ড. মইনুল ইসলাম
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দাবি করছে। আইএমএফের প্রাক্কলন ব্যুরোর চেয়ে কম হলেও তারা বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ একটি মাইলফলকে পৌঁছেছে। ২০২০ সালে আইএমএফ দাবি করেছে, করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ২০১৫ সালেই ছাড়িয়ে গেছে, ২০২০ সালে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেল। অবশ্য, গত তিন বছর ধরে টাকার অঙ্কে ডলারের দাম বাড়ার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৭৬৫ ডলার থেকে কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় ভারতের মাথাপিছু জিএনআই এ বছর আবার বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবু বলব, ২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছরে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
এত কিছু সত্ত্বেও ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ জনগণের মন জয় করতে পারছে না কেন? আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগতে হয়তো ১৫ বছর ধরে এমন ধারণা গেড়ে বসে রয়েছে যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এ জন্য ২০১১ সালে তারা সুযোগ পাওয়া মাত্রই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। অথচ দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘অনির্বাচিত’ হওয়ার কারণে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা সত্ত্বেও প্রয়োজনে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে করার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা তো এমনিতেই জয়ী হতে যাচ্ছিল, এরপরও কার বুদ্ধিতে আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরাতে হয়েছিল?
গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি একতরফা সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ওই নির্বাচন বয়কট করেছে। এবারের একতরফা নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টিতে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। মিডিয়ার কল্যাণে দেখা গেছে, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রায় সারা দিন ভোটের কেন্দ্রগুলো জনবিরল ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে দীর্ঘ ভোটার লাইন দেখা গিয়েছিল, এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টিও একেবারেই অবিশ্বাস্য। নির্বাচন কমিশনের দাবি, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি?
বিরোধী দলগুলোর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি অদূর ভবিষ্যতে পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, অদূর ভবিষ্যতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনেরও কোনো আশা নেই বলা চলে। এই পর্যায়ে যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে তা হলো, গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার ভয় করছে কেন? তারা একতরফা নির্বাচন করার অগ্রহণযোগ্য পথে রয়ে গেছে কেন?
বর্তমানে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করেছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে, তার তালিকাটা দেখুন: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রাবন্দর, পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক, মিরসরাই-ফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-পায়রা-যশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়া-লাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ।
এই মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অভূতপূর্ব গতিসঞ্চার করেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত ১৫ বছরে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও আওয়ামী লীগ জনগণের বৃহদংশের মন জয় করতে পারেনি কেন? এই প্রকল্পগুলোকে কি জনগণ পুঁজি-লুণ্ঠনের মেগা-মওকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে? ১৫ বছরে সরকারের ঘনিষ্ঠ দেশের কয়েক শ পুঁজি-লুটেরা পুঁজিপতির ধন-সম্পদের যে অভাবনীয় স্ফীতি জনগণ পর্যবেক্ষণ করছে, এর পেছনে মেগা প্রকল্পের এই পুঁজি-লুণ্ঠন প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুণ্ঠনের মচ্ছবকাল। হয়তো সে জন্যই এত সব উন্নয়ন-প্রকল্প বাস্তবায়ন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের মন জয় করতে পারেনি!
দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট শাসকমহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে, কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি-লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের মধ্যেই বিদেশি ঋণের উল্লম্ফন হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থনীতি বিপদে পড়বে যখন ২০২৫ সাল থেকে প্রধান মেগা প্রকল্পের ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে। দেশের নেতৃস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ জানিয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে, তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতিসামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। বাকি অর্থ জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হিসেবে চেপে বসবে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে নেমে গেছে। কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও এখনো সফল হতে পারেনি। ইতিমধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৮ মাসে এলসি খোলা অনেকখানি কমে এসেছে, কিন্তু হুন্ডি ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স পাঠানোকে কোনোমতেই নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা দিন দিন বাড়তে থাকার প্রধান কারণ আন্তব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সঙ্গে হুন্ডি মার্কেটের ডলারের দামের পার্থক্য ৭-৮ টাকায় স্থির থাকা। এই পার্থক্য বজায় থাকলে ডলারের দামের ক্রম-বাজারীকরণের সিদ্ধান্ত তেমন সুফল দেবে না, হুন্ডি ব্যবসা চাঙাই থেকে যাবে শক্তিশালী চাহিদার কারণে। বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না)। ফরমাল চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো চাঙা হওয়া।
এটা অনস্বীকার্য যে আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, যা পুনরুদ্ধার করতে হলে জনপ্রিয়তায় ধস নামানো দুর্নীতি, পুঁজি-লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতেই হবে। হুন্ডি পদ্ধতিতে বিদেশে থেকে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা কেনার ক্ষেত্রে চাহিদার প্রধান অংশটাই আসছে দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদ এবং ব্যাংকঋণ লুটেরাদের পক্ষ থেকে, যাদের আওয়ামী লীগ লালন করছে। গত ১৫ বছরে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম একেবারেই ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত হয়েছে। কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন না করলে পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দাবি করছে। আইএমএফের প্রাক্কলন ব্যুরোর চেয়ে কম হলেও তারা বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ একটি মাইলফলকে পৌঁছেছে। ২০২০ সালে আইএমএফ দাবি করেছে, করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ২০১৫ সালেই ছাড়িয়ে গেছে, ২০২০ সালে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেল। অবশ্য, গত তিন বছর ধরে টাকার অঙ্কে ডলারের দাম বাড়ার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৭৬৫ ডলার থেকে কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় ভারতের মাথাপিছু জিএনআই এ বছর আবার বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবু বলব, ২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছরে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
এত কিছু সত্ত্বেও ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ জনগণের মন জয় করতে পারছে না কেন? আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগতে হয়তো ১৫ বছর ধরে এমন ধারণা গেড়ে বসে রয়েছে যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এ জন্য ২০১১ সালে তারা সুযোগ পাওয়া মাত্রই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। অথচ দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘অনির্বাচিত’ হওয়ার কারণে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা সত্ত্বেও প্রয়োজনে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে করার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা তো এমনিতেই জয়ী হতে যাচ্ছিল, এরপরও কার বুদ্ধিতে আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরাতে হয়েছিল?
গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি একতরফা সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ওই নির্বাচন বয়কট করেছে। এবারের একতরফা নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টিতে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। মিডিয়ার কল্যাণে দেখা গেছে, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রায় সারা দিন ভোটের কেন্দ্রগুলো জনবিরল ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে দীর্ঘ ভোটার লাইন দেখা গিয়েছিল, এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টিও একেবারেই অবিশ্বাস্য। নির্বাচন কমিশনের দাবি, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি?
বিরোধী দলগুলোর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি অদূর ভবিষ্যতে পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, অদূর ভবিষ্যতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনেরও কোনো আশা নেই বলা চলে। এই পর্যায়ে যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে তা হলো, গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার ভয় করছে কেন? তারা একতরফা নির্বাচন করার অগ্রহণযোগ্য পথে রয়ে গেছে কেন?
বর্তমানে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করেছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে, তার তালিকাটা দেখুন: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রাবন্দর, পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক, মিরসরাই-ফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-পায়রা-যশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়া-লাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ।
এই মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অভূতপূর্ব গতিসঞ্চার করেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত ১৫ বছরে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও আওয়ামী লীগ জনগণের বৃহদংশের মন জয় করতে পারেনি কেন? এই প্রকল্পগুলোকে কি জনগণ পুঁজি-লুণ্ঠনের মেগা-মওকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে? ১৫ বছরে সরকারের ঘনিষ্ঠ দেশের কয়েক শ পুঁজি-লুটেরা পুঁজিপতির ধন-সম্পদের যে অভাবনীয় স্ফীতি জনগণ পর্যবেক্ষণ করছে, এর পেছনে মেগা প্রকল্পের এই পুঁজি-লুণ্ঠন প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুণ্ঠনের মচ্ছবকাল। হয়তো সে জন্যই এত সব উন্নয়ন-প্রকল্প বাস্তবায়ন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের মন জয় করতে পারেনি!
দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট শাসকমহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে, কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি-লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের মধ্যেই বিদেশি ঋণের উল্লম্ফন হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থনীতি বিপদে পড়বে যখন ২০২৫ সাল থেকে প্রধান মেগা প্রকল্পের ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে। দেশের নেতৃস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ জানিয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে, তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতিসামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। বাকি অর্থ জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হিসেবে চেপে বসবে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে নেমে গেছে। কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও এখনো সফল হতে পারেনি। ইতিমধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৮ মাসে এলসি খোলা অনেকখানি কমে এসেছে, কিন্তু হুন্ডি ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স পাঠানোকে কোনোমতেই নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা দিন দিন বাড়তে থাকার প্রধান কারণ আন্তব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সঙ্গে হুন্ডি মার্কেটের ডলারের দামের পার্থক্য ৭-৮ টাকায় স্থির থাকা। এই পার্থক্য বজায় থাকলে ডলারের দামের ক্রম-বাজারীকরণের সিদ্ধান্ত তেমন সুফল দেবে না, হুন্ডি ব্যবসা চাঙাই থেকে যাবে শক্তিশালী চাহিদার কারণে। বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না)। ফরমাল চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো চাঙা হওয়া।
এটা অনস্বীকার্য যে আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, যা পুনরুদ্ধার করতে হলে জনপ্রিয়তায় ধস নামানো দুর্নীতি, পুঁজি-লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতেই হবে। হুন্ডি পদ্ধতিতে বিদেশে থেকে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা কেনার ক্ষেত্রে চাহিদার প্রধান অংশটাই আসছে দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদ এবং ব্যাংকঋণ লুটেরাদের পক্ষ থেকে, যাদের আওয়ামী লীগ লালন করছে। গত ১৫ বছরে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম একেবারেই ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত হয়েছে। কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন না করলে পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে