আবু তাহের খান
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা তাঁদের নেই। এ ধরনের দুষ্টচক্র বা সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব এককভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের না হলেও মূল দায়িত্ব অবশ্যই তাদের। কিন্তু তা করতে না পারলেও টিপু মুনশি যে বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বা সত্যকে লুকাতে চাননি, তার জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। আর নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী তাঁর পূর্বসূরির মতো এ বিষয়ে অতটা অকপট না হলেও তিনিও পরোক্ষে একাধিকবার এই বাস্তবতাকেই মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন। তো সেই একই ধারাবাহিকতায় ২ জুলাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদও বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই।
এখন কথা হচ্ছে, উল্লিখিত সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের না-ই থাকে, তাহলে উক্ত মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বাস্তব কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর সেই প্রশ্নের মুখে তখন অনিবার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় উল্লিখিত সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেন ও কীভাবে হারিয়ে ফেলল, তা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান করে দেখা। অবশ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে এর কারণ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আরও আগে থেকেই অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বহুলাংশে সুনির্দিষ্ট।
বহুল আলোচিত এবং প্রায় সর্বজনজ্ঞাত তথ্য এই যে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৬৭ শতাংশ সদস্যই ব্যবসায়ী এবং ৯০ শতাংশই কোটিপতি। তদুপরি জাতীয় সংসদের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও স্তরে এখন ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য ও আধিপত্য, বিশেষত নীতিনৈতিকতাবিহীন অসৎ ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড তথা বাজার পরিস্থিতি যে অসৎ ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং সেই নিয়ন্ত্রণ গড়া বা ভাঙার ক্ষমতা যেহেতু এখন তাঁদেরই হাতে, সেহেতু তাঁরা যে এটিকে না ভেঙে বরং একে মুনাফা অর্জনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করবেন, তাতেও বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর সেই ‘স্বাভাবিক ও বিস্ময়বিহীন’ পরিস্থিতিই এখন দেশে বিরাজ করছে। ফলে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই—এ কথা না বলে বরং বলা প্রয়োজন যে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা এই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যবসায়ীদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ভাঙা বা না ভাঙার বিষয়টি এখন পুরোপুরিই ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেখানে তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের প্রতিনিধি মাত্র।
এরূপ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, বাজার সিন্ডিকেট কি তাহলে তার চলমান প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে এভাবে টিকেই থাকবে? জবাব হচ্ছে: হ্যাঁ, জবাবদিহিপূর্ণ বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান না ঘটা পর্যন্ত তা শুধু টিকেই থাকবে না, দিনে দিনে আরও জোরদার হবে। এখন তো তারা অন্তত এই বলে ক্রেতাকে আশ্বস্ত করে যে, দাম যা-ই হোক, বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে তারা হয়তো পণ্য মজুত থাকা সত্ত্বেও বলবে যে বাজারে পণ্যের কোনো সরবরাহই নেই। ফলে তখন পণ্য কিনতে হলে তা মজুতদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করেই কিনতে হবে।
আর মজার ব্যাপার হলো, দেশের ক্রেতাসাধারণ সিন্ডিকেট নির্ধারিত উক্ত অন্যায় ও অন্যায্য সরবরাহব্যবস্থা ও মূল্যকাঠামোতেই সন্তুষ্ট। আর এই অন্যায্য বাজারব্যবস্থার ব্যাপারে তাদের যত কষ্ট ও অসন্তুষ্টিই থাকুক না কেন, এ ব্যাপারে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের মতো কোনো মানসিকতাই এখন আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। অথচ মাত্র পাঁচ দশক আগে ১৯৬৯-৭০ সময়কালে তাদের চেয়ে কম পড়াশোনা জানা ও অধিকতর নিরীহ পূর্বসূরিরা মাথায় গামছা ও লাল কাপড় বেঁধে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সমস্বরে স্লোগান দিয়েছে, ‘চাল-ডাল-নুনের দাম, কমাতে হবে, কমাতে হবে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় বৈষম্য, বঞ্চনা ও অন্যায্যতার মাত্রা সেই পরাধীন সময়ের তুলনায় এই স্বাধীন দেশে আরও অধিক মাত্রায় বাড়লেও এ নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের স্পৃহা বাড়ার পরিবর্তে তা কি ক্রমান্বয়ে আরও শূন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে? এ বিষয়ে প্রতিবাদী লেখক ও ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল—বাঙালির হাজার বছরের প্রতিবাদী চেতনা কি তবে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে? পরম আশাবাদী এই লেখক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সেলিনা হোসেন যতই আশাবাদী হোন না কেন, বিরাজমান বাস্তবতা কি বলে যে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার প্রতিবাদী চেতনা এখনো সেই আগের ধারাতেই অবশিষ্ট আছে? মোটেও না। বরং সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বৃত্তি ও আপসকামিতাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালি সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য—তা সেটি রাজনীতি, আমলাতন্ত্র কিংবা সামাজিক মধ্যবিত্ত ইত্যাদি যেকোনো শ্রেণি ও স্তরেই হোক না কেন।
তবে মানতেই হবে যে, এ দেশের নিম্নবিত্ত কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সুবিধাবাদিতার ধারা অন্যান্য শ্রেণি-পেশার তুলনায় এখনো অতটা প্রকট নয়। তবে সমস্যা হচ্ছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় তারা এখন অনেক বেশি অনুদ্যমী ও অসংগঠিত। আর এর পেছনের মূল কারণ সম্ভবত এই যে, যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি অতীতে কৃষক ও শ্রমিকদের নেপথ্যে থেকে সংগঠিত করার কাজে ভূমিকা রেখেছে, তারা এখন পলায়নপরতা ও সুবিধাবাদিতার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন যে, ঐতিহ্যিক ধারার সুবিধাবাদী টাউটরাও এখন তাদের দেখে লজ্জা পায়।
তো এ অবস্থায় বলাই যেতে পারে যে, বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহের বাস্তবায়ন করা। সিন্ডিকেট সদস্যরা যখন কোনো বিশেষ বিশেষ পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, খুচরা মূল্য বৃদ্ধিকরণ কিংবা নগদ ভর্তুকির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবেন, বর্তমান ধারায় তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে এ-জাতীয় বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে সেটি সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাকে প্রদান করা, তা সেটি রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে যাক বা না যাক।
বস্তুত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এখন নিয়ন্ত্রণ করছে এমন কতিপয় অসাধু ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যাদের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত কুক্ষিগতকরণ, ব্যাংক লুটপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদি প্রায় সব অভিযোগই রয়েছে। আর এসব তাঁরা করছেন কখনো দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে, আবার কখনো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক তদবির ও সমর্থন নিয়ে। জাতীয় সংসদকে অনেকেই যেমন এখন ব্যবসায়ী ও কোটিপতিদের ক্লাব বলে অভিহিত করেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এখন তেমনিভাবে বাজার সিন্ডিকেট সদস্যের একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের বিনোদন ক্লাব। ধারণা করা যায়, এই ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তা সিন্ডিকেট সদস্যদের পরম আরাধ্য লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা এখন কখনো কখনো অর্থ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতিপথ এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই এখন মূল নিয়ামক প্রতিষ্ঠান। তো সেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই যদি পুরোপুরিভাবে বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে তা যে শুধু পণ্যমূল্যকেই প্রভাবিত করবে তা নয়, একই সঙ্গে তা রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনযাপনকেও অধিকতর কঠিন ও দুর্বিষহ করে তুলবে। এবং পণ্যমূল্য ও জীবন-জীবিকা নিয়ে বস্তুত সে ধরনের এক কষ্টকর ও দুর্বিষহ সময়ই এখন এ দেশের সাধারণ মানুষ যাপন করছে, যা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে দলমত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উল্লিখিত সিন্ডিকেট ও অনুরূপ সব অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানো।
কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয় মোটেও। আর সেই কঠিন কাজটি কেবল তখনই সম্ভব হতে পারে, যখন সেই দায়িত্ব গ্রহণ করবে এ দেশের সাহসী তরুণেরা। বস্তুত ওই প্রতিবাদী তরুণেরাই আমাদের শেষ ভরসা, যাদের সুবিধাবাদিতা ও স্বার্থপরতা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা তাঁদের নেই। এ ধরনের দুষ্টচক্র বা সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব এককভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের না হলেও মূল দায়িত্ব অবশ্যই তাদের। কিন্তু তা করতে না পারলেও টিপু মুনশি যে বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বা সত্যকে লুকাতে চাননি, তার জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। আর নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী তাঁর পূর্বসূরির মতো এ বিষয়ে অতটা অকপট না হলেও তিনিও পরোক্ষে একাধিকবার এই বাস্তবতাকেই মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন। তো সেই একই ধারাবাহিকতায় ২ জুলাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদও বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই।
এখন কথা হচ্ছে, উল্লিখিত সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের না-ই থাকে, তাহলে উক্ত মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বাস্তব কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর সেই প্রশ্নের মুখে তখন অনিবার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় উল্লিখিত সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেন ও কীভাবে হারিয়ে ফেলল, তা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান করে দেখা। অবশ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে এর কারণ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আরও আগে থেকেই অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বহুলাংশে সুনির্দিষ্ট।
বহুল আলোচিত এবং প্রায় সর্বজনজ্ঞাত তথ্য এই যে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৬৭ শতাংশ সদস্যই ব্যবসায়ী এবং ৯০ শতাংশই কোটিপতি। তদুপরি জাতীয় সংসদের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও স্তরে এখন ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য ও আধিপত্য, বিশেষত নীতিনৈতিকতাবিহীন অসৎ ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড তথা বাজার পরিস্থিতি যে অসৎ ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং সেই নিয়ন্ত্রণ গড়া বা ভাঙার ক্ষমতা যেহেতু এখন তাঁদেরই হাতে, সেহেতু তাঁরা যে এটিকে না ভেঙে বরং একে মুনাফা অর্জনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করবেন, তাতেও বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর সেই ‘স্বাভাবিক ও বিস্ময়বিহীন’ পরিস্থিতিই এখন দেশে বিরাজ করছে। ফলে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই—এ কথা না বলে বরং বলা প্রয়োজন যে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা এই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যবসায়ীদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ভাঙা বা না ভাঙার বিষয়টি এখন পুরোপুরিই ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেখানে তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের প্রতিনিধি মাত্র।
এরূপ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, বাজার সিন্ডিকেট কি তাহলে তার চলমান প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে এভাবে টিকেই থাকবে? জবাব হচ্ছে: হ্যাঁ, জবাবদিহিপূর্ণ বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান না ঘটা পর্যন্ত তা শুধু টিকেই থাকবে না, দিনে দিনে আরও জোরদার হবে। এখন তো তারা অন্তত এই বলে ক্রেতাকে আশ্বস্ত করে যে, দাম যা-ই হোক, বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে তারা হয়তো পণ্য মজুত থাকা সত্ত্বেও বলবে যে বাজারে পণ্যের কোনো সরবরাহই নেই। ফলে তখন পণ্য কিনতে হলে তা মজুতদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করেই কিনতে হবে।
আর মজার ব্যাপার হলো, দেশের ক্রেতাসাধারণ সিন্ডিকেট নির্ধারিত উক্ত অন্যায় ও অন্যায্য সরবরাহব্যবস্থা ও মূল্যকাঠামোতেই সন্তুষ্ট। আর এই অন্যায্য বাজারব্যবস্থার ব্যাপারে তাদের যত কষ্ট ও অসন্তুষ্টিই থাকুক না কেন, এ ব্যাপারে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের মতো কোনো মানসিকতাই এখন আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। অথচ মাত্র পাঁচ দশক আগে ১৯৬৯-৭০ সময়কালে তাদের চেয়ে কম পড়াশোনা জানা ও অধিকতর নিরীহ পূর্বসূরিরা মাথায় গামছা ও লাল কাপড় বেঁধে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সমস্বরে স্লোগান দিয়েছে, ‘চাল-ডাল-নুনের দাম, কমাতে হবে, কমাতে হবে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় বৈষম্য, বঞ্চনা ও অন্যায্যতার মাত্রা সেই পরাধীন সময়ের তুলনায় এই স্বাধীন দেশে আরও অধিক মাত্রায় বাড়লেও এ নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের স্পৃহা বাড়ার পরিবর্তে তা কি ক্রমান্বয়ে আরও শূন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে? এ বিষয়ে প্রতিবাদী লেখক ও ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল—বাঙালির হাজার বছরের প্রতিবাদী চেতনা কি তবে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে? পরম আশাবাদী এই লেখক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সেলিনা হোসেন যতই আশাবাদী হোন না কেন, বিরাজমান বাস্তবতা কি বলে যে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার প্রতিবাদী চেতনা এখনো সেই আগের ধারাতেই অবশিষ্ট আছে? মোটেও না। বরং সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বৃত্তি ও আপসকামিতাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালি সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য—তা সেটি রাজনীতি, আমলাতন্ত্র কিংবা সামাজিক মধ্যবিত্ত ইত্যাদি যেকোনো শ্রেণি ও স্তরেই হোক না কেন।
তবে মানতেই হবে যে, এ দেশের নিম্নবিত্ত কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সুবিধাবাদিতার ধারা অন্যান্য শ্রেণি-পেশার তুলনায় এখনো অতটা প্রকট নয়। তবে সমস্যা হচ্ছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় তারা এখন অনেক বেশি অনুদ্যমী ও অসংগঠিত। আর এর পেছনের মূল কারণ সম্ভবত এই যে, যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি অতীতে কৃষক ও শ্রমিকদের নেপথ্যে থেকে সংগঠিত করার কাজে ভূমিকা রেখেছে, তারা এখন পলায়নপরতা ও সুবিধাবাদিতার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন যে, ঐতিহ্যিক ধারার সুবিধাবাদী টাউটরাও এখন তাদের দেখে লজ্জা পায়।
তো এ অবস্থায় বলাই যেতে পারে যে, বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহের বাস্তবায়ন করা। সিন্ডিকেট সদস্যরা যখন কোনো বিশেষ বিশেষ পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, খুচরা মূল্য বৃদ্ধিকরণ কিংবা নগদ ভর্তুকির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবেন, বর্তমান ধারায় তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে এ-জাতীয় বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে সেটি সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাকে প্রদান করা, তা সেটি রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে যাক বা না যাক।
বস্তুত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এখন নিয়ন্ত্রণ করছে এমন কতিপয় অসাধু ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যাদের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত কুক্ষিগতকরণ, ব্যাংক লুটপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদি প্রায় সব অভিযোগই রয়েছে। আর এসব তাঁরা করছেন কখনো দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে, আবার কখনো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক তদবির ও সমর্থন নিয়ে। জাতীয় সংসদকে অনেকেই যেমন এখন ব্যবসায়ী ও কোটিপতিদের ক্লাব বলে অভিহিত করেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এখন তেমনিভাবে বাজার সিন্ডিকেট সদস্যের একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের বিনোদন ক্লাব। ধারণা করা যায়, এই ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তা সিন্ডিকেট সদস্যদের পরম আরাধ্য লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা এখন কখনো কখনো অর্থ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতিপথ এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই এখন মূল নিয়ামক প্রতিষ্ঠান। তো সেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই যদি পুরোপুরিভাবে বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে তা যে শুধু পণ্যমূল্যকেই প্রভাবিত করবে তা নয়, একই সঙ্গে তা রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনযাপনকেও অধিকতর কঠিন ও দুর্বিষহ করে তুলবে। এবং পণ্যমূল্য ও জীবন-জীবিকা নিয়ে বস্তুত সে ধরনের এক কষ্টকর ও দুর্বিষহ সময়ই এখন এ দেশের সাধারণ মানুষ যাপন করছে, যা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে দলমত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উল্লিখিত সিন্ডিকেট ও অনুরূপ সব অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানো।
কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয় মোটেও। আর সেই কঠিন কাজটি কেবল তখনই সম্ভব হতে পারে, যখন সেই দায়িত্ব গ্রহণ করবে এ দেশের সাহসী তরুণেরা। বস্তুত ওই প্রতিবাদী তরুণেরাই আমাদের শেষ ভরসা, যাদের সুবিধাবাদিতা ও স্বার্থপরতা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে