আন্তঃনগর সিনেমায় এক সাধারণ মধ্যবিত্ত নারী রোজিনা চরিত্রে আপনি অভিনয় করেছেন। এই রকম মধ্যবিত্ত জীবন, তাদের বেচে থাকা, তাদের প্রেম, এত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের স্বপ্ন দেখা; এসব আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করে?
এটার উত্তর যদি আমি অনেস্টলি দিতে চাই, তাহলে যে উত্তরটা হবে, রোজিনা তো আন্তঃনগরের চরিত্র, আর আমি ব্যক্তি রুনা। ব্যক্তি রুনার জীবনটাই আসলে এটা। আমি একেবারেই মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মেয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। আমি জন্মেছি একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে। যে গ্রামে বিদ্যুৎ গিয়েছে যখন আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি তখন। তার আগ পর্যন্ত সেই গ্রামের মানুষ হারিকেন, কুপিবাতি জ্বালিয়ে চলতো। বাবার চাকরির সুবাদে আমি বড় হয়েছি একটা ছোট মফস্বল শহরে। আমার বন্ধুবান্ধব যারা, আমরা সবাই আসলে এ রকম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। তো আপনার প্রশ্ন যেটা ছিল, এ রকম মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন কীভাবে আমাকে ইন্সপায়ার করে! আসলে এটাই আমার জীবন। আমি এই জীবন থেকেই এসেছি। এটার উত্তর দিতে গেলে আসলে একটু লম্বা হয়ে যাবে।
আমাদের সময় আছে। আপনি বলুন।
যে গ্রামের কথা বলছিলাম, যে গ্রামে আমার বাবার জন্ম। গ্রামে তো কিছু বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া হয়। সেই পাড়ায় আমার বাবা প্রথম লোক যিনি এসএসসি পাশ করেছেন। সেই পাড়ায় আমিই প্রথম মেয়ে, যে এসএসসি পাশ করেছে। সেই পাড়ায় আমিই প্রথম মেয়ে, যে মাস্টার্স অব্দি পড়াশোনা করেছে। শুধু তাই না, আমার বাবার পরিবারে এবং মায়ের পরিবারে আমিই প্রথম মেয়ে যে মাস্টার্স পাশ করেছে। আমার বাবা এবং মায়ের পরিবারের ধারেকাছে কেউ কোথাও অভিনয়, নাচ, গান, শিল্প-সংস্কৃতি এসবের সঙ্গে যুক্ত না। সে রকম একটা জায়গায় জন্মে, স্কুলে পড়ার সময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করি আমি অভিনয় করব। ওই জায়গা থেকে আজকে এখানে এসে এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এই পুরো জীবনটাই আসলে ওই মধ্যবিত্ত পরিবারের। ওটাই আমার জীবন, ওটাই আমি। আমি এই জীবনটাই যাপন করি।
রুনা খানের বদল হয়নি তাহলে?
একদমই না। আমি ঘরে ডালভাত খাই। আমি ঘরে মেয়ের বাবার সাথে চিল্লাচিল্লি করি। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষরা যেমন করে। ঘরে ছেঁড়াতেনা কাপড় পরে থাকি। এটাই আমার জীবন।
আন্তঃনগরের রোজিনা খুবই পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ। আপনার নিজের একটা দারুণ পরিবার আছে। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমি বিশ্বাস করি, শুধু শিল্পী হিসেবে নয়। যে কোনো মানুষের জীবনে পরিবারটা হচ্ছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস। উৎসাহ বলেন, প্রেরণা বলেন, জীবনে যে কোনো ভালো কাজ করবার খুঁটির জোর, ওটা আমি মনে করি পরিবার। যে কোনো মানুষের জন্য। সে আপনি শিল্পী হন, ব্যবসায়ী হন, ডাক্তার হন, ইঞ্জিনিয়ার হন, শিক্ষক হন, যা-ই হন না কেন।
কিন্তু এখন সময়টা তো অস্থির। মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। ফলে সম্পর্ক ভাঙছে, পরিবার ভাঙছে। এটা শুধু শহরে হচ্ছে না তো নয়, গ্রামেও। এসব নিয়ে আপনার চিন্তা হয় কিনা?
আপনি খুব সুন্দর একটা শব্দ বলেছেন। অসহিষ্ণুতা। কর্মক্ষেত্রে, ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, সংসারজীবনের ক্ষেত্রে, আমরা যদি একটু সহিষ্ণুতা বাড়াবার চেষ্টা করি। সবাই সবার প্রতি। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি, বন্ধু হিসেবে বন্ধুর প্রতি, সহকর্মী হিসেবে সহকর্মীর প্রতি। অসহিষ্ণুতা পাশ কাটিয়ে সবার প্রতি যদি একটু ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করতে পারি, তাহলে হয়তো অনেক জটিলতা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।
মঞ্চ, টিভি নাটক, সিনেমা এবং এখন ওয়েব কনটেন্ট—সব মিলিয়ে অনেকদিন ধরে আপনি কাজ করছেন। সব সময়ই আপনি খুব সিলেকটিভ। আপনি একটা কাজের অংশ হয়ে আছেন মানে, সে কাজের ন্যুনতম একটা মানের নিশ্চয়তা আছে। আন্তঃনগর সিনেমায় অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন?
আবারও এখানে বলব পরিবারের কথা। আমার বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর। মানুষের তো একটাই জীবন, একটা আমার কর্মজীবন, আমি পেশাদার অভিনেতা, অভিনয়টা আমার কাজ। আরেকটা আমার ব্যক্তিজীবন। ঘরে আমি আমার সন্তানের মা। আমার সন্তানের বাবার সঙ্গী। আমি আসলে একজীবনে দুটো জীবনকেই উপভোগ করতে চাই। আমার কর্মজীবনটাকেও, আমার ব্যক্তিজীবনটাকেও। তো দুটো জীবনকে যদি আমি উপভোগ করতে চাই তাহলে দুটো জীবনের ক্ষেত্রেই আমাকে সমান গুরুত্ব এবং সময় দিতে হবে। আমি শুধু কর্মজীবন নিয়ে থাকলাম তাহলে আমার ব্যক্তিজীবনে প্রভাব পড়বে। অথবা শুধু ব্যক্তিজীবন নিয়ে থাকলে কর্মজীবনে প্রভাব পড়বে। তো এই দুই জীবন উপভোগ করবার লোভ থেকে আমি যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি, সারাবছর আমাকে পর্দায় দেখা যাবে, সেটা আমি চাইনি। বছরে আমাকে একটা দুটো কাজে পর্দায় দেখা যাক। কিন্তু যে কাজটা নিয়ে আমি আসব, সেটা যেন অন্তত একটা মান রাখে। যারা দেখবে তাদের যাতে মনে হয়, এটা একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো কাজ না। এটা আমার একটা সচেতন চেষ্টা এবং এই চেষ্টাটা গত ১৫ বছর ধরে করছি।
যে কারণে যখন আমি টিভি নাটক করেছি, বা চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, বা বিজ্ঞাপনে বা ওটিটিতে; প্রত্যেক জায়গায় ওই ব্যাপারটা থেকেছে। আমি যেহেতু বছরে কাজই করি খুব কম। তো এটা তো চাইবো, যে তিন-চারটা কাজ নিয়ে আসব, সেটা যেন খুব যাচ্ছেতাই মানের কাজ না হয়।
আর আন্তনগরের কথা বলছিলেন। আন্তনগরে কাজ করতে আগ্রহ বোধ করবার কারণ আসলে অনেক। প্রথমত পরিচালক গৌতম কৈরী। তাঁর কাজ আমি পছন্দ করি। যে গল্প তিনি আমাকে বলেছেন, যে চরিত্রে তিনি আমাকে ভেবেছেন, সে গল্প এবং চরিত্র আমার পছন্দ হয়েছে। এখানে আমার সহশিল্পী যাঁরা আছেন, তাঁরাও আমার খুব পছন্দের। একটা কাজের ক্ষেত্রে যখন এতগুলো বিষয় পছন্দসই হয়ে যায়, তখন সেই কাজটা না করার কোনো কারণ থাকে না।
আপনি বলছিলেন ব্যক্তিজীবন এবং পেশাগত জীবন—এর মাঝখানে বাউন্ডারি লাইনের কথা। এই সুযোগটা তো সবার ক্ষেত্রে হয় না। টাকার জন্যও অনেককে কাজ করতে হয়। একটা কাজের প্রস্তাব এলে সেটাকে না বলা, বা ফিরিয়ে দেওয়া… এটা তো কঠিন…
এখানে আমাদের আসলে কাজের ধরণটা এমন, আপনি তো জানেন, আমি সব সময় বলি এটা…
একটা কাজ করে এখানে অনেক টাকা পাওয়া যায় তাও তো নয়…
অনেক না হলেও আমরা একটু কাঁচা টাকার কাজ করি। কাঁচা টাকা বলতে, আমাদের কাজের ধরনটা আসলে দিনমজুরের মতো। মাসে আমি পাঁচদিন কাজ করলাম, পাঁচদিনের জন্য টাকা পেলাম। পঁচিশ দিন কাজ করলাম না, পঁচিশ দিনে একটা টাকাও নেই। একেবারে দিন মজুরের মতো কাজ। যখন আমি পাঁচ দিনের জায়গায় পনেরো দিন কাজে বেরুবো, পনেরো দিনই কিন্তু আমি টাকা পাব। ওই প্রতিদিন টাকা পাওয়ার লোভ… অবশ্যই মানুষের জীবনে টাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে ওই যে শুরুতে বলেছিলাম, আমি একটু ডালভাত খেয়ে অল্পে চলতে পারা মানুষ।
এই যে অল্পে তুষ্ট হওয়া। বা কতখানি হলে আমার প্রয়োজন মিটবে, এটা বুঝে ফেলা এবং সে অনুযায়ী জীবনের লক্ষ ঠিক করা। এটাতে আপনার পরিবারের কোনো ভূমিকা আছে কিনা?
অবশ্যই। পরিবার না শুধু, বন্ধু বা আশপাশের মানুষের (সবার ভূমিকা থাকে)। আমার মা একটা কথা বলেন, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। সঙ্গের একটা প্রভাব কিন্তু মানুষের ওপর পড়ে। তার চিন্তার প্রভাব। আর আমি আসলে যাদেরকে পছন্দ করি, তাদের দ্বারা অনেক প্রভাবিত হই। তাদের ভাবনার দ্বারা, বিশ্বাসের দ্বারা। আমি যে জীবনের কথা বলছি, যে দর্শনের কথা বলছি, এর পেছনে আমার পরিবার, আমার বর, আমার কাছের মানুষ যারা, তাদের অনেক প্রভাব আছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের পরিচয় হচ্ছে তার কাজ। অর্থ অবশ্যই জীবনে প্রয়োজন। কিন্তু একটা মানুষের জীবনের আয়ুষ্কাল কতটুকু! ৮০-৯০ বছর।
আমি শুধু আমার ভাবনাটা বলছি, কোনো বিতর্কের জন্য না। ধরেন আমি এক হাজার কোটি টাকার মালিক হলাম। এত টাকা কি আমি ৮০ বছরে ভোগ করে যেতে পারব? কোনো মানুষ কি পারে? তো ওই টাকাটা তো আসলে আমার প্রয়োজন নেই। আমি বরং তার চেয়ে মনে করি, আমার জীবদ্দশায় যদি এমন কোনো একটা কাজ করে যেতে পারি, যে কাজ আমার মৃত্যুর ২০-৩০-৫০ বছর পরেও কাউকে প্রভাবিত করবে, সেটা আমার কাছে অনেক আকর্ষণীয় জীবন।
কোনো কিছুর সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই। যে অর্থ উপার্জন করতে পারছে, ওটা অবশ্যই যোগ্যতা। যে কোনো পেশায় অর্থ উপার্জন করতে পারা মানেই সেটা দোষের কিছু না। প্রত্যেকেই অনেক শ্রম দিয়ে, ঘাম দিয়ে তার জীবনের সিঁড়ি নির্ধারণ করেন। বিষয়টা হচ্ছে, তিনি কী চান আর আমি কী চাই। চাওয়াতে চাওয়াতে পার্থক্য। এখন আমার চাওয়াটা এমন, আমি স্বপ্ন দেখি যে, আমি পথের পাঁচালীর মতো কোনো একটা ছবির কোনো একটা চরিত্রে কাজ করব। এটা আমার স্বপ্ন। এখন একেকজন মানুষের স্বপ্ন একেক রকম হবে।
আন্তঃনগরে অনেকেই আপনার সাথে অনেকে আছেন। কিন্তু বিশেষ করে আপনার কো-আর্টিস্ট শ্যামল মাওলা। তাঁকে নিয়ে যদি কিছু বলেন?
শ্যামলের সাথে আমার পরিচয় একটু অন্যভাবে। আমি আমার পেশাগত অভিনয়জীবন শুরু করেছিলাম সিসিমপুরের মাধ্যমে। সিসিমপুরের সুমনা নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করতাম। শ্যামলের সাথে পরিচয় আমার সিসিমপুরের সেটে। সেখানে সুমনা এবং মুকুল চরিত্রে আমি আর চঞ্চল ভাই (চঞ্চল চৌধুরী) অভিনয় করতাম, আর শ্যামল ওখানে পাপেট প্লে করতো। আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম, সেদিন এক ইন্টারভিউতে শ্যামল বলছিল, পরে আমার মনে পড়ল। শ্যামল বলছিল, আজকে যে অভিনেতা শ্যামলকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই অভিনেতা শ্যামলের কাজের শুরুটা আমার মাধ্যমে। তখন শ্যামল দেশ নাটকে অভিনয় করে। আমি বলেছিলাম, তুমি অভিনয় (টিভিতে) করো না কেন? তারপর একটা বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে আমি একজনকে ওর কথা বলেছিলাম। তারপর সে কাজটা করে। তারপর আস্তে আস্তে ওর কাজ করবার শুরু।
এটা আমি ভুলে গেছিলাম। ও যখন এ কথা বললো, আমি অবাক হয়েছি, আবেগতাড়িত হয়েছি যে, ও এটা মনে রেখেছে। এই হচ্ছে আমার শ্যামলের সাথে পরিচয়, তারপর একসাথে অনেক কাজ হয়েছে। হইচইতে প্রথম আমাদের একটা ফিল্ম রিলিজ হয়েছিল আশফাক নিপুণের ‘কষ্টনীড়’। সেখানে আমরা ভাইবোনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। শ্যামলের সাথে আমার কাজের অভিজ্ঞতা সব সময়ই দারুণ। যে চরিত্রেই আমরা কাজ করেছি না কেন! আর অভিনেতা হিসেবে শ্যামল যে অসাধারণ সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কষ্টনীড়ে আপনার অভিনয় অনেক প্রশংসিত হয়েছিল। সব সময়ই আপনার অভিনয় প্রসঙ্গে দর্শক যে কমন কথাটা বলেন, আপনার অভিনয় খুবই ন্যাচারাল। বাস্তবতার কাছাকাছি গিয়ে আপনি অভিনয়টা করেন। এ ব্যাপারটা কি আপনি সচেতনভাবে মাথায় রাখেন?
এটার সত্যি উত্তর দিলে গোমর একদম ফাঁস হয়ে যাবে। সত্যি উত্তরটা হচ্ছে, কষ্টনীড়ের রেজোয়ানা, বা আন্তঃনগরের রোজিনা, বা ছিটকিনির মায়মুনা, বা হালদার জুঁই—এরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই জীবনগুলো আমি চিনি। এই জীবন দেখেই আমি বড় হয়েছি। সেজন্য আমি যখন এই জীবনের প্রতিনিধি হয়ে পর্দায় আসি, তখন আমাকে আলাদা কিছু মনে হয় না। আমি ওদেরকে চিনি। সত্যি বলতে, আমাকে যদি আজকে সমাজের খুব উচ্চবিত্ত কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে দেওয়া হয়, নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি ফেল করব। কারণ ওই জীবনটা আমি চিনি না। ওই জীবনটা আমি জানি না। এটা আমার সীমাবদ্ধতা। আমি ফেল করব, আমার ধারণা।
এই ঢাকা শহরের কিছু চরিত্র নিয়ে আন্তঃনগর সিনেমার গল্প। বলা হয়, এই ইট-পাথরের নগরে শুধুই কঠিন বাস্তবতা। এখানে ভালোবাসা, আন্তরিকতা এসব একটু কম। আপনি এত বছর ধরে ঢাকায় আছেন, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
এই শহর তো আমাকে দুহাত ভরে দিয়েছে। এসএসসি পর্যন্ত আমি সখীপুরে ছিলাম, তারপর ঢাকায় আসি। বদরুন্নেসা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি, তারপর ইডেনে অনার্স-মাস্টার্স। আমার বাবা-মা সে সময় টাঙ্গাইলে ছিলেন। ঢাকায় আমার থাকার জায়গা ছিল না। হলে আমার সিট হয়। তবে হলের গেট বন্ধ হয়ে যায় রাত ৮টায়। আমার নাগরিকের (নাট্যদল) রিহার্সেল হয় দশটা পর্যন্ত। যে সময়টার কথা আমি বলছি, সে সময়টায় অভিনয় করতে গেলে রাতে আমার ঢাকায় থাকবার জায়গা ছিল না। সেই একদম একলা, খালি হাতে, ঢাকায় একটা থাকবার ঘর পর্যন্ত নেই। সেই অবস্থা থেকে শুরু করে আজকে ঢাকা আমাকে ঘর দিয়েছে, বর দিয়েছে, সন্তান দিয়েছে। নাম দিয়েছে। দু-একজন মানুষ আমাকে চেনেন। আমার কাজ ভালোবাসেন। এ শহর তো আমাকে দু-হাত ভরে দিয়েছে।
মঞ্চে অভিনয়ের শুরুর দিকের কথা বলছিলেন। ওই সময় আপনার স্বপ্নটা কেমন ছিল?
ওই যে বলছিলাম ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আমি টাঙ্গাইলে ছিলাম। আমার এসএসসি পর্যন্ত। সে সময় রোজ টিভি দেখতাম। তখন সাপ্তাহিক নাটক হতো বৃহস্পতিবারে আর ধারাবাহিক নাটক হতো মঙ্গলবারে। ওটা ছিল সে সময়ের বড় বিনোদন, শুধু বিটিভি ছিল। আমি অভিনয় করতে চাই, এ স্বপ্নটাই আমার তৈরি হয়েছিল বিপাশা আপু, শমী আপু, জাহিদ ভাই, তৌকীর ভাই, মাহফুজ ভাই—তাঁদেরকে দেখে দেখে।
পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঙ্গে আপনার কাজও হয়েছে…
হ্যাঁ, পরবর্তী সময়ে তাঁরা সবাই আমার সহকর্মী হয়েছেন। তো তখন পত্রিকার বিনোদন পাতা ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। সেখানে আমি দেখতাম, শমী কায়সার ঢাকা থিয়েটার করেন। বিপাশা হায়াত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে অভিনয় করেন। আফসানা মিমি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে অভিনয় করেন। তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান নাট্যকেন্দ্রে অভিনয় করেন। যাঁরা আমার স্বপ্নের মানুষ প্রত্যেকে থিয়েটার করেন। যখন আমার ১২-১৩ বছর বয়স, তখন থেকে মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, আমি যদি অভিনয় করতে চাই, আমাকে থিয়েটার করতে হবে। তারপর আমি ঢাকায় আসি। বদরুন্নেছায় পড়ার সময় বাফাতে নাচ শিখি। বাফাতে নাচ করতে গিয়ে আমার সাথে পরিচয় হয় দাউদ হোসাইন রনির। সে সরাসরি থিয়েটার করত। যখন রনি যে দলটা করত, থিয়েটার, সেই দলে আমি রনির সাথে কয়েকদিন যাই। মাস দুয়েক-তিনেক। তারপর আমি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে ইন্টারভিউ দিই। নির্বাচিত হই। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে কাজ করতে শুরু করি। আপনি কি আমার নাগরিকের যাত্রা বা সেই সময়ের গল্পটা জানতে চান?
ওই সময়ে আপনার পরিকল্পনাটা কী ছিল?
আমি আসলে পরিকল্পনা করে কিছু করতে পারি না। আমি জানতাম, অভিনয় শেখার জায়গা থিয়েটার। ফলে আমি থিয়েটারে গিয়েছি। নাগরিকে যুক্ত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে আমি টিভি নাটকে কাজ করি। ওই সময়ে নাগরিকের সিনিয়র ভাইয়েরা একটা নাটকে কাজ করছিলেন। সে নাটকের পরিচালক ছিলেন কায়েস চৌধুরী। আমার জীবনের প্রথম নাটকের সহশিল্পী ছিলেন তৌকীর আহমেদ। সেটার শুটিং হয়েছিল টাঙ্গাইলে। কায়েস চৌধুরীর পরিচালনায় টাঙ্গাইলে আমি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। নাটকের নাম ছিল ‘গেরদালী’। এটা আমি বলছি ২০০২ সালের কথা। তারপর একটু একটু করে কাজ করছি। ২০০৪ সালে ডিসেম্বরে আমি যুক্ত হই ‘সিসিমপুর’-এর সাথে। আমি সিসিমপুরকেই ধরি আমার পেশাগত অভিনয়জীবনের শুরু হিসেবে।
আন্তঃনগর সিনেমায় আপনার চরিত্রের নাম রোজিনা। শ্যামলের চরিত্রের নাম ইলিয়াস। আরও কিছু নাম আছে—শুভ, পূর্ণিমা, মারুফ, মৌসুমী। এ সিনেমার সব চরিত্রের নাম বেশ ফিল্মি। এটা কেন?
আপনার প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু উত্তরটা আছে। কারণ, এই নামগুলো ফিল্মি। এর এদের জীবনের ফিল্মের নায়ক-নায়িকা। এরা এই নগরের নায়ক নায়িকা। এরা তাদের জীবনের নায়কা নায়িকা। এরা এই ফিল্মের নায়ক নায়িকা। সবার নাম যে ফিল্মি, এটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু আমাদের পরিচালকের চিন্তা ছিল, এটা আমরা আগে থেকে কোথাও বলবো না, বা এটা আমাদের পাবলিসিটি স্ট্যান্ট না।
এ সিনেমার শুটিং হয়েছে কোথায়?
আমার প্রথম লটের শুটিং হয়েছে মোহাম্মদপুরের বিহারী পল্লীতে। তারপর স্টেশনে শুটিং হয়েছে। আমার মূল কাজ হয়েছে বিহারী ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা বাড়িতে। একটা চারতলা বাড়ি। খুবই ছোট্ট, ঘিঞ্জি। একটা বড় অংশের কাজ হয়েছে পার্লারে। বাড়িতে রোজিনার যে জীবন, সেটা খুবই রঙহীন। একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন। আর যেখানে সে কাজ করে, সেখানটা রঙে ভরা। জৌলুসে ভরা। ঝকঝকে, কালারফুল।
তারকাদের ক্ষেত্রে তো পান থেকে চুন খসলে খবর হয়ে যায়। সব সময় এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালের এই চাপ অনুভব করেন কিনা?
আমি তো নিজেকে তারকা মনে করি না। আমি তো তারকা না। আমি একজন অভিনয়কর্মী, যে স্বপ্ন দেখে সে একদিন ভালো অভিনেতা হবে। আমি এই স্বপ্নটা দেখি, এবং স্বপ্নের পথে হাঁটার চেষ্টা করছি। একদম আমার বিশ্বাসের কথা এটা, আমি কোনো তারকা না।
তবে যে চাপের কথা বলছিলেন, সেটার উত্তর আমি দিচ্ছি। সেটা শুধু অভিনয়শিল্পী না, আমাদের দেশের খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ বা যে কোনো পেশার মানুষ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী; যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই আমরা যে মুহূর্তের মধ্যে একটা ডিসিশনে চলে আসি, মন্তব্য করে দেই, এটা খুব অসুস্থ চর্চা আমার মনে হয়। এটা আমাদের সমাজের জন্য, এটা আমাদের মানবিকতার জন্য সঠিক চর্চা বলে আমার মনে হয় না। বেশিরভাগ সময় আমরা ভাবি না, সেই মানুষটা বা সেই মানুষটা পরিবারের কথা। আমার কাছে এগুলো অমানবিক আচরণ। আমি একটু মানবিক মানুষ হতে চাই।
কিন্তু বলা হয় তো সমাজ এগোচ্ছে। সমাজ তো এগুচ্ছে, কিন্তু ট্রলিং, বুলিং, মানুষকে ছোট করা, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এসব তো বাড়ছে।
ভীষণভাবে বাড়ছে।
এটা আপনাকে বিরক্ত করে না?
আহত করে। আমি প্রতিদিন, প্রতিবেলায় নিজেকে আরেকটু সংশোধন করার চেষ্টা করি। আমি যতদিন বেঁচে আছি, এ চেষ্টাটাই করে যাবো। আমি চাই আমার দ্বারা পথিবীর একটি প্রাণ, শুধু মানুষ না, পৃথিবীর কোনো প্রাণীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি যেন আমার দ্বারা না হয়। আমার জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে এটা। আমি যখন এভাবে ভাবি, সেই আমি যখন দেখতে পাই মানুষ মানুষকে এভাবে আঘাত করছে, আহত করছে, ছোট করছে, অসম্মান করছে; তখন আমি আহত হই। আমি আমার সন্তানকে এভাবে বড় করতে চাই যে, পৃথিবীর কোনো প্রাণ যেন তোমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমরা সবাই এ পৃথিবীর বাসিন্দা, পৃথিবীর সবার অধিকার আছে এ পৃথিবীতে। কাউকে আঘাত করার অধিকার নেই। কারও ভালো করতে না পারি, চুপ থাকি অন্তত।
তারকা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করার আগে চিন্তাভাবনা করেন? মনের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো ভয় কাজ করে?
আমি আসলে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার কাজ ছাড়া খুব বেশি কিছু পোস্ট করি না। আপনি দেখতে পাবেন, গত দুই তিন-চার বছরের পুরোনো পোস্ট দেখলে বুঝতে পারবেন। তার আগে করতাম। সময়ের সাথে সাথে তো অনেক কিছু বুঝতে শিখি আমরা। একটু আগে বলছিলাম, আমি প্রতি বেলায় নিজেকে আরেকটু উন্নত করতে চাই। এখন কাজ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার পোস্ট খুব কম দেখতে পাবেন। হয়তো ঈদে বা পয়লা বৈশাখে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালাম। যেহেতু আমি শুধু কাজের বিষয়ে পোস্ট করি, সেক্ষেত্রে বাড়তি কোনো চাপ থাকে না। শুধু এইটুকু ব্যাপার যে, আমার সব কাজ যে সবার ভালো লাগবে তা তো নয়। সে আশাও আমি করতে পারি না। কাজের ক্ষেত্রে ভালোবাসা, সমালোচনা দুটোই আসবে। সেটাকে আমি স্বাগত জানাই। আমি এজন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যক্তিগত কোনো কিছু পোস্ট করি না কারণ, আমি মনে করি, দর্শকের সাথে আমার সম্পর্কটা হচ্ছে কাজের সম্পর্ক। তাঁদের কাছ থেকে আমার জন্য ভালোবাসা বা সমালোচনা যেটাই আসবে, সেটা কাজের মধ্য দিয়ে আসুক। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চায় থাকতে চাই না।
সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে আসা সব কমেন্ট পড়েন?
সব সময় পড়া হয় না। মাঝে মধ্যে পড়ি। কখনো সখনো আমার পেজের কমেন্টের উত্তরও দিই।
কঠিন পরিস্থিতিতে কার সঙ্গে কথা বলেন?
আমি বেশিরভাগ সময় রাজেশ্বরীর (রুনার মেয়ে) বাবার সঙ্গে কথা বলি। এছাড়া আমার আরও দুটো মেয়ে বন্ধু আছে। কিন্তু তারা এমন মানুষ যে, তারা চায় না তাঁদের নামটা সামনে আসুক। আমার আরও একটা বন্ধু আছে, যে ছেলে। ছেলে আর মেয়ে আর হলেই তো আমাদের অন্য একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। এজন্য আমি আলাদা করে বললাম। তারা আমার বন্ধু। তাদের সাথে আমার কথা বলার সময় ভাবতে হয় না। আমি যে কোনো কথা, যে কোনো বিষয় নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করতে পারি। আমি ভাগ্যবান।
বন্ধুভাগ্য তাহলে খুবই ভালো আপনার?
হয়তো তারা আমার সাথে সব সময় একমত হবে না। বা রাজেশ্বরীর বাবাও। আমি যা বলছি, যা ভাবছি, সব বিষয়ে সে একমত হবে তা নয়। আমাদের মতের পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা বলতে পারি। আমার জীবনের এমন কোনো কথা নেই, যা আমি রাজেশ্বরীর বাবার সাথে আলোচনা করতে পারি না। এটা একটা অদ্ভুত সম্পর্ক। আমি মনে করি, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হচ্ছে রাজেশ্বরীর বাবা।
রাজেশ্বরী তো বড় হচ্ছে। ওকে নিয়ে আপনাদের কী পরিকল্পনা?
আমার শুধু একটাই চাওয়া, আমার মেয়ে আত্মনির্ভরশীল মানুষ হোক। আমার মেয়ে এমন মানুষ হোক, যে মানুষ যা যা স্বপ্ন দেখবে, সব স্বপ্ন পূরণ করার যোগ্যতা যেন তার থাকে। আর ওর জীবনটা ও প্রাণভরে উপভোগ করুক।
ওর আগ্রহ কোনদিকে?
ও চায় পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে। এখন তো এটা বলছে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়। আমার ওর কাছে কিছু চাইবার নেই। আমার প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার কাছে, প্রকৃতির কাছে যে, আমার সন্তান সুস্থ থাকুক। সকল বাঙালি মায়ের মতো। আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। আর আমি চাই, আমার মেয়ে আত্মনির্ভরশীল হোক।
সিনেমায় কি রুনা খান তার পুরোটা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন?
না না। তা কী করে। সিনেমায় কেন, কোথাও নয়। এই প্রশ্নটা এলেই সবাই ভাবতে থাকে, আমি বোধহয় একটু বিনয় করে বলবার জন্য বলছি। একদম আমি আমার অন্তর থেকে বলছি। আমি স্বপ্ন দেখি সেই কাজ করবার, যে কাজ আমার মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে অভিনেতা হিসেবে। সে রকম কোনো কাজের ধারেকাছেও আমি যেতে পারিনি। জীবনে পারব কিনা সেটাও জানি না। তবে আমি স্বপ্নটা দেখি।
আমি যদি এখন বলি যে, আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমার অভিনীত চলচ্চিত্র অস্কার জয় করবে। সেটা শুনে অনেকেই হাসবেন। এই কথাটা শুনে লোকে হাসতে হাসতে মরে যাবে। কিন্তু যে কুপিবাতিওয়ালা টিনের ঘরে জন্মে, যে ধানখেতের আইল ধরে হেঁটে যাওয়া স্কুল থেকে পাশ করে, যে মেয়ে স্বপ্ন দেখেছিল অভিনয় করবে। ওখান থেকে আজকের রুনা খানের জার্নি যতটা কঠিন, এর চাইতে এখানে বসে অস্কার দেখবার স্বপ্ন কম কঠিন। যে পথ পার হয়ে এসেছি, সেটা এখন যে স্বপ্ন দেখছি তার তুলনায় অনেক বেশি কঠিন পথ ছিল। আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা জানি না। তবে স্বপ্নটা আমি আজীবন দেখে যাব।
আন্তঃনগর সিনেমায় এক সাধারণ মধ্যবিত্ত নারী রোজিনা চরিত্রে আপনি অভিনয় করেছেন। এই রকম মধ্যবিত্ত জীবন, তাদের বেচে থাকা, তাদের প্রেম, এত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের স্বপ্ন দেখা; এসব আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করে?
এটার উত্তর যদি আমি অনেস্টলি দিতে চাই, তাহলে যে উত্তরটা হবে, রোজিনা তো আন্তঃনগরের চরিত্র, আর আমি ব্যক্তি রুনা। ব্যক্তি রুনার জীবনটাই আসলে এটা। আমি একেবারেই মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মেয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। আমি জন্মেছি একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে। যে গ্রামে বিদ্যুৎ গিয়েছে যখন আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি তখন। তার আগ পর্যন্ত সেই গ্রামের মানুষ হারিকেন, কুপিবাতি জ্বালিয়ে চলতো। বাবার চাকরির সুবাদে আমি বড় হয়েছি একটা ছোট মফস্বল শহরে। আমার বন্ধুবান্ধব যারা, আমরা সবাই আসলে এ রকম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। তো আপনার প্রশ্ন যেটা ছিল, এ রকম মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন কীভাবে আমাকে ইন্সপায়ার করে! আসলে এটাই আমার জীবন। আমি এই জীবন থেকেই এসেছি। এটার উত্তর দিতে গেলে আসলে একটু লম্বা হয়ে যাবে।
আমাদের সময় আছে। আপনি বলুন।
যে গ্রামের কথা বলছিলাম, যে গ্রামে আমার বাবার জন্ম। গ্রামে তো কিছু বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া হয়। সেই পাড়ায় আমার বাবা প্রথম লোক যিনি এসএসসি পাশ করেছেন। সেই পাড়ায় আমিই প্রথম মেয়ে, যে এসএসসি পাশ করেছে। সেই পাড়ায় আমিই প্রথম মেয়ে, যে মাস্টার্স অব্দি পড়াশোনা করেছে। শুধু তাই না, আমার বাবার পরিবারে এবং মায়ের পরিবারে আমিই প্রথম মেয়ে যে মাস্টার্স পাশ করেছে। আমার বাবা এবং মায়ের পরিবারের ধারেকাছে কেউ কোথাও অভিনয়, নাচ, গান, শিল্প-সংস্কৃতি এসবের সঙ্গে যুক্ত না। সে রকম একটা জায়গায় জন্মে, স্কুলে পড়ার সময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করি আমি অভিনয় করব। ওই জায়গা থেকে আজকে এখানে এসে এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এই পুরো জীবনটাই আসলে ওই মধ্যবিত্ত পরিবারের। ওটাই আমার জীবন, ওটাই আমি। আমি এই জীবনটাই যাপন করি।
রুনা খানের বদল হয়নি তাহলে?
একদমই না। আমি ঘরে ডালভাত খাই। আমি ঘরে মেয়ের বাবার সাথে চিল্লাচিল্লি করি। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষরা যেমন করে। ঘরে ছেঁড়াতেনা কাপড় পরে থাকি। এটাই আমার জীবন।
আন্তঃনগরের রোজিনা খুবই পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ। আপনার নিজের একটা দারুণ পরিবার আছে। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমি বিশ্বাস করি, শুধু শিল্পী হিসেবে নয়। যে কোনো মানুষের জীবনে পরিবারটা হচ্ছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস। উৎসাহ বলেন, প্রেরণা বলেন, জীবনে যে কোনো ভালো কাজ করবার খুঁটির জোর, ওটা আমি মনে করি পরিবার। যে কোনো মানুষের জন্য। সে আপনি শিল্পী হন, ব্যবসায়ী হন, ডাক্তার হন, ইঞ্জিনিয়ার হন, শিক্ষক হন, যা-ই হন না কেন।
কিন্তু এখন সময়টা তো অস্থির। মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। ফলে সম্পর্ক ভাঙছে, পরিবার ভাঙছে। এটা শুধু শহরে হচ্ছে না তো নয়, গ্রামেও। এসব নিয়ে আপনার চিন্তা হয় কিনা?
আপনি খুব সুন্দর একটা শব্দ বলেছেন। অসহিষ্ণুতা। কর্মক্ষেত্রে, ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, সংসারজীবনের ক্ষেত্রে, আমরা যদি একটু সহিষ্ণুতা বাড়াবার চেষ্টা করি। সবাই সবার প্রতি। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি, বন্ধু হিসেবে বন্ধুর প্রতি, সহকর্মী হিসেবে সহকর্মীর প্রতি। অসহিষ্ণুতা পাশ কাটিয়ে সবার প্রতি যদি একটু ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করতে পারি, তাহলে হয়তো অনেক জটিলতা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।
মঞ্চ, টিভি নাটক, সিনেমা এবং এখন ওয়েব কনটেন্ট—সব মিলিয়ে অনেকদিন ধরে আপনি কাজ করছেন। সব সময়ই আপনি খুব সিলেকটিভ। আপনি একটা কাজের অংশ হয়ে আছেন মানে, সে কাজের ন্যুনতম একটা মানের নিশ্চয়তা আছে। আন্তঃনগর সিনেমায় অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন?
আবারও এখানে বলব পরিবারের কথা। আমার বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর। মানুষের তো একটাই জীবন, একটা আমার কর্মজীবন, আমি পেশাদার অভিনেতা, অভিনয়টা আমার কাজ। আরেকটা আমার ব্যক্তিজীবন। ঘরে আমি আমার সন্তানের মা। আমার সন্তানের বাবার সঙ্গী। আমি আসলে একজীবনে দুটো জীবনকেই উপভোগ করতে চাই। আমার কর্মজীবনটাকেও, আমার ব্যক্তিজীবনটাকেও। তো দুটো জীবনকে যদি আমি উপভোগ করতে চাই তাহলে দুটো জীবনের ক্ষেত্রেই আমাকে সমান গুরুত্ব এবং সময় দিতে হবে। আমি শুধু কর্মজীবন নিয়ে থাকলাম তাহলে আমার ব্যক্তিজীবনে প্রভাব পড়বে। অথবা শুধু ব্যক্তিজীবন নিয়ে থাকলে কর্মজীবনে প্রভাব পড়বে। তো এই দুই জীবন উপভোগ করবার লোভ থেকে আমি যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি, সারাবছর আমাকে পর্দায় দেখা যাবে, সেটা আমি চাইনি। বছরে আমাকে একটা দুটো কাজে পর্দায় দেখা যাক। কিন্তু যে কাজটা নিয়ে আমি আসব, সেটা যেন অন্তত একটা মান রাখে। যারা দেখবে তাদের যাতে মনে হয়, এটা একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো কাজ না। এটা আমার একটা সচেতন চেষ্টা এবং এই চেষ্টাটা গত ১৫ বছর ধরে করছি।
যে কারণে যখন আমি টিভি নাটক করেছি, বা চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, বা বিজ্ঞাপনে বা ওটিটিতে; প্রত্যেক জায়গায় ওই ব্যাপারটা থেকেছে। আমি যেহেতু বছরে কাজই করি খুব কম। তো এটা তো চাইবো, যে তিন-চারটা কাজ নিয়ে আসব, সেটা যেন খুব যাচ্ছেতাই মানের কাজ না হয়।
আর আন্তনগরের কথা বলছিলেন। আন্তনগরে কাজ করতে আগ্রহ বোধ করবার কারণ আসলে অনেক। প্রথমত পরিচালক গৌতম কৈরী। তাঁর কাজ আমি পছন্দ করি। যে গল্প তিনি আমাকে বলেছেন, যে চরিত্রে তিনি আমাকে ভেবেছেন, সে গল্প এবং চরিত্র আমার পছন্দ হয়েছে। এখানে আমার সহশিল্পী যাঁরা আছেন, তাঁরাও আমার খুব পছন্দের। একটা কাজের ক্ষেত্রে যখন এতগুলো বিষয় পছন্দসই হয়ে যায়, তখন সেই কাজটা না করার কোনো কারণ থাকে না।
আপনি বলছিলেন ব্যক্তিজীবন এবং পেশাগত জীবন—এর মাঝখানে বাউন্ডারি লাইনের কথা। এই সুযোগটা তো সবার ক্ষেত্রে হয় না। টাকার জন্যও অনেককে কাজ করতে হয়। একটা কাজের প্রস্তাব এলে সেটাকে না বলা, বা ফিরিয়ে দেওয়া… এটা তো কঠিন…
এখানে আমাদের আসলে কাজের ধরণটা এমন, আপনি তো জানেন, আমি সব সময় বলি এটা…
একটা কাজ করে এখানে অনেক টাকা পাওয়া যায় তাও তো নয়…
অনেক না হলেও আমরা একটু কাঁচা টাকার কাজ করি। কাঁচা টাকা বলতে, আমাদের কাজের ধরনটা আসলে দিনমজুরের মতো। মাসে আমি পাঁচদিন কাজ করলাম, পাঁচদিনের জন্য টাকা পেলাম। পঁচিশ দিন কাজ করলাম না, পঁচিশ দিনে একটা টাকাও নেই। একেবারে দিন মজুরের মতো কাজ। যখন আমি পাঁচ দিনের জায়গায় পনেরো দিন কাজে বেরুবো, পনেরো দিনই কিন্তু আমি টাকা পাব। ওই প্রতিদিন টাকা পাওয়ার লোভ… অবশ্যই মানুষের জীবনে টাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে ওই যে শুরুতে বলেছিলাম, আমি একটু ডালভাত খেয়ে অল্পে চলতে পারা মানুষ।
এই যে অল্পে তুষ্ট হওয়া। বা কতখানি হলে আমার প্রয়োজন মিটবে, এটা বুঝে ফেলা এবং সে অনুযায়ী জীবনের লক্ষ ঠিক করা। এটাতে আপনার পরিবারের কোনো ভূমিকা আছে কিনা?
অবশ্যই। পরিবার না শুধু, বন্ধু বা আশপাশের মানুষের (সবার ভূমিকা থাকে)। আমার মা একটা কথা বলেন, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। সঙ্গের একটা প্রভাব কিন্তু মানুষের ওপর পড়ে। তার চিন্তার প্রভাব। আর আমি আসলে যাদেরকে পছন্দ করি, তাদের দ্বারা অনেক প্রভাবিত হই। তাদের ভাবনার দ্বারা, বিশ্বাসের দ্বারা। আমি যে জীবনের কথা বলছি, যে দর্শনের কথা বলছি, এর পেছনে আমার পরিবার, আমার বর, আমার কাছের মানুষ যারা, তাদের অনেক প্রভাব আছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের পরিচয় হচ্ছে তার কাজ। অর্থ অবশ্যই জীবনে প্রয়োজন। কিন্তু একটা মানুষের জীবনের আয়ুষ্কাল কতটুকু! ৮০-৯০ বছর।
আমি শুধু আমার ভাবনাটা বলছি, কোনো বিতর্কের জন্য না। ধরেন আমি এক হাজার কোটি টাকার মালিক হলাম। এত টাকা কি আমি ৮০ বছরে ভোগ করে যেতে পারব? কোনো মানুষ কি পারে? তো ওই টাকাটা তো আসলে আমার প্রয়োজন নেই। আমি বরং তার চেয়ে মনে করি, আমার জীবদ্দশায় যদি এমন কোনো একটা কাজ করে যেতে পারি, যে কাজ আমার মৃত্যুর ২০-৩০-৫০ বছর পরেও কাউকে প্রভাবিত করবে, সেটা আমার কাছে অনেক আকর্ষণীয় জীবন।
কোনো কিছুর সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই। যে অর্থ উপার্জন করতে পারছে, ওটা অবশ্যই যোগ্যতা। যে কোনো পেশায় অর্থ উপার্জন করতে পারা মানেই সেটা দোষের কিছু না। প্রত্যেকেই অনেক শ্রম দিয়ে, ঘাম দিয়ে তার জীবনের সিঁড়ি নির্ধারণ করেন। বিষয়টা হচ্ছে, তিনি কী চান আর আমি কী চাই। চাওয়াতে চাওয়াতে পার্থক্য। এখন আমার চাওয়াটা এমন, আমি স্বপ্ন দেখি যে, আমি পথের পাঁচালীর মতো কোনো একটা ছবির কোনো একটা চরিত্রে কাজ করব। এটা আমার স্বপ্ন। এখন একেকজন মানুষের স্বপ্ন একেক রকম হবে।
আন্তঃনগরে অনেকেই আপনার সাথে অনেকে আছেন। কিন্তু বিশেষ করে আপনার কো-আর্টিস্ট শ্যামল মাওলা। তাঁকে নিয়ে যদি কিছু বলেন?
শ্যামলের সাথে আমার পরিচয় একটু অন্যভাবে। আমি আমার পেশাগত অভিনয়জীবন শুরু করেছিলাম সিসিমপুরের মাধ্যমে। সিসিমপুরের সুমনা নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করতাম। শ্যামলের সাথে পরিচয় আমার সিসিমপুরের সেটে। সেখানে সুমনা এবং মুকুল চরিত্রে আমি আর চঞ্চল ভাই (চঞ্চল চৌধুরী) অভিনয় করতাম, আর শ্যামল ওখানে পাপেট প্লে করতো। আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম, সেদিন এক ইন্টারভিউতে শ্যামল বলছিল, পরে আমার মনে পড়ল। শ্যামল বলছিল, আজকে যে অভিনেতা শ্যামলকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই অভিনেতা শ্যামলের কাজের শুরুটা আমার মাধ্যমে। তখন শ্যামল দেশ নাটকে অভিনয় করে। আমি বলেছিলাম, তুমি অভিনয় (টিভিতে) করো না কেন? তারপর একটা বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে আমি একজনকে ওর কথা বলেছিলাম। তারপর সে কাজটা করে। তারপর আস্তে আস্তে ওর কাজ করবার শুরু।
এটা আমি ভুলে গেছিলাম। ও যখন এ কথা বললো, আমি অবাক হয়েছি, আবেগতাড়িত হয়েছি যে, ও এটা মনে রেখেছে। এই হচ্ছে আমার শ্যামলের সাথে পরিচয়, তারপর একসাথে অনেক কাজ হয়েছে। হইচইতে প্রথম আমাদের একটা ফিল্ম রিলিজ হয়েছিল আশফাক নিপুণের ‘কষ্টনীড়’। সেখানে আমরা ভাইবোনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। শ্যামলের সাথে আমার কাজের অভিজ্ঞতা সব সময়ই দারুণ। যে চরিত্রেই আমরা কাজ করেছি না কেন! আর অভিনেতা হিসেবে শ্যামল যে অসাধারণ সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কষ্টনীড়ে আপনার অভিনয় অনেক প্রশংসিত হয়েছিল। সব সময়ই আপনার অভিনয় প্রসঙ্গে দর্শক যে কমন কথাটা বলেন, আপনার অভিনয় খুবই ন্যাচারাল। বাস্তবতার কাছাকাছি গিয়ে আপনি অভিনয়টা করেন। এ ব্যাপারটা কি আপনি সচেতনভাবে মাথায় রাখেন?
এটার সত্যি উত্তর দিলে গোমর একদম ফাঁস হয়ে যাবে। সত্যি উত্তরটা হচ্ছে, কষ্টনীড়ের রেজোয়ানা, বা আন্তঃনগরের রোজিনা, বা ছিটকিনির মায়মুনা, বা হালদার জুঁই—এরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই জীবনগুলো আমি চিনি। এই জীবন দেখেই আমি বড় হয়েছি। সেজন্য আমি যখন এই জীবনের প্রতিনিধি হয়ে পর্দায় আসি, তখন আমাকে আলাদা কিছু মনে হয় না। আমি ওদেরকে চিনি। সত্যি বলতে, আমাকে যদি আজকে সমাজের খুব উচ্চবিত্ত কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে দেওয়া হয়, নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি ফেল করব। কারণ ওই জীবনটা আমি চিনি না। ওই জীবনটা আমি জানি না। এটা আমার সীমাবদ্ধতা। আমি ফেল করব, আমার ধারণা।
এই ঢাকা শহরের কিছু চরিত্র নিয়ে আন্তঃনগর সিনেমার গল্প। বলা হয়, এই ইট-পাথরের নগরে শুধুই কঠিন বাস্তবতা। এখানে ভালোবাসা, আন্তরিকতা এসব একটু কম। আপনি এত বছর ধরে ঢাকায় আছেন, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
এই শহর তো আমাকে দুহাত ভরে দিয়েছে। এসএসসি পর্যন্ত আমি সখীপুরে ছিলাম, তারপর ঢাকায় আসি। বদরুন্নেসা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি, তারপর ইডেনে অনার্স-মাস্টার্স। আমার বাবা-মা সে সময় টাঙ্গাইলে ছিলেন। ঢাকায় আমার থাকার জায়গা ছিল না। হলে আমার সিট হয়। তবে হলের গেট বন্ধ হয়ে যায় রাত ৮টায়। আমার নাগরিকের (নাট্যদল) রিহার্সেল হয় দশটা পর্যন্ত। যে সময়টার কথা আমি বলছি, সে সময়টায় অভিনয় করতে গেলে রাতে আমার ঢাকায় থাকবার জায়গা ছিল না। সেই একদম একলা, খালি হাতে, ঢাকায় একটা থাকবার ঘর পর্যন্ত নেই। সেই অবস্থা থেকে শুরু করে আজকে ঢাকা আমাকে ঘর দিয়েছে, বর দিয়েছে, সন্তান দিয়েছে। নাম দিয়েছে। দু-একজন মানুষ আমাকে চেনেন। আমার কাজ ভালোবাসেন। এ শহর তো আমাকে দু-হাত ভরে দিয়েছে।
মঞ্চে অভিনয়ের শুরুর দিকের কথা বলছিলেন। ওই সময় আপনার স্বপ্নটা কেমন ছিল?
ওই যে বলছিলাম ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আমি টাঙ্গাইলে ছিলাম। আমার এসএসসি পর্যন্ত। সে সময় রোজ টিভি দেখতাম। তখন সাপ্তাহিক নাটক হতো বৃহস্পতিবারে আর ধারাবাহিক নাটক হতো মঙ্গলবারে। ওটা ছিল সে সময়ের বড় বিনোদন, শুধু বিটিভি ছিল। আমি অভিনয় করতে চাই, এ স্বপ্নটাই আমার তৈরি হয়েছিল বিপাশা আপু, শমী আপু, জাহিদ ভাই, তৌকীর ভাই, মাহফুজ ভাই—তাঁদেরকে দেখে দেখে।
পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঙ্গে আপনার কাজও হয়েছে…
হ্যাঁ, পরবর্তী সময়ে তাঁরা সবাই আমার সহকর্মী হয়েছেন। তো তখন পত্রিকার বিনোদন পাতা ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। সেখানে আমি দেখতাম, শমী কায়সার ঢাকা থিয়েটার করেন। বিপাশা হায়াত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে অভিনয় করেন। আফসানা মিমি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে অভিনয় করেন। তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান নাট্যকেন্দ্রে অভিনয় করেন। যাঁরা আমার স্বপ্নের মানুষ প্রত্যেকে থিয়েটার করেন। যখন আমার ১২-১৩ বছর বয়স, তখন থেকে মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, আমি যদি অভিনয় করতে চাই, আমাকে থিয়েটার করতে হবে। তারপর আমি ঢাকায় আসি। বদরুন্নেছায় পড়ার সময় বাফাতে নাচ শিখি। বাফাতে নাচ করতে গিয়ে আমার সাথে পরিচয় হয় দাউদ হোসাইন রনির। সে সরাসরি থিয়েটার করত। যখন রনি যে দলটা করত, থিয়েটার, সেই দলে আমি রনির সাথে কয়েকদিন যাই। মাস দুয়েক-তিনেক। তারপর আমি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে ইন্টারভিউ দিই। নির্বাচিত হই। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে কাজ করতে শুরু করি। আপনি কি আমার নাগরিকের যাত্রা বা সেই সময়ের গল্পটা জানতে চান?
ওই সময়ে আপনার পরিকল্পনাটা কী ছিল?
আমি আসলে পরিকল্পনা করে কিছু করতে পারি না। আমি জানতাম, অভিনয় শেখার জায়গা থিয়েটার। ফলে আমি থিয়েটারে গিয়েছি। নাগরিকে যুক্ত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে আমি টিভি নাটকে কাজ করি। ওই সময়ে নাগরিকের সিনিয়র ভাইয়েরা একটা নাটকে কাজ করছিলেন। সে নাটকের পরিচালক ছিলেন কায়েস চৌধুরী। আমার জীবনের প্রথম নাটকের সহশিল্পী ছিলেন তৌকীর আহমেদ। সেটার শুটিং হয়েছিল টাঙ্গাইলে। কায়েস চৌধুরীর পরিচালনায় টাঙ্গাইলে আমি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। নাটকের নাম ছিল ‘গেরদালী’। এটা আমি বলছি ২০০২ সালের কথা। তারপর একটু একটু করে কাজ করছি। ২০০৪ সালে ডিসেম্বরে আমি যুক্ত হই ‘সিসিমপুর’-এর সাথে। আমি সিসিমপুরকেই ধরি আমার পেশাগত অভিনয়জীবনের শুরু হিসেবে।
আন্তঃনগর সিনেমায় আপনার চরিত্রের নাম রোজিনা। শ্যামলের চরিত্রের নাম ইলিয়াস। আরও কিছু নাম আছে—শুভ, পূর্ণিমা, মারুফ, মৌসুমী। এ সিনেমার সব চরিত্রের নাম বেশ ফিল্মি। এটা কেন?
আপনার প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু উত্তরটা আছে। কারণ, এই নামগুলো ফিল্মি। এর এদের জীবনের ফিল্মের নায়ক-নায়িকা। এরা এই নগরের নায়ক নায়িকা। এরা তাদের জীবনের নায়কা নায়িকা। এরা এই ফিল্মের নায়ক নায়িকা। সবার নাম যে ফিল্মি, এটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু আমাদের পরিচালকের চিন্তা ছিল, এটা আমরা আগে থেকে কোথাও বলবো না, বা এটা আমাদের পাবলিসিটি স্ট্যান্ট না।
এ সিনেমার শুটিং হয়েছে কোথায়?
আমার প্রথম লটের শুটিং হয়েছে মোহাম্মদপুরের বিহারী পল্লীতে। তারপর স্টেশনে শুটিং হয়েছে। আমার মূল কাজ হয়েছে বিহারী ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা বাড়িতে। একটা চারতলা বাড়ি। খুবই ছোট্ট, ঘিঞ্জি। একটা বড় অংশের কাজ হয়েছে পার্লারে। বাড়িতে রোজিনার যে জীবন, সেটা খুবই রঙহীন। একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন। আর যেখানে সে কাজ করে, সেখানটা রঙে ভরা। জৌলুসে ভরা। ঝকঝকে, কালারফুল।
তারকাদের ক্ষেত্রে তো পান থেকে চুন খসলে খবর হয়ে যায়। সব সময় এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালের এই চাপ অনুভব করেন কিনা?
আমি তো নিজেকে তারকা মনে করি না। আমি তো তারকা না। আমি একজন অভিনয়কর্মী, যে স্বপ্ন দেখে সে একদিন ভালো অভিনেতা হবে। আমি এই স্বপ্নটা দেখি, এবং স্বপ্নের পথে হাঁটার চেষ্টা করছি। একদম আমার বিশ্বাসের কথা এটা, আমি কোনো তারকা না।
তবে যে চাপের কথা বলছিলেন, সেটার উত্তর আমি দিচ্ছি। সেটা শুধু অভিনয়শিল্পী না, আমাদের দেশের খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ বা যে কোনো পেশার মানুষ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী; যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই আমরা যে মুহূর্তের মধ্যে একটা ডিসিশনে চলে আসি, মন্তব্য করে দেই, এটা খুব অসুস্থ চর্চা আমার মনে হয়। এটা আমাদের সমাজের জন্য, এটা আমাদের মানবিকতার জন্য সঠিক চর্চা বলে আমার মনে হয় না। বেশিরভাগ সময় আমরা ভাবি না, সেই মানুষটা বা সেই মানুষটা পরিবারের কথা। আমার কাছে এগুলো অমানবিক আচরণ। আমি একটু মানবিক মানুষ হতে চাই।
কিন্তু বলা হয় তো সমাজ এগোচ্ছে। সমাজ তো এগুচ্ছে, কিন্তু ট্রলিং, বুলিং, মানুষকে ছোট করা, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এসব তো বাড়ছে।
ভীষণভাবে বাড়ছে।
এটা আপনাকে বিরক্ত করে না?
আহত করে। আমি প্রতিদিন, প্রতিবেলায় নিজেকে আরেকটু সংশোধন করার চেষ্টা করি। আমি যতদিন বেঁচে আছি, এ চেষ্টাটাই করে যাবো। আমি চাই আমার দ্বারা পথিবীর একটি প্রাণ, শুধু মানুষ না, পৃথিবীর কোনো প্রাণীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি যেন আমার দ্বারা না হয়। আমার জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে এটা। আমি যখন এভাবে ভাবি, সেই আমি যখন দেখতে পাই মানুষ মানুষকে এভাবে আঘাত করছে, আহত করছে, ছোট করছে, অসম্মান করছে; তখন আমি আহত হই। আমি আমার সন্তানকে এভাবে বড় করতে চাই যে, পৃথিবীর কোনো প্রাণ যেন তোমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমরা সবাই এ পৃথিবীর বাসিন্দা, পৃথিবীর সবার অধিকার আছে এ পৃথিবীতে। কাউকে আঘাত করার অধিকার নেই। কারও ভালো করতে না পারি, চুপ থাকি অন্তত।
তারকা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করার আগে চিন্তাভাবনা করেন? মনের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো ভয় কাজ করে?
আমি আসলে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার কাজ ছাড়া খুব বেশি কিছু পোস্ট করি না। আপনি দেখতে পাবেন, গত দুই তিন-চার বছরের পুরোনো পোস্ট দেখলে বুঝতে পারবেন। তার আগে করতাম। সময়ের সাথে সাথে তো অনেক কিছু বুঝতে শিখি আমরা। একটু আগে বলছিলাম, আমি প্রতি বেলায় নিজেকে আরেকটু উন্নত করতে চাই। এখন কাজ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার পোস্ট খুব কম দেখতে পাবেন। হয়তো ঈদে বা পয়লা বৈশাখে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালাম। যেহেতু আমি শুধু কাজের বিষয়ে পোস্ট করি, সেক্ষেত্রে বাড়তি কোনো চাপ থাকে না। শুধু এইটুকু ব্যাপার যে, আমার সব কাজ যে সবার ভালো লাগবে তা তো নয়। সে আশাও আমি করতে পারি না। কাজের ক্ষেত্রে ভালোবাসা, সমালোচনা দুটোই আসবে। সেটাকে আমি স্বাগত জানাই। আমি এজন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যক্তিগত কোনো কিছু পোস্ট করি না কারণ, আমি মনে করি, দর্শকের সাথে আমার সম্পর্কটা হচ্ছে কাজের সম্পর্ক। তাঁদের কাছ থেকে আমার জন্য ভালোবাসা বা সমালোচনা যেটাই আসবে, সেটা কাজের মধ্য দিয়ে আসুক। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চায় থাকতে চাই না।
সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে আসা সব কমেন্ট পড়েন?
সব সময় পড়া হয় না। মাঝে মধ্যে পড়ি। কখনো সখনো আমার পেজের কমেন্টের উত্তরও দিই।
কঠিন পরিস্থিতিতে কার সঙ্গে কথা বলেন?
আমি বেশিরভাগ সময় রাজেশ্বরীর (রুনার মেয়ে) বাবার সঙ্গে কথা বলি। এছাড়া আমার আরও দুটো মেয়ে বন্ধু আছে। কিন্তু তারা এমন মানুষ যে, তারা চায় না তাঁদের নামটা সামনে আসুক। আমার আরও একটা বন্ধু আছে, যে ছেলে। ছেলে আর মেয়ে আর হলেই তো আমাদের অন্য একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। এজন্য আমি আলাদা করে বললাম। তারা আমার বন্ধু। তাদের সাথে আমার কথা বলার সময় ভাবতে হয় না। আমি যে কোনো কথা, যে কোনো বিষয় নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করতে পারি। আমি ভাগ্যবান।
বন্ধুভাগ্য তাহলে খুবই ভালো আপনার?
হয়তো তারা আমার সাথে সব সময় একমত হবে না। বা রাজেশ্বরীর বাবাও। আমি যা বলছি, যা ভাবছি, সব বিষয়ে সে একমত হবে তা নয়। আমাদের মতের পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা বলতে পারি। আমার জীবনের এমন কোনো কথা নেই, যা আমি রাজেশ্বরীর বাবার সাথে আলোচনা করতে পারি না। এটা একটা অদ্ভুত সম্পর্ক। আমি মনে করি, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হচ্ছে রাজেশ্বরীর বাবা।
রাজেশ্বরী তো বড় হচ্ছে। ওকে নিয়ে আপনাদের কী পরিকল্পনা?
আমার শুধু একটাই চাওয়া, আমার মেয়ে আত্মনির্ভরশীল মানুষ হোক। আমার মেয়ে এমন মানুষ হোক, যে মানুষ যা যা স্বপ্ন দেখবে, সব স্বপ্ন পূরণ করার যোগ্যতা যেন তার থাকে। আর ওর জীবনটা ও প্রাণভরে উপভোগ করুক।
ওর আগ্রহ কোনদিকে?
ও চায় পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে। এখন তো এটা বলছে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়। আমার ওর কাছে কিছু চাইবার নেই। আমার প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার কাছে, প্রকৃতির কাছে যে, আমার সন্তান সুস্থ থাকুক। সকল বাঙালি মায়ের মতো। আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। আর আমি চাই, আমার মেয়ে আত্মনির্ভরশীল হোক।
সিনেমায় কি রুনা খান তার পুরোটা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন?
না না। তা কী করে। সিনেমায় কেন, কোথাও নয়। এই প্রশ্নটা এলেই সবাই ভাবতে থাকে, আমি বোধহয় একটু বিনয় করে বলবার জন্য বলছি। একদম আমি আমার অন্তর থেকে বলছি। আমি স্বপ্ন দেখি সেই কাজ করবার, যে কাজ আমার মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে অভিনেতা হিসেবে। সে রকম কোনো কাজের ধারেকাছেও আমি যেতে পারিনি। জীবনে পারব কিনা সেটাও জানি না। তবে আমি স্বপ্নটা দেখি।
আমি যদি এখন বলি যে, আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমার অভিনীত চলচ্চিত্র অস্কার জয় করবে। সেটা শুনে অনেকেই হাসবেন। এই কথাটা শুনে লোকে হাসতে হাসতে মরে যাবে। কিন্তু যে কুপিবাতিওয়ালা টিনের ঘরে জন্মে, যে ধানখেতের আইল ধরে হেঁটে যাওয়া স্কুল থেকে পাশ করে, যে মেয়ে স্বপ্ন দেখেছিল অভিনয় করবে। ওখান থেকে আজকের রুনা খানের জার্নি যতটা কঠিন, এর চাইতে এখানে বসে অস্কার দেখবার স্বপ্ন কম কঠিন। যে পথ পার হয়ে এসেছি, সেটা এখন যে স্বপ্ন দেখছি তার তুলনায় অনেক বেশি কঠিন পথ ছিল। আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা জানি না। তবে স্বপ্নটা আমি আজীবন দেখে যাব।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে