাল থেকে পুরো আশির দশক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ ছিল বাংলাদেশ। একুশের বইমেলা সেই আন্দোলনে নতুন শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছে। সে সময় একটি স্লোগান খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। বাস্তবিক অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার দ্রোহ থেকেই একুশের জন্ম।
আমরা কয়েকজন তরুণ সে সময় ‘প্রতিধ্বনি’ নামে একটি একুশে সংকলন বের করতাম। সম্পাদক ছিলাম আমি, নির্বাহী সম্পাদক বন্ধু সদ্য প্রয়াত মাহমুদ হাদী। অখ্যাত ও নবীন লেখকদের পাশাপাশি কবি শামসুর রাহমান, কবি সিকদার আমিনুল হক, ফারুক মাহমুদ, সমুদ্র গুপ্ত, হেলাল হাফিজ, আবু সালেহ, মুশাররফ করিম, মাশুক চৌধুরী, মাহবুব হাসান, প্রখ্যাত সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, সালাহউদ্দিন চৌধুরী, শেখ নূরুল ইসলাম, প্রমুখ বিশিষ্ট কবি ও লেখক সেই সংকলনে লেখা দিয়ে আমাদের কৃতার্থ করেছেন। লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল আমার।
অমর একুশে বইমেলা ছিল আমাদের প্রাণের স্পন্দন। আমরা সেই স্পন্দনের স্পর্শ অনুভব করতে মেলায় যেতাম। আগের তুলনায় মেলার পরিসর এখন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে তা আজ সম্প্রসারিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। স্টলের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বইমেলা যেন তার সেই আকর্ষণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে।
রাজনীতি একে গ্রাস করেছে। অভিযোগ রয়েছে দলীয়করণের। সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত প্রকাশকেরা স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে হন বৈষম্যের শিকার। এর প্রতিবাদে অভিজাত প্রকাশনী সূচিপত্র কয়েক বছর ধরে মেলায় স্টল নেয় না। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখকদের বই প্রদর্শন ও বিক্রয় অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ। অথচ একুশের চেতনা এ কথা বলে না। কিন্তু সেই চেতনা আজ অনেকটাই উপেক্ষিত।
তবে এবার একুশে বইমেলায় যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল, তাকে ন্যক্কারজনক বললেও কম বলা হয়। অসম বয়সের এক দম্পতিকে কেন্দ্র করে মেলায় আসা তরুণদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মেলার সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্যকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। তিশা নামের মেয়েটিকে মুশতাক নামের বৃদ্ধ লোকটির বিয়ে করা ইসলামি শরিয়ত বা দেশের প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ কাজ নয়
। তবে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে শোভন-অশোভন বলে একটি বিষয় আছে। মুশতাক-তিশার বিয়ে অবৈধ না হলেও সমাজ তা ভালোভাবে নেয়নি। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে নিন্দা-ধিক্কারের ঝড় তুলেছে। এই নিন্দা-ধিক্কারের অগ্নিকুণ্ডে ঘৃতাহুতি দেন মুশতাক-তিশা নিজেরাই। মুশতাক তাঁর বালিকা বধূর নামে লেখা বই নিয়ে মেলায় গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তরুণদের। দুই দিন এই দম্পতিকে বিক্ষোভের মুখে মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন তাঁরা।
অপরদিকে করোনাকালে উৎকট দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও কারাভোগী ডা. সাবরিনা শারমিন তাঁর হাজতবাস সময়ের স্মৃতিচারণামূলক বই নিয়ে মেলায় গিয়ে বাধিয়েছেন আরেক ফ্যাসাদ। নানা কেলেঙ্কারির নায়িকা সাবরিনা বিভিন্ন মিডিয়ায় এখন এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছেন, যেন মহৎ কোনো কাজ করতে গিয়ে তিনি কারাবাসী হয়েছিলেন।
অথচ তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির মামলা বিচারাধীন। কতটা নির্লজ্জ হলে ‘একে চুরি, তার ওপর সিনাজুরি’র মতো একজন অপরাধী বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে সদম্ভে চলাফেরা করতে পারে, ভাবলে অবাক হতে হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ঠিকই বলেছিলেন, ‘সবকিছু চলে যাবে নষ্টদের দখলে’।
মুশতাক-তিশা আর সাবরিনাদের কায়কারবার সে কথাকে সত্য প্রমাণ করে। হতাশার কথা, নষ্টরা এখন একুশে বইমেলার মতো জাতীয় অহংকারের অঙ্গনকে দখল করতে উদ্যত হয়েছে।
এসব অব্যবস্থা, অরাজকতা, নষ্টামি-ভ্রষ্টামিতে নষ্ট পরিবেশের কারণে আমার বইমেলায় যেতে ইচ্ছে করছে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে