জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ক্যাসিনো কারবারসহ নানা উপায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাড়ে তিন বছর অনুসন্ধান শেষে চলতি মাসে দুদক অনুসন্ধানের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছে। দুদকের এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। একইভাবে ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন চলা অনুসন্ধান ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে দুদক। এ ধরনের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান শেষে প্রমাণ না মেলার অজুহাতে দুদক তাঁদের অব্যাহতি দেয়।
সুশাসন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, প্রভাবশালী লোকজনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ছাড় দেওয়ায় দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তবে দুদক বলছে, তারা আইন অনুযায়ী সব করছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, অভিযোগ নিষ্পত্তি করা দুদকের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। তবে ব্যক্তির অবস্থান, রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় তদন্ত থেকে সরে এলে তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
জানা যায়, দুদক চলতি বছর ৩০০ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন সাবেক অ্যাডিশনাল আইজিপি নূরুল আনোয়ার, যুগ্ম সচিব জালাল আহম্মেদ, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান, দুদকের সাবেক উপপরিচালক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফুল কবির চন্দন, সওজ অধিদপ্তরের নির্বাহী বৃক্ষপালনবিদ মো. কামাল উদ্দিন মোল্লা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. তালুকদার নুরুন্নাহার, সাবেক তথ্যসচিব মকবুল হোসেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুল করিম প্রমুখ।
অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কমিশন যদি মনে করে আমলযোগ্য, তখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো চাপ থাকে না।
আরও যত অব্যাহতি
চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের অক্টোবরে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ছিল। তাঁর সম্পদের হিসাবও নেওয়া হয়। ২০২১ সালের মার্চে দুদক মাহফুজুর রহমানকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। দুদকের পরিসমাপ্তিকরণ চিঠিতে বলা হয়, সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।
সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারার পেছনে ক্ষমতার প্রভাব কাজ করেছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে। তবে দুদক বলছে, তারা কাউকে ছাড় দেয় না। দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, তারা যদি কোনো অভিযোগ পরিসমাপ্ত করে, সে ক্ষেত্রে কেউ প্রভাবশালী কি না, তা বিবেচনায় রাখে না। আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করে।
প্রমাণিত হওয়ার পরও অব্যাহতি
দুদকে আসা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়ার নজির আছে। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগে দুর্নীতির একটি অভিযোগ ২০১৯ সালে দুদকে আসে। পরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৩৯ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ জনের বয়স বেশি ছিল; যা নিয়োগ কমিটি অসৎ উদ্দেশ্যে আমলে নেয়নি।
ওই ঘটনায় তখনকার জেলা প্রশাসক সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম রকিবুল হাসানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের সহকারী পরিচালক সাধনচন্দ্র সূত্রধর। কিন্তু সেই সুপারিশ গ্রহণ না করে দুদক অভিযোগটি নিষ্পত্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্ত করে। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর দুদকের তৎকালীন সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সই করা চিঠিতে অভিযোগ নিষ্পত্তির কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।
২০২০ সালে কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট একটি দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তখনকার উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন ৩৬ কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পান। কক্সবাজারের পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশও করেন তিনি। কিন্তু দুদক সেটি গ্রহণ করেনি। পরে প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক আলী আকবরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেন। কিন্তু সে দফায়ও দুদক সেটি আমলে নেয়নি।
অনুমতি সত্ত্বেও মামলা হয়নি
২০২২ সালের শুরুতে বিআইডব্লিউটিএর আরিচা নদীবন্দরে ঘাট ইজারায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসে দুদকে। পরে দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন অনুসন্ধানে দুটি ঘাট কম মূল্যে ইজারা দিয়ে ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ পান। গত বছরের মাঝামাঝি বিআইডব্লিউটিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। সেপ্টেম্বরে ওই ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমোদন দেয় দুদক। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মামলাটি দায়ের করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নথিটি আইন শাখায় আছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুদক যদি কাউকে অন্যায়ভাবে ছাড় দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা কাম্য নয়। কারণ, দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দুর্নীতি দমনের জন্য। আইন অনুযায়ী কাজ করবে, এমনটাই প্রত্যাশা।