শব্দের আড়ালে গল্প: ‘বিজয়া দশমী’

রাজীব কুমার সাহা
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৭: ০৯

শারদীয় দুর্গোৎসবের পাঁচ দিনব্যাপী আয়োজনের শেষ দিন হলো বিজয়া দশমী। বিজয়া দশমীতে পরিবার, বংশের গুরুজন, আপনজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পারস্পরিক কুশল বিনিময় সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু একবারও কি মনে হয়েছে, কেন আমরা ‘দশমী’ শব্দের সঙ্গে ‘বিজয়া’ শব্দটি জুড়ে দিচ্ছি? চার দিনের আনন্দ-উদ্‌যাপন শেষে দশমী তো প্রতিমা বিসর্জনের দিন। শুধু ‘দশমী’ শব্দটি ব্যবহার করাই কি অধিক যুক্তিসংগত ছিল না? তাহলে ‘বিজয়া’ মানে কি ‘বিসর্জন’? আবার শুধু ‘দশমী’ না বলে ‘বিজয়া দশমী’ কেন বলছি? তবে চলুন আজ জানব বিজয়া দশমীর ইতিবৃত্ত। 

প্রথমেই জেনে নিই আমরা এই অনুষ্ঠানে সাধারণত কী কী দেখি। ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। সমবয়সীরা নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি করে পারস্পরিক কুশল বিনিময় করে। একে অপরকে মিষ্টিমুখ করায়। সধবা নারীরা সিঁদুরখেলায় মেতে ওঠেন। এমনকি বিসর্জনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আনন্দে নাচানাচি করে। এখান থেকেই কৌতূহলী মনে একটি সাধারণ প্রশ্ন উঁকি দেয়, তা হলো দেবী দুর্গার বিদায়বেলায় তো আবেগে কান্না আসার কথা, আনন্দ-উল্লাসে নাচানাচি করার কথা না। তাই নয় কি? 

‘দশমী’ শব্দটির পূর্বে যখন ‘বিজয়া’ শব্দটি বসানো হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারি, এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বিজয়ের। সেই বিজয় পাপের ওপর পুণ্যের, অধর্মের ওপর ধর্মের, অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির। বিজয়া সম্পর্কে পুরাণে কথিত রয়েছে, মহিষাসুর নামক এক পরাক্রমশালী অসুর দীর্ঘকাল ব্রহ্মার আরাধনা করে। অবশেষে ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে দেখা দেন মহিষাসুরকে। ভক্তের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন যে, কোনো পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। এরপর প্রবল শক্তিধর মহিষাসুর হিতাহিত জ্ঞান ভুলে একের পর এক রাজ্য জয় করতে থাকে। ক্রমে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল দখল করে মহিষাসুর। স্বর্গপুরীতে দেবরাজ ইন্দ্রকেও স্বর্গচ্যুত করে। অসীম শক্তির মোহে অন্ধ হয়ে মহিষাসুর ভুলে যায় যে, তাঁকে কোনো নারীও বধ করতে পারে!

মহিষাসুরের নিরন্তর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একসঙ্গে মিলিত হন দেবতাগণ। সম্মিলিতভাবে বুদ্ধি-পরামর্শ করতে থাকেন কীভাবে মহিষাসুরকে পরাজিত করা যায়। নানান ঘটনাক্রমের ফলে তাঁদের সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। পুরাণে মহিষাসুর বধ কাহিনিতে লেখা রয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন দেবী দুর্গা। অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির এই জয়লাভকেই ‘বিজয়া’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক আরেকটি তথ্য হলো, পুরাণে মহিষাসুর বধ সম্পর্কে উল্লিখিত আছে যে, ‘দেবী দুর্গা আবির্ভূত হন আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে এবং মহিষাসুরকে বধ করেন শুক্লা দশমীতে।’ তাই দশমীতে এই বিজয়কেই চিহ্নিত করে বলা হয় ‘বিজয়া দশমী’। 

এবার ‘বিজয়া’য় দৃষ্টিনিক্ষেপ করি। প্রকৃতপক্ষে এর পেছনেই লুকিয়ে আছে আমাদের ‘ক্ষাত্রবীর্যে’র পরিচয় বহনকারী ইতিহাস। আভিধানিকভাবে ‘বিজয়া’ শব্দটি এসেছে ‘বিজয়’ শব্দ থেকে। দুর্গা হলেন শক্তির আরাধ্যা দেবী। তাঁর আরাধনার মূল উদ্দেশ্য হলো মহাশক্তি লাভ করা। পাশাপাশি জয় ও যশ লাভ করা। প্রকৃতপক্ষে পুরাকালে আমাদের দেশীয় রাজন্যবর্গ দেবী দুর্গার আরাধনা করতেন শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়লাভের উদ্দেশ্যে। দেবী দুর্গার পূজা শেষ করে এই দিনটিতে পররাজ্য জয় করার উদ্দেশ্যে তারা বীর বিক্রমে ধাবমান হতেন। সেই সময় কিন্তু জলের মধ্যে প্রতিমা বিসর্জনের এখনকার এই রীতি প্রচলিত ছিল না। 

যুদ্ধে রাজার সঙ্গে চলত এক বিরাট সৈন্যবাহিনী, অনেক লোক-লস্কর প্রভৃতি। যাঁরা যুদ্ধে যাবেন, তাঁদের প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা থাকত সর্বদা। যুদ্ধ শেষে তাঁদের মধ্যে কজন জীবিত ফিরতে পারবেন তা কেউ জানে না। তাই যুদ্ধে যাওয়ার আগে দেবীর আরাধনা করে শক্তি অর্জন ও আশীর্বাদ পাথেয় করে তাঁরা প্রস্তুতি নিতেন। এই জীবনে আর কখনো দেখা হবে কি না—এই ভেবে তাঁরা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতেন। শিশুরা তাদের প্রণাম করত। সবাই শেষবারের জন্য কোলাকুলি করে বিজয় অর্জনের শপথ নিতেন। শুভ বা আনন্দের প্রতীক হিসেবে পরিবারের ব্যক্তিবর্গ মূলত নারীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। তাঁদের সিঁথির সিঁদুর যেন অক্ষয় থাকে, সেই উদ্দেশ্যে পরিবারের বিবাহিত নারীরা দেবীর পায়ে সিঁদুর দিয়ে তা নিজেদের সিঁথিতে ধারণ করতেন।

কালের পরিক্রমায় এ বিষয়টিই আজ নারীদের সিঁদুরখেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। যোদ্ধাদের উদ্দীপিত করার জন্য রণভেরির সঙ্গে করা হতো সমবেত উল্লাস, যা আজও দশমীর নাচ বলেই পরিচিত এবং সব বয়সীরা এতে অংশগ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য, এই সমবেত আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদানের বিষয়টি আজও খেলার মাঠে আমরা দেখতে পাই। নতুবা, দেবীকে বিসর্জন দেওয়ার মধ্যে বিষাদ লুকিয়ে থাকে, আনন্দ থাকে না। আর বিষাদে কে আর নাচতে পারে? 

বর্তমান সময়ে সেই রাজাও নেই, আর সেই রাজ্য জয়ের উন্মাদনাও নেই। তার পরেও বিজয়া দশমীর বিধিবদ্ধ আচারগুলো কালের পরিক্রমায় কিছুটা পরিবর্তিত রূপে প্রতিবছর আমাদের নতুন উদ্যমে জাগিয়ে তোলে। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, শরৎকালে সীতা উদ্ধারের জন্য শ্রী রামচন্দ্র অকালবোধন করে দেবীর পূজা করেছিলেন। দেবীর আশীর্বাদে রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। তাই প্রচলিত প্রথা অনুসারে ‘বিজয়া’ শ্রী রামচন্দ্রের বিজয়ের দিন। সাধনজগতে ‘বিজয়া’ কথাটির তাৎপর্য হলো, ‘মহাদেবীর বিশেষ আবির্ভাবক্ষণে তাঁরই প্রসাদে তাঁরই প্রসন্নতায় ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষলাভ।’ যাঁরা শ্রেয়কাম, তাঁরা সংসার বন্ধনরূপ অজ্ঞানতার প্রতি বিজয়প্রাপ্ত হয়ে মোক্ষলাভ করেন। অশুভের পরাজয়ে শুভের উদ্ভব এদিন থেকেই। সে কারণে বিজয়া দশমী আনন্দের দিন, উৎসবের দিন। পারস্পরিক প্রীতি ও সম্প্রীতির দিন।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা
আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত