সেলিম জাহান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী গেল দুই বছর আগে। এ বছরের ২৬ মার্চ ৫২ বছর পূর্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার। ১৯৭১ সালে নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সেই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে। ২০২৩ সালে এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষ করে আর্থসামাজিক অঙ্গনে। বায়ান্ন বছর আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত বায়ান্ন বছরে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে। বায়ান্ন নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ–৩৫ বিলিয়ন থেকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৬৪ ডলারে।
মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার আজ মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ সেখানে বাস করে। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫তে হ্রাস পেয়েছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি বিস্ময়কর। আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৩ বছর, ভারতে ৭০ বছর, পাকিস্তানে যেখানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসিত হয়েছে। জানি, অন্তরায় অনেক আছে, কিন্তু তবু দেশের ভেতরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বারবার উন্নয়ন আলোচনায় উঠে এসেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে বহু খাতে নারীরা অগ্রণী হিসেবে কাজ করছেন। সামান্য মুঠোফোনের ওপর ভরসা করে তাঁরা তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছেন। পোশাকশিল্পে মূলত তাঁদের অবদান থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগের উৎপত্তি। প্রশাসনের নানান স্তর এবং পর্যায়েও তাঁদের সরব উপস্থিতি। সামাজিক অঙ্গনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান পুরুষের অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করেছে। প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তাঁরা যেসব নতুন নতুন পদ্ধতি বা জ্ঞান সম্প্রসারিতবিষয়ক কাজ করছেন, তা দৃষ্টান্তমূলক। নানান ক্ষেত্রে নব্য জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজের দ্বারা আমাদের তরুণ সমাজ দেশ ও সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। এই অর্জন উদ্যাপিত হওয়া প্রয়োজন।
দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বিস্তার ও বেসরকারি সংস্থার বিস্তৃতি আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মজবুত করেছে এবং বহু ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানান বিষয়ে তারা জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ—এ রকমের একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ। সাধারণ মানুষের কাছে নানান রকমের সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে বেসরকারি সাহায্য সংস্থার ভূমিকা লক্ষণীয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে, নানান স্বাস্থ্যসুবিধা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপেয় জলের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাদের নানান কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তিনটি অর্জনের জন্য আমি গর্ববোধ করি। এক. জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশিদের ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাত কেন্দ্রে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী কর্মকর্তারা যে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা সবার কাছে নন্দিত হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও তাঁরা স্থানীয় জনগণের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন।
দক্ষিণ সুদানের বুভুক্ষু জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনী খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছে। হাইতিতে কলেরার প্রকোপ এড়ানোর জন্য আমাদের সেনারা বহুদূর থেকে শুদ্ধ জল বহন করে এনেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। নানান দেশ নানানভাবে এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। সিয়েরা লিয়ন বাংলাকে তার দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে আমাদের সেনারা চরম আত্মত্যাগও স্বীকার করেছেন। চিরনিদ্রায় তাঁরা শায়িত আছেন নানান ভূমিতে। স্থানীয় জনগণ পরম যত্নে, পরম মমতায় এই সব বীরের শেষ শয্যা তৈরি করে দিয়েছে।
দুই. মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকেরা শুধু কাজকর্ম করেন না, শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন না, তাঁরা বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতও বটে। এসব মানুষ কঠোর পরিশ্রম, কর্মকুশলতা ও সততার দ্বারা তাঁদের দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। এ ব্যাপারটি মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ঘটতে দেখেছি। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিপণিতে বাঙালি কর্মীদের চাহিদা অনেক বেশি, তাঁদের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার কারণে। এ বিষয়গুলো শুধু ব্যক্তিগত, পেশাগত কর্মোৎকর্ষতাকে তুলে ধরে না, এসব মাত্রিকতা দেশকেও তুলে ধরে। এই অর্জনের তুল্য কি কিছু আছে?
তিন. কূটনৈতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ নানান প্রয়াসে ও গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব দিয়েছে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক আন্দোলন ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রয়াসে বাংলাদেশ নানান সময়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতিসম্প্রতি কোভিডের টিকা আবিষ্কারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা দলকেও অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু এত সব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা—ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ, যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫, সেখানে সিলেটে সেই হার হচ্ছে ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষেরা সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্র্যের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপরে। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না। আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমার বৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি—তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ন, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরে জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্রকে মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আজ বাংলাদেশ এই মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমনতর ধুয়া তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি, গণতন্ত্রের জন্য যে নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র। সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। অতিসম্প্রতি দুর্গাপূজার সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে যে ন্যক্কারজনক হামলা ও অত্যাচার হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, আমরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়েছি।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। তাদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতাগুলো জয় করতে হলে সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই সবগুলোর সমাধানও করতে পারব না।
কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আমরা এখনই চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের। অপশক্তির নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে।
মনে রাখা দরকার, ‘এ দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শুধবার ভার’। আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর, সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে; পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের পথে রওনা হতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে।’ সেই সুরে আমি বলি, ‘আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিক্দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।’
সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী গেল দুই বছর আগে। এ বছরের ২৬ মার্চ ৫২ বছর পূর্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার। ১৯৭১ সালে নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সেই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে। ২০২৩ সালে এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষ করে আর্থসামাজিক অঙ্গনে। বায়ান্ন বছর আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত বায়ান্ন বছরে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে। বায়ান্ন নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ–৩৫ বিলিয়ন থেকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৬৪ ডলারে।
মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার আজ মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ সেখানে বাস করে। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫তে হ্রাস পেয়েছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি বিস্ময়কর। আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৩ বছর, ভারতে ৭০ বছর, পাকিস্তানে যেখানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসিত হয়েছে। জানি, অন্তরায় অনেক আছে, কিন্তু তবু দেশের ভেতরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বারবার উন্নয়ন আলোচনায় উঠে এসেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে বহু খাতে নারীরা অগ্রণী হিসেবে কাজ করছেন। সামান্য মুঠোফোনের ওপর ভরসা করে তাঁরা তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছেন। পোশাকশিল্পে মূলত তাঁদের অবদান থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগের উৎপত্তি। প্রশাসনের নানান স্তর এবং পর্যায়েও তাঁদের সরব উপস্থিতি। সামাজিক অঙ্গনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান পুরুষের অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করেছে। প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তাঁরা যেসব নতুন নতুন পদ্ধতি বা জ্ঞান সম্প্রসারিতবিষয়ক কাজ করছেন, তা দৃষ্টান্তমূলক। নানান ক্ষেত্রে নব্য জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজের দ্বারা আমাদের তরুণ সমাজ দেশ ও সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। এই অর্জন উদ্যাপিত হওয়া প্রয়োজন।
দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বিস্তার ও বেসরকারি সংস্থার বিস্তৃতি আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মজবুত করেছে এবং বহু ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানান বিষয়ে তারা জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ—এ রকমের একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ। সাধারণ মানুষের কাছে নানান রকমের সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে বেসরকারি সাহায্য সংস্থার ভূমিকা লক্ষণীয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে, নানান স্বাস্থ্যসুবিধা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপেয় জলের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাদের নানান কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তিনটি অর্জনের জন্য আমি গর্ববোধ করি। এক. জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশিদের ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাত কেন্দ্রে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী কর্মকর্তারা যে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা সবার কাছে নন্দিত হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও তাঁরা স্থানীয় জনগণের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন।
দক্ষিণ সুদানের বুভুক্ষু জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনী খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছে। হাইতিতে কলেরার প্রকোপ এড়ানোর জন্য আমাদের সেনারা বহুদূর থেকে শুদ্ধ জল বহন করে এনেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। নানান দেশ নানানভাবে এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। সিয়েরা লিয়ন বাংলাকে তার দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে আমাদের সেনারা চরম আত্মত্যাগও স্বীকার করেছেন। চিরনিদ্রায় তাঁরা শায়িত আছেন নানান ভূমিতে। স্থানীয় জনগণ পরম যত্নে, পরম মমতায় এই সব বীরের শেষ শয্যা তৈরি করে দিয়েছে।
দুই. মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকেরা শুধু কাজকর্ম করেন না, শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন না, তাঁরা বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতও বটে। এসব মানুষ কঠোর পরিশ্রম, কর্মকুশলতা ও সততার দ্বারা তাঁদের দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। এ ব্যাপারটি মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ঘটতে দেখেছি। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিপণিতে বাঙালি কর্মীদের চাহিদা অনেক বেশি, তাঁদের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার কারণে। এ বিষয়গুলো শুধু ব্যক্তিগত, পেশাগত কর্মোৎকর্ষতাকে তুলে ধরে না, এসব মাত্রিকতা দেশকেও তুলে ধরে। এই অর্জনের তুল্য কি কিছু আছে?
তিন. কূটনৈতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ নানান প্রয়াসে ও গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব দিয়েছে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক আন্দোলন ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রয়াসে বাংলাদেশ নানান সময়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতিসম্প্রতি কোভিডের টিকা আবিষ্কারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা দলকেও অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু এত সব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা—ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ, যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫, সেখানে সিলেটে সেই হার হচ্ছে ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষেরা সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্র্যের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপরে। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না। আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমার বৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি—তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ন, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরে জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্রকে মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আজ বাংলাদেশ এই মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমনতর ধুয়া তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি, গণতন্ত্রের জন্য যে নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র। সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। অতিসম্প্রতি দুর্গাপূজার সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে যে ন্যক্কারজনক হামলা ও অত্যাচার হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, আমরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়েছি।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। তাদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতাগুলো জয় করতে হলে সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই সবগুলোর সমাধানও করতে পারব না।
কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আমরা এখনই চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের। অপশক্তির নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে।
মনে রাখা দরকার, ‘এ দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শুধবার ভার’। আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর, সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে; পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের পথে রওনা হতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে।’ সেই সুরে আমি বলি, ‘আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিক্দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।’
সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে