ড. মইনুল ইসলাম
২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনের আগের রাতের ব্যাপক ব্যালট জালিয়াতির অভিযোগের কারণে পৌনে পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দেশের বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেরও কূটনৈতিক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করত বলে সাধারণ ধারণা থাকলেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশি প্রহরায় এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যালট বাক্সগুলো ভরে ফেলার যে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি দেশের অধিকাংশ এলাকায় ঘটানো হয়েছিল, তার সত্যতা সম্পর্কে সিংহভাগ জনগণের মনে বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেছে। যেভাবে এই ‘রাত্রিকালীন ব্যালট জালিয়াতি’ সম্পন্ন করে সংসদের তিন-চতুর্থাংশ আসন দখল করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট, সেটা কি এ দেশের গণতন্ত্রকে পুরোপুরি লাইনচ্যুত করে দেয়নি? এ ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় বিরাট ধস নামিয়েছে।
অতএব, আগামী সংসদ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয় হয়তো সারা দেশে অপেক্ষা করছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জালিয়াতি করার অপপ্রয়াস নেওয়া হলে আওয়ামী লীগের খবর আছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ এ রকম জালিয়াতি কোনোমতেই মেনে নেবে না। তারা ইতিমধ্যেই এ-ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে প্রবল চাপ দিতে শুরু করেছে। এসব চাপে কাজ না হলে তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়াও হতে পারে। অথচ আওয়ামী লীগের এবারের পৌনে পনেরো বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় গতিশীলতা সৃষ্টির বিষয়টিকে এই নির্বাচনী-জালিয়াতির ইস্যুটি অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। গত পৌনে পনেরো বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছে, সেটা কি গুরুত্ব দাবি করে না?
১. ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ইউএনইকোসক) কর্তৃক নির্ধারিত ‘লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি’ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে ‘ডেভেলপিং কান্ট্রি’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ২০২৪ সালে ‘ডেভেলপিং কান্ট্রি’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির শিকার হওয়ায় ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলডিসির সুবিধাগুলো বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের ডেভেলপিং কান্ট্রিতে উত্তরণকে দুই বছর পিছিয়ে দিতে সম্মত হয়েছে।
২. বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে এর তালিকাটা দেখুন: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক, মিরসরাই-ফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-পায়রা-যশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়া-লাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অভূতপূর্ব গতি-সঞ্চার করেছে তা কীভাবে অস্বীকার করা যাবে? এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত পৌনে পনেরো বছরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হচ্ছে একমাত্র মেগা প্রকল্প, যেটা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। প্রায় পৌনে চার বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত করে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে একটি ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ‘ব্ল্যাকমেলিং’য়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। এই সেতু প্রমাণ করেছে, যে দেশটিকে ১৯৭২ সালে ‘আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সেই দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম।
৪. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ ২০২১ সালে বিদ্যুৎসুবিধার আওতায় এসেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন মহাজোট সরকার ক্ষমতা নিয়েছিল, তখন জনগণের মাত্র ৪৩ শতাংশ ছিল বিদ্যুৎসুবিধার আওতায়। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল—১৪ বছরে প্রধান অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো প্ল্যান্ট স্থাপন এবং সঞ্চালন লাইনের প্রসারের মাধ্যমে বর্তমান সরকার এই বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
৫. এখন বাংলাদেশে একটি কৃষিবিপ্লব চলমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতিমালা গ্রহণের কারণেই কৃষি খাতে এই চমকপ্রদ সাফল্যের ধারা সূচিত হয়েছে। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগত আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। ২০২২ সালে এ দেশে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। ১৭ কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্যের জোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। (অবশ্য প্রতিবছর আমরা ৬০-৬৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, তরিতরকারী উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও গরু-মহিষের মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে।
৬. ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান ছিল বাংলাদেশের জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ, কিন্তু এখন তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
৭. বাংলাদেশ গত পৌনে পনেরো বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের হাতে ১৮ কোটি মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে, ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
উপরোল্লিখিত সফলতার বিপরীতে দুঃখজনকভাবে ২০১৪ সাল থেকে ৯ বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে। সর্বশেষ বিশ্বর্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১২ নম্বর দেশ হিসেবেই নির্ণীত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই গত পৌনে পনেরো বছরে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার ব্যাপারটা তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে পুরোপুরি দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও আমলারা ‘ক্ষমতার আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে কোটিপতির কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটা লুকোনোর কোনো উপায় আছে কি? দুর্নীতির অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন দেশের অর্থনীতির ‘এক নম্বর’ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর এখন কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার। পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণ গ্রহীতারা। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও আমলারা যে উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে পুঁজি পাচার করে দেশে-বিদেশে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করছেন, সেটাও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফসল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশে-বিদেশে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম এখন দেশে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
এর বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-০৬ মেয়াদের জঙ্গিবাদ ও মহাদুর্নীতিবাজ অপশাসনের দুষ্কৃতিগুলো জনগণ হয়তো অনেকখানি ভুলে গেছে! বাংলাদেশকে যে ওই বছরগুলোতে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল তা কি ভুলে যাওয়া যায়? জামাআতুল মুজাহিদীনের বাংলা ভাই, ভারতের আসামের জঙ্গি সংগঠন উলফার জন্য আনীত ২০০৪ সালের এপ্রিলে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বর্বর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের আগস্টে দেশের ৬৩টি স্থানে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ, কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা—এগুলো ভোলা যায়? যুবরাজ তারেক রহমানের ‘হাওয়া ভবনের’ প্যারালাল গভর্নমেন্টের দৌরাত্ম্য ও দুর্নীতির অসহনীয় তাণ্ডবকে কি ভোলা যায়?
সে জন্যই আমার মনে হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, মাথাপিছু জিডিপির প্রসার এবং মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনের আগের রাতের ব্যাপক ব্যালট জালিয়াতির অভিযোগের কারণে পৌনে পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দেশের বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেরও কূটনৈতিক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করত বলে সাধারণ ধারণা থাকলেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশি প্রহরায় এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যালট বাক্সগুলো ভরে ফেলার যে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি দেশের অধিকাংশ এলাকায় ঘটানো হয়েছিল, তার সত্যতা সম্পর্কে সিংহভাগ জনগণের মনে বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেছে। যেভাবে এই ‘রাত্রিকালীন ব্যালট জালিয়াতি’ সম্পন্ন করে সংসদের তিন-চতুর্থাংশ আসন দখল করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট, সেটা কি এ দেশের গণতন্ত্রকে পুরোপুরি লাইনচ্যুত করে দেয়নি? এ ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় বিরাট ধস নামিয়েছে।
অতএব, আগামী সংসদ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয় হয়তো সারা দেশে অপেক্ষা করছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জালিয়াতি করার অপপ্রয়াস নেওয়া হলে আওয়ামী লীগের খবর আছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ এ রকম জালিয়াতি কোনোমতেই মেনে নেবে না। তারা ইতিমধ্যেই এ-ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে প্রবল চাপ দিতে শুরু করেছে। এসব চাপে কাজ না হলে তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়াও হতে পারে। অথচ আওয়ামী লীগের এবারের পৌনে পনেরো বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় গতিশীলতা সৃষ্টির বিষয়টিকে এই নির্বাচনী-জালিয়াতির ইস্যুটি অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। গত পৌনে পনেরো বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছে, সেটা কি গুরুত্ব দাবি করে না?
১. ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ইউএনইকোসক) কর্তৃক নির্ধারিত ‘লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি’ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে ‘ডেভেলপিং কান্ট্রি’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ২০২৪ সালে ‘ডেভেলপিং কান্ট্রি’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির শিকার হওয়ায় ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলডিসির সুবিধাগুলো বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের ডেভেলপিং কান্ট্রিতে উত্তরণকে দুই বছর পিছিয়ে দিতে সম্মত হয়েছে।
২. বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে এর তালিকাটা দেখুন: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক, মিরসরাই-ফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-পায়রা-যশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়া-লাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অভূতপূর্ব গতি-সঞ্চার করেছে তা কীভাবে অস্বীকার করা যাবে? এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত পৌনে পনেরো বছরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হচ্ছে একমাত্র মেগা প্রকল্প, যেটা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। প্রায় পৌনে চার বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত করে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে একটি ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ‘ব্ল্যাকমেলিং’য়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। এই সেতু প্রমাণ করেছে, যে দেশটিকে ১৯৭২ সালে ‘আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সেই দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম।
৪. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ ২০২১ সালে বিদ্যুৎসুবিধার আওতায় এসেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন মহাজোট সরকার ক্ষমতা নিয়েছিল, তখন জনগণের মাত্র ৪৩ শতাংশ ছিল বিদ্যুৎসুবিধার আওতায়। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল—১৪ বছরে প্রধান অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো প্ল্যান্ট স্থাপন এবং সঞ্চালন লাইনের প্রসারের মাধ্যমে বর্তমান সরকার এই বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
৫. এখন বাংলাদেশে একটি কৃষিবিপ্লব চলমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতিমালা গ্রহণের কারণেই কৃষি খাতে এই চমকপ্রদ সাফল্যের ধারা সূচিত হয়েছে। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগত আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। ২০২২ সালে এ দেশে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। ১৭ কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্যের জোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। (অবশ্য প্রতিবছর আমরা ৬০-৬৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, তরিতরকারী উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও গরু-মহিষের মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে।
৬. ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান ছিল বাংলাদেশের জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ, কিন্তু এখন তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
৭. বাংলাদেশ গত পৌনে পনেরো বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের হাতে ১৮ কোটি মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে, ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
উপরোল্লিখিত সফলতার বিপরীতে দুঃখজনকভাবে ২০১৪ সাল থেকে ৯ বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে। সর্বশেষ বিশ্বর্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১২ নম্বর দেশ হিসেবেই নির্ণীত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই গত পৌনে পনেরো বছরে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার ব্যাপারটা তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে পুরোপুরি দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও আমলারা ‘ক্ষমতার আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে কোটিপতির কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটা লুকোনোর কোনো উপায় আছে কি? দুর্নীতির অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন দেশের অর্থনীতির ‘এক নম্বর’ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর এখন কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার। পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণ গ্রহীতারা। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও আমলারা যে উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে পুঁজি পাচার করে দেশে-বিদেশে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করছেন, সেটাও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফসল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশে-বিদেশে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম এখন দেশে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
এর বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-০৬ মেয়াদের জঙ্গিবাদ ও মহাদুর্নীতিবাজ অপশাসনের দুষ্কৃতিগুলো জনগণ হয়তো অনেকখানি ভুলে গেছে! বাংলাদেশকে যে ওই বছরগুলোতে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল তা কি ভুলে যাওয়া যায়? জামাআতুল মুজাহিদীনের বাংলা ভাই, ভারতের আসামের জঙ্গি সংগঠন উলফার জন্য আনীত ২০০৪ সালের এপ্রিলে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বর্বর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের আগস্টে দেশের ৬৩টি স্থানে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ, কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা—এগুলো ভোলা যায়? যুবরাজ তারেক রহমানের ‘হাওয়া ভবনের’ প্যারালাল গভর্নমেন্টের দৌরাত্ম্য ও দুর্নীতির অসহনীয় তাণ্ডবকে কি ভোলা যায়?
সে জন্যই আমার মনে হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, মাথাপিছু জিডিপির প্রসার এবং মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
১২ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
১২ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
১৩ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
১৩ ঘণ্টা আগে