মামুনুর রশীদ
ডিসেম্বর আমাদের একটি আনন্দের মাস, আন্দোলন-সংগ্রামের মাস এবং সর্বোপরি বিজয়ের মাস। ছোটবেলায় আমাদের ফাইনাল পরীক্ষাটা হতো ডিসেম্বর মাসে, তারপর মুক্তি। ডিসেম্বরের প্রায় অর্ধ মাসের পরে জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হতো। সেটিও আনন্দের।
প্রমোশন পেয়ে আমাদের হাতে আসত নতুন বই। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে আমাদের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো। আমরা অপেক্ষা করতাম পরবর্তী ডিসেম্বরের জন্য। এই সময়ে বাংলার ফসলের মাঠে নতুন ধানের গন্ধে শুরু হতো পিঠা-পুলির আয়োজন। নানা ধরনের লোকসংগীতের সময় ছিল এটা। যাত্রা পালাগান, কবিগান, উত্তরবঙ্গের পালাটিয়া, ভাওয়াইয়া এসব গানের সুর পথে-প্রান্তরে ভাসতে থাকত।
আমাদের আন্দোলনের মাসও ছিল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। সেভাবেই আমাদের জীবনে এসেছিল ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাসের যুদ্ধের পর এক রক্তাক্ত বিজয়। একদিকে আকাশে-বাতাসে সর্বত্র বিজয়ের ধ্বনি আর অন্যদিকে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। এই সবকিছুর পরেই আমাদের জীবনে এল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যে স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং কোনো বিদেশি শাসন নয়, একেবারেই বাঙালির নিজস্ব শাসনের রাষ্ট্র। বাঙালি কোনো দিন স্বাধীন ছিল না। সুদূর অতীত থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত বাঙালিরা বিদেশি শাসিত। সর্বশেষ শাসন পাঞ্জাবির। আমরা দীর্ঘদিন লড়াই করেছি, বিদেশি শাসকদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও আমাদের কৃষক ন্যূনতম অর্থ পেতেন, যা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকা যেত।
পলাশীর এক ইংরেজ সৈনিকের চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, এই অঞ্চল অত্যন্ত সুফলা, বঙ্গের গরিব মানুষেরাও দুবেলা খেতে পায় এবং এতেই তারা সুখী। তারা পরিশ্রমী এবং খাবারের অতিরিক্ত তেমন কোনো চাহিদা নেই। সেই সৈনিক সে সময়ের শাসনব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, সুশাসন ও স্বাধীনতার অনুপস্থিতি এ দেশের মানুষকে আয়েশে দিন কাটাতে দেয়নি। প্রাচ্য শাসকদের মনোভাব হচ্ছে প্রজাদের গোলাম করে রাখা। অতিরিক্ত শাসন নিয়ন্ত্রণের ফলে প্রজাকুল নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হতো।
ষাটের দশকে আমরা সাধারণ মানুষের নিদারুণ কষ্ট দেখেছি; বিশেষ করে কৃষকদের। আমাদের পাট সারা বিশ্বে রপ্তানি হতো। বিপুল অর্থ আসত বিদেশ থেকে। কিন্তু সেই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর আমাদের কোনো হাত ছিল না। কাগজ উৎপাদন করেও বাংলার মানুষকে উচ্চমূল্যেই কাগজ কিনতে হতো। এটা ছিল একটি নয়া ঔপনিবেশিক অবস্থা। এসব অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও করা হয়েছিল; কিন্তু তখন সুশাসনের অভাবে এগুলো কার্যকর হতে পারেনি।
এরপর আসে সেনাশাসন। সেনাশাসনে দীর্ঘ সময় এক জবাবদিহিবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা চলে সোনার বাংলায়। আবারও রাজপথে আন্দোলন। সেই স্বৈরাচারী শাসনেরও অবসান হয় এই ডিসেম্বরে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর মধ্যেই জাতি বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। আবার সেই বিদেশি শাসনের সংস্কৃতিকে শাসকগোষ্ঠী গ্রহণ করে ফেলেছে। একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশে ইংরেজি, বাংলা এবং আরবি তিনটি ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা বিভক্ত হয়েছে। ইংরেজি উচ্চবিত্তদের, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের বাংলা এবং নিম্নবিত্তদের একটা বড় অংশ আরবিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় যে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, তা থেকে রাষ্ট্র সরে গেল। ফলে প্রাথমিকের অর্ধেক শিক্ষার্থী ভাষা শিক্ষায় দুর্বল হয়ে পড়ল। অন্যদিকে যারা ইংরেজি শিক্ষায় গেল, সেই সব শিক্ষার্থী ইংরেজিটা ভালো বলতে পারল, কিন্তু মাতৃভাষায় একেবারে কাঁচাই রয়ে গেল এবং এই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা দেশে থাকতে চাইল না। তারা অভিবাসনমুখী।
দেশ পরিচালনার জন্য প্রকৃত শিক্ষা এবং মেধার প্রয়োজন হয়। ব্যাপকভাবে অভিবাসন এবং ইংরেজি শিক্ষার ফলে সর্বক্ষেত্রেই একটা মেধার সংকট দেখা দিয়েছে। পরীক্ষাপদ্ধতি এবং নিয়োগপদ্ধতিতে কোনো সংস্কার না হওয়ায় সমাজে প্রকৃত শিক্ষা ও যথাযথ নিয়োগ সম্পন্ন করা যায়নি। যার ফলাফল রাজনীতি, প্রশাসন এবং শিক্ষার পরিপূর্ণ ব্যবস্থাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। শিক্ষায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে হয়। কারণ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের লগ্নিও দীর্ঘস্থায়ী। এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিও রাজনীতিতে এবং প্রশাসনে খুঁজে পাওয়া যায় না।
শিক্ষা রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকদের অধিকার। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি প্রকৃত শিক্ষা না হয়ে শুধু নম্বর ও সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা অপচয় ও শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেয়। আজ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ত্রিশোর্ধ্ব, যেখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিও দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন কলেজেও এখন মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। আবার দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর তাঁদের চাকরির সংস্থানও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উচ্চতর সরকারি চাকরিতে পদের সংখ্যা কয়েক হাজার, কিন্তু প্রার্থী লাখ লাখ। ফলে বিপুল পরিমাণ বেকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রিকে কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীরা এত বেশি মাস্টার্স ডিগ্রি পেতেন না। যাঁরা পেতেন তাঁদের একটা কাজের সংস্থানও হয়ে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যা কোথাও প্রয়োজন নেই। তাই দেখা যায় রসায়নে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকে চাকরি করছেন। তাঁর অর্জিত শিক্ষা ব্যাংকে কোনো কাজেই লাগছে না। এই যে অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এবং শিক্ষা প্রশাসন কোনো সুনির্দিষ্ট পথও দেখাতে পারছে না। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে হাজার হাজার বিদ্যাপীঠ একধরনের শিক্ষিত মানুষ তৈরি করছে বটে, কিন্তু এই শিক্ষিত মানুষেরা সমাজে কোনো অবদান রাখতে পারছেন না।
এই সুযোগে ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এই ছাত্ররাজনীতি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে বা মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছিল, সেই ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা অনেকেই বিপুল অর্থের মালিক। ছাত্র থাকাকালেই কেউ যদি এত অর্থের মালিক হন, তবে শিক্ষার সমূহ উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যায়।
শিক্ষার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য। একটি স্বাধীন দেশে মানুষের বড় অধিকার হচ্ছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে চিকিৎসার অধিকার পাওয়া। স্বাস্থ্যের পূর্বশর্তই হচ্ছে একটি যৌক্তিক পুষ্টির ব্যবস্থা। বহুকাল বিদেশি শোষণের ফলে এই অঞ্চলের মানুষ যথার্থ পুষ্টি পায়নি এবং যথেষ্ট চিকিৎসাও তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়। পাকিস্তান আমলে অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কয়েকটি হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ ও ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর যদিও চিকিৎসাব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে; তবু এখনো সেটা অপ্রতুল। যেকোনো মহামারি এলে আমরা অপ্রস্তুত চিকিৎসাব্যবস্থা দেখতে পাই। সাম্প্রতিককালে করোনা ও ডেঙ্গু—এই দুটি মহামারিতেই এর প্রমাণ মেলে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে চিকিৎসাব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা দেশের রোগীদের বিদেশে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছে। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে রাষ্ট্রের যথাযথ মনোযোগ প্রয়োজন ছিল এবং প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে একটা ঐকমত্যে গিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল। সব স্বাধীন রাষ্ট্রে এই প্রথাই চালু আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বায়ান্ন বছরে রাজনীতিবিদদের তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার পীঠস্থান সংসদ অধিকাংশ সময়ই অকার্যকর থেকেছে। এ কারণেই সমাজে কোনো সংলাপের প্রথা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংলাপের খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা রাষ্ট্রকে অমানবিক এবং একধরনের অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছে।
ডিসেম্বরে এই বিজয়ের মাসে এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা শুধু কি ভাবব, নাকি প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নেব?
ডিসেম্বর আমাদের একটি আনন্দের মাস, আন্দোলন-সংগ্রামের মাস এবং সর্বোপরি বিজয়ের মাস। ছোটবেলায় আমাদের ফাইনাল পরীক্ষাটা হতো ডিসেম্বর মাসে, তারপর মুক্তি। ডিসেম্বরের প্রায় অর্ধ মাসের পরে জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হতো। সেটিও আনন্দের।
প্রমোশন পেয়ে আমাদের হাতে আসত নতুন বই। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে আমাদের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো। আমরা অপেক্ষা করতাম পরবর্তী ডিসেম্বরের জন্য। এই সময়ে বাংলার ফসলের মাঠে নতুন ধানের গন্ধে শুরু হতো পিঠা-পুলির আয়োজন। নানা ধরনের লোকসংগীতের সময় ছিল এটা। যাত্রা পালাগান, কবিগান, উত্তরবঙ্গের পালাটিয়া, ভাওয়াইয়া এসব গানের সুর পথে-প্রান্তরে ভাসতে থাকত।
আমাদের আন্দোলনের মাসও ছিল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। সেভাবেই আমাদের জীবনে এসেছিল ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাসের যুদ্ধের পর এক রক্তাক্ত বিজয়। একদিকে আকাশে-বাতাসে সর্বত্র বিজয়ের ধ্বনি আর অন্যদিকে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। এই সবকিছুর পরেই আমাদের জীবনে এল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যে স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং কোনো বিদেশি শাসন নয়, একেবারেই বাঙালির নিজস্ব শাসনের রাষ্ট্র। বাঙালি কোনো দিন স্বাধীন ছিল না। সুদূর অতীত থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত বাঙালিরা বিদেশি শাসিত। সর্বশেষ শাসন পাঞ্জাবির। আমরা দীর্ঘদিন লড়াই করেছি, বিদেশি শাসকদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও আমাদের কৃষক ন্যূনতম অর্থ পেতেন, যা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকা যেত।
পলাশীর এক ইংরেজ সৈনিকের চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, এই অঞ্চল অত্যন্ত সুফলা, বঙ্গের গরিব মানুষেরাও দুবেলা খেতে পায় এবং এতেই তারা সুখী। তারা পরিশ্রমী এবং খাবারের অতিরিক্ত তেমন কোনো চাহিদা নেই। সেই সৈনিক সে সময়ের শাসনব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, সুশাসন ও স্বাধীনতার অনুপস্থিতি এ দেশের মানুষকে আয়েশে দিন কাটাতে দেয়নি। প্রাচ্য শাসকদের মনোভাব হচ্ছে প্রজাদের গোলাম করে রাখা। অতিরিক্ত শাসন নিয়ন্ত্রণের ফলে প্রজাকুল নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হতো।
ষাটের দশকে আমরা সাধারণ মানুষের নিদারুণ কষ্ট দেখেছি; বিশেষ করে কৃষকদের। আমাদের পাট সারা বিশ্বে রপ্তানি হতো। বিপুল অর্থ আসত বিদেশ থেকে। কিন্তু সেই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর আমাদের কোনো হাত ছিল না। কাগজ উৎপাদন করেও বাংলার মানুষকে উচ্চমূল্যেই কাগজ কিনতে হতো। এটা ছিল একটি নয়া ঔপনিবেশিক অবস্থা। এসব অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও করা হয়েছিল; কিন্তু তখন সুশাসনের অভাবে এগুলো কার্যকর হতে পারেনি।
এরপর আসে সেনাশাসন। সেনাশাসনে দীর্ঘ সময় এক জবাবদিহিবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা চলে সোনার বাংলায়। আবারও রাজপথে আন্দোলন। সেই স্বৈরাচারী শাসনেরও অবসান হয় এই ডিসেম্বরে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর মধ্যেই জাতি বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। আবার সেই বিদেশি শাসনের সংস্কৃতিকে শাসকগোষ্ঠী গ্রহণ করে ফেলেছে। একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশে ইংরেজি, বাংলা এবং আরবি তিনটি ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা বিভক্ত হয়েছে। ইংরেজি উচ্চবিত্তদের, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের বাংলা এবং নিম্নবিত্তদের একটা বড় অংশ আরবিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় যে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, তা থেকে রাষ্ট্র সরে গেল। ফলে প্রাথমিকের অর্ধেক শিক্ষার্থী ভাষা শিক্ষায় দুর্বল হয়ে পড়ল। অন্যদিকে যারা ইংরেজি শিক্ষায় গেল, সেই সব শিক্ষার্থী ইংরেজিটা ভালো বলতে পারল, কিন্তু মাতৃভাষায় একেবারে কাঁচাই রয়ে গেল এবং এই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা দেশে থাকতে চাইল না। তারা অভিবাসনমুখী।
দেশ পরিচালনার জন্য প্রকৃত শিক্ষা এবং মেধার প্রয়োজন হয়। ব্যাপকভাবে অভিবাসন এবং ইংরেজি শিক্ষার ফলে সর্বক্ষেত্রেই একটা মেধার সংকট দেখা দিয়েছে। পরীক্ষাপদ্ধতি এবং নিয়োগপদ্ধতিতে কোনো সংস্কার না হওয়ায় সমাজে প্রকৃত শিক্ষা ও যথাযথ নিয়োগ সম্পন্ন করা যায়নি। যার ফলাফল রাজনীতি, প্রশাসন এবং শিক্ষার পরিপূর্ণ ব্যবস্থাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। শিক্ষায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে হয়। কারণ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের লগ্নিও দীর্ঘস্থায়ী। এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিও রাজনীতিতে এবং প্রশাসনে খুঁজে পাওয়া যায় না।
শিক্ষা রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকদের অধিকার। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি প্রকৃত শিক্ষা না হয়ে শুধু নম্বর ও সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা অপচয় ও শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেয়। আজ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ত্রিশোর্ধ্ব, যেখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিও দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন কলেজেও এখন মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। আবার দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর তাঁদের চাকরির সংস্থানও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উচ্চতর সরকারি চাকরিতে পদের সংখ্যা কয়েক হাজার, কিন্তু প্রার্থী লাখ লাখ। ফলে বিপুল পরিমাণ বেকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রিকে কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীরা এত বেশি মাস্টার্স ডিগ্রি পেতেন না। যাঁরা পেতেন তাঁদের একটা কাজের সংস্থানও হয়ে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যা কোথাও প্রয়োজন নেই। তাই দেখা যায় রসায়নে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকে চাকরি করছেন। তাঁর অর্জিত শিক্ষা ব্যাংকে কোনো কাজেই লাগছে না। এই যে অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এবং শিক্ষা প্রশাসন কোনো সুনির্দিষ্ট পথও দেখাতে পারছে না। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে হাজার হাজার বিদ্যাপীঠ একধরনের শিক্ষিত মানুষ তৈরি করছে বটে, কিন্তু এই শিক্ষিত মানুষেরা সমাজে কোনো অবদান রাখতে পারছেন না।
এই সুযোগে ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এই ছাত্ররাজনীতি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে বা মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছিল, সেই ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা অনেকেই বিপুল অর্থের মালিক। ছাত্র থাকাকালেই কেউ যদি এত অর্থের মালিক হন, তবে শিক্ষার সমূহ উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যায়।
শিক্ষার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য। একটি স্বাধীন দেশে মানুষের বড় অধিকার হচ্ছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে চিকিৎসার অধিকার পাওয়া। স্বাস্থ্যের পূর্বশর্তই হচ্ছে একটি যৌক্তিক পুষ্টির ব্যবস্থা। বহুকাল বিদেশি শোষণের ফলে এই অঞ্চলের মানুষ যথার্থ পুষ্টি পায়নি এবং যথেষ্ট চিকিৎসাও তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়। পাকিস্তান আমলে অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কয়েকটি হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ ও ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর যদিও চিকিৎসাব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে; তবু এখনো সেটা অপ্রতুল। যেকোনো মহামারি এলে আমরা অপ্রস্তুত চিকিৎসাব্যবস্থা দেখতে পাই। সাম্প্রতিককালে করোনা ও ডেঙ্গু—এই দুটি মহামারিতেই এর প্রমাণ মেলে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে চিকিৎসাব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা দেশের রোগীদের বিদেশে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছে। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে রাষ্ট্রের যথাযথ মনোযোগ প্রয়োজন ছিল এবং প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে একটা ঐকমত্যে গিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল। সব স্বাধীন রাষ্ট্রে এই প্রথাই চালু আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বায়ান্ন বছরে রাজনীতিবিদদের তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার পীঠস্থান সংসদ অধিকাংশ সময়ই অকার্যকর থেকেছে। এ কারণেই সমাজে কোনো সংলাপের প্রথা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংলাপের খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা রাষ্ট্রকে অমানবিক এবং একধরনের অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছে।
ডিসেম্বরে এই বিজয়ের মাসে এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা শুধু কি ভাবব, নাকি প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নেব?
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩৮ মিনিট আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪৪ মিনিট আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
১ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ ঘণ্টা আগে