অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর
ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। বাংলা ভাষাও ঠিক সেভাবেই তার উৎপত্তি ঘটেছিল। এর কোনো জন্ম ছিল না। মানুষের যেমন জন্ম হয়, পশুপাখির যেমন জন্ম হয়, ভাষার জন্ম ঠিক সেভাবে নয়। এটি একটি পরম্পরাজাত এবং এই পরম্পরার মধ্য দিয়েই মূলত ভাষা বিকশিত হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীতেই মূলত ভাষার নামে অঞ্চলের নাম হয়ে থাকে, পরবর্তীকালে দেশের নাম হয়ে থাকে, কিন্তু দেশগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় হয়, তবে সেটা আলাদা। সেদিক থেকে আমাদের যে বাংলাদেশ, সেখানে মূলত বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন যে অঞ্চলে বাস করে, যে অঞ্চলটি মূলত বাংলা অঞ্চল এবং পরবর্তীকালে যেটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে। বাংলাদেশে যেহেতু মূল ভাষা হচ্ছে বাংলা, এই বাংলা ভাষাকে সাধারণ মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার একটা চক্রান্ত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। আসলে বাংলা ভাষার লড়াইটি খুব গভীর। বাংলা ভাষা সব সময়ই লড়াই করে টিকে ছিল। বহু আগে এটি সংস্কৃত পণ্ডিতদের, তাঁদের চাপিয়ে দেওয়া রীতিনীতির বিরুদ্ধে গণমানুষের বাংলা ভাষা লড়াই সংগ্রাম করে গণমানুষের মুখে মুখে টিকে ছিল। যারা অভিজাত, অভিজাতেরা বাংলা ভাষা বলত না। পরবর্তীকালে ফারসি হলো রাজভাষা। রাজেন্দ্রবর্গরা ফারসিতে কথা বলতেন, রাজকার্য পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ অভিজাতদের ভাষা ছিল ফারসি। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেছেন। এরপর যখন ইংরেজরা এল, ইংরেজরা এসে রাজকার্যে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য দিল এবং তারা ইংরেজিতেই কথা বলতেন। তখন সাধারণ মানুষ বাংলায় কথা বলে বাংলা ভাষা টিকিয়ে রেখেছেন। এরপর যখন পাকিস্তানিরা এল, পাকিস্তানিরা এসে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বা দেশের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করল। তখনো কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলাকে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। এবং ১৯৫২ সালে সাধারণ মানুষ যারা, তারা রক্ত দিয়েছিলেন, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, যাঁদের নাম আমরা জানি।এ কারণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটি বাঙালির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাঙালি মূলত সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে তাদের রাষ্ট্রের ভাষা করেছে। এই ভাষাটি স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরপরই মৌখিক স্বীকৃতি ও পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বলে একটি রাষ্ট্র গঠিত হলো এবং সেখানে ১৯৭২ সালে একটি সংবিধান প্রণীত হয়, যে সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। এই স্বীকার প্রদানের পরবর্তীকালে সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের একটা চেষ্টা চলে। যদিও সেই চেষ্টাটি সার্বিকভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত বাঙালিবিরোধী অপশক্তি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে চেষ্টা, সেই চেষ্টাকেও মূলত হত্যা করে। এ কারণে চারদিকে ইংরেজি ভাষার প্রভাব বিস্তার হতে দেখা যায়, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল বাড়ে, ক্যাডেট কলেজ বাড়ে, ইংরেজিতে অফিস-আদালত চলে, এমনকি চারদিকে বাংলা ভাষাকে অপমান বা হেয়প্রতিপন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। বাংলা ক্যালেন্ডার বর্জিত হয়, সম্পূর্ণভাবে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটা পর্যায়ে আবার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাকে মর্যাদা প্রদানের প্রশ্ন আসে এবং তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে, পার্লামেন্টের প্রস্তাব অনুসারে রাষ্ট্রসংঘ বা জাতিসংঘ তার যে সংস্থা ইউনেসকো, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এর পেছনে কানাডাপ্রবাসী কয়েকজন বাঙালি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের দুজনের নাম আমাদের সবার কাছে জানা, একজন রফিকুল ইসলাম, অপরজন আব্দুস সালাম। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি যে রক্তদান করেছিল, সেই ইতিহাসটি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষ অবগত হয় এবং তারা তাদের নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে মনে করে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সারা পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ তার মাতৃভাষা রক্ষার জন্য, মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, এটি বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের বিষয়।
বর্তমান কালে দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাংলাদেশে বাংলা ভাষার যে মর্যাদা, যে মর্যাদা ১৯৭২ সালে আমরা দেখেছিলাম, যে মর্যাদার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালিরা রক্ত দিয়েছিলেন, সেই মর্যাদার খানিকটা ব্যত্যয় আমরা লক্ষ করি। এবং সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনেও আমরা এখন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা লক্ষ করছি। আমাদের যে পত্রপত্রিকা, সেখানের বাংলা লেখা, আমাদের যে প্রচার ফলক রয়েছে, সাইনবোর্ড রয়েছে, সেসব জায়গায় যে বাংলা লেখা, আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা লেখার প্রতি যে অনীহা এবং ভুল লেখা, সেটি আমাদের চোখে পড়ে। আর তাতে মনে হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা বেশ সংকটেই রয়েছে। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, তার মর্যাদাকে আরও বেশি বাড়ানোর জন্য, তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলাকে আকর্ষণীয় করবার জন্য, বাংলার আধুনিকায়ন খুব করে জরুরি। সেদিক থেকে জাতির মননের প্রতীক ‘বাংলা একাডেমি’ বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অভিধান প্রণয়ন, পরিভাষা কোষ, বাংলা বানানের নিয়ম এবং বাংলায় প্রচুর বই প্রকাশ আমরা দেখেছি। কিন্তু এর চেয়ে বেশি করে বাংলার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বাংলা লেখার ক্ষেত্রে নানান ধরনের সংকট রয়েছে, বিশেষ করে যুক্তবর্ণগুলো, বানানের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জায়গায় প্রশ্ন থাকে, সেগুলো নিয়ে যখন আগ্রহীরা প্রশ্ন উপস্থাপন করেন সেগুলোর উত্তর পাওয়া যায় না। যদি সত্যিই বাংলা ভাষা নিয়ে সব সময় গবেষণা করার মতো একটি প্রতিষ্ঠান হতো বা বাংলা একাডেমির মধ্যেই কোনো একটি শাখাকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেওয়া হতো, প্রতিনিয়ত গবেষণা করা, পণ্ডিতদের মত, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদিকে ধারণ করে সাধারণ মানুষের মতকে প্রভাবিত করা, তাহলে বোধকরি বাংলা আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে আরও একটু এগিয়ে যেত। এর সঙ্গে আরও একটি ব্যাপার যুক্ত করা যায়, বাংলা লেখনীর ক্ষেত্রে কম্পিউটার সফটওয়্যারের ব্যবহার। বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিবান্ধব করা খুব জরুরি। প্রযুক্তির সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ করে সহজেই যাতে বাংলাকে মানুষ ব্যবহার করতে পারে, সেই কাজটি রাষ্ট্রেরই করতে হবে।
উচ্চশিক্ষাতেও বাংলা ভাষার প্রচলন খুব জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে স্লোগান বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা প্রচলন শুরু হয়েছিল। এমনকি বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা— এই নানা ক্ষেত্রে বাংলাতে পড়ানোর জন্য একধরনের আগ্রহ দেখা যায়। এ সূত্রে বিশেষভাবে স্মরণ করি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক, তখন ইংরেজিতে লেখা রসায়ন বই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য। এটি তিনি একটি বৃত্তি নিয়ে কাজটি করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে এর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। যে দেশ উন্নত হয়েছে, সেই দেশগুলোর প্রায় সবাই মাতৃভাষাতেই উচ্চশিক্ষা দিয়ে থাকেন, এ ক্ষেত্রে জার্মানি, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, ইংল্যান্ডসহ সব দেশের নামই বলা চলে, যারা মূলত উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার করে থাকে। সেদিক থেকে বাংলা ভাষাকে যদি উচ্চশিক্ষায় ব্যবহার করা যায়, তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি আগ্রহী হবে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে অনুবাদ। আর অনুবাদের জন্য একটা অনুবাদ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
আমাদের সর্বস্তরে বাংলার ক্ষেত্রে যে সংকট, সমস্যাগুলো রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে ইচ্ছের সংকট। আমাদের অনেকেই ইচ্ছে করে বাংলা লেখেন না বা বাংলায় বলেন না এবং এর পেছনে তাঁরা অনুযোগ করে থাকেন, বাংলা বানান নাকি খুব বিভ্রাটপূর্ণ, ভুল হয়ে যেতে পারে—এ কারণে বাংলাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষা, বিশেষত ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে বাংলা বানান, বানান রীতিকে সহজবোধ্য ও জনবান্ধন করা দরকার। সবশেষে আমি এটাই বলতে চাই, বাঙালিরা যেহেতু বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন, চিন্তা করে থাকেন, মাতৃভাষাই তার প্রধান ভাষা, সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভাষাবিদ, শিক্ষিত মানুষ ও ভাষাপ্রেমীদের সার্বিক অংশগ্রহণ। এর মধ্য দিয়েই মূলত আমরা বাংলা ভাষার যে মর্যাদা, সেই মর্যাদা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে পারব।
অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর, উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। বাংলা ভাষাও ঠিক সেভাবেই তার উৎপত্তি ঘটেছিল। এর কোনো জন্ম ছিল না। মানুষের যেমন জন্ম হয়, পশুপাখির যেমন জন্ম হয়, ভাষার জন্ম ঠিক সেভাবে নয়। এটি একটি পরম্পরাজাত এবং এই পরম্পরার মধ্য দিয়েই মূলত ভাষা বিকশিত হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীতেই মূলত ভাষার নামে অঞ্চলের নাম হয়ে থাকে, পরবর্তীকালে দেশের নাম হয়ে থাকে, কিন্তু দেশগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় হয়, তবে সেটা আলাদা। সেদিক থেকে আমাদের যে বাংলাদেশ, সেখানে মূলত বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন যে অঞ্চলে বাস করে, যে অঞ্চলটি মূলত বাংলা অঞ্চল এবং পরবর্তীকালে যেটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে। বাংলাদেশে যেহেতু মূল ভাষা হচ্ছে বাংলা, এই বাংলা ভাষাকে সাধারণ মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার একটা চক্রান্ত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। আসলে বাংলা ভাষার লড়াইটি খুব গভীর। বাংলা ভাষা সব সময়ই লড়াই করে টিকে ছিল। বহু আগে এটি সংস্কৃত পণ্ডিতদের, তাঁদের চাপিয়ে দেওয়া রীতিনীতির বিরুদ্ধে গণমানুষের বাংলা ভাষা লড়াই সংগ্রাম করে গণমানুষের মুখে মুখে টিকে ছিল। যারা অভিজাত, অভিজাতেরা বাংলা ভাষা বলত না। পরবর্তীকালে ফারসি হলো রাজভাষা। রাজেন্দ্রবর্গরা ফারসিতে কথা বলতেন, রাজকার্য পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ অভিজাতদের ভাষা ছিল ফারসি। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেছেন। এরপর যখন ইংরেজরা এল, ইংরেজরা এসে রাজকার্যে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য দিল এবং তারা ইংরেজিতেই কথা বলতেন। তখন সাধারণ মানুষ বাংলায় কথা বলে বাংলা ভাষা টিকিয়ে রেখেছেন। এরপর যখন পাকিস্তানিরা এল, পাকিস্তানিরা এসে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বা দেশের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করল। তখনো কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলাকে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। এবং ১৯৫২ সালে সাধারণ মানুষ যারা, তারা রক্ত দিয়েছিলেন, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, যাঁদের নাম আমরা জানি।এ কারণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটি বাঙালির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাঙালি মূলত সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে তাদের রাষ্ট্রের ভাষা করেছে। এই ভাষাটি স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরপরই মৌখিক স্বীকৃতি ও পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বলে একটি রাষ্ট্র গঠিত হলো এবং সেখানে ১৯৭২ সালে একটি সংবিধান প্রণীত হয়, যে সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। এই স্বীকার প্রদানের পরবর্তীকালে সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের একটা চেষ্টা চলে। যদিও সেই চেষ্টাটি সার্বিকভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত বাঙালিবিরোধী অপশক্তি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে চেষ্টা, সেই চেষ্টাকেও মূলত হত্যা করে। এ কারণে চারদিকে ইংরেজি ভাষার প্রভাব বিস্তার হতে দেখা যায়, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল বাড়ে, ক্যাডেট কলেজ বাড়ে, ইংরেজিতে অফিস-আদালত চলে, এমনকি চারদিকে বাংলা ভাষাকে অপমান বা হেয়প্রতিপন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। বাংলা ক্যালেন্ডার বর্জিত হয়, সম্পূর্ণভাবে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটা পর্যায়ে আবার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাকে মর্যাদা প্রদানের প্রশ্ন আসে এবং তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে, পার্লামেন্টের প্রস্তাব অনুসারে রাষ্ট্রসংঘ বা জাতিসংঘ তার যে সংস্থা ইউনেসকো, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এর পেছনে কানাডাপ্রবাসী কয়েকজন বাঙালি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের দুজনের নাম আমাদের সবার কাছে জানা, একজন রফিকুল ইসলাম, অপরজন আব্দুস সালাম। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি যে রক্তদান করেছিল, সেই ইতিহাসটি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষ অবগত হয় এবং তারা তাদের নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে মনে করে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সারা পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ তার মাতৃভাষা রক্ষার জন্য, মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, এটি বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের বিষয়।
বর্তমান কালে দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাংলাদেশে বাংলা ভাষার যে মর্যাদা, যে মর্যাদা ১৯৭২ সালে আমরা দেখেছিলাম, যে মর্যাদার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালিরা রক্ত দিয়েছিলেন, সেই মর্যাদার খানিকটা ব্যত্যয় আমরা লক্ষ করি। এবং সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনেও আমরা এখন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা লক্ষ করছি। আমাদের যে পত্রপত্রিকা, সেখানের বাংলা লেখা, আমাদের যে প্রচার ফলক রয়েছে, সাইনবোর্ড রয়েছে, সেসব জায়গায় যে বাংলা লেখা, আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা লেখার প্রতি যে অনীহা এবং ভুল লেখা, সেটি আমাদের চোখে পড়ে। আর তাতে মনে হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা বেশ সংকটেই রয়েছে। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, তার মর্যাদাকে আরও বেশি বাড়ানোর জন্য, তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলাকে আকর্ষণীয় করবার জন্য, বাংলার আধুনিকায়ন খুব করে জরুরি। সেদিক থেকে জাতির মননের প্রতীক ‘বাংলা একাডেমি’ বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অভিধান প্রণয়ন, পরিভাষা কোষ, বাংলা বানানের নিয়ম এবং বাংলায় প্রচুর বই প্রকাশ আমরা দেখেছি। কিন্তু এর চেয়ে বেশি করে বাংলার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বাংলা লেখার ক্ষেত্রে নানান ধরনের সংকট রয়েছে, বিশেষ করে যুক্তবর্ণগুলো, বানানের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জায়গায় প্রশ্ন থাকে, সেগুলো নিয়ে যখন আগ্রহীরা প্রশ্ন উপস্থাপন করেন সেগুলোর উত্তর পাওয়া যায় না। যদি সত্যিই বাংলা ভাষা নিয়ে সব সময় গবেষণা করার মতো একটি প্রতিষ্ঠান হতো বা বাংলা একাডেমির মধ্যেই কোনো একটি শাখাকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেওয়া হতো, প্রতিনিয়ত গবেষণা করা, পণ্ডিতদের মত, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদিকে ধারণ করে সাধারণ মানুষের মতকে প্রভাবিত করা, তাহলে বোধকরি বাংলা আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে আরও একটু এগিয়ে যেত। এর সঙ্গে আরও একটি ব্যাপার যুক্ত করা যায়, বাংলা লেখনীর ক্ষেত্রে কম্পিউটার সফটওয়্যারের ব্যবহার। বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিবান্ধব করা খুব জরুরি। প্রযুক্তির সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ করে সহজেই যাতে বাংলাকে মানুষ ব্যবহার করতে পারে, সেই কাজটি রাষ্ট্রেরই করতে হবে।
উচ্চশিক্ষাতেও বাংলা ভাষার প্রচলন খুব জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে স্লোগান বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা প্রচলন শুরু হয়েছিল। এমনকি বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা— এই নানা ক্ষেত্রে বাংলাতে পড়ানোর জন্য একধরনের আগ্রহ দেখা যায়। এ সূত্রে বিশেষভাবে স্মরণ করি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক, তখন ইংরেজিতে লেখা রসায়ন বই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য। এটি তিনি একটি বৃত্তি নিয়ে কাজটি করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে এর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। যে দেশ উন্নত হয়েছে, সেই দেশগুলোর প্রায় সবাই মাতৃভাষাতেই উচ্চশিক্ষা দিয়ে থাকেন, এ ক্ষেত্রে জার্মানি, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, ইংল্যান্ডসহ সব দেশের নামই বলা চলে, যারা মূলত উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার করে থাকে। সেদিক থেকে বাংলা ভাষাকে যদি উচ্চশিক্ষায় ব্যবহার করা যায়, তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি আগ্রহী হবে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে অনুবাদ। আর অনুবাদের জন্য একটা অনুবাদ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
আমাদের সর্বস্তরে বাংলার ক্ষেত্রে যে সংকট, সমস্যাগুলো রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে ইচ্ছের সংকট। আমাদের অনেকেই ইচ্ছে করে বাংলা লেখেন না বা বাংলায় বলেন না এবং এর পেছনে তাঁরা অনুযোগ করে থাকেন, বাংলা বানান নাকি খুব বিভ্রাটপূর্ণ, ভুল হয়ে যেতে পারে—এ কারণে বাংলাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষা, বিশেষত ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে বাংলা বানান, বানান রীতিকে সহজবোধ্য ও জনবান্ধন করা দরকার। সবশেষে আমি এটাই বলতে চাই, বাঙালিরা যেহেতু বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন, চিন্তা করে থাকেন, মাতৃভাষাই তার প্রধান ভাষা, সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভাষাবিদ, শিক্ষিত মানুষ ও ভাষাপ্রেমীদের সার্বিক অংশগ্রহণ। এর মধ্য দিয়েই মূলত আমরা বাংলা ভাষার যে মর্যাদা, সেই মর্যাদা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে পারব।
অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর, উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে