ইউভাল নোয়াহ হারারি
ইউক্রেন সংকটের ঠিক মাঝখানে ইতিহাসের প্রকৃতি ও মানবধর্ম সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে—পরিবর্তন কি সম্ভব? মানুষ কি তার আচরণ পরিবর্তন করতে পারে, নাকি ঐতিহাসিকভাবে পুনরাবৃত্তি করে যায়? মানুষ তার সাজসজ্জার পরিবর্তন করা ছাড়া আর কীই-বা করতে পারে? সে কি অতীতের ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তিতে শুধু নিন্দাই জানিয়ে যায়?
পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে খুব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে চিন্তাবিদদের একটি দল। তারা মনে করেন, পৃথিবী একটি জঙ্গল। এখানে দুর্বলের ওপর সবলেরা নিপীড়ন চালায়। এখানে একমাত্র সামরিক শক্তিই এক দেশের আক্রমণ থেকে আরেক দেশকে রক্ষা করে। পৃথিবী সব সময় এভাবেই চলেছে। আগামী দিনগুলোতেও এভাবেই চলবে। যারা এই জঙ্গলের আইনে বিশ্বাস করে না, তারা আসলে নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। নিজেদের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তারা খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না এই পৃথিবীতে।
অন্য আরেক দল চিন্তাবিদ মনে করেন, তথাকথিত ‘জঙ্গল আইন’টি মোটেও প্রকৃতিসম্মত নয়। এই আইন মানুষই তৈরি করেছে এবং মানুষই এর পরিবর্তন করতে পারে।
জনপ্রিয় এসব ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতেও কথা আছে। পৃথিবীর প্রথম সংঘটিত যুদ্ধের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে আজ থেকে ১৩ হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নথিতে। এমনকি সেই তারিখের পরেও পৃথিবীতে অনেক অনেক সময় বয়ে গেছে, যে সময়গুলোতে যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু তার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। যুদ্ধ প্রকৃতির কোনো মৌলিক শক্তি নয়। যুদ্ধের তীব্রতা ও অস্তিত্ব নির্ভর করে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর। এই কারণগুলো যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি পরিবর্তিত হয় যুদ্ধও।
এ রকম পরিবর্তনের প্রমাণ আমাদের চারপাশে আরও আছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে। এই অস্ত্র বৃদ্ধি তাদের যুদ্ধংদেহী মানসিকতাকে হৃষ্টপুষ্ট করেছে। ফলে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, পরাশক্তিগুলো সম্মিলিতভাবে আত্মহত্যা করার মতো পাগলামি করতে যাচ্ছে। তবে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কম হিংসাত্মক উপায়ও খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে পরাশক্তিগুলো। সে কারণেই গত সাত দশকে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি।আর এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বস্তুবাদী থেকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। একসময় পৃথিবীর সম্পদের প্রধান উৎস ছিল সোনার খনি, গমের খেত, তেলের খনি—এ রকম বৈষয়িক সম্পদ। এখন সম্পদের মূল উৎস হচ্ছে জ্ঞান। আপনি এই যুগে বলপ্রয়োগ করে তেলের খনি দখল করতে পারেন, কিন্তু এই পন্থায় জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। ফলে বলপ্রয়োগ থেকে মুনাফার অর্জনের সম্ভাবনা কমে গেছে।
শান্তির পরিমাপক
যুদ্ধ করার মানসিকতার পরিবর্তন যে ঘটেছে, তা অসংখ্য পরিসংখ্যানে প্রমাণিত। ১৯৪৫ সাল থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ দখল করা তুলনামূলকভাবে বিরল হয়ে উঠেছে। বাইরের কোনো দেশ একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রকে দখল করে নিয়েছে এবং মানচিত্র থেকে মুছে ফেলেছে—এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে গৃহযুদ্ধ ও বিদ্রোহের মতো নানা ঘটনা অবশ্য ঘটেছে। এসব সংঘাতকে বিবেচনায় নিয়েও বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে আত্মহত্যা, গাড়ি দুর্ঘটনা বা স্থূলতাজনিত রোগের তুলনায় মানবসৃষ্ট সহিংসতায় কম মানুষ মারা গেছে। চিনির চেয়ে বারুদ কম প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে শান্তির মানে দাঁড়িয়েছে ‘যুদ্ধের অবাস্তবতা’। অনেক পরাশক্তি দেশের জন্যই প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করা এবং জয় করা প্রায় অকল্পনীয় হয়ে উঠেছে। আমি মধ্যপ্রাচ্যে বাস করি, সুতরাং আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল যে এই প্রবণতাগুলোরও ব্যতিক্রম রয়েছে। তবে যুদ্ধের একটি অবাস্তব ধারণা হয়ে ওঠাকে স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এর ব্যতিক্রম চিহ্নিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই ‘নতুন শান্তি’র বিষয়টি শুধু পরিসংখ্যানগত সাফল্য বা হিপিদের কল্পকাহিনির মতো ব্যাপার নয়। এটি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে ঠান্ডা মাথায় হিসাব করা বার্ষিক বাজেটে। সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো তাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বাজেটে গড়ে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করেছে। এর চেয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য কল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা হয়েছে ঢের বেশি।
এটি মানব ইতিহাসের এক আশ্চর্যজনক ও অভিনব পরিবর্তন। যদিও মানুষ একে সাধারণত ‘প্রাপ্য’ হিসেবে বিবেচনা করতে পছন্দ করে। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা দেখে এসেছি, প্রত্যেক যুবরাজ, খান, সুলতান ও সম্রাট তাঁদের বাজেটের সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতেন সামরিক খাতে। তাঁরা জনসাধারণের জন্য শিক্ষা বা চিকিৎসা সহায়তার জন্য খুব কম অর্থই খরচ করতেন।
যুদ্ধ কমে আসার এ বিষয়টি স্বর্গীয় কোনো আশীর্বাদ নয় বা প্রকৃতির আইনের কোনো নাটকীয় পরিবর্তনেও এটি ঘটেনি। মানুষ অপেক্ষাকৃত ভালো বিকল্প বেছে নেওয়াতেই এমনটা ঘটেছে। মানুষই যুদ্ধের বদলে অন্য পন্থা বেছে নিয়েছে। আধুনিক সভ্যতায় রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে সবচেয়ে বড় অর্জন এটি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটি মানুষের ইচ্ছাতেই ঘটেছে বলে এর উল্টোটাও সম্ভব।
পৃথিবীতে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পরিবর্তন এখনো ঘটছে। সাইবার অস্ত্রের উত্থান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত অর্থনীতি এবং নবধারার সামরিক সংস্কৃতির কারণে আমরা হয়তো অচিরেই যুদ্ধের একটি নতুন যুগ দেখব। এ কারণেই রুশ বাহিনীর ইউক্রেন আক্রমণের হুমকি পৃথিবীর মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো যদি তাদের প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলোর ওপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে তা সারা বিশ্বের মানুষের অনুভূতি ও আচরণকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে। জঙ্গলের আইন ফিরে আসার প্রথম ও সবচেয়ে সুস্পষ্ট সাফল্য হবে অন্য সবকিছুর চেয়ে সামরিক ব্যয়ে অর্থের জোগান বাড়ানো এবং এর অর্থ হচ্ছে শিক্ষক, নার্স ও সমাজকর্মীদের কাছে অর্থ না দিয়ে, তা ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার অস্ত্রের কাছে নিয়ে যাওয়া।
পৃথিবী যদি জঙ্গলের আইনে ফিরে যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় রোধ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মতো ইস্যুতে বৈশ্বিক সহযোগিতা ক্ষুণ্ন হবে। যে দেশ আপনাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা সহজ নয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাজাত অস্ত্রের ইঁদুর দৌড় যদি গতি পায়, তবে তা এমন এক দুষ্টচক্রের সৃষ্টি করবে, যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইতিহাসের দিকনির্দেশনা
আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে ঐতিহাসিক প্রথা কখনোই পরিবর্তন হবে না, মানবতা জঙ্গল ত্যাগ করেনি এবং কখনোই করবে না—তাহলে আপনাকে হয় শিকারি অথবা শিকারের ভবিতব্য মেনে নিতে হবে। কিন্তু জঙ্গলের আইন বেছে নেওয়ার বিষয়টি কি বিকল্প উপায়, নাকি অনিবার্য বিষয়? যদি অনিবার্যই হয়, তাহলে প্রতিবেশী দেশকে দখল করে নেওয়া নেতাটি মানুষের স্মৃতিতে একটি বিশেষ স্থানে আসীন হবেন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এটি হবে নিঃসন্দেহে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। তিনি ইতিহাসে সেই ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবেন, যিনি আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনকে ধ্বংস করেছিলেন। আমরা যখন ভাবছিলাম, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছি, ঠিক তখনই তিনি আবার আমাদের টেনে জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলেন।
ইউক্রেনে কী হবে, জানি না। তবে একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি পরিবর্তনের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করি। আমি মনে করি না যে এটি নির্বোধের ভাবনা; বরং এটিই বাস্তববাদী। মানব ইতিহাসে ধ্রুব সত্য হলো পরিবর্তন। এটি এমন এক ব্যাপার, যা আমরা সম্ভবত ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে শিখতে পারি। বহু প্রজন্ম ধরে ইউক্রেনের অধিবাসীরা অত্যাচার ও সহিংসতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা জারদের দুই শতাব্দীর স্বৈরশাসন সহ্য করেছে। তাদের স্বাধীন হওয়ার ক্ষণস্থায়ী চেষ্টা রাশিয়ার রেড আর্মি ধূলিসাৎ করে রুশ শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইউক্রেনীয়রা তখন হলডোমোর, স্তালিনবাদী সন্ত্রাস, নাৎসি দখলদারত্ব এবং কয়েক দশকের কমিউনিস্ট একনায়কত্বের ভয়ানক মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মধ্যে বেঁচে ছিল।
তবে এত কিছুর পরও ইউক্রেনের মানুষেরা ভিন্নভাবে ভেবেছিল। ভেতরটা নিংড়ে নেওয়া দারিদ্র্য এবং পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইউক্রেনীয়রা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। বেলারুশ বা রাশিয়ার মতো ছিল না ইউক্রেন। সেখানে ক্ষমতাসীনের কুর্সি নিয়মিত বিরতিতে পরিবর্তন হতে থাকে, বিরোধীরা চলে আসতে পারে গদিতে। এরপর ২০০৪ সালে একবার এবং ২০১৩ সালে আরও একবার স্বৈরাচারী শাসনের হুমকির মুখোমুখি হয়েছিল ইউক্রেন। সেই সময়েও দেশটির নাগরিকেরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য দুর্বার বিপ্লব করেছিল। সুতরাং তাদের গণতন্ত্র একটি নতুন বস্তু। ‘নতুন শান্তি’ও তাই। দুটোই ভঙ্গুর ও নড়বড়ে, হয়তো বেশি দিন না-ও টিকতে পারে। তারপরও বলা যায়, শান্তি ও গণতন্ত্র—দুই-ই সম্ভব। কারণ, প্রতিটি পুরোনো জিনিস একসময় নতুনই ছিল। সবকিছুই শেষ পর্যন্ত স্রেফ মানুষের বেছে নেওয়ার ওপর নির্ভর করে।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত খবর আরও পড়ুন:
ইউক্রেন সংকটের ঠিক মাঝখানে ইতিহাসের প্রকৃতি ও মানবধর্ম সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে—পরিবর্তন কি সম্ভব? মানুষ কি তার আচরণ পরিবর্তন করতে পারে, নাকি ঐতিহাসিকভাবে পুনরাবৃত্তি করে যায়? মানুষ তার সাজসজ্জার পরিবর্তন করা ছাড়া আর কীই-বা করতে পারে? সে কি অতীতের ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তিতে শুধু নিন্দাই জানিয়ে যায়?
পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে খুব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে চিন্তাবিদদের একটি দল। তারা মনে করেন, পৃথিবী একটি জঙ্গল। এখানে দুর্বলের ওপর সবলেরা নিপীড়ন চালায়। এখানে একমাত্র সামরিক শক্তিই এক দেশের আক্রমণ থেকে আরেক দেশকে রক্ষা করে। পৃথিবী সব সময় এভাবেই চলেছে। আগামী দিনগুলোতেও এভাবেই চলবে। যারা এই জঙ্গলের আইনে বিশ্বাস করে না, তারা আসলে নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। নিজেদের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তারা খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না এই পৃথিবীতে।
অন্য আরেক দল চিন্তাবিদ মনে করেন, তথাকথিত ‘জঙ্গল আইন’টি মোটেও প্রকৃতিসম্মত নয়। এই আইন মানুষই তৈরি করেছে এবং মানুষই এর পরিবর্তন করতে পারে।
জনপ্রিয় এসব ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতেও কথা আছে। পৃথিবীর প্রথম সংঘটিত যুদ্ধের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে আজ থেকে ১৩ হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নথিতে। এমনকি সেই তারিখের পরেও পৃথিবীতে অনেক অনেক সময় বয়ে গেছে, যে সময়গুলোতে যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু তার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। যুদ্ধ প্রকৃতির কোনো মৌলিক শক্তি নয়। যুদ্ধের তীব্রতা ও অস্তিত্ব নির্ভর করে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর। এই কারণগুলো যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি পরিবর্তিত হয় যুদ্ধও।
এ রকম পরিবর্তনের প্রমাণ আমাদের চারপাশে আরও আছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে। এই অস্ত্র বৃদ্ধি তাদের যুদ্ধংদেহী মানসিকতাকে হৃষ্টপুষ্ট করেছে। ফলে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, পরাশক্তিগুলো সম্মিলিতভাবে আত্মহত্যা করার মতো পাগলামি করতে যাচ্ছে। তবে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কম হিংসাত্মক উপায়ও খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে পরাশক্তিগুলো। সে কারণেই গত সাত দশকে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি।আর এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বস্তুবাদী থেকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। একসময় পৃথিবীর সম্পদের প্রধান উৎস ছিল সোনার খনি, গমের খেত, তেলের খনি—এ রকম বৈষয়িক সম্পদ। এখন সম্পদের মূল উৎস হচ্ছে জ্ঞান। আপনি এই যুগে বলপ্রয়োগ করে তেলের খনি দখল করতে পারেন, কিন্তু এই পন্থায় জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। ফলে বলপ্রয়োগ থেকে মুনাফার অর্জনের সম্ভাবনা কমে গেছে।
শান্তির পরিমাপক
যুদ্ধ করার মানসিকতার পরিবর্তন যে ঘটেছে, তা অসংখ্য পরিসংখ্যানে প্রমাণিত। ১৯৪৫ সাল থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ দখল করা তুলনামূলকভাবে বিরল হয়ে উঠেছে। বাইরের কোনো দেশ একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রকে দখল করে নিয়েছে এবং মানচিত্র থেকে মুছে ফেলেছে—এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে গৃহযুদ্ধ ও বিদ্রোহের মতো নানা ঘটনা অবশ্য ঘটেছে। এসব সংঘাতকে বিবেচনায় নিয়েও বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে আত্মহত্যা, গাড়ি দুর্ঘটনা বা স্থূলতাজনিত রোগের তুলনায় মানবসৃষ্ট সহিংসতায় কম মানুষ মারা গেছে। চিনির চেয়ে বারুদ কম প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে শান্তির মানে দাঁড়িয়েছে ‘যুদ্ধের অবাস্তবতা’। অনেক পরাশক্তি দেশের জন্যই প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করা এবং জয় করা প্রায় অকল্পনীয় হয়ে উঠেছে। আমি মধ্যপ্রাচ্যে বাস করি, সুতরাং আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল যে এই প্রবণতাগুলোরও ব্যতিক্রম রয়েছে। তবে যুদ্ধের একটি অবাস্তব ধারণা হয়ে ওঠাকে স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এর ব্যতিক্রম চিহ্নিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই ‘নতুন শান্তি’র বিষয়টি শুধু পরিসংখ্যানগত সাফল্য বা হিপিদের কল্পকাহিনির মতো ব্যাপার নয়। এটি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে ঠান্ডা মাথায় হিসাব করা বার্ষিক বাজেটে। সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো তাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বাজেটে গড়ে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করেছে। এর চেয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য কল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা হয়েছে ঢের বেশি।
এটি মানব ইতিহাসের এক আশ্চর্যজনক ও অভিনব পরিবর্তন। যদিও মানুষ একে সাধারণত ‘প্রাপ্য’ হিসেবে বিবেচনা করতে পছন্দ করে। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা দেখে এসেছি, প্রত্যেক যুবরাজ, খান, সুলতান ও সম্রাট তাঁদের বাজেটের সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতেন সামরিক খাতে। তাঁরা জনসাধারণের জন্য শিক্ষা বা চিকিৎসা সহায়তার জন্য খুব কম অর্থই খরচ করতেন।
যুদ্ধ কমে আসার এ বিষয়টি স্বর্গীয় কোনো আশীর্বাদ নয় বা প্রকৃতির আইনের কোনো নাটকীয় পরিবর্তনেও এটি ঘটেনি। মানুষ অপেক্ষাকৃত ভালো বিকল্প বেছে নেওয়াতেই এমনটা ঘটেছে। মানুষই যুদ্ধের বদলে অন্য পন্থা বেছে নিয়েছে। আধুনিক সভ্যতায় রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে সবচেয়ে বড় অর্জন এটি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটি মানুষের ইচ্ছাতেই ঘটেছে বলে এর উল্টোটাও সম্ভব।
পৃথিবীতে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পরিবর্তন এখনো ঘটছে। সাইবার অস্ত্রের উত্থান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত অর্থনীতি এবং নবধারার সামরিক সংস্কৃতির কারণে আমরা হয়তো অচিরেই যুদ্ধের একটি নতুন যুগ দেখব। এ কারণেই রুশ বাহিনীর ইউক্রেন আক্রমণের হুমকি পৃথিবীর মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো যদি তাদের প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলোর ওপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে তা সারা বিশ্বের মানুষের অনুভূতি ও আচরণকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে। জঙ্গলের আইন ফিরে আসার প্রথম ও সবচেয়ে সুস্পষ্ট সাফল্য হবে অন্য সবকিছুর চেয়ে সামরিক ব্যয়ে অর্থের জোগান বাড়ানো এবং এর অর্থ হচ্ছে শিক্ষক, নার্স ও সমাজকর্মীদের কাছে অর্থ না দিয়ে, তা ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার অস্ত্রের কাছে নিয়ে যাওয়া।
পৃথিবী যদি জঙ্গলের আইনে ফিরে যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় রোধ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মতো ইস্যুতে বৈশ্বিক সহযোগিতা ক্ষুণ্ন হবে। যে দেশ আপনাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা সহজ নয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাজাত অস্ত্রের ইঁদুর দৌড় যদি গতি পায়, তবে তা এমন এক দুষ্টচক্রের সৃষ্টি করবে, যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইতিহাসের দিকনির্দেশনা
আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে ঐতিহাসিক প্রথা কখনোই পরিবর্তন হবে না, মানবতা জঙ্গল ত্যাগ করেনি এবং কখনোই করবে না—তাহলে আপনাকে হয় শিকারি অথবা শিকারের ভবিতব্য মেনে নিতে হবে। কিন্তু জঙ্গলের আইন বেছে নেওয়ার বিষয়টি কি বিকল্প উপায়, নাকি অনিবার্য বিষয়? যদি অনিবার্যই হয়, তাহলে প্রতিবেশী দেশকে দখল করে নেওয়া নেতাটি মানুষের স্মৃতিতে একটি বিশেষ স্থানে আসীন হবেন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এটি হবে নিঃসন্দেহে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। তিনি ইতিহাসে সেই ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবেন, যিনি আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনকে ধ্বংস করেছিলেন। আমরা যখন ভাবছিলাম, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছি, ঠিক তখনই তিনি আবার আমাদের টেনে জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলেন।
ইউক্রেনে কী হবে, জানি না। তবে একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি পরিবর্তনের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করি। আমি মনে করি না যে এটি নির্বোধের ভাবনা; বরং এটিই বাস্তববাদী। মানব ইতিহাসে ধ্রুব সত্য হলো পরিবর্তন। এটি এমন এক ব্যাপার, যা আমরা সম্ভবত ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে শিখতে পারি। বহু প্রজন্ম ধরে ইউক্রেনের অধিবাসীরা অত্যাচার ও সহিংসতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা জারদের দুই শতাব্দীর স্বৈরশাসন সহ্য করেছে। তাদের স্বাধীন হওয়ার ক্ষণস্থায়ী চেষ্টা রাশিয়ার রেড আর্মি ধূলিসাৎ করে রুশ শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইউক্রেনীয়রা তখন হলডোমোর, স্তালিনবাদী সন্ত্রাস, নাৎসি দখলদারত্ব এবং কয়েক দশকের কমিউনিস্ট একনায়কত্বের ভয়ানক মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মধ্যে বেঁচে ছিল।
তবে এত কিছুর পরও ইউক্রেনের মানুষেরা ভিন্নভাবে ভেবেছিল। ভেতরটা নিংড়ে নেওয়া দারিদ্র্য এবং পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইউক্রেনীয়রা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। বেলারুশ বা রাশিয়ার মতো ছিল না ইউক্রেন। সেখানে ক্ষমতাসীনের কুর্সি নিয়মিত বিরতিতে পরিবর্তন হতে থাকে, বিরোধীরা চলে আসতে পারে গদিতে। এরপর ২০০৪ সালে একবার এবং ২০১৩ সালে আরও একবার স্বৈরাচারী শাসনের হুমকির মুখোমুখি হয়েছিল ইউক্রেন। সেই সময়েও দেশটির নাগরিকেরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য দুর্বার বিপ্লব করেছিল। সুতরাং তাদের গণতন্ত্র একটি নতুন বস্তু। ‘নতুন শান্তি’ও তাই। দুটোই ভঙ্গুর ও নড়বড়ে, হয়তো বেশি দিন না-ও টিকতে পারে। তারপরও বলা যায়, শান্তি ও গণতন্ত্র—দুই-ই সম্ভব। কারণ, প্রতিটি পুরোনো জিনিস একসময় নতুনই ছিল। সবকিছুই শেষ পর্যন্ত স্রেফ মানুষের বেছে নেওয়ার ওপর নির্ভর করে।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত খবর আরও পড়ুন:
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে