বিভুরঞ্জন সরকার
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা কবে, কীভাবে স্বাভাবিক হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা কোনো রাজনৈতিক জ্যোতিষীর পক্ষেও সম্ভব নয়। সরকার নানাভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসার লক্ষণ নেই তা বলা যাবে না। দেশের অধিকাংশ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চায়।
সরকারের মিত্র রাজনৈতিক জোট ১৪ দল এত দিন আওয়ামী লীগের কাছে তেমন গুরুত্ব না পেলেও এখন পাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এখন ১৪ দলকে পাশে পেতে চায়। ১৪ দলও আওয়ামী লীগের পাশেই থাকতে চায়। ২৯ জুলাই ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবার আর নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কোনো ধরনের টালবাহানা করা হবে না। কারণ ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করে দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার পেছনে মূল কারিগর জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি। বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার কথা ওঠেনি। বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়াও যুক্তিসংগত নয়। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে কি খুব সুফল পাওয়া যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কিছু কথা বলা দরকার।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি ঢাকার বাইরে একটি উপজেলা সদরে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় স্থানীয় প্রেসক্লাবে এক জমজমাট আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই আড্ডায় নানা বিষয়ে কথা হয়। দেশের কথা, মানুষের কথা, রাজনীতির কথা, উন্নয়নের কথা, দুর্নীতির কথা, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সবাই স্থানীয়ভাবে বিশিষ্টজন। তাঁরা বলতে চান কম, আমার কাছে শুনতে চান বেশি। আমিও তাঁদের কথা শুনতে চাই বেশি, বলতে চাই কম।
একটি বিষয় লক্ষ করলাম, উপস্থিত প্রায় সবারই আগ্রহ ‘ভেতরের খবর’ জানার। তাঁদের ধারণা, আমি যেহেতু ঢাকায় থাকি, দীর্ঘ দিন থেকে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে আছি, সেহেতু সব ‘হাঁড়ির খবর’ আমার জানা। শেখ হাসিনার সরকার আর কয় মেয়াদে থাকবে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কী, দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দল গড়ে উঠবে কি না, নির্বাচনব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানার আগ্রহ সবার। কিন্তু কারও কৌতূহলই আমি মেটাতে পারি না। আমার কাছে এমন কোনো গোপন তথ্য নেই, যা অন্য কারও জানা নেই।
একপর্যায়ে আমি জানতে চাই, ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা এবং অবস্থান কেমন। প্রায় সবাই একবাক্যে বললেন, এখন জামায়াতে ইসলামী সব থেকে ভালো অবস্থায় আছে। প্রকাশ্যে তারা নীরব। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তলা গোছানোর কাজ তারা করছে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে। জামায়াতের নারী কর্মীরা খুবই তৎপর। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা জামায়াতের রাজনীতি প্রচার করছে। জামায়াত বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে।
সেই সময়ও কিন্তু জামায়াত প্রকাশ্যে খুব তৎপর ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে দলটির নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিও করার কথা নয়। দলটি বাংলাদেশ চায়নি। ১৯৭১ সালে এই দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ঘাতক, এরা দালাল। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এরাও গর্তে লুকিয়েছিল। ছিল সময়ের, সুযোগের অপেক্ষায়। তারা সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর। জামায়াতের নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। তিনি একপর্যায়ে লন্ডনে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।
গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন ক্ষমতা জবরদখলকারী সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। জামায়াতকে তিনি রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আওয়ামী লীগকে জব্দ করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই গোলাম আযম আর জামায়াত নিয়ে কৌশলের রাজনীতি করেছিলেন জিয়া। কিন্তু তাঁর কৌশল ফাল হয়ে উঠেছে দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালেরা এখন অনেক শক্তিশালী। তারা দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। তারা রাজনীতিতে আছে, তাদের নিয়ে রাজনীতিও আছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষ নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরাও গ্রেপ্তার-আতঙ্কেই আছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এত কিছুর পরও জামায়াত আছে। জামায়াত আছে, কারণ তাদের পেছনে বিএনপি আছে।
বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে, সেহেতু তারা পরস্পর ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ—কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি, পারে না।
মাঝে মাঝে আমাদের গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে খবর বের হয়। কদিন নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারপর সব ঠিক। বিএনপি-জামায়াত কেউ কাউকে ছাড়ে না, ছাড়ার কথা ভাবে না; বরং বাইরের সমালোচনা তাদের আরও কাছে আনে, কাছে টানে। ভাইয়ে ভাইয়ে শরিকানা বিরোধের মতো কিছু বিরোধ তাদের হয়তো হয়, কিন্তু সেটা নিষ্পত্তি হয় নীরবে, সবার চোখের আড়ালে। আমার ধারণা, এই বিরোধের খবর জামায়াতের পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে দেওয়া হয়। মানুষকে, বিশেষ করে যারা জামায়াতবিরোধী, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এটা করা হয়। এ রকম খবর প্রচার হলে তাদের দিকে মনোযোগ কম থাকে। তারা ঘর গোছানোয় অধিক তৎপর হতে পারে। সব সময় প্রচারণায় থাকাও জামায়াতের একটি লক্ষ্য। নেগেটিভ-পজিটিভ যা-ই হোক না কেন, জামায়াত আলোচনায় থাকতে চায়। এতে জামায়াতের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল বাড়ে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত অনেক এগিয়ে, অন্তত বিএনপির তুলনায় তো বটেই। তাই বিএনপিকে জামায়াতীকরণ করার কাজ তারা এগিয়ে নিতে পেরেছে।
রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই সরকার এত দিন চেয়েছে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ। সরকার বিএনপি ও জামায়াত—দুই দলকেই শত্রু মনে করে। দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়। তবে সরকার জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই আশু বড় বিপদ বলে মনে করে এসেছে। ভেবেছে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতটা বিএনপি, ততটা জামায়াত নয়। তাই বিএনপিকে যতটা চাপে রাখতে চেয়েছে, জামায়াতকে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে জামায়াত-শিবিরের হিংস্র রূপ সরকারকে বিচলিত করেছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জনপ্রিয় দাবিটি সরকার এত দিন সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের কথা বিবেচনায় নিয়েই গা করেনি। কিন্তু সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের বিপুল তাণ্ডবের পর সরকার আর নমনীয়তার নীতিতে চলা ঠিক মনে করছে না। এখন প্রশ্ন হলো, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন পথে হাঁটবে? জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফণা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে একই কৌশল বারবার ভালো ফল দেয় না।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন কৌশলে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে তাদের ভাবনা এখনই জানা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক বা ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে সক্রিয় হতে পারে, নাম পাল্টিয়ে নতুন পরিচয়ে রাজনীতির মাঠে নামতে পারে আবার অন্য দলের ভেতরে ঢুকে কাজ করার চিন্তাও করতে পারে। এখনো বিভিন্ন দলে জামায়াতের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। শোনা যায়, আওয়ামী লীগেও আছে। তবে ধারণা করা হয়, জামায়াতের একটি বড় অংশ বিএনপিতে বিলীন হবে। বিএনপি হলো জামায়াতের স্বাভাবিক মিত্র। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসও কাছাকাছি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ প্রশ্নে দুই দলের অবস্থানে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এখন তা কমে এসেছে। জামায়াত যদি বিএনপিতে লীন হতে চায়, তাহলে বিএনপি অখুশি হবে বলে মনে হয় না; বরং বিএনপি হয়তো তেমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কী কৌশল নেবে, সেটা এখনই স্পষ্ট না হলেও জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি এবং জামায়াতের রাজনীতি যে সহজে শেষ হচ্ছে না, তা বলা যায়। জামায়াত মাঠ ছাড়বে না; বিশেষ করে তাদের আর্থিক বনিয়াদ যত দিন দুর্বল না হবে, তত দিন তাদের কৌশলের খেলাও চলতে থাকবে।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা কবে, কীভাবে স্বাভাবিক হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা কোনো রাজনৈতিক জ্যোতিষীর পক্ষেও সম্ভব নয়। সরকার নানাভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসার লক্ষণ নেই তা বলা যাবে না। দেশের অধিকাংশ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চায়।
সরকারের মিত্র রাজনৈতিক জোট ১৪ দল এত দিন আওয়ামী লীগের কাছে তেমন গুরুত্ব না পেলেও এখন পাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এখন ১৪ দলকে পাশে পেতে চায়। ১৪ দলও আওয়ামী লীগের পাশেই থাকতে চায়। ২৯ জুলাই ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবার আর নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কোনো ধরনের টালবাহানা করা হবে না। কারণ ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করে দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার পেছনে মূল কারিগর জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি। বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার কথা ওঠেনি। বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়াও যুক্তিসংগত নয়। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে কি খুব সুফল পাওয়া যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কিছু কথা বলা দরকার।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি ঢাকার বাইরে একটি উপজেলা সদরে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় স্থানীয় প্রেসক্লাবে এক জমজমাট আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই আড্ডায় নানা বিষয়ে কথা হয়। দেশের কথা, মানুষের কথা, রাজনীতির কথা, উন্নয়নের কথা, দুর্নীতির কথা, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সবাই স্থানীয়ভাবে বিশিষ্টজন। তাঁরা বলতে চান কম, আমার কাছে শুনতে চান বেশি। আমিও তাঁদের কথা শুনতে চাই বেশি, বলতে চাই কম।
একটি বিষয় লক্ষ করলাম, উপস্থিত প্রায় সবারই আগ্রহ ‘ভেতরের খবর’ জানার। তাঁদের ধারণা, আমি যেহেতু ঢাকায় থাকি, দীর্ঘ দিন থেকে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে আছি, সেহেতু সব ‘হাঁড়ির খবর’ আমার জানা। শেখ হাসিনার সরকার আর কয় মেয়াদে থাকবে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কী, দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দল গড়ে উঠবে কি না, নির্বাচনব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানার আগ্রহ সবার। কিন্তু কারও কৌতূহলই আমি মেটাতে পারি না। আমার কাছে এমন কোনো গোপন তথ্য নেই, যা অন্য কারও জানা নেই।
একপর্যায়ে আমি জানতে চাই, ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা এবং অবস্থান কেমন। প্রায় সবাই একবাক্যে বললেন, এখন জামায়াতে ইসলামী সব থেকে ভালো অবস্থায় আছে। প্রকাশ্যে তারা নীরব। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তলা গোছানোর কাজ তারা করছে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে। জামায়াতের নারী কর্মীরা খুবই তৎপর। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা জামায়াতের রাজনীতি প্রচার করছে। জামায়াত বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে।
সেই সময়ও কিন্তু জামায়াত প্রকাশ্যে খুব তৎপর ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে দলটির নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিও করার কথা নয়। দলটি বাংলাদেশ চায়নি। ১৯৭১ সালে এই দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ঘাতক, এরা দালাল। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এরাও গর্তে লুকিয়েছিল। ছিল সময়ের, সুযোগের অপেক্ষায়। তারা সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর। জামায়াতের নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। তিনি একপর্যায়ে লন্ডনে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।
গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন ক্ষমতা জবরদখলকারী সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। জামায়াতকে তিনি রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আওয়ামী লীগকে জব্দ করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই গোলাম আযম আর জামায়াত নিয়ে কৌশলের রাজনীতি করেছিলেন জিয়া। কিন্তু তাঁর কৌশল ফাল হয়ে উঠেছে দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালেরা এখন অনেক শক্তিশালী। তারা দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। তারা রাজনীতিতে আছে, তাদের নিয়ে রাজনীতিও আছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষ নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরাও গ্রেপ্তার-আতঙ্কেই আছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এত কিছুর পরও জামায়াত আছে। জামায়াত আছে, কারণ তাদের পেছনে বিএনপি আছে।
বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে, সেহেতু তারা পরস্পর ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ—কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি, পারে না।
মাঝে মাঝে আমাদের গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে খবর বের হয়। কদিন নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারপর সব ঠিক। বিএনপি-জামায়াত কেউ কাউকে ছাড়ে না, ছাড়ার কথা ভাবে না; বরং বাইরের সমালোচনা তাদের আরও কাছে আনে, কাছে টানে। ভাইয়ে ভাইয়ে শরিকানা বিরোধের মতো কিছু বিরোধ তাদের হয়তো হয়, কিন্তু সেটা নিষ্পত্তি হয় নীরবে, সবার চোখের আড়ালে। আমার ধারণা, এই বিরোধের খবর জামায়াতের পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে দেওয়া হয়। মানুষকে, বিশেষ করে যারা জামায়াতবিরোধী, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এটা করা হয়। এ রকম খবর প্রচার হলে তাদের দিকে মনোযোগ কম থাকে। তারা ঘর গোছানোয় অধিক তৎপর হতে পারে। সব সময় প্রচারণায় থাকাও জামায়াতের একটি লক্ষ্য। নেগেটিভ-পজিটিভ যা-ই হোক না কেন, জামায়াত আলোচনায় থাকতে চায়। এতে জামায়াতের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল বাড়ে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত অনেক এগিয়ে, অন্তত বিএনপির তুলনায় তো বটেই। তাই বিএনপিকে জামায়াতীকরণ করার কাজ তারা এগিয়ে নিতে পেরেছে।
রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই সরকার এত দিন চেয়েছে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ। সরকার বিএনপি ও জামায়াত—দুই দলকেই শত্রু মনে করে। দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়। তবে সরকার জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই আশু বড় বিপদ বলে মনে করে এসেছে। ভেবেছে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতটা বিএনপি, ততটা জামায়াত নয়। তাই বিএনপিকে যতটা চাপে রাখতে চেয়েছে, জামায়াতকে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে জামায়াত-শিবিরের হিংস্র রূপ সরকারকে বিচলিত করেছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জনপ্রিয় দাবিটি সরকার এত দিন সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের কথা বিবেচনায় নিয়েই গা করেনি। কিন্তু সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের বিপুল তাণ্ডবের পর সরকার আর নমনীয়তার নীতিতে চলা ঠিক মনে করছে না। এখন প্রশ্ন হলো, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন পথে হাঁটবে? জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফণা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে একই কৌশল বারবার ভালো ফল দেয় না।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন কৌশলে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে তাদের ভাবনা এখনই জানা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক বা ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে সক্রিয় হতে পারে, নাম পাল্টিয়ে নতুন পরিচয়ে রাজনীতির মাঠে নামতে পারে আবার অন্য দলের ভেতরে ঢুকে কাজ করার চিন্তাও করতে পারে। এখনো বিভিন্ন দলে জামায়াতের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। শোনা যায়, আওয়ামী লীগেও আছে। তবে ধারণা করা হয়, জামায়াতের একটি বড় অংশ বিএনপিতে বিলীন হবে। বিএনপি হলো জামায়াতের স্বাভাবিক মিত্র। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসও কাছাকাছি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ প্রশ্নে দুই দলের অবস্থানে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এখন তা কমে এসেছে। জামায়াত যদি বিএনপিতে লীন হতে চায়, তাহলে বিএনপি অখুশি হবে বলে মনে হয় না; বরং বিএনপি হয়তো তেমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কী কৌশল নেবে, সেটা এখনই স্পষ্ট না হলেও জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি এবং জামায়াতের রাজনীতি যে সহজে শেষ হচ্ছে না, তা বলা যায়। জামায়াত মাঠ ছাড়বে না; বিশেষ করে তাদের আর্থিক বনিয়াদ যত দিন দুর্বল না হবে, তত দিন তাদের কৌশলের খেলাও চলতে থাকবে।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে