১১ জ্যৈষ্ঠ এলে একটামাত্র অবয়ব ভেসে ওঠে চোখে। আনন্দ-বেদনার এক মিলিত সংগীত যেন স্রোতোধারার মতো বয়ে চলে বুকজুড়ে। ‘অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে’ জন্মগ্রহণ করেছেন বলে যাঁর নিঃশঙ্ক দাবি, সেই নজরুল এসে সেদিন যেন বেহালার ছড়ে হাত রাখেন।
আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এই দিনটিতে তাঁর জন্ম। আমাদের জাতীয় কবি তিনি। ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতেছিলেন। জীবনপ্রবাহকে থোড়াই কেয়ার করে ভেসে বেড়িয়েছেন নিজের মতো। স্থির হয়ে যাওয়া অসুখের আগপর্যন্ত এক মহত্তম গতিশীল জীবনযাপন করে গেছেন।
নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক বাঙালির দেখা মিলেছে কম। আপাদমস্তক মানুষ হিসেবেই ছিল তাঁর পরিচয়। লিখেছেন হামদ-নাত, লিখেছেন শ্যামাসংগীত। কোনো রকম ভয় না পেয়ে করে গেছেন উপনিবেশবাদের সমালোচনা। মৌলবাদকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে ছেড়েছেন। কাজ করেছেন সংবাদপত্রে, লিখেছেন জ্বালাময়ী সম্পাদকীয়। খেটেছেন জেল। বেতারে কাজ করে কতশত গানের জন্ম দিয়েছেন, তার হিসাব মেলানো ভার। রাজনীতির মাঠেও সক্রিয় থেকেছেন। প্রেমিক হিসেবেও বাঁধনহারা জীবনকে কাছে টেনে নিয়েছেন।
গ্রামীণজীবন লেপ্টে আছে নজরুলের শরীরে। বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলের কবিতা-গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিকে তৈরি লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি বাল্যকালেই। এখানেই পরিচয় হয়েছিল হিন্দু পুরাণের সঙ্গে। আর তার আগেই মক্তব, মাজার আর মসজিদজীবনের সঙ্গে পরিচিত হন। ফলে নিজেকে মুক্তমনের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পেরেছিলেন।
বিদ্রোহী কবি বলি আমরা তাঁকে। দুঃখের কবি বা প্রেমের কবি হিসেবেও তাঁকে মূল্যায়ন করা যায়। তাঁর গান? কথায়-সুরে-ছন্দে যে বৈচিত্র্য রয়েছে নজরুলে, তা বিস্মিত করে সংগীতপ্রেমী মানুষকে। আর তাঁর কবিতা ও গানে বরাভয় হয়ে জেগে ওঠে সংগ্রামী মানুষ। রাজনৈতিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিকভাবে নজরুল হয়ে ওঠেন মুক্তির কারিগর। তাঁর ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু’, ‘জাগো অনশন-বন্দী ওঠ রে যত’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’, ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমার’ ইত্যাদি গান যখন ভেসে আসত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে, তখন বীর মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল ফিরে পেতেন।
যে কয় বছর সৃষ্টিশীল ছিলেন, লিখে গেছেন দাপটের সঙ্গে। চা আর পান দিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে নজরুলের দিন-রাত এক হয়ে যেত। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করত গুণগ্রাহীরা।
রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় ৪০ বছর। নজরুল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। বাঁধন সেনগুপ্ত লিখছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত পুস্তক…কাজীর কাছে ছিল।’ সামরিক বাহিনী থেকে ফিরে আসার পর নজরুল যখন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বোর্ডিং হাউসে কয়েক দিন থেকে কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে জায়গা করে নেন, তখন তাঁর গাঁটরি-বোঁচকায় অন্য বইপত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিও পাওয়া গিয়েছিল। এ কথা জানাচ্ছেন মুজফফর আহমদ। আর জেলে থাকা নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত নাটকটি উৎসর্গ করে জানিয়ে গেছেন, এই নবীন কবির প্রতি তাঁর কতটা সমর্থন রয়েছে। ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল তাৎক্ষণিকভাবে লেখেন ‘রবিহারা; ও ‘সালাম অস্তরবি’ নামে কবিতা এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ নামে গান।
প্রায় ৩৪ বছর নজরুল ছিলেন বাক্হারা। কিন্তু সে সময়টিতেও তিনি অনুরণিত হন বাঙালির মনে। আজও, মৃত্যুর এতকাল পরেও সংগ্রামে, ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে তিনি জাগ্রত। আর বেদনার ঋষি হয়ে তাঁর গান আর বিচ্ছেদের কবিতাগুলো স্থিত হয়েছে কাব্যজগতে। বিদ্রোহ আর সাম্যবাদের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা এখনো অনুপ্রাণিত করে মুক্তিকামী মানুষকে।
তাই ১১ জ্যৈষ্ঠকে বরণ করে নিতে হয় একজন অনবদ্য মানুষের জন্মতিথি হিসেবেই, যাঁর মৃত্যু নেই।