মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
কোভিড-১৯ এখনো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনো বিশ্বকে করোনামুক্ত বলতে পারছে না। কারণ চীন, ভারত, ইউরোপ এবং আমেরিকায় এখনো অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। ভারতে করোনা চোখ রাঙাচ্ছে। ভারত সরকার তাই অনেকগুলো রাজ্যেই মাস্ক পরার বিধান শক্তভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করছে। প্রতিবেশী ভারতে যখন করোনা কড়া নাড়াচ্ছে, তখন আমাদের শঙ্কামুক্ত থাকার কোনো কারণ নেই। যদিও কয়েক মাস থেকে মানুষ অনেকটা ধরেই নিয়েছে আমরা করোনা থেকে এখন মুক্ত হয়ে গেছি।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জনগণের এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন। তাঁরা জনগণকে সাবধান থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এরই মধ্যে আমাদের দেশে নববর্ষ পালিত হয়েছে, আগামী সপ্তাহে উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ২০২০-২১ সালে মানুষ করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার কারণে কোনো উৎসবই আগের মতো পালন করতে পারেনি। সে কারণে এবার বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর থেকে গ্রামে ঈদযাত্রায় অংশ নিতে যাচ্ছে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, বিমান এবং ব্যক্তিগত ও ভাড়া করা যানবাহন নিয়ে অসংখ্য মানুষ এরই মধ্যে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। শুক্রবার থেকে এই যাত্রা অনেকটাই ঢল নামার মতো হয়ে যেতে পারে বলে সবার অনুমান। এর ফলে একদিকে পরিবহনগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতে পারে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধির ন্যূনতম শর্ত মেনে চলার লক্ষণ প্রায় নেই। দেশ থেকে ওমিক্রন এখনো বিলুপ্ত হয়নি। স্বল্পসংখ্যক হলেও কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন।
তাই এমন ঈদযাত্রায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে কারণেই নিবন্ধের শিরোনামে ‘প্রায়’ শব্দটি উল্লেখ করতে হলো, করোনা-উত্তর কথাটি ব্যবহার করতে পারছি না। করোনা-উত্তর বিশ্বব্যবস্থার প্রতীক্ষায় আমরাও আছি, এখনো নেই সেটিই কষ্টের বিষয়। কিন্তু এই কষ্টটা তো মেনে নিতেই হবে, উপেক্ষা করলে নতুন করে বিপদের মুখে পড়ব না, সেটি তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। দুই বছর করোনায় আমরা অনেককেই হারিয়েছি, অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা ভুলে যাইনি, ভুলতেও চাই না। সে কারণেই এবার যাঁরা ঈদযাত্রায় ব্যাপকভাবে অংশ নিতে যাচ্ছেন, তাঁরা যেন নিকট অতীতের করোনা সংকটের কথা ভুলে না যান। করোনায় আমরা দুই বছরে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সারা বিশ্বের মতো আমাদের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক মানুষ কর্ম হারিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দুই বছরে শিখনফল অর্জনে এতটাই পিছিয়ে পড়েছে যে তাদের সামান্য সংখ্যকই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে হয়তো পারবে। আমাদের একটি বড় ধরনের প্রজন্ম শিক্ষার মানের সংকটে পড়েছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনের বড় ক্ষতি, যা পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অর্থনীতির অতি ক্ষতি হয়তো স্বল্প সময়ের মধ্যেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু ৫-৬ কোটি শিক্ষার্থীর শিখন ফলের ঘাটতি পূরণ করা খুবই অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। সে কারণে আমরা আর চাই না করোনা সংক্রমণের মতো আর মারাত্মক ব্যাধি আমাদের জীবনে আবার ফিরে আসুক।
অতীতেও ঈদ উপলক্ষে মানুষের ঢল সামলাতে কোনো কর্তৃপক্ষই পারেনি। গণপরিবহন বা নানা ধরনের পরিবহনে এই চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েক কোটি মানুষ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার জন্য যত পরিবহনের দরকার, তা বাংলাদেশ কেন কোনো দেশই জোগান দিতে সক্ষম নয়। ট্রেনের টিকিট কাটতে এখনই বহু মানুষকে যারপরনাই কষ্ট করতে দেখা যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিটি টিকিটের বিপরীতে ৬০-৭০ জনের যে ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে, তা পূরণ করতে হলে দেশের সবকটি রেল সড়কে বিরতিহীন সারিবদ্ধভাবে ট্রেন যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাতেও সম্ভব হবে কি না, বলা মুশকিল। অন্যদিকে গণপরিবহনের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়লে ড্রাইভার-হেলপারদের বিরতি, বিশ্রাম প্রায় হারাম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়! তাতে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে। ঈদে আনন্দ করতে গিয়ে অতীতে অসংখ্য মানুষ ঈদযাত্রায় প্রাণ হারিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, পরিবার ঈদে স্বজন হারানোর বেদনায় দিনাতিপাত করেছে। এবার যেহেতু বাড়তি মানুষের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাই পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানাব। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করব ঈদ শেষে সবাই যেন আবার নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারেন। ঈদের আনন্দ শত শত বছর ধরে মানুষ উপভোগ করে আসছে। যখন যানবাহন বা সড়কপথ ছিল না, তখন হেঁটে মানুষকে গ্রামে যেতে দেখেছি। এখন মানুষের সচ্ছলতা বেড়েছে। যোগাযোগ ও যানবাহন বেড়েছে বহুমাত্রিক। সুতরাং সবাই চাইছে ইচ্ছেমতো ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে। অসংখ্য মানুষ ঈদ শেষে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ছুটে বেড়াবেন। জীবনের এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমাদের জাতীয় জীবনে দুটি ঈদ, বাংলা নববর্ষ, দুর্গাপূজা, নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বড় উৎসব। আরও অনেক পালা-পার্বণ আছে। এসব উৎসব ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবর্তিত হচ্ছে। যখন সমাজে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল তখন এসব পার্বণের সঙ্গে মানুষের সংশ্লিষ্টতা অনেকটাই নিয়ম রক্ষার পর্যায়ে ছিল। সীমিতসংখ্যক মানুষই ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পারত। আমাদের প্রজন্মের শিশু-কিশোরেরা ঈদে পিতামাতার কাছ থেকে নতুন জামাকাপড়, জুতা, স্যান্ডেল পেয়েছে—এমনটি মনে পড়ে না। অভিভাবকদের সক্ষমতার ওপর এসব কেনাকাটা হতো, যা খুব স্বল্পপরিসরেই ছিল। ঈদে ঘরে তৈরি খাবার এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করার বেশি কিছু ছিল না। কালক্রমে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই ৫০ বছরে অভূতপূর্ব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যেই স্তরেই আমরা এখন থাকি না কেন, শহর-গ্রামভেদে সর্বত্র মানুষের আয়-উপার্জন দেশে-বিদেশে নানাভাবেই বেড়ে চলেছে। এখন ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে কেনাকাটার যে ধুম পড়ে যায়, তা ৩০-৪০ বছর আগে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নতুন কাপড়চোপড় কেনাকাটা বা পাওয়ার নানা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা তো সব ঈদ এবং পার্বণেই নানা ধরনের কেনাকাটায় অংশ নিচ্ছে। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, আত্মীয়স্বজন, বাড়িতে কাজের লোকসহ সবাইকে এই ঈদ বা পূজা-পার্বণে নতুন পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল এবং অন্যান্য উপহারসামগ্রী দিতে দেখা যায়।
গত দুই-তিন দশকে ধীরে ধীরে পার্বণকেন্দ্রিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। একেক পার্বণের চাহিদা একেক রকম, বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন রকমের। সেভাবেই বাজারের চাহিদা পূরণে অসংখ্য মানুষ ফ্যাক্টরি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এটি এখন গ্রাম পর্যায়েও বিস্তৃত হয়ে গেছে। ঈদুল ফিতরে পোশাক-আশাক এবং ব্যবহার্য জিনিসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তাই ব্যবসার পসরা সাজিয়ে শহর ও গ্রামে ক্রেতাসাধারণের চাহিদা পূরণ করছেন ব্যবসায়ীরা। কয়েক মাস আগ থেকেই এসব চাহিদা অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী তৈরি ও উৎপাদনে অসংখ্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী যুক্ত হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে এখন মাসব্যাপী কেনাবেচা হচ্ছে। শুধু পণ্যসামগ্রীই নয়, খাবার-দাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য এই সময় ব্যাপকভাবে কেনাবেচা হচ্ছে। মানুষ কয়েক দিন ঈদের আনন্দ নিজেদের মধ্যে উপভোগ করতে চায়। ফলে প্রতিটি উৎসবকে কেন্দ্র করেই দেশে এখন চলছে কেনাবেচা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও যাতায়াত। এর ফলে যে উৎসবে প্রায় সবাই যুক্ত, সেই উৎসবের কেনাকাটাও অনেক বেশি হয়। ঈদুল ফিতরের আয়োজনকে কেন্দ্র করে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। এখন তাই ঈদ অর্থনীতি নামের ধারণাও প্রযুক্ত হয়েছে।
গত দুই বছর করোনার কারণে ঈদ অর্থনীতিতে ছেদ পড়েছিল। এবার সেটি পুষিয়ে নেওয়ার প্রবণতা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিতে তেজিভাব ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে লক্ষ-কোটি টাকার সঞ্চালন ঘটছে। এটি অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আমাদের লাখো প্রবাসী এই সময়ে বাড়তি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। ঈদ বোনাস, নানা পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন, বেচা-বিক্রি সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ায় প্রতিটি পরিবারই বাড়তি অর্থ উপার্জন বা খরচের সক্ষমতায় কম-বেশি যুক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ঈদ অর্থনীতির প্রভাব সমাজ ও জনজীবনে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে সেটি পরবর্তী ঈদ কিংবা পার্বণকেও একইভাবে উদ্যাপিত করার শক্তি সঞ্চালনের প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এটি জাতীয় অর্থনীতি এবং জাতীয় জীবনের জন্যও বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়হীনদের মধ্যে ঈদ উপলক্ষে ৩৩ হাজার ঘর উপহার দিয়েছেন। এটা কখনো কল্পনা করা গিয়েছিল? আমাদের রাষ্ট্রের সক্ষমতাও এর মাধ্যমে অনুমান করা যেতে পারে। এ ধরনের সক্ষমতা দিয়েই বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
কোভিড-১৯ এখনো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনো বিশ্বকে করোনামুক্ত বলতে পারছে না। কারণ চীন, ভারত, ইউরোপ এবং আমেরিকায় এখনো অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। ভারতে করোনা চোখ রাঙাচ্ছে। ভারত সরকার তাই অনেকগুলো রাজ্যেই মাস্ক পরার বিধান শক্তভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করছে। প্রতিবেশী ভারতে যখন করোনা কড়া নাড়াচ্ছে, তখন আমাদের শঙ্কামুক্ত থাকার কোনো কারণ নেই। যদিও কয়েক মাস থেকে মানুষ অনেকটা ধরেই নিয়েছে আমরা করোনা থেকে এখন মুক্ত হয়ে গেছি।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জনগণের এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন। তাঁরা জনগণকে সাবধান থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এরই মধ্যে আমাদের দেশে নববর্ষ পালিত হয়েছে, আগামী সপ্তাহে উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ২০২০-২১ সালে মানুষ করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার কারণে কোনো উৎসবই আগের মতো পালন করতে পারেনি। সে কারণে এবার বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর থেকে গ্রামে ঈদযাত্রায় অংশ নিতে যাচ্ছে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, বিমান এবং ব্যক্তিগত ও ভাড়া করা যানবাহন নিয়ে অসংখ্য মানুষ এরই মধ্যে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। শুক্রবার থেকে এই যাত্রা অনেকটাই ঢল নামার মতো হয়ে যেতে পারে বলে সবার অনুমান। এর ফলে একদিকে পরিবহনগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতে পারে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধির ন্যূনতম শর্ত মেনে চলার লক্ষণ প্রায় নেই। দেশ থেকে ওমিক্রন এখনো বিলুপ্ত হয়নি। স্বল্পসংখ্যক হলেও কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন।
তাই এমন ঈদযাত্রায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে কারণেই নিবন্ধের শিরোনামে ‘প্রায়’ শব্দটি উল্লেখ করতে হলো, করোনা-উত্তর কথাটি ব্যবহার করতে পারছি না। করোনা-উত্তর বিশ্বব্যবস্থার প্রতীক্ষায় আমরাও আছি, এখনো নেই সেটিই কষ্টের বিষয়। কিন্তু এই কষ্টটা তো মেনে নিতেই হবে, উপেক্ষা করলে নতুন করে বিপদের মুখে পড়ব না, সেটি তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। দুই বছর করোনায় আমরা অনেককেই হারিয়েছি, অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা ভুলে যাইনি, ভুলতেও চাই না। সে কারণেই এবার যাঁরা ঈদযাত্রায় ব্যাপকভাবে অংশ নিতে যাচ্ছেন, তাঁরা যেন নিকট অতীতের করোনা সংকটের কথা ভুলে না যান। করোনায় আমরা দুই বছরে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সারা বিশ্বের মতো আমাদের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক মানুষ কর্ম হারিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দুই বছরে শিখনফল অর্জনে এতটাই পিছিয়ে পড়েছে যে তাদের সামান্য সংখ্যকই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে হয়তো পারবে। আমাদের একটি বড় ধরনের প্রজন্ম শিক্ষার মানের সংকটে পড়েছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনের বড় ক্ষতি, যা পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অর্থনীতির অতি ক্ষতি হয়তো স্বল্প সময়ের মধ্যেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু ৫-৬ কোটি শিক্ষার্থীর শিখন ফলের ঘাটতি পূরণ করা খুবই অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। সে কারণে আমরা আর চাই না করোনা সংক্রমণের মতো আর মারাত্মক ব্যাধি আমাদের জীবনে আবার ফিরে আসুক।
অতীতেও ঈদ উপলক্ষে মানুষের ঢল সামলাতে কোনো কর্তৃপক্ষই পারেনি। গণপরিবহন বা নানা ধরনের পরিবহনে এই চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েক কোটি মানুষ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার জন্য যত পরিবহনের দরকার, তা বাংলাদেশ কেন কোনো দেশই জোগান দিতে সক্ষম নয়। ট্রেনের টিকিট কাটতে এখনই বহু মানুষকে যারপরনাই কষ্ট করতে দেখা যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিটি টিকিটের বিপরীতে ৬০-৭০ জনের যে ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে, তা পূরণ করতে হলে দেশের সবকটি রেল সড়কে বিরতিহীন সারিবদ্ধভাবে ট্রেন যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাতেও সম্ভব হবে কি না, বলা মুশকিল। অন্যদিকে গণপরিবহনের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়লে ড্রাইভার-হেলপারদের বিরতি, বিশ্রাম প্রায় হারাম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়! তাতে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে। ঈদে আনন্দ করতে গিয়ে অতীতে অসংখ্য মানুষ ঈদযাত্রায় প্রাণ হারিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, পরিবার ঈদে স্বজন হারানোর বেদনায় দিনাতিপাত করেছে। এবার যেহেতু বাড়তি মানুষের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাই পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানাব। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করব ঈদ শেষে সবাই যেন আবার নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারেন। ঈদের আনন্দ শত শত বছর ধরে মানুষ উপভোগ করে আসছে। যখন যানবাহন বা সড়কপথ ছিল না, তখন হেঁটে মানুষকে গ্রামে যেতে দেখেছি। এখন মানুষের সচ্ছলতা বেড়েছে। যোগাযোগ ও যানবাহন বেড়েছে বহুমাত্রিক। সুতরাং সবাই চাইছে ইচ্ছেমতো ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে। অসংখ্য মানুষ ঈদ শেষে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ছুটে বেড়াবেন। জীবনের এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমাদের জাতীয় জীবনে দুটি ঈদ, বাংলা নববর্ষ, দুর্গাপূজা, নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বড় উৎসব। আরও অনেক পালা-পার্বণ আছে। এসব উৎসব ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবর্তিত হচ্ছে। যখন সমাজে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল তখন এসব পার্বণের সঙ্গে মানুষের সংশ্লিষ্টতা অনেকটাই নিয়ম রক্ষার পর্যায়ে ছিল। সীমিতসংখ্যক মানুষই ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পারত। আমাদের প্রজন্মের শিশু-কিশোরেরা ঈদে পিতামাতার কাছ থেকে নতুন জামাকাপড়, জুতা, স্যান্ডেল পেয়েছে—এমনটি মনে পড়ে না। অভিভাবকদের সক্ষমতার ওপর এসব কেনাকাটা হতো, যা খুব স্বল্পপরিসরেই ছিল। ঈদে ঘরে তৈরি খাবার এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করার বেশি কিছু ছিল না। কালক্রমে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই ৫০ বছরে অভূতপূর্ব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যেই স্তরেই আমরা এখন থাকি না কেন, শহর-গ্রামভেদে সর্বত্র মানুষের আয়-উপার্জন দেশে-বিদেশে নানাভাবেই বেড়ে চলেছে। এখন ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে কেনাকাটার যে ধুম পড়ে যায়, তা ৩০-৪০ বছর আগে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নতুন কাপড়চোপড় কেনাকাটা বা পাওয়ার নানা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা তো সব ঈদ এবং পার্বণেই নানা ধরনের কেনাকাটায় অংশ নিচ্ছে। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, আত্মীয়স্বজন, বাড়িতে কাজের লোকসহ সবাইকে এই ঈদ বা পূজা-পার্বণে নতুন পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল এবং অন্যান্য উপহারসামগ্রী দিতে দেখা যায়।
গত দুই-তিন দশকে ধীরে ধীরে পার্বণকেন্দ্রিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। একেক পার্বণের চাহিদা একেক রকম, বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন রকমের। সেভাবেই বাজারের চাহিদা পূরণে অসংখ্য মানুষ ফ্যাক্টরি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এটি এখন গ্রাম পর্যায়েও বিস্তৃত হয়ে গেছে। ঈদুল ফিতরে পোশাক-আশাক এবং ব্যবহার্য জিনিসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তাই ব্যবসার পসরা সাজিয়ে শহর ও গ্রামে ক্রেতাসাধারণের চাহিদা পূরণ করছেন ব্যবসায়ীরা। কয়েক মাস আগ থেকেই এসব চাহিদা অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী তৈরি ও উৎপাদনে অসংখ্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী যুক্ত হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে এখন মাসব্যাপী কেনাবেচা হচ্ছে। শুধু পণ্যসামগ্রীই নয়, খাবার-দাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য এই সময় ব্যাপকভাবে কেনাবেচা হচ্ছে। মানুষ কয়েক দিন ঈদের আনন্দ নিজেদের মধ্যে উপভোগ করতে চায়। ফলে প্রতিটি উৎসবকে কেন্দ্র করেই দেশে এখন চলছে কেনাবেচা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও যাতায়াত। এর ফলে যে উৎসবে প্রায় সবাই যুক্ত, সেই উৎসবের কেনাকাটাও অনেক বেশি হয়। ঈদুল ফিতরের আয়োজনকে কেন্দ্র করে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। এখন তাই ঈদ অর্থনীতি নামের ধারণাও প্রযুক্ত হয়েছে।
গত দুই বছর করোনার কারণে ঈদ অর্থনীতিতে ছেদ পড়েছিল। এবার সেটি পুষিয়ে নেওয়ার প্রবণতা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিতে তেজিভাব ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে লক্ষ-কোটি টাকার সঞ্চালন ঘটছে। এটি অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আমাদের লাখো প্রবাসী এই সময়ে বাড়তি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। ঈদ বোনাস, নানা পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন, বেচা-বিক্রি সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ায় প্রতিটি পরিবারই বাড়তি অর্থ উপার্জন বা খরচের সক্ষমতায় কম-বেশি যুক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ঈদ অর্থনীতির প্রভাব সমাজ ও জনজীবনে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে সেটি পরবর্তী ঈদ কিংবা পার্বণকেও একইভাবে উদ্যাপিত করার শক্তি সঞ্চালনের প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এটি জাতীয় অর্থনীতি এবং জাতীয় জীবনের জন্যও বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়হীনদের মধ্যে ঈদ উপলক্ষে ৩৩ হাজার ঘর উপহার দিয়েছেন। এটা কখনো কল্পনা করা গিয়েছিল? আমাদের রাষ্ট্রের সক্ষমতাও এর মাধ্যমে অনুমান করা যেতে পারে। এ ধরনের সক্ষমতা দিয়েই বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে