মামুনুর রশীদ
দুটি সংবাদ, দুটি ঘটনা। দুটি ঘটনাই এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একটি হলো, এ বছর এক হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে না। যদিও পুলিশ ও সেনাবাহিনী পূজামণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। এর আগেও পূজামণ্ডপগুলোতে পুলিশ রাখা হতো, তারপরও দু-একটি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতার পালাবদলের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এবার হয়তো কোনো আগাম তথ্যের ভিত্তিতে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে। একসময় ধর্মভিত্তিক দলগুলো বলেছিল, মাদ্রাসার ছাত্ররা পূজামণ্ডপ ভাঙবে। এবার এ রকম একটি ভয়ের পূর্বাভাস কী করে পাওয়া গেল, এটি একটি বড় প্রশ্ন।
যুগ যুগ ধরে এ দেশে সব ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের উৎসব পালন করে আসছে। দ্বিজাতি শাসন থাকলেও উৎসব পালনে কোনো ধরনের তাণ্ডব নেমে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের আগেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়েছে এবং স্বাধীন দেশের সংবিধানে তা স্থান পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে গত ৫৩ বছরে হিন্দুদের উৎসবে ভাঙচুর হয়েছে, সংখ্যালঘুরা ভীত হয়েছে এবং বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশত্যাগ করেছে। শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নয়, বিশেষ জাতিসত্তার মানুষেরাও দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে।
এবারের দুর্গাপূজা ছাড়াও আরেকটি ঘটনা ঘটেছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে। তিন দিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ নেতারা তাঁদের কঠিন চীবরদান উৎসব সংবাদ সম্মেলন ডেকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তার কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দির আক্রান্ত হয়েছে, তাদের দানবাক্সে যে অর্থ জমা ছিল, তা-ও অনেক জায়গায় লুট করা হয়েছে। এর আগে একবার ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণার ফলে বৌদ্ধমন্দির এবং তাদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে। সেই আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনার কোনো তদন্ত বা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা শোনা যায়নি। যে দেশে সংবিধান সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করেছে, সেই দেশে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুঃখজনক শুধু নয়, লজ্জাকরও বটে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে একেবারে সহ্য করতে পারছে না।
সব ধর্মেরই শিক্ষা সহনশীলতা, ধৈর্য এবং অপর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখানো। ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরের শাঁখারীবাজারে দাঙ্গার সূচনা হয়েছিল। সেটিকে থামাতে গিয়ে একজন মুসলমান পুলিশ সার্জেন্ট প্রাণ দিয়েছিলেন। তখন আশপাশ এলাকার মুসলমানরা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেই দাঙ্গাকে প্রতিহত করেছিল। আশির দশকে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু দাঙ্গার চেষ্টাকে জনগণ ব্যর্থ করে দিয়েছে। সম্প্রতি যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হলো এবং নানা ধরনের সংস্কারের সূচনাও এই জনগণই করেছে। কিন্তু জনগণের কাছে এই বার্তা কেন পৌঁছানো গেল না যে ধর্মের নামে কারও প্রতি অসহনশীল আচরণ করা যাবে না?
কিছুদিন আগে বেশ কিছু মাজার ভাঙা হয়েছে। মুসলমানদের মাজার মুসলমানরাই ভেঙেছে। একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটি একটি সংঘাতে পরিণত হলো। এ অবস্থায় অন্য ধর্মাবলম্বীরা ভয় পাবে, এটাই স্বাভাবিক। মাজার ভাঙচুর হওয়ার পর এটা নিয়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। সংঘাতকারীরা নির্বিঘ্নে অনেকগুলো মাজার ভেঙে পার পেয়ে গেছে।
দাঙ্গার পেছনে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাড়াও আরেকটি বড় বিষয় জড়িত, তা হলো লুণ্ঠন এবং সম্পত্তির অধিকার। একসময় সংখ্যালঘুরা পানির দামে নিজের বসতবাড়ি ও জায়গাজমি বিক্রি করে ভারতে চলে যেত। কিন্তু তারপর আর বেচাবিক্রি নয়, ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে যাওয়াটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেকোনো অভ্যুত্থান মানুষকে একটি বড় বার্তা দেয়, তা হলো মুক্তি। অনাচার, অবিচার, লুটপাট, অন্যের সম্পত্তি লুণ্ঠন—এসব থেকে মানুষ মুক্তি পায়। সেই গুণগত পরিবর্তনগুলো আমরা অতীতে সাময়িক হলেও দেখেছি। কিন্তু এবার তার ব্যাপকতা দেখতে পাওয়া গেছে এবং সাবেক ক্ষমতাসীন সরকারের ঘরবাড়ি এমনকি সরকারি স্থাপনাও লুটপাটের শিকার হয়েছে। যেসব ছাত্র প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন, তাঁরা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাহলে কারা করল?
যাদের জন্য আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয় এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব কঠিন চীবরদান বন্ধ করে দিতে হয়।
এখন পর্যন্ত বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে সম্ভবত সরকারের কোনো মহল আলোচনায় বসেনি। এসব ঘটনা শুধু যারা ভুক্তভোগী তাদের জীবন আতঙ্কিত করে তোলে তা নয়, বিশ্বে আমাদের জাতিগত মর্যাদাও ক্ষুণ্ন করে। একশ্রেণির লোক এটা থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। বিদেশে যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়, তারাও একটা সুযোগ পেয়ে যায়। এই সুযোগ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ আশ্বাসে এবং সরকারের ব্যবস্থা নেওয়াতে মানুষ যে আতঙ্ক থেকে মুক্তি পায়নি, তার প্রমাণ এক হাজার মণ্ডপে পূজা না হওয়া। বৌদ্ধরাও উৎসবে আগাম সন্ত্রাসী হামলার কারণে কঠিন চীবরদান উৎসব বন্ধ করে দিয়েছে।
গতকাল এক হিন্দু ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জের কোনো এক গ্রামে। প্রতিবছর তাঁর বাড়িতে দুর্গপূজা হতো, এবার সেটা হচ্ছে না। তিনি ঢাকায় থাকেন বটে, কিন্তু পূজার সময় অবশ্যই বাড়িতে যান। এবার তিনি যাচ্ছেন না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার বাড়িতে পূজা হচ্ছে না, তাহলে যেতে অসুবিধা কী?’ তিনি জবাব দিতে চাইলেন না, আমি পীড়াপীড়ি করায় অনুচ্চকণ্ঠে শুধু এটুকু বললেন, ‘ভয় করছে।’ এই যে ভয়, এই ভয় কারা সৃষ্টি করে? তাদের মধ্যে কি দ্বিজাতি তত্ত্বের ভূত এখনো রয়ে গেছে? ভারতের ধর্মভিত্তিক একটি গোষ্ঠী যেমন চায় তাদের দেশে হিন্দুত্ববাদ এবং হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরি করা তার প্রমাণ বহন করে। আবার বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠীও শুধু মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চায়।
কিন্তু এটাও প্রমাণিত যে উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে হিন্দুদের সম-অধিকার সুনিশ্চিত। প্রশাসনে, পুলিশে, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র উল্লেখযোগ্য হিন্দু মানুষ কাজ করছেন। কোনো দিন তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়নি। কিন্তু কতিপয় গোষ্ঠী নানা ধরনের অপপ্রচার করে গুজব রটিয়ে দিনের পর দিন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। আমাদের বাংলাভাষাভাষীর মধ্যে কিছু অখণ্ড বিষয় আছে, যেমন সংস্কৃতি। যেহেতু ভাষা এক, তাই আমরা একটা অখণ্ড সাহিত্যচর্চা করে থাকি। সংগীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নাটক, নৃত্য—এসবের মধ্যে বৃহত্তর একটা ঐক্য দেখা যায়। যদিও মাঝখানে একটি কাঁটাতারের বেড়া রয়ে গেছে।
ধর্মের ক্ষেত্রে আমাদের ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু সুফিদর্শন অন্য ধর্মের প্রতি যে উদারনীতি আমাদের শিখিয়েছে, তাতে সংঘাত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইসলামের যে বাণী সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে আমাদের দেশে এসে পৌঁছেছে, তা পরস্পরের সহাবস্থানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। যে ধর্মপ্রচারকেরা এ দেশে এসেছেন, তাঁরা দুই ধর্মের মানুষকেই বুকে টেনে নিয়েছেন। যে কারণে বিভিন্ন মাজারে দেখা গেছে হিন্দ, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করছেন। সম্প্রীতির সহযোগিতার এক মিলনকেন্দ্র আমাদের বাংলাদেশ। যে মুসলিম শাসকেরা ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায়নি। তাঁদের শাসনে সেনাবাহিনীতে, সুবেদারদের মধ্যে উভয় ধর্মাবলম্বীরা কাজ করেছেন।
ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর তাদের লুণ্ঠনকার্যের সহায়তার প্রয়োজনে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চর্চা করতে থাকে। তাদের শাসন প্রলম্বিত করার জন্য এই ব্যবস্থা তাদের প্রয়োজন ছিল। বিষয়টা এত গভীরে তারা নিয়ে গেছে যে সাতচল্লিশের দেশভাগের প্রাক্কালে এক বিরাট দাঙ্গার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ওই সময়ের শাসকগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার অপপ্রচারের চেষ্টা করে। লিওনার্দো মুজলে বলে এক লেখক তৎকালীন কলকাতার দাঙ্গাবিধ্বস্ত একটি চিত্র এঁকেছিলেন—কলকাতার একটি এলাকায় আগুন জ্বলছে, লুণ্ঠন হচ্ছে, রক্ত ঝরছে; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে একজন ব্রিটিশ নারী সাইকেলে করে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছে, তার ক্ষেত্রে কোনো বিঘ্ন ঘটছে না। ব্রিটিশ শাসকেরা এই দাঙ্গায় কোনোভাবে আক্রান্ত হননি। দাঙ্গার পর নিরাপদে তাঁদের লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গেছেন।
আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। কেন আমরা পরস্পরবিরোধী স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব? কেন এই আতঙ্কের সৃষ্টি হবে? ধর্মে রাজনৈতিক ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। বেশি দিন আগের কথা নয়, আমরা দেখেছি কখনো কখনো ঈদ ও পূজা একসঙ্গে পড়েছে, কিন্তু কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। খ্রিষ্টানরা বিশাল আনন্দের সঙ্গে ক্রিসমাস উদ্যাপন করেছে, বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা কঠিন চীবরদান পালন করেছে এবং বিশেষ জাতিসত্তার মানুষেরাও তাদের উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করে গেছে। মানুষ সবাই নিঃসঙ্গ, কিন্তু উৎসব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জীবনে প্রেরণার সঞ্চয় করে। জীবনের এই প্রেরণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন জামাকাপড়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচার, উন্নত খাবার—এসব আয়োজনের মধ্য দিয়েই নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে মানুষ। সেই স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত করা হবে পাপ—মহাপাপ।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
দুটি সংবাদ, দুটি ঘটনা। দুটি ঘটনাই এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একটি হলো, এ বছর এক হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে না। যদিও পুলিশ ও সেনাবাহিনী পূজামণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। এর আগেও পূজামণ্ডপগুলোতে পুলিশ রাখা হতো, তারপরও দু-একটি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতার পালাবদলের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এবার হয়তো কোনো আগাম তথ্যের ভিত্তিতে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে। একসময় ধর্মভিত্তিক দলগুলো বলেছিল, মাদ্রাসার ছাত্ররা পূজামণ্ডপ ভাঙবে। এবার এ রকম একটি ভয়ের পূর্বাভাস কী করে পাওয়া গেল, এটি একটি বড় প্রশ্ন।
যুগ যুগ ধরে এ দেশে সব ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের উৎসব পালন করে আসছে। দ্বিজাতি শাসন থাকলেও উৎসব পালনে কোনো ধরনের তাণ্ডব নেমে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের আগেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়েছে এবং স্বাধীন দেশের সংবিধানে তা স্থান পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে গত ৫৩ বছরে হিন্দুদের উৎসবে ভাঙচুর হয়েছে, সংখ্যালঘুরা ভীত হয়েছে এবং বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশত্যাগ করেছে। শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নয়, বিশেষ জাতিসত্তার মানুষেরাও দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে।
এবারের দুর্গাপূজা ছাড়াও আরেকটি ঘটনা ঘটেছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে। তিন দিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ নেতারা তাঁদের কঠিন চীবরদান উৎসব সংবাদ সম্মেলন ডেকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তার কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দির আক্রান্ত হয়েছে, তাদের দানবাক্সে যে অর্থ জমা ছিল, তা-ও অনেক জায়গায় লুট করা হয়েছে। এর আগে একবার ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণার ফলে বৌদ্ধমন্দির এবং তাদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে। সেই আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনার কোনো তদন্ত বা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা শোনা যায়নি। যে দেশে সংবিধান সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করেছে, সেই দেশে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুঃখজনক শুধু নয়, লজ্জাকরও বটে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে একেবারে সহ্য করতে পারছে না।
সব ধর্মেরই শিক্ষা সহনশীলতা, ধৈর্য এবং অপর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখানো। ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরের শাঁখারীবাজারে দাঙ্গার সূচনা হয়েছিল। সেটিকে থামাতে গিয়ে একজন মুসলমান পুলিশ সার্জেন্ট প্রাণ দিয়েছিলেন। তখন আশপাশ এলাকার মুসলমানরা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেই দাঙ্গাকে প্রতিহত করেছিল। আশির দশকে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু দাঙ্গার চেষ্টাকে জনগণ ব্যর্থ করে দিয়েছে। সম্প্রতি যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হলো এবং নানা ধরনের সংস্কারের সূচনাও এই জনগণই করেছে। কিন্তু জনগণের কাছে এই বার্তা কেন পৌঁছানো গেল না যে ধর্মের নামে কারও প্রতি অসহনশীল আচরণ করা যাবে না?
কিছুদিন আগে বেশ কিছু মাজার ভাঙা হয়েছে। মুসলমানদের মাজার মুসলমানরাই ভেঙেছে। একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটি একটি সংঘাতে পরিণত হলো। এ অবস্থায় অন্য ধর্মাবলম্বীরা ভয় পাবে, এটাই স্বাভাবিক। মাজার ভাঙচুর হওয়ার পর এটা নিয়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। সংঘাতকারীরা নির্বিঘ্নে অনেকগুলো মাজার ভেঙে পার পেয়ে গেছে।
দাঙ্গার পেছনে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাড়াও আরেকটি বড় বিষয় জড়িত, তা হলো লুণ্ঠন এবং সম্পত্তির অধিকার। একসময় সংখ্যালঘুরা পানির দামে নিজের বসতবাড়ি ও জায়গাজমি বিক্রি করে ভারতে চলে যেত। কিন্তু তারপর আর বেচাবিক্রি নয়, ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে যাওয়াটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেকোনো অভ্যুত্থান মানুষকে একটি বড় বার্তা দেয়, তা হলো মুক্তি। অনাচার, অবিচার, লুটপাট, অন্যের সম্পত্তি লুণ্ঠন—এসব থেকে মানুষ মুক্তি পায়। সেই গুণগত পরিবর্তনগুলো আমরা অতীতে সাময়িক হলেও দেখেছি। কিন্তু এবার তার ব্যাপকতা দেখতে পাওয়া গেছে এবং সাবেক ক্ষমতাসীন সরকারের ঘরবাড়ি এমনকি সরকারি স্থাপনাও লুটপাটের শিকার হয়েছে। যেসব ছাত্র প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন, তাঁরা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাহলে কারা করল?
যাদের জন্য আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয় এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব কঠিন চীবরদান বন্ধ করে দিতে হয়।
এখন পর্যন্ত বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে সম্ভবত সরকারের কোনো মহল আলোচনায় বসেনি। এসব ঘটনা শুধু যারা ভুক্তভোগী তাদের জীবন আতঙ্কিত করে তোলে তা নয়, বিশ্বে আমাদের জাতিগত মর্যাদাও ক্ষুণ্ন করে। একশ্রেণির লোক এটা থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। বিদেশে যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়, তারাও একটা সুযোগ পেয়ে যায়। এই সুযোগ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ আশ্বাসে এবং সরকারের ব্যবস্থা নেওয়াতে মানুষ যে আতঙ্ক থেকে মুক্তি পায়নি, তার প্রমাণ এক হাজার মণ্ডপে পূজা না হওয়া। বৌদ্ধরাও উৎসবে আগাম সন্ত্রাসী হামলার কারণে কঠিন চীবরদান উৎসব বন্ধ করে দিয়েছে।
গতকাল এক হিন্দু ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জের কোনো এক গ্রামে। প্রতিবছর তাঁর বাড়িতে দুর্গপূজা হতো, এবার সেটা হচ্ছে না। তিনি ঢাকায় থাকেন বটে, কিন্তু পূজার সময় অবশ্যই বাড়িতে যান। এবার তিনি যাচ্ছেন না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার বাড়িতে পূজা হচ্ছে না, তাহলে যেতে অসুবিধা কী?’ তিনি জবাব দিতে চাইলেন না, আমি পীড়াপীড়ি করায় অনুচ্চকণ্ঠে শুধু এটুকু বললেন, ‘ভয় করছে।’ এই যে ভয়, এই ভয় কারা সৃষ্টি করে? তাদের মধ্যে কি দ্বিজাতি তত্ত্বের ভূত এখনো রয়ে গেছে? ভারতের ধর্মভিত্তিক একটি গোষ্ঠী যেমন চায় তাদের দেশে হিন্দুত্ববাদ এবং হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরি করা তার প্রমাণ বহন করে। আবার বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠীও শুধু মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চায়।
কিন্তু এটাও প্রমাণিত যে উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে হিন্দুদের সম-অধিকার সুনিশ্চিত। প্রশাসনে, পুলিশে, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র উল্লেখযোগ্য হিন্দু মানুষ কাজ করছেন। কোনো দিন তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়নি। কিন্তু কতিপয় গোষ্ঠী নানা ধরনের অপপ্রচার করে গুজব রটিয়ে দিনের পর দিন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। আমাদের বাংলাভাষাভাষীর মধ্যে কিছু অখণ্ড বিষয় আছে, যেমন সংস্কৃতি। যেহেতু ভাষা এক, তাই আমরা একটা অখণ্ড সাহিত্যচর্চা করে থাকি। সংগীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নাটক, নৃত্য—এসবের মধ্যে বৃহত্তর একটা ঐক্য দেখা যায়। যদিও মাঝখানে একটি কাঁটাতারের বেড়া রয়ে গেছে।
ধর্মের ক্ষেত্রে আমাদের ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু সুফিদর্শন অন্য ধর্মের প্রতি যে উদারনীতি আমাদের শিখিয়েছে, তাতে সংঘাত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইসলামের যে বাণী সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে আমাদের দেশে এসে পৌঁছেছে, তা পরস্পরের সহাবস্থানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। যে ধর্মপ্রচারকেরা এ দেশে এসেছেন, তাঁরা দুই ধর্মের মানুষকেই বুকে টেনে নিয়েছেন। যে কারণে বিভিন্ন মাজারে দেখা গেছে হিন্দ, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করছেন। সম্প্রীতির সহযোগিতার এক মিলনকেন্দ্র আমাদের বাংলাদেশ। যে মুসলিম শাসকেরা ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায়নি। তাঁদের শাসনে সেনাবাহিনীতে, সুবেদারদের মধ্যে উভয় ধর্মাবলম্বীরা কাজ করেছেন।
ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর তাদের লুণ্ঠনকার্যের সহায়তার প্রয়োজনে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চর্চা করতে থাকে। তাদের শাসন প্রলম্বিত করার জন্য এই ব্যবস্থা তাদের প্রয়োজন ছিল। বিষয়টা এত গভীরে তারা নিয়ে গেছে যে সাতচল্লিশের দেশভাগের প্রাক্কালে এক বিরাট দাঙ্গার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ওই সময়ের শাসকগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার অপপ্রচারের চেষ্টা করে। লিওনার্দো মুজলে বলে এক লেখক তৎকালীন কলকাতার দাঙ্গাবিধ্বস্ত একটি চিত্র এঁকেছিলেন—কলকাতার একটি এলাকায় আগুন জ্বলছে, লুণ্ঠন হচ্ছে, রক্ত ঝরছে; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে একজন ব্রিটিশ নারী সাইকেলে করে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছে, তার ক্ষেত্রে কোনো বিঘ্ন ঘটছে না। ব্রিটিশ শাসকেরা এই দাঙ্গায় কোনোভাবে আক্রান্ত হননি। দাঙ্গার পর নিরাপদে তাঁদের লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গেছেন।
আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। কেন আমরা পরস্পরবিরোধী স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব? কেন এই আতঙ্কের সৃষ্টি হবে? ধর্মে রাজনৈতিক ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। বেশি দিন আগের কথা নয়, আমরা দেখেছি কখনো কখনো ঈদ ও পূজা একসঙ্গে পড়েছে, কিন্তু কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। খ্রিষ্টানরা বিশাল আনন্দের সঙ্গে ক্রিসমাস উদ্যাপন করেছে, বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা কঠিন চীবরদান পালন করেছে এবং বিশেষ জাতিসত্তার মানুষেরাও তাদের উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করে গেছে। মানুষ সবাই নিঃসঙ্গ, কিন্তু উৎসব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জীবনে প্রেরণার সঞ্চয় করে। জীবনের এই প্রেরণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন জামাকাপড়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচার, উন্নত খাবার—এসব আয়োজনের মধ্য দিয়েই নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে মানুষ। সেই স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত করা হবে পাপ—মহাপাপ।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে