স্বপ্না রেজা
বাংলাদেশের বিজয়ের বয়স ৫২ বছর। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জন। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এবং ২ থেকে ৪ লাখ নিরীহ বাঙালি নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত বলে অনুধাবন করতে পেরেছে, তখনই তারা তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহায়তায় নবগঠিত এই দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে পঙ্গু ও ধ্বংস করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী। এই বুদ্ধিজীবীরা হলেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের হত্যা করা হলে নবগঠিত দেশ এগোতে পারবে না। মূলত এটা ছিল নবগঠিত দেশকে মেধাশূন্য ও অচল করার নিকৃষ্ট পদক্ষেপ এবং পাকিস্তানি বর্বরতার নৃশংস পরিকল্পনা।
তাদের এই কাজে সহযোগিতা করতে যারা এগিয়ে এসেছিল, সেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস—তারা এদেশীয় বাঙালি বেইমান, বড় বিশ্বাসঘাতক এবং ইতিহাসের কলঙ্ক। শুধু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা নয়, পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের পাশবিক কামনা-বাসনা মেটাতে অনেক নিরীহ বাঙালি নারীকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। লজ্জায়, অপমানে এসব নারীর অনেকেই জীবনের পরিসমাপ্তি টেনেছেন পরবর্তী সময়ে। কেউ দেশান্তর হয়েছেন, কেউবা সমাজচ্যুত হয়ে আড়ালবাসী হয়েছেন। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই নারীদের নিজের কন্যা বলে পরিচিত করেছেন এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদা হিসেবে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছেন।
৯ মাসব্যাপী যে নির্যাতন-নিপীড়ন নারীদের ওপর চালানো হয়, তার পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদন পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে করা সম্ভব হলে নির্ঘাত তা পাঠ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম শিউরে উঠত। বর্বরতার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠত। আমি এমন একজন বীরাঙ্গনাকে জানতাম, যাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কও করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিক অভাব-অনটন ও সামাজিক তিরস্কারের কারণে বীরাঙ্গনা বোনটিকে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে সরে যেতে হয়েছে। যৌনপল্লি তাঁর ঠিকানা হয়েছে।
এমন বীরাঙ্গনা নারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কিন্তু তাঁদের জন্য কার কী করণীয় ছিল? মফস্বল, গ্রামগঞ্জে বসবাসরত এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। কতজনের খবর কতজনইবা জানেন, জানতে পেরেছেন কিংবা রেখেছেন? যদি এ বিষয়ে সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিসংখ্যান করা হতো, করা হতো গবেষণা, তাহলে অন্তত উত্তর পাওয়া সম্ভব ছিল। আর পাকিস্তানিদের বর্বরতা সম্পর্কে জ্ঞান পরিষ্কার এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হয়তো সমর্থ হতো। মুখে মুখে বা লিখিতভাবে ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছেমতো, নিজের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, অসম্পূর্ণ ও অসংলগ্ন করা হয়েছে। কাজটি করেছে প্রাদেশিক চিন্তাচ্ছন্ন এদেশীয় কিছু ব্যক্তি, যারা ১৯৭১ সালের রাজাকার, আলবদর, আলশামসেরই গোষ্ঠীভুক্ত। আজও তারা সক্রিয় বিভিন্ন কৌশলে ও আবরণে। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ও সর্বজনীন ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ এবং তা প্রচারে আন্তরিকতার, সততার স্বচ্ছ উদ্যোগ থাকলে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, অবমাননা ও অসম্মান প্রদর্শনের দুঃসাহস হতো না কারোর।
এটা তো সত্যি যে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় থাকার পরও মুক্তিযুদ্ধ করেনি এমন অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধার জায়গা হয়েছে রাজাকারের তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা—বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত দুটি অন্যতম বিষয় এবং সর্বোপরি সংবেদনশীল। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা করতেই যদি অসতর্কতা ও অসাবধানতার অজুহাত ওঠে, তাহলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চেতনার মাত্রা কতটা, তা সহজেই অনুমেয়। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চেতনাকে জাগ্রত এবং তা সুরক্ষিত করার দায়িত্ব যাদের, তাদের অবহেলা, উদাসীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা, অপরিপক্বতাকে দায়ী করা দরকার। যে ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধই জানে না, তাকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত, প্রণয়ন কতটা যুক্তিযুক্ত?
৩২ বছরের এক ব্যক্তি বিরক্তি নিয়ে বলছিল, সব সময় মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। কারণ জানতে চাইলে সে জবাবে বলল, মুক্তিযুদ্ধ তো আওয়ামী লীগের। তা কেন হবে? মুক্তিযুদ্ধ তৎকালীন ৭ কোটি মানুষের এবং এখন ১৭ কোটি মানুষের—আমার এমন জবাবে সে হেসে উঠল। পরমুহূর্তে বলল, আওয়ামী লীগ কথায় কথায় বলে, তারা দেশ স্বাধীন করেছে। পাল্টা প্রশ্ন করি তাকে, বিএনপি কেন কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে না? কেন তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের শাস্তির বিষয়ে বিরোধিতা করে? এই দেশ স্বাধীন না হলে তো বিএনপি বলে একটি রাজনৈতিক সংগঠন বা দল তৈরি হতো না, তাই না?
মুক্তিযুদ্ধ এবং তার বিজয় সম্পর্কে সবার জ্ঞান পরিষ্কার থাকতে হবে। এই পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার কাজটি করতে হবে সম্মিলিতভাবে, যেখানে কোনো সংশয়, সন্দেহ বা তর্কবিতর্কের সুযোগ থাকবে না। একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যদি সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাহলে সেই দেশের অস্তিত্বের সংকট যেমন থাকে, তেমনি থাকে জাতির ভেতরে বিভাজন, বিভক্তি। এতে একটা সুবিধাবাদী শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা জাতির ভেতরে রাজনৈতিক বিভাজন টেনে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়। কারও কারও মতে, মনে রাজাকার অথচ পরনে মুক্তিযুদ্ধের পোশাক—এমন ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি। এদের চেনা সহজ নয়, এরা মুখোশধারী।
অরাজকতা, অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতির নেপথ্যে এরাই সক্রিয় থাকে। আবার যারা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিরূপ মনোভাব বা অনীহা প্রকাশ করে থাকে, তারাই রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির তালিকায় শীর্ষে থাকে।
একটা ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করছি। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমার বাবা সাংবাদিক আসফ উদ দৌলা রেজাকে ধরতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস আমাদের বাসায় হামলা চালায়। বাবাকে আঘাত করে। ছোট্ট এক শিশু আমি সেই দিন ওদের পা ধরে আকুতি জানিয়েছিলাম, যেন তারা বাবাকে না নিয়ে যায়। ওরা সেই শিশুকে লাথি মেরেছিল। মায়ের কৌশলগত কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিলে বাবা প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু ওরা আবারও গভীর রাতে বাবার খোঁজে হামলা চালায়। বাবাকে না পেয়ে আশপাশের বাসায়ও হামলা চালায়। দেশ স্বাধীন হলে স্থানীয় কজন মুক্তিযোদ্ধা সেই রাজাকার ও আলবদরদের একজনকে ধরে নিয়ে আসেন বাসায়। ড্রয়িংরুমে তাকে ঘিরে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর সেই ছোট্ট শিশু প্রতিশোধ নিতে জ্বলে ওঠে। বাবার রেজর বক্স থেকে ব্লেড নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে রাজাকারের কাছে পৌঁছে তার সারা শরীরে ব্লেডের আঁচড় দিতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘তুই আমার আব্বাকে মারছিস, আমাকে লাথি দিচ্ছিস, তোকে মেরে ফেলব!’ এই শিশু আমি।
ঘটনা উল্লেখ করার কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আমার চেতনার সঙ্গে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে আছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো অবমাননাকর বক্তব্য, অসম্মানজনক উক্তি সহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি আপসহীন। কিন্তু যার এমন অভিজ্ঞতা নেই কিংবা পরিপূর্ণভাবে জানে না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তার ভেতরে কিন্তু এরূপ চেতনা জাগ্রত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে সবার কাছে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে কোনো বিভাজন, দ্বিমত থাকবে না। শেষ প্রশ্ন—এমন কাজে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকবে তো?
স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
বাংলাদেশের বিজয়ের বয়স ৫২ বছর। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জন। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এবং ২ থেকে ৪ লাখ নিরীহ বাঙালি নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত বলে অনুধাবন করতে পেরেছে, তখনই তারা তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহায়তায় নবগঠিত এই দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে পঙ্গু ও ধ্বংস করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী। এই বুদ্ধিজীবীরা হলেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের হত্যা করা হলে নবগঠিত দেশ এগোতে পারবে না। মূলত এটা ছিল নবগঠিত দেশকে মেধাশূন্য ও অচল করার নিকৃষ্ট পদক্ষেপ এবং পাকিস্তানি বর্বরতার নৃশংস পরিকল্পনা।
তাদের এই কাজে সহযোগিতা করতে যারা এগিয়ে এসেছিল, সেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস—তারা এদেশীয় বাঙালি বেইমান, বড় বিশ্বাসঘাতক এবং ইতিহাসের কলঙ্ক। শুধু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা নয়, পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের পাশবিক কামনা-বাসনা মেটাতে অনেক নিরীহ বাঙালি নারীকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। লজ্জায়, অপমানে এসব নারীর অনেকেই জীবনের পরিসমাপ্তি টেনেছেন পরবর্তী সময়ে। কেউ দেশান্তর হয়েছেন, কেউবা সমাজচ্যুত হয়ে আড়ালবাসী হয়েছেন। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই নারীদের নিজের কন্যা বলে পরিচিত করেছেন এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদা হিসেবে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছেন।
৯ মাসব্যাপী যে নির্যাতন-নিপীড়ন নারীদের ওপর চালানো হয়, তার পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদন পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে করা সম্ভব হলে নির্ঘাত তা পাঠ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম শিউরে উঠত। বর্বরতার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠত। আমি এমন একজন বীরাঙ্গনাকে জানতাম, যাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কও করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিক অভাব-অনটন ও সামাজিক তিরস্কারের কারণে বীরাঙ্গনা বোনটিকে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে সরে যেতে হয়েছে। যৌনপল্লি তাঁর ঠিকানা হয়েছে।
এমন বীরাঙ্গনা নারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কিন্তু তাঁদের জন্য কার কী করণীয় ছিল? মফস্বল, গ্রামগঞ্জে বসবাসরত এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। কতজনের খবর কতজনইবা জানেন, জানতে পেরেছেন কিংবা রেখেছেন? যদি এ বিষয়ে সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিসংখ্যান করা হতো, করা হতো গবেষণা, তাহলে অন্তত উত্তর পাওয়া সম্ভব ছিল। আর পাকিস্তানিদের বর্বরতা সম্পর্কে জ্ঞান পরিষ্কার এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হয়তো সমর্থ হতো। মুখে মুখে বা লিখিতভাবে ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছেমতো, নিজের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, অসম্পূর্ণ ও অসংলগ্ন করা হয়েছে। কাজটি করেছে প্রাদেশিক চিন্তাচ্ছন্ন এদেশীয় কিছু ব্যক্তি, যারা ১৯৭১ সালের রাজাকার, আলবদর, আলশামসেরই গোষ্ঠীভুক্ত। আজও তারা সক্রিয় বিভিন্ন কৌশলে ও আবরণে। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ও সর্বজনীন ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ এবং তা প্রচারে আন্তরিকতার, সততার স্বচ্ছ উদ্যোগ থাকলে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, অবমাননা ও অসম্মান প্রদর্শনের দুঃসাহস হতো না কারোর।
এটা তো সত্যি যে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় থাকার পরও মুক্তিযুদ্ধ করেনি এমন অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধার জায়গা হয়েছে রাজাকারের তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা—বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত দুটি অন্যতম বিষয় এবং সর্বোপরি সংবেদনশীল। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা করতেই যদি অসতর্কতা ও অসাবধানতার অজুহাত ওঠে, তাহলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চেতনার মাত্রা কতটা, তা সহজেই অনুমেয়। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চেতনাকে জাগ্রত এবং তা সুরক্ষিত করার দায়িত্ব যাদের, তাদের অবহেলা, উদাসীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা, অপরিপক্বতাকে দায়ী করা দরকার। যে ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধই জানে না, তাকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত, প্রণয়ন কতটা যুক্তিযুক্ত?
৩২ বছরের এক ব্যক্তি বিরক্তি নিয়ে বলছিল, সব সময় মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। কারণ জানতে চাইলে সে জবাবে বলল, মুক্তিযুদ্ধ তো আওয়ামী লীগের। তা কেন হবে? মুক্তিযুদ্ধ তৎকালীন ৭ কোটি মানুষের এবং এখন ১৭ কোটি মানুষের—আমার এমন জবাবে সে হেসে উঠল। পরমুহূর্তে বলল, আওয়ামী লীগ কথায় কথায় বলে, তারা দেশ স্বাধীন করেছে। পাল্টা প্রশ্ন করি তাকে, বিএনপি কেন কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে না? কেন তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের শাস্তির বিষয়ে বিরোধিতা করে? এই দেশ স্বাধীন না হলে তো বিএনপি বলে একটি রাজনৈতিক সংগঠন বা দল তৈরি হতো না, তাই না?
মুক্তিযুদ্ধ এবং তার বিজয় সম্পর্কে সবার জ্ঞান পরিষ্কার থাকতে হবে। এই পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার কাজটি করতে হবে সম্মিলিতভাবে, যেখানে কোনো সংশয়, সন্দেহ বা তর্কবিতর্কের সুযোগ থাকবে না। একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যদি সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাহলে সেই দেশের অস্তিত্বের সংকট যেমন থাকে, তেমনি থাকে জাতির ভেতরে বিভাজন, বিভক্তি। এতে একটা সুবিধাবাদী শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা জাতির ভেতরে রাজনৈতিক বিভাজন টেনে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়। কারও কারও মতে, মনে রাজাকার অথচ পরনে মুক্তিযুদ্ধের পোশাক—এমন ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি। এদের চেনা সহজ নয়, এরা মুখোশধারী।
অরাজকতা, অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতির নেপথ্যে এরাই সক্রিয় থাকে। আবার যারা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিরূপ মনোভাব বা অনীহা প্রকাশ করে থাকে, তারাই রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির তালিকায় শীর্ষে থাকে।
একটা ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করছি। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমার বাবা সাংবাদিক আসফ উদ দৌলা রেজাকে ধরতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস আমাদের বাসায় হামলা চালায়। বাবাকে আঘাত করে। ছোট্ট এক শিশু আমি সেই দিন ওদের পা ধরে আকুতি জানিয়েছিলাম, যেন তারা বাবাকে না নিয়ে যায়। ওরা সেই শিশুকে লাথি মেরেছিল। মায়ের কৌশলগত কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিলে বাবা প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু ওরা আবারও গভীর রাতে বাবার খোঁজে হামলা চালায়। বাবাকে না পেয়ে আশপাশের বাসায়ও হামলা চালায়। দেশ স্বাধীন হলে স্থানীয় কজন মুক্তিযোদ্ধা সেই রাজাকার ও আলবদরদের একজনকে ধরে নিয়ে আসেন বাসায়। ড্রয়িংরুমে তাকে ঘিরে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর সেই ছোট্ট শিশু প্রতিশোধ নিতে জ্বলে ওঠে। বাবার রেজর বক্স থেকে ব্লেড নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে রাজাকারের কাছে পৌঁছে তার সারা শরীরে ব্লেডের আঁচড় দিতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘তুই আমার আব্বাকে মারছিস, আমাকে লাথি দিচ্ছিস, তোকে মেরে ফেলব!’ এই শিশু আমি।
ঘটনা উল্লেখ করার কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আমার চেতনার সঙ্গে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে আছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো অবমাননাকর বক্তব্য, অসম্মানজনক উক্তি সহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি আপসহীন। কিন্তু যার এমন অভিজ্ঞতা নেই কিংবা পরিপূর্ণভাবে জানে না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তার ভেতরে কিন্তু এরূপ চেতনা জাগ্রত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে সবার কাছে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে কোনো বিভাজন, দ্বিমত থাকবে না। শেষ প্রশ্ন—এমন কাজে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকবে তো?
স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩৫ মিনিট আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪১ মিনিট আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
১ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ ঘণ্টা আগে